#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১৫
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
সমুদ্র এসে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে আমাকে পেয়েও গেল। পরনের পাতলা একটি সাদা শার্ট আর নীল প্যান্ট।
অন্ধকারের মাঝেও ওর সাদা শার্টটি যেন আলোর মত ঝলঝল করতে লাগল। এক দৌড়ে আমার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে অস্থিরতা ভরা কন্ঠে বলল,
” এই রাতের বেলা তুই এখানে একা একা কী করছিস? তোকে খুঁজতে খুঁজতে আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানিস? রাগ করেছিস ভালো কথা, কিন্তু এরজন্য এই অন্ধকারে সমুদ্র তীরে চলে আসতে হবে? এটা কোনো কথা?এই শুনশান জায়গায় রাতের বেলা একা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা কতটা রিস্ক তুই জানিস? ”
আমি কিছু বললাম না। কেবল পলকহীন চাহনি দিয়ে সমুদ্রের চিন্তিত মুখ টুকু দেখে উপভোগ করতে লাগলাম। মিনিট কয়েক যেতেই সমুদ্রের চোখের ভাষা যেন পরিবর্তন হয়ে লাগল। যে চোখে কিছুক্ষণ আগেও দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল, সেই চোখেই এখন অবাকর চাহনি। সমুদ্র আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার তাকালো। বলল,
” শাড়ি পড়েছিস যে? এটা কার শাড়ি? তোর? তুই পিকনিকে শাড়ি নিয়ে এসেছিস?”
আমি এবার পুরোপুরি সমুদ্রের দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম। বললাম,
” কেন ভালো লাগছে না?”
সমুদ্র এবার মুচকি হাসল। বলল,
” সবকিছুই তাহলে প্রি প্ল্যান করাছিল? ”
” ধরে নেয় ওরকম কিছুই। তাতে কী কোনো ক্ষতি হয়েছে? খুব ইচ্ছে ছিল তোর সাথে সমুদ্র স্নান করার। তাই আর কি….”
” ইচ্ছে কী পূরণ হয়েছে? ”
” যদি বলি এখনো পুরোপুরি ভাবে পূরণ হয়নি।”
” মানে?”
” মানে…..”
বলেই কিছুটা ঝুঁকে সমুদ্রের বুকে হাত চেপে সজোরে এক ধাক্কা দিলাম।সমুদ্রও আচমকা আমার এরকম কাজে তাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে সমুদ্রের নোনা জল আর বালুর মাঝে পড়ে যায়। সারা শরীর বালু ভর্তি হলেও সমুদ্রের ঢেউ এসে সেই বালুগুলো শুষে নিয়ে যায়। সমুদ্র দাঁড়িয়ে ভেজা প্যান্টের নিচের অংশ বটে হাঁটু সমান করে আমার দিকে তাকাতেই আমার বুক ধক করে উঠল।সমুদ্র এক পা বাড়াতেই আমি শাড়ির কুচি ধরে সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। তখন সমুদ্রও আমার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছে। আমাদের মাঝে গ্যাপ কেবল দু-তিন হাত। দৌড়ানোর মাঝে আমিও হাসছি, সমুদ্রও হাসছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার স্বপ্নগুলো পূরণ হতে। আমার সুখের মুহুর্ত গুলো আমাদের চারিদিক ঘুরঘুর করতে। আমার হাসির শব্দ যেন কমছিলই না, কেবল ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছিল। একসময় সমুদ্র আমাকে ধরে ফেলে। এবং তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে লুটে পড়ে সমুদ্র বুকে। আমি উঠার জন্য জোর দেখালেও সমুদ্র আমাকে ছাড়েনি। বলে,
” আমাকে টাখনু সমান পানিতে ফেলে দিয়েছিলি না? এখন আমি তোকে বুক সমান পানিতে চুবাবো।”
বলেই আমার মাথা পানির নিচে যেতে ধরে একটা চুবানি দেয় সমুদ্র। তারপরও আমি হাসছি। আর আমার হাসি দেখে হাসছে সমুদ্রও।
বুক সমান পানিতে আমি আর সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছি। মাঝের দূরত্ব একহাত। সমুদ্রের দুটো হাত অজানা দেশে পাড়ি জমালেও আমার দুটো হাত রয়েছে সমুদ্রের কাঁধ জড়িয়ে। আমি সমুদ্রের দিকে একচোখে তাকিয়ে আর সমুদ্র আমার দিকে। হঠাৎই একটা বড় ঢেউয়ের ঝাপটা আসার সাথে সাথে অনুভূত হলো দুটো হাত আমার কোমরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আমার সারা শরীরে কাঁটা কাঁটা দিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ জন্মায়। যার দরুণ কোন এক অদৃশ্য টানে আমি সমুদ্রের আরও কাছে যেতে লাগলাম। তখন আমাদের মাঝের দূরত্ব কেবল নিঃশ্বাসের। আমি চোখ বুজে সমুদ্রের আরও কাছে যেতে নিলেই সমুদ্র আমার কোমর ছেড়ে দেয়। অস্বস্তিকর ভাব ফুটিয়ে বলে,
” ১২ টায় গাড়ি। এখন হয়তো ৯ টা বেজেও গিয়েছে। আমাদের দ্রুত হোটেলে যাওয়া উচিৎ।”
এরকম সময়ে সমুদ্রের এরকম আচরণ আমি মোটেও মেনে নিতে পারছিলাম না। চোখ জোড়া ভিজে আসছিল। তারউপর এরকম সময় এ জীবনে ফিরে আসবে কি-না তা নিয়েও যথেষ্ট শঙ্কা ছিল আমার মনে। তাই আমি সমুদ্রকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম,
” কেন এরকম করিস আমার সাথে? একটু কাছে টেনে নিলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে তোর? বেশি কিছু তো চাইনি…..ক্ষনিকের জন্য মিশে যেতে চেয়েছি তোর মাঝে। তাহলে কেন এভাবে দূরে সরিয়ে দিস আমাকে?”
