নীলাম্বুর গহীনে পর্ব ৮

#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৮
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
” সমুদ্র তোমায় আটকানোর চেষ্টা করেনি মা?”
রুবাইয়ার প্রশ্নে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরল ইউশরা। মুচকি হেসে বলল,
” আবেগ! সে তো কখনোই ওর মাঝে ছিল না। এসব রাগ, অভিমান,কাছে টেনে নেয়া আর বিশেষ করে প্রেম নামক নাটকীয়তা কখনোই ওর পছন্দ ছিল না। তাই কখনোই এগুলোর পাত্তা ও দেয়নি। ও জানত, আজ রেগে চলে এলেও কাল ফিরে ওর কাছেও যাবো। তাই ওসব আটকানো, জোরাজুরি ও করেনি।”
রুবাইয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,
” তাই বলে এত হেয়ালিপনা? আশ্চর্য মানুষ তো! এতটাও উদ্ভট টাইপ মানুষ কিন্তু ভালো না।”
” হয়তো! ”
” আচ্ছা যাই হোক তারপর কী হলো? ”
ইউশরা আবার বলতে শুরু করল,,,,
__________________
সেদিনের পর রাগে, অভিমানে টানা সাত দিন কলেজ যাইনি। অবশ্য এ সাত দিনের মাঝে সারা দু’বার বাড়িতে এসে মানানোর চেষ্টা করলেও আমি কলেজ যাবার কথা স্বীকারোক্তি দেইনি। সারা মন খারাপ করে চলে গেলেও সেদিকে পাত্তা দেইনি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছি। দিন গিয়ে রাত এলো। রাত গিয়ে আবার দিন এলো। এভাবেই বদ্ধ ঘরে কাটতে লাগল আমার দিনগুলি। ঘুরে ঘুরে পরের সপ্তাহ এলো। সেদিন ছিল সোমবার।অবাধ্য মনের সাথে বহু বোঝাপড়া করে চলেই গেলাম কলেজ। দূর থেকে দেখছি ডিপার্টমেন্টের সামনের মাঠে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। সারা’র সাথে চোখাচোখি ব্যাপারটিও হয়ে গেল। তাই বেশি আর নজর দিলাম না সেদিকে। সারাসহ অনেকেই ডাকাডাকি করলেও পাত্তা দিলাম না। না শোনার ভান করে চোখ ঘুরিয়ে সোজা চলে গেলাম ক্লাসরুমে। অন্যদিনের মত ফাঁকা বেঞ্চে বসলাম না। আর না কারো আসার অপেক্ষা করলাম।যে মেয়ের সাথে আজ অবধি একটি সিঙ্গেল কথা পর্যন্ত হয়নি তার সাথে গিয়ে বসলাম। সারা,ওসমান, সমুদ্র সহ সবাই এসে বলল,
” কী রে? এখানে বসলি যে? ”
আমি কারো কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা বোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আবারও বলল,
” কথা বলছিস না কেন? ”
আমি এবারও চুপ। ওসমান ব্যাগ ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলল,
” বুজেছি তুই কথা বলবি না,তাই তো? বেশ তোকে কথা বলতে হবে না। আর না আমরা তোর সাথে কথা বলব। কিন্তু এভাবে একা বসলে তো হবে না। ওঠ, আমাদের সাথে বসবি চল।”
” বসার হলে আগেই বসতাম। বসার ইচ্ছে নেই বলেই এখানে বসেছি। আর তাছাড়াও ফ্রেন্ডশিপ করার আগে তোদের সাথে বসা নিয়ে কোনো রকম ডিল করেছি বলে তো আমার মনে পড়ছে না। তাহলে এরকম ব্যাগ টানা হেঁচড়ার মানে কী?”
