নীলাম্বুর গহীনে পর্ব ৯

#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৯
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
সমুদ্রের বাবা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
” আমি সোজা কথার মানুষ। তাছাড়া সরাসরি কথা বলা অনেক পছন্দ করি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলার অভ্যাস একেবারে নেই বললেই চলে। আমার ছেলে সমুদ্র। আপনার মেয়ে ইউশরার সাথেই পড়াশোনা করে। বর্তমানে বেকার। কামাই রোজগার শিকিয়ানাও নেই। যদিও ওর খেটে খাওয়ার বয়স এখনো হয়নি। তারপরও ব্যাপারটা আপনাদের সম্মুখে খোলাসা করলাম। ”
বাবা চেয়ার টেনে বসে ভ্রু দুটো কুচকে বলল,
” সে না’হয় বুঝলাম। কিন্তু এসব কথা আমাদের বাড়ি বয়ে এসে বলার কারণ কী?”
” হ্যাঁ কারণ তো আছেই। আর সেজন্যই বলা। আসলে হয়েছে কী, আমার ছেলে আপনার মেয়েকে খুব পছন্দ করে। এখন জিজ্ঞেস করতে পারেন, পছন্দ টা কি একতরফা না…..পছন্দ টা একতরফা না, দুতরফা। আপনার মেয়ে তদ্রূপই পছন্দ করে যতটা আমার ছেলে পছন্দ করে। এখন মূল কথা হচ্ছে তারা একে অপরকে পছন্দ করার সুবাদে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়। তবে কিছুটা সময় নিয়ে। যেহেতু দু’জনই স্টুডেন্ট। তারউপর সমুদ্রও বেকার। তাই বছর খানেক অপেক্ষা করে ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়েটা হলে ভালো হয়। এখন আপনি কী বলেন?”
বাবা, মা, চাচা, চাচিসহ সবার দৃষ্টি তখন আমার উপর। তবে প্রত্যেকের দৃষ্টির অর্থ ভিন্ন ভিন্ন। কারো দৃষ্টি অবাক, তো কারো আবার ক্রোধে পূর্ণ। তবে একটি দৃষ্টি ছিল স্নেহময়ী। যার চক্ষুদ্বয় বলে দিচ্ছিল সমুদ্র ঠিক তার কতটা পছন্দ হয়েছে। হ্যাঁ, মায়ের সমুদ্রকে ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। আর হবে না-ই বা না কেন? যে মেয়ে কালো হওয়ার অপরাধে সবার চোখে অপরাধী ছিল সেই মেয়ের জন্য এরকম রাজপুত্রের মত বর! মা তো খুশিতে টইটুম্বুর হবেই।
ওদিকে বাবা বেশ কঠোর গলায় বলে,
” আপনি আমার মতামত জানতে চাইলেন না-কি শুধুই বলার জন্য বললেন আমি ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না? না মানে আপনার বলার ধরন দেখে তো মনে হলো না, আপনি আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। ”
” মতামত….. না মতামত বললে ভুল হবে। এটা কেবলই সৌজন্যতা। কেননা এখানে আপনার কিংবা আমার মতামত মূখ্য নয়। যাদের জীবন তাদের মতামত মুখ্য। তাই আপনাকে যা বলেছি সেটা কেবলই সৌজন্যতাবোধ হিসেবেই বিবেচনা করে নিন।”
” আজব মানুষ তো আপনি! একে তো ছেলেমেয়ের প্রেমের কথা বলছেন।তারউপর শিনাজুরিও করছেন। কী ভেবেছেন কী আপনি? এভাবে হুট করে এসে দাপট গিরি দেখাবেন আর আমরা সুড়সুড় করে মেনে নেব? আর হ্যাঁ, কোন সাহসে আর কোন যুক্তির ভিত্তিতে আপনার বেকার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন? লজ্জা করল না? আজকের দিনে কেউ বেকার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে না-কি? ”
” আহা….আপনি এত চড়ে যাচ্ছেন কেন? আমার পুরো কথাটা তো শুনুন। তারপর নাহয় যা ইচ্ছে বলুন। পুরোটা না শুনে কথা বলা তো যৌক্তিক না।”
” আরও কিছু বলার বাকি আছে না-কি আপনার?”
” হ্যাঁ, অবশ্যই বাকি আছে। বিয়ের কথা কী দু-চার কথায় হয় না-কি! হাজার কথায় একটি বিয়ে হয়। ”
” হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝেছি। এতো ভনিতা না করে কী বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন তো।”
” ছোট্ট একটি পরিবার আমার। যেখানে আমি, আমার স্ত্রী আর সমুদ্র ছাড়া কারো বিচরণ নেই। সমুদ্র আমাদের একমাত্র ছেলে। ও ছাড়া আমাদের কেউ নেই। ওর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেবে দ্বিতীয় কোনো সন্তানের মুখ দেখার সামর্থ্য কিংবা সুযোগ আমাদের হয়ে উঠেনি। অবশ্য কখনো স্বাদও জাগেনি।এই এক ছেলের মুখ দেখেই জীবন পার করে দিয়েছি। আমার জমিজিরাত যা আছে সবই সমুদ্রের। সেদিক থেকে আমার ছেলে বেকার হলেও বেকার না। চালের কেজি যেখানে ৬/৭ টাকা, সেখানে আমার প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া উঠে ২০০০০ টাকার উপরে। এসবই তো আমার ছেলে সমুদ্রের। আমার ব্যবসা বাণিজ্য সবই তো ওর নামের। ও যদি সারাজীবন পায়ের উপর পা তুলে বসেও খায় আশাকরি কম পড়বে না। কিন্তু তারপরও আমার ছেলে চায় নিজে কিছু করতে। নিজের অর্থে নিজের সংসারের চাকা ঘুরাতে। আর সেজন্যই আপনার কাছে সময়ের ব্যাপারটা বলা। এখন সবকিছু শুনেও যদি সমুদ্রকে বেকার হিসেবে মূল্যায়ন করেন তাহলে আর আমাদের বলার কিছু থাকে না। ”
সমুদ্রের বাবার কথা শেষ হতেই আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবার চোখ দুটো বড় বড় হাস্যোজ্জ্বল। দৃষ্টিতে ভেসে উঠছে লোভ লালসার অমায়িক খেলা। বাবার এই লোভাতুর দৃষ্টি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। মূর্খ গোয়ার জানতাম। কিন্তু সে যে একজন লোভীও তা নতুন করে জেনেছিলাম। মুহুর্তের মাঝে বাবা পল্টি নিয়ে হাসি মুখ করে বলল,
” আহা.. …এতকিছু বলা লাগে? মানুষ মাত্রই তো ভুল। আমারও কিছু ভুল হয়েছিল। আসলে কী বলুন, মেয়ের বাবা আমি চিন্তা তো হয়েই। মেয়ের ভালো খারাপ থাকাটা তো আমাদের উপরই প্রভাব পড়ে তাই সবকিছু ভেবেচিন্তে করতে হয়।”
বলেই মায়ের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল,
” এই দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে এসো। বিয়ের কথা কো মিষ্টি ছাড়া হয় না-কি! যাও……”
পেছন থেকে আমার বড় ভাই নাফিজ মুখ বাঁকিয়ে বাবাকে সাবধান করার উদ্দেশ্যে কিছু করতে চাইলে বাবা একহাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেয়। বলে,
” তোমাদের থেকে আমার বুঝ কয়েকগুন বেশি। আমাকে আমার মত এগোতে দাও।”
বলেই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বিভিন্ন কথা বলে বিয়ের কথা ফাইনাল করে ফেলল বাবা সেদিন। ঠিক হলো অনার্স কমপ্লিট হলেই বিয়ে হবে। স্বস্তির নিঃশ্বাস গুলো যেন চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল আমাকে। গায়ের রঙ নিয়ে আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না ভেবেই খুশিতে চোখে জল ভরে উঠছিল। মা আমাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেলেছিল সেদিন।
তারপর থেকে শুরু হলো আমার খুশির দিন। বিয়ের ঘর নিয়ে না ছিল শঙ্কা, না ছিল ভয়। আমি আমার মত দিব্যি দিন কাটাচ্ছিলাম। বাবার নিকট হয়ে উঠেছিলাম তার চোখের মণি। যেন কিছুই বুঝত না আমায় ছাড়া। ধীরে ধীরে সবার নিকটই মূল্য হয়ে উঠেছিল আকাশচুম্বী। বড় লোক ঘরের হবু বউ বলে কথা! যেকোন অকেশনে সমুদ্রের বাবা আমাদের বাড়ি এসে বাবার সাথে কুশল বিনিময় করে আমার জন্য কেনাকাটা করে দিতে যেতেন। কিন্তু কখনো সমুদ্র আসেনি। ও তো বরাবরই এরকম বেখেয়ালি ছিল তাই আমিও আর এসব বেখেয়ালিপনা গায়ে লাগাতাম না। সবকিছু মন মত এগোচ্ছিল এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম আমি।
সমুদ্র আমাদের বাড়ি আসার কয়েক মাস পরের ঘটনা। খুব স্পেশাল একটি দিন। এখনো স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসে সেই দিনের প্রতিটি মুহূর্ত।
ক্লাস শেষে সেদিনের মত সবার থেকে বিদায় নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রিক্সায় উঠেছিলাম। হঠাৎ করেই পেছন থেকে সমুদ্রের গলা ভেসে এলো। রিক্সা থামাতেই ও ছুটে এসে রিক্সায় উঠে বসল। বলল,
” মামা, সামনের গলির মোড়ে নিয়ে যাও।”
রিক্সাওয়ালাও সমুদ্রের কথায় সায় দিয়ে সামনের গলির মোড়ে যাচ্ছে। আমি অবাক চাহনি ছুঁড়ে বললাম,
” সামনের গলির মোড়ে তো ছোট পার্ক। সেখানে যাবি কেন?”