সমুদ্র যেন আমার কথাগুলো শুনেও শুনল না। আস্তে করে আমাকে দূরে সরিয়ে বলল,
” বড় বড় ঢেউ আসতে শুরু করে দিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা বিপদজনক হতে পারে আমাদের জন্য। উপরে চল।”
বলেই সমুদ্র আমাকে ছেড়ে চলে যেতে লাগল। আমিও কোনো কথা না বলে উপরে উঠে পড়লাম। সমুদ্র আমার থেকে ঠিক দু পা এগিয়ে। তাই বললাম,
” দু সপ্তাহ বাদেই আমার বিয়ে সমুদ্র। ”
সমুদ্রের পা দুটো থমকে গেল। আমি সামনে এগিয়ে বললাম,
” হ্যাঁ, এই শুক্রবারের পরের শুক্রবারেই আমার বিয়ে।তোরই মতো বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। আবার তোরই মত সুন্দর, উঁচা লম্বা,শিক্ষিত।তবে ছেলের ভালো একটা জব আছে যেটা তোর কাছে নেই। ভাবিস না কালো বলে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিচ্ছে। ছেলে না-কি অনেক আগে থেকেই আমাকে ভালোবাসে। এতদিনে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। তারমানে বিয়ের পর ছেলে আমাকে খুব ভালোবাসবে। আর খুব আদরও করবে। তোর ভালোবাসা সযত্নে আমাকে ভুলিয়ে দিবে। অপ্রাপ্তি গুলো মুছে প্রাপ্তিতে ভরিয়ে দিবে আমার জীবন। ”
কথাগুলো বলেই থেমে গিয়েছিলাম। কারণ তখন গলা আমার অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছিল আর ব্যাথা করছিল। ঢোক গিলতেও যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার।
অন্যদিকে সমুদ্র আমার কথা শুনে স্তব্ধ। যেন কেউ ওর মাথায় বড্ড সযত্নে আঘাত করেছে। চোখ দুটো বিস্ফোরণ হওয়ার পথে। আর পর্যায়ক্রমে নোনা জল ঝরছে। তারউপর মাথা তুলে আমার দিকে একবারের জন্য তাকায়ও নি। আমি বেশ কষ্ট করেই আবার বললাম,
” কাঁদছিস কেন? তোর তো আজ সুখের দিন। সুখের দিনে কেউ কাঁদে? এতবড় একটা সুসংবাদ পেলি… একটু হাস। আর কেউ তোকে বিরক্ত করবে না। বিয়ে কর বিয়ে কর বলে মাথা খাবে না। কেউ বলবে না, আর কত সময় নিবি!এমনকি প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার সময় কেউ আর পাশে এসে বসে তোর মূল্যবান সময় টাকেও কেড়ে নিবে না। উফফ……তোর তো শান্তিই শান্তি তাই না? ”
” ইউশরা! ”
” আর কিছু বলিস না, অনেক তো শুনলাম তোর কথা। এবার না’হয় আমার কথা শোন।
চার চারটি বছর আমি তোর কথায় তোর পেছনে ঘুরে ঘুরে নষ্ট করেছি। যা বলেছিস, যেভাবে বলেছিস সেভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু রেজাল্ট কী হলো…..শূন্য। হ্যাঁ হ্যাঁ, শূন্য। তোর তো আমার থেকে বেশি পৃথিবীর আলো, বাতাস, পানির উপর ইন্টারেস্ট। অবশ্য হবে নাই বা না কেন? স্বয়ং তোর নামই যে সমুদ্র। না চাইতেও এই নাম তোকে সেদিকে ধাবিত করে এবং করবে। কারণ মানুষের আচার আচরণের উপর নামের প্রভাব ব্যাপক।প্রমাণস্বরূপ দেখ, নাম যেরকম উদাসীন তুই মানুষ টাও তদ্রূপ উদাসীন। সমুদ্রের যেরকম কোনো কূল কিনারা নেই, ঠিক তোর জীবনেরও কোনো কূল কিনারা নেই। সে যাই হোক বাদ দেয়। এখানে ভুল তোর একার নয়, ভুল আমারও রয়েছে। তোর সম্পর্কে শুরু থেকেই সবকিছু জানা সত্ত্বেও এই সম্পর্কে জড়ানো টাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর মত একটি অপদার্থ, বেকার,মেরুদণ্ডহীন ছেলের সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে সত্যিই বড় ভুল করেছি। যার খেসারত গত চার বছর যাবৎ দিচ্ছি আর ভবিষ্যতে বিয়ে করেও দিয়ে যাবো। তবে খেসারত দিলেও সুযোগ আর তোকে দিব না। অন্য পুরুষকে বিয়ে করে বাস্তব জীবন একাকীত্ব ঠিক কতটা দুর্বিষহ তোকে হাড়ে হাড়ে বোঝাবো। তখন বুঝবি আমি ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলাম তোর জীবনে। তবে তুই যেই নির্দয় চরিত্রের মানুষ, তোর কাছে দুর্বিষহ নাও লাগতে পারে। আমার অনুপস্থিতি তোকে নাও গ্রাস করতে পারে। স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করা তোর জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। খুবই স্বাভাবিক। ”