” এরকম করছিস কেন ইউশরা? আমরা তোর সাথে কিছু করেছি? করলে নির্দ্বিধায় বল। আমরা ক্ষমা চেয়ে নেব।কিন্তু এভাবে বলিস না।”
” দেখ ওসমান, আমাকে আমার মত থাকতে দেয়। অনেক সময় নষ্ট করেছি আর না। কলেজে আমি কীভাবে ভর্তি হয়েছি আমি জানি। এসব আড্ডাবাজি অন্তত আমাকে মানায় না। দয়া করে তোদের ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে আমার নামটা মুছে দিস।এসব উটকো ঝামেলা আর ভালো লাগে না। ”
ওসমান আর কথা বাড়ালো না। সে জানে, এই মুহূর্তে হাজার কথা বললেও লাভ হবে না। কেননা ইউশরা যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন। ও বেঁকে বসলে সামলিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে যায় । তাই সমুদ্রকে চোখের ইশারায় বন্ধ মুখ খুলতে বলল। সমুদ্রও বাধ্য ছেলের মত এগিয়ে বলল,
” কী হয়েছে তোর? এতদিন কলেজে আসিস নি। আর আজ এসে এরকম উদ্ভট আচরণ করছিস। কারণ টা কী?”
ইউশরা এবার একহাত বেঞ্চের উপর সজোরে আঘাত করে এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চড়া গলায় বলল,
” উদ্ভট আচরণ আমি করি? না-কি তুই করিস? আর আমি কলেজে এতদিন আসিনি তো কী হয়েছে? তুই তো এসেছিস। প্রকৃতির সাথে প্রেম করেছিস, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছিস। ”
” এভাবে কথা বলছিস কেন? কী হয়েছে খুলে বল না?”
” দেখ, আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে। আমাকে দিয়ে বেশি কথা বলাস না। চলে যা আমার সামনে থেকে। ”
” তুই কিন্তু এতটা উত্তেজিত মেয়ে কখনোই ছিলি না ইউশরা…..”
” ধ্যাৎ! ”
বলেই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সমুদ্রকে ঠেলে ক্লাসরুম থেকে বেড়িয়ে গেলাম। দ্রুত পায়ে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠতেই দেখি সমুদ্র পেছন পেছন দৌড়ে এসেছে।চলন্ত রিক্সায় একলাফে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” মামা সামনের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাও।”
আমার সেই মুহুর্তে মাথায় রক্ত টগবগ টগবগ করছিল। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
” কীসের রেস্টুরেন্ট?আমি কোনো রেস্টুরেন্টে যাবো না। তোর যেতে হলে তুই যা। ”
” রাস্তার মাঝেও কী এখন শুরু করবি না-কি? কলেজে করেছিস কিছু বলিনি। রাস্তায় সিনক্রিয়েট করলে থাপড়িয়ে গাল দুটো লাল করে দেব। ”
” কী?”
” চুপ। আর একটা কথাও না। তুই কী ভেবেছিস, দৌড়িয়ে এসেছি তোর হাত ধরে,বুকে জড়িয়ে,রাগ ভাঙিয়ে লুতুপুতু করতে? তাহলে বলব তুই ভুল ভাবছিস। আগেও বলেছি আজও বলছি, আমি ওরকম ছেলেই নই। আমি বিশ্বাস করি সবকিছুর যেরকম শুরু আছে আবার শেষও আছে। সেই শেষ টাই দেখতে এসেছি আজ। তোর রাগ দেখতে নয়।”
সমুদ্রের এরকম কড়া কথা শুনে আমার আর গলা দিয়ে কথা বের হলো না। চুপচাপ বসে রইলাম রিক্সায়।দু’জনের মাঝে বেশ ফাঁক। সমুদ্র আমার ঠিক বিপরীত দিক মুখ করে বসে। রেস্টুরেন্ট আসতেই রিক্সা থেকে নামল সমুদ্র। বলল,
” নামবি না-কি এখনো বসে থাকবি?”
কিছু না বলে বড় করে শ্বাস নিয়ে রিক্সা থেকে নামলাম। আর পিছু নিলাম সমুদ্রের।
পাশাপাশি নয়,মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছি দুজন। সামনে দু কাপ কোল্ড কফি। সমুদ্র এক চুমুক কফি খেয়ে বলল,
” কী করতে চাস তুই?”