” দরকার আছে। ”
” কী দরকার? ”
” আছে আছে, পরে বলব। এখন চুপ থাক।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। কেননা সমুদ্র বেশি জিজ্ঞাসাবাদ পছন্দ করে না। তাই নীরবতাকে সঙ্গ দিয়ে সমুদ্রের না বলা কথাটি জানার অপেক্ষায় মশগুল হতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক যেতেই পার্কের সামনে রিক্সা এসে থামল। সমুদ্র নেমে ভাড়া চুকাতেই আমি নেমে এগোতে লাগলাম। সমুদ্র পেছন থেকে এসে বলল,
” ওইদিক টায় চল।”
” হুম।”
পায়ে পা মিলিয়ে পাশাপাশি দু’জন হেঁটে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের মাঝে কোনো কথা নেই। নেই কোনো প্রেমিক প্রেমিকার অসংগতিপূর্ণ চাহনি কিংবা আচরণ। কিছু দূর যেতেই সমুদ্র বলল,
” সামনে না, ডান দিকে আয়। ”
ডান দিকে মোড় কাটতেই একটা ছোট বেঞ্চ চোখে পড়ল। সমুদ্র গিয়ে সেই বেঞ্চের এক কোণে বসল। আর আমি অন্য পাশে। মাঝে বেশ কিছুটা গ্যাপ। হাত আমার বেঞ্চের উপর। সমুদ্র চোখ দুটো সামনে রেখে আমার হাতের উপর হাত রাখল। সারা শরীর কেঁপে এক অদ্ভুত শিহরণ যেন অনুভূত হলো আমার। বুকের মাঝে হাতুড়ি পিটার মত জোরে জোরে ধকধক শব্দ হতে লাগল। আমি সমুদ্রের দিকে করুণ দৃষ্টি মেলে ধরলেও সমুদ্রের দৃষ্টি সামনে পথে। এক পলকের জন্যেও আমার চোখে চোখ রাখেনি। সামনে তাকিয়েই বলল,
” আজ তারিখ কত জানিস?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
” হু, ৭ই জুন। ”
” কিছু মনে পড়ে?”
” মনে পড়াটা কি অস্বাভাবিক? ”
” সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করা। ”
” হুম। ”
” চোখের পলকে যেন দু বছর কেটে গেল। কখন, কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ফাইনাল পরীক্ষাও নাকের ডগায় চলে এসেছে। তাও টের পেলাম না। দু বছর বন্ধুত্বে আর দু বছর অদৃশ্য সম্পর্কের টানে কেটে গেল তোর ছায়াপথে…….”
সমুদ্রের কথাগুলো শুনে যতটা না ভালো লাগছিল তার থেকে বেশি হাসি পাচ্ছিল। কারণ অন্তত ওর পক্ষে এসব বছর টছর মনে রাখা আবার পালনও করা অসম্ভব ছিল। তাই বলেই ফেলেছিলাম,
” কাগজ টা কোথায়? না মানে যে কাগজ টা মুখস্থ করে এত কষ্টে লাইনগুলো বলছিস সেই কাগজটা কোথায়? কেই বা মনে করিয়ে দিয়েছে দিনটি? আর এই পুরো বুদ্ধি টাই বা কার?”
সমুদ্র হেসে দিল। বলল,
” এরজন্যই তোকে এত ভালো লাগে। তুই কত সুন্দর বুঝিস আমাকে। কিন্তু ওরা…..উফ! জ্বালিয়ে খেয়েছে আমাকে।”
” কারা?”
” আরে ওসমান, সারা ওরা সবাই। তুই না-কি আজ সারাকে বলেছিলি আজ আমাদের সম্পর্কের দু বছর হয়েছে। সেই থেকেই তোর পেছন পেছন শুরু হয়েছে নানা কথার ঝড়। আমি এমন কেন? আমি ওমন কেন? রোমান্টিকতার ছিঁটেফোঁটাও আমার মাঝে নেই। ইত্যাদি…. ”
” তারপর?”
” তারপর আর কী? জোর করে সব এরেঞ্জ করে তোর সাথে আমায় পাঠিয়ে দিল। তবে…..”
” তবে?”
” তবে…ওরা সব এরেঞ্জ করলেও কিছুক্ষণ আগে বলা কথাগুলো কিন্তু ওরা এরেঞ্জ করে দেয়নি। মানে লিখে দেয়নি। আমি নিজে থেকেই বলেছি। জানি ভালো হয়নি কিন্তু চেষ্টা করেছি। ”
আমার চোখ দুটো গোল গোল বড় হয়ে মুখ বন্ধ হয়ে গেল। সমুদ্র বলেছে কথাগুলো তাও নিজে থেকে কল্পনার বাইরে। আমি তোতলিয়ে বললাম,
” স….সত্যি! তুই সত্যি বলছিস? তