#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_শুভ্রতা_জাহান
কেটে গেছে অনেক গুলো দিন। এর মধ্যে আয়রা বেগম আর নওশাদ শেখের ছেলের নাম ঠিক করে আকিকা করা হয়ে গেছে। নাম রাখা হয়েছে নয়ন। নীলাঞ্জনার ভাই নয়ন। কিছুদিন পর স্কুলে পরীক্ষা থাকায় নভ আর তার পরিবার ফিরে গেছে নিজেদের গ্রামে। নীলাঞ্জনার পরিবার তেমনই আছে। নওশাদ শেখ চেষ্টা করেছিলেন তার স্ত্রীর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের কারণ জানতে কিন্তু সক্ষম হননি তিনি। হাসপাতাল থেকে তো কিছু জানতে পারেনইনি সেই সাথে তার স্ত্রী আয়রার কাছ থেকেও কিছু জানতে পারেননি। উল্টো কথা ঘুরিয়ে আয়রা বেগম বলেছেন ওগুলো নভর চোখের ভুল। বাচ্চা মানুষ, কি দেখতে কি দেখেছে ঠিক আছে তার? আরো নানা ওজুহাত। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবৎ নওশাদ শেখ খেয়াল করছেন ঘুমের মধ্যে তার স্ত্রী বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন। আরো বেশি খেয়াল করলে শুনতে পান
“ও আমার মেয়ে না। ওর জন্য আমার ছেলেকে নিয়ে গেছে। ও আমার মেয়ে না। চলে যেতে বলো ওকে।”
অবাক হন তিনি। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যান আয়রা বেগম। অনেক চেষ্টার পর জানার আশা ত্যাগ করেছেন নওশাদ শেখ। তিনি জানেন তার স্ত্রী কেমন জেদি। একবার যেটা না বলবেন সেটা আর কেউ হ্যাঁ বলাতে পারবে না। কিন্তু নীলাঞ্জনার চিন্তা তিনি মাথা থেকে বের করতে পারছেন না কিছুতেই। মেয়েটাকে যে বড্ড ভালোবাসেন। নিজের মা অনেক বছর আগেই পরলোক গমন করায় নীলের মাঝে খুঁজে পান তার মায়ের ছাঁয়া। নীলের কিছু হলে তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন? কোথায় পাবেন তার আম্মাকে? কে তার কাছে আধো আধো বুলিতে আবদার করবে? চোখ ঝাপসা হয়ে আসে নওশাদ শেখের।
নভ এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি পরীক্ষা দেবে। বাবা মায়ের অনেক আশা তাকে নিয়ে। স্টুডেন্ট হিসেবেও বেশ মেধাবী সে। বাবা মা দুজনেই তাড়া দিচ্ছে যেন পরীক্ষার জন্য একেবারে সেরা প্রস্তুতি নেয়। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছে কিন্তু এই পরীক্ষার প্রস্তুতির চক্করে তার আর নীলময়ীর সাথে খুনসুটি হচ্ছে না। নীলদের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না নভ। নিহাল সওদাগর ও তার স্ত্রী আনোয়ারা পর্যায় ক্রমে গিয়ে নয়ন, আয়রা বেগম আর নীলকে দেখে আসলেও সে যেতে পারছে না। কিন্তু তার বড্ড ইচ্ছে পরীক্ষার আগে একবার নীলের সাথে ঝগড়া করার। হাহাহা। বেশ লাগে বিচ্ছুটাকে ক্ষেপাতে।
আয়রা বেগমের মতিগতি বোঝা দায়। সবার সামনে নীলাঞ্জনার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করেন তিনি। অবস্থা এমন যেন কিছুই হয়নি। তাই আর কেউ কিছু বলতেও পারে না তাকে। তার এমন আচরণ দেখে নওশাদ শেখ প্রথমে ভেবেছিলেন সত্যিই হয়তো নভর চোখের ভুল ছিলো সেগুলো। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় খুব শীঘ্রই। জমিতে কাজ করে বাড়ি ফিরে তিনি প্রায়ই নীলাঞ্জনার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম ক্ষত, দাগ দেখতে পান। কখনো বা পাঁচ আঙুলের ছাপ। আয়রা বেগমকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন হয়তো কোথাও পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। শুরুর দিকে স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করলেও পরে তাতে ফাটল ধরে। কেনোনা এটা কীভাবে হয় যে একটা বাচ্চা প্রতিদিন পড়ে গিয়ে ক্ষত, দাগ বানিয়ে নিয়ে আসে?
এইতো সেদিন নওশাদ শেখ পুকুর থেকে মাছ ধরে এসে উঠোনে বসে ছিলেন। তখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলো নীল। গালে তার পাঁচ আঙুলের ছাপ। দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি। আয়রা বেগমকে ডাকলে তিনি শুনলেন না। রান্না ঘরে রান্নার কাজে ব্যাস্ত আছে বোধহয়। বারান্দায় শুয়ে থাকা নিজের মায়ের মতো ফুফুকে সুধালেন নওশাদ শেখ। তিনি বললেন
“আমি পাশের বাড়ির বকুলের দাদির কাছে পান আনতে গেছিলাম বাজান। ফিরে আইসা দেহি নাতিনডার মুখ অমন লাল হইয়া আছে। বউরে জিগাইলাম হেই কয় জানে না কিছু।”
“জানে না মানে? অয় তো বাড়িতেই ছিলো। আমার আম্মায় ব্যথা ক্যামনে পাইলো তা জানবে না ক্যান? নাকি নিজেই মারছে!”
“কি জানি বাজান। বউডার কাজকাম সুবিধের লাগে না। মাইয়াডারে যেন দ্যাখতেই পারে না হেই। পোলাডার কাছেও যাইতে দেয় না।”
ফুফুর কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবলেন নওশাদ শেখ। তারপর কোলে তুলে নিলেন তার আদরের কন্যাকে। ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন সারা মুখে অধর ছোঁয়াতে। নীলাঞ্জনাও দুহাতে বাবার গলা আঁকড়ে ধরে তার কথার ঝুড়ি খুলে বসলো। তার আধো আধো বুলিতে মুখরিত হলো বাড়ির আঙিনা।
“আব্বু আব্বু ভাই না নবুল মতো চুন্দল।”
“হ আম্মা। তোমার ভাই বড়ই সুন্দর কিন্তু আম্মা তুমি কি জানো তুমি তোমার ভাইয়ের থেইকা বেশি সুন্দর?”
বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে গালে হাতে রেখে জিজ্ঞেস করে নীল
“আল্লা তত্তি?”
নীলের গাল টেনে দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে নওশাদ শেখ বলেন
“এক্কেরে সত্যি আম্মা। আমার নীলময়ী আম্মা চান্দের লাহান সুন্দর।”
বাবার মুখে নীলময়ী ডাক শুনে গাল ফুলায় নীল
“তুমিও তেনো নবুর মতো নীলমই বলতো?”
“আপনি তো নীলময়ীই আম্মা। নীলময়ী নীলাঞ্জনা। আমার আন্ধার ঘরের বাতি আপনি।”
খিলখিল করে হেসে ওঠে নীল। যেন তার বাবা অনেক মজার কিছু বলেছে। বাবা মেয়ের খুনসুটির মধ্যে বাড়িতে প্রবেশ করে আনোয়ারা বেগম। নীল, নওশাদ শেখ আর তার ফুফুকে একসাথে হাসতে দেখে নিজেও হেসে তাঁদের হাসির কারণ জিজ্ঞেস করে। তখন নওশাদ শেখের ফুফু বলেন
“আর কইস না মা। আমার নাতিনডায় যে কি পাকা পাকা কথা কয়। হেই কইতাছে হের ভাই নয়ইন্না নাকি তর পোলার মতোন সুন্দর।”
আনোয়ারা বেগম নীলকে কোলে নিতে নিতে বলেন
“আমার ছেলে বুঝি খুব সুন্দর মামনি?”
দুহাত মেলে নীল বলে
“নবু এত্ত চুন্দল মনি।”
“হাহাহা, তাই নাকি মামনি! তা তুমি যাবে নাকি নবুর কাছে? সে তো আসতে পারছে না পরীক্ষার জন্য। যাবে তুমি?”
“হুম জাবু। তলো যায়।”
নীলের তাড়া দেখে হেসে ফেললো সবাই। অতঃপর নওশাদ শেখের সাথে কথা বলে আনোয়ারা বেগম ঠিক করলেন নীলকে নিজের সাথে নিয়ে যাবেন দুদিনের জন্য তার বাড়িতে। এমনিতেও এখানে আয়রা বেগম ঠিকমতো যত্ন করে না মেয়েটার। নওশাদ শেখ থাকেন কাজের জন্য বাইরে বাইরে, তার ফুফু বৃদ্ধা মানুষ। হেলাফেলায় পড়ে থাকে মেয়েটা। তার কাছে থাকলে অন্তত অযত্ন হবে না।
নীলাঞ্জনার বড় বড় চোখ দুখানা যেন সারাক্ষণ টলমল করতে থাকে। যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। অজস্র মায়ায় ভরা মুখখানি। আনোয়ারা বেগম ভেবে পান না কীভাবে তার বোন এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। নীল তো এমন একটা বাচ্চা যাকে দেখলে পাষান হৃদয়ের ব্যাক্তিরও মায়া হবে আর সেখানে… দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। কিছুক্ষণ বোনের সাথে কথা বলে, নয়নকে কোলে নিয়ে নীলাঞ্জনাকে সাথে নিয়েই বেরিয়ে যান নওশাদ শেখের অনুমতি নিয়ে।
খাওয়ার সময় নওশাদ শেখ আয়রা বেগমকে জিজ্ঞেস করেন
“তুমি আজকে আম্মারে মারছিলা নাকি?”
আয়রা বেগম বিরস মুখে বলেন
“আমি কেন আপনার আম্মারে মারতে যাবো?”
“তাইলে যে দেখলাম আম্মার গালে আঙুলের দাগ!”
“আমি কীভাবে জানবো কোত্থেকে কীভাবে করে এনেছে।”
আর কথা বাড়ালেন না নওশাদ শেখ। তার স্ত্রী যে নীলাঞ্জনার প্রতি বিরক্ত তা তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছেন। মনে মনে ঠিক করলেন এখন থেকে নীলকে আয়রা বেগমের কাছে কম আসতে দেবেন। প্রয়োজনে বেড়ানোর ওজুহাতে নিহাল সওদাগর এর বাড়িতে রাখবেন বেশির ভাগ সময়। আরো ঠিক করলেন কাজ থেকে ফেরার আগে একবার দেখে আসবেন মেয়েকে। যে মেয়েকে কখনো চোখের আড়াল করতে চান না তাকেই কিনা অন্যের বাড়িতে রাখতে হচ্ছে নিরাপদ রাখার তাগিদে।
নিজের মায়ের সাথে নীলাঞ্জনাকে বাড়িতে আসতে দেখে বেজায় খুশি নভ। আসতে না আসতে নীলকে কোলে তুলে নিয়েছে। নিজেদের সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে। ছোট্ট নীলও নিজের আধো কথার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে নভর সাথে। ছেলের কান্ড দেখে নিহাল সওদাগর আর আনোয়ারা বেগম হেসে ফেললেন। নীল কি বোঝে যে নভ তাকে বাড়ি ঘুরে দেখাচ্ছে? দুই বাচ্চা একসাথে হলে যা হয়। হাহাহা।
চলবে…?
[আস্সালামুআলাইকুম। আগামীকাল ব্যাক্তিগত কিছু কাজ থাকায় গল্প দিতে পারবো কিনা তা নিশ্চিত নই। তাই কেউ অপেক্ষা করবেন না। আর যদি পারি তো অবশ্যই দিবো, আপনারাও পেয়ে যাবেন। ধন্যবাদ]