বলেই চলে যাবার জন্য পা বাড়াতে নিয়েও আবার পেছনে ফিরলাম। বললাম,
” আজই হয়তো তোর সাথে আমার শেষ দেখা ও কথা। হয়তো কেন, অবশ্যই আজ তোর সাথে আমার শেষ দেখা। আর কলেজে আসব না কখনো। বিয়ে যখন হয়েই যাবে পরীক্ষা দেবার প্রয়োজন আমার অন্তত নেই। ভালো থাকিস। সুস্থ থাকিস। আর অনেক ভালোমন্দ কথা বলেছি তো পারলে ক্ষমা করে দিস। আল্লাহ হাফেজ। ”
বলেই সমুদ্র থেকে শেষ বিদায় নিয়ে চলে এলাম হোটেলে। কাপড় চেঞ্জ করার নাম করে বাথরুমে বসে মাথার উপর ঝর্না ছেড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাঁদলাম। সারা, আফরোজা বেশ কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিলেও খুললাম না। নিজের ইচ্ছেমত কাঁদতে লাগলাম। একপর্যায়ে সারা জোরে জোরে বলতে লাগল রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে। ১২ টায় বাস। এক্ষুনি স্যার রা বাসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যাবে। এ কথা শুনেও আমি কোনো কিছু বললাম না সারা’কে।
মিনিট পাঁচেক যেতেই আমি বাথরুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে আসতেই আফরোজা আর সারা আমাকে জড়িয়ে ধরল। নানান ধরনের প্রশ্ন করলেও আমার মুখ থেকে কোনো উত্তর বের করতে পারল না। আমি ওদের হাত ছাড়িয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে হোটেলের নিচে চলে গেলাম।
রাত যখন ১২ টা বেজে ১০ মিনিট। তখন আমাদের বাস ছেড়ে দিল। আমি বসেছিলাম জানালার পাশের সিটে। আর আমার পাশের সিটে আফরোজা। যদিও সবাই সমুদ্রকে অনেক জোরাজুরি করেছিল আমার পাশের সিটে বসার জন্য কিন্তু সমুদ্র রাজি হয়নি। আর না আমি ওকে বসতে বলেছি। সমুদ্র একেবারে বাসের শেষের দিকে চলে গেল। তবে কার সাথে, কোথায়, কীভাবে বসল কোনটাই জানার ইচ্ছা জাগেনি মনের ভেতর। আর সেই অনিচ্ছার ভেতরই ইতি নেয় আমার আর সমুদ্রের মাঝের সম্পর্ক কিংবা অদৃশ্য টান।
____________________
রুবাইয়া ভেজা চক্ষুদ্বয় দিয়ে তাকিয়ে আছে ইউশরার দিকে। আর ইউশরা ভরা চোখের জল নিয়ে তাকিয়ে আছে খোলা আকাশের দিকে। আর ওমনি চতুর্দিক থেকে কানে ভেসে এলো ফজরের আযান। ইউশরা চোখের জল মুছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
” দেখেছিস রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল। আর আমাদের কোনো খবরই নেই। এরজন্যই এত রাত করে গল্পে বসতে চাই না। সকালে কী করে উঠব। ধ্যাৎ!”
” বাবা তো ঘরে নেই যে অফিস যাবে সকাল সকাল। তাই তোমার সকালে উঠার তাড়াও নেই। এত চিন্তা করছ কেন?”
” হ্যাঁ, সেটা কিন্তু ঠিক বলেছিস। এবার চল আযান যেহেতু দিয়েই দিয়েছে, নামাজ পড়ে একেবারে শুয়ে পড়ি।”
বলেই ইউশরা বসা থেকে উঠে চলে যেতে লাগল। রুবাইয়া বলে উঠল,
” সমুদ্রের কথা কী আজও তোমার মনে পড়ে মা?”
ইউশরা পেছনে ফিরে একপলক তাকালো রুবাইয়ার দিকে। রুবাইয়ার দৃষ্টি স্থির দেখে কিছু বলল না, কেবল মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে এগিয়ে গেল নিজ রুমের দিকে।
.
.
চলবে…….