আমি চুপ করে রইলাম। সমুদ্র আবারও বলল,
” কিছু বলছি তোকে।”
” শুনছি।”
” তাহলে উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
” প্রয়োজন বোধ করিনি। ”
” এরকম করছিস কেন ইউশরা? স্বাভাবিক হো না। খুলে বল কী হয়েছে? এভাবে চুপচাপ থেকে, মেজাজ দেখালে তো সমস্যার সমাধান হবে না। খুলে বলতে হবে।”
” কী বলব?কাকে বলব? তুই কী কোনোকিছু শোনার যোগ্য? আমার তো মনে হয় না।”
” আচ্ছা বেশ আমি শোনার যোগ্য না, কিন্তু তুই তো বলার যোগ্য। তুই-ই বল।”
আমি আবারও চুপ করে গেলাম। সমুদ্র আমার হাত চেপে ধরল।বলল,
” বল না কী হয়েছে? তুই এরকম করলে আমার কী ভালো লাগে? বল প্লিজ….”
আমি আবার কেঁদেই ফেলি। বলে উঠি,
” বিয়ে করবি আমায়?লাল বেনারসি পড়িয়ে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবি তোর সাথে তোর বাড়ি? দিবি একটা ছোট্ট সংসার? আমি আর পারছি না রে! এই গায়ের রঙ, বিয়ে ভাঙা নিয়ে হাজার কথা হাজার জনের মুখে। এসব আর সহ্য হচ্ছে না। অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছি আমি। ”
” বিয়ে……”
” হ্যাঁ বিয়ে।”
সমুদ্র ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
” আমি বেকার ইউশরা। আদৌ কিছু করতে পারব কি-না জানি না। কারণ ঘোরাফেরা ছাড়া কিছুতেই আমার মন বসে না। হ্যাঁ, আমার বাবা মা অন্যরকম। তোকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে ফেলে দিবে না, মাথায় করেই রাখবে। কিন্তু আমি যে তা মেনে নিতে পারব না। তোকে আগেই বলেছি আমার পক্ষে দ্রুত বিয়ে করা সম্ভব না। বাবা মায়ের ঘাড়ে বউ রেখে সংসার করতে আমি পারব না। তাহলে আজ কেন এসব বলছিস?”
” আমি নিরুপায় সমুদ্র। আমি নিরুপায় হয়েই তোকে কথাগুলো বলছি। আমি কোন পজিশনে আছি একমাত্র আমি জানি। হাজার বলেও কাউকে বুঝানো আমার পক্ষে সম্ভব না। তবে এতটুকু মনে রাখিস, একটা মানুষ যে পর্যায়ে গেলে নির্দ্বিধায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে, আমি ঠিক সেই পর্যায়ে আছি। ”
আমার কথাটি শেষ হতেই সমুদ্রের চোখমুখের ভাষা এতটাই পরিবর্তন হলো যে, ভেতরকার ছটফটানি গুলো স্পষ্ট মুখগহ্বরে ভেসে উঠছিল। সমুদ্রের বুকের ভেতরের প্রতিটি মোচড়ের গভীরতা যেন আমি দূর থেকেও অনুভব করতে পারছিলাম। সমুদ্র ছিল মারাত্মক নরম মনের ছেলে। তবে আবেগ, অনুভূতি, মায়া, টান প্রকাশ করার পক্ষপাতী ছিল না। ফলস্বরূপ তার ভেতর ফেটে চৌচির হলেও মুখের ভাষা শক্ত করে বলল,
” আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। সমস্যা যত বড়ই হোক না কেন, সেটাকে ফেস করার সাহস বুকে রাখতে হয়। তবেই সমাধান মেলে, মেলে জয়। নয়তো কপালে জুটে পরাজয়। ”
আমি চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সমুদ্র আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” বাসায় আমার কথা বলেছিস?”
” না।”
” কেন?”
” কী বলব? বলার মত আহামরি কিছু পাইনি। যা বলে সবার মন জয় কর‍তে পারব।”
সমুদ্র মুচকি হেসে বলল,
” আগামী কাল বিকেল ৫ টায় বাবাকে নিয়ে তোদের বাড়ি আসছি। রেডি থাকিস। আর হ্যাঁ, আজ গিয়ে বাসায় বলে দিস। সামান্য আদর যত্ন তো অন্তত পেতে পারি। কী বলিস?”
সমুদ্রের কথা শুনে আমি পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
” মানে কী? তোরা আসবি মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।তুই না মাত্র বললি বিয়ে করতে পারবি না, তাহলে এখন আবার আসবি বলছিস! তুই ক্লিয়ার করে বলতো তুই আসলে কী করতে চাইছিস?”
” আরে এই মুহূর্তে বিয়ে করতে সমস্যা কিন্তু বিয়ে ঠিক করতে তো সমস্যা নেই তাই না? আপাতত বিয়ে ঠিক করে রাখি। তারপর না’হয় বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে। ”
আমার ঠোঁটের কোণে যেন বিশ্বের সমস্ত সুখ এসে ভর করল।ঝুঁকে থাকা কাঁধ উঁচিয়ে বসে সমুদ্রে হাত শক্ত করে চেপে বললাম,
” সত্যি? তুই সত্যি বলছিস? তুই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমাদের বাসায় যাবি? ”
” হ্যাঁ রে যাবো। যেতে তো আমাকে হবেই। তাহলে দেরি করে তোকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী? আর অনেক তো মানুষ দেখল তোকে, আর কত? সবকিছুরই সমাপ্তি ঘটানো উচিৎ। ”
হাসির মাঝেই চোখ জুড়ে বর্ষণের ধারা নামতে শুরু করল। তবে সুখের বর্ষণ। দূর থেকেই সমুদ্র সেই বর্ষণ আলতো করে মুছে বলল,
” বাসায় গিয়ে উত্তেজনা বসত আমাদের সম্পর্কের কথা বলে ফেলিস না। ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বাসায় গিয়ে ধীরে সুস্থে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলবি, তোর ফ্রেন্ড আসবে কাল। কিন্তু সেই ফ্রেন্ড ছেলে না মেয়ে কিছুই বলবি না। কেন আসবে তাও বলবি না। কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকবি। কিচ্ছু বলার দরকার নেই। যা বলার আমরা এসেই বলব, বুঝলি?”
” হুম। ”
” এবার একটু না অনেকখানি হাস। তবে হ্যাঁ, কেঁদে হাসা যাবে না কিন্তু। হাসি মুখে হাসতে হবে।”
বলামাত্রই ফিক করে হেসে দিলাম আমি। সেই সাথে হেসে দিল সমুদ্রও।
পরেরদিন বিকেল ৫ টার ঘটনা। সুতি একটি থ্রি পিছ পড়ে পায়চারি করছি ঘরের ভেতর। চুলগুলো টাইট করে বেনি করা। হাঁটার তালে তালে চুলগুলিও দুলছে। দুলছে কানের ঝুলন্ত দুল গুলোও। চাপা ভয় গ্রাস করছে আমার ভেতরটা। গলা শুকিয়ে খরখরা হয়ে যাচ্ছে। যত পানি খাচ্ছি ততই দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। মা এসে বলল, আমার বন্ধু চলে এসেছে। সেখানে যেতে বলেছে। তাই দেরি না করে মাথা ঘোমটা টেনে বিসমিল্লাহ বলে চলে গেলাম বসার ঘরে।
সমুদ্র আর তার বাবা মাঝ সোফায় বসে আছে। আমি সালাম দিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই ছোট চাচি আমাকে একটি চেয়ারে বসাল। সবার দৃষ্টি একবার আমার দিকে আরেবার সমুদ্রের দিকে। সবুর করতে না পেরে বাবা বলে ফেলল,
” মেয়ে তো আমার চলে এসেছে। এবার তো বলুন আপনারা ঠিক কী বলতে এসেছেন।”
.
.
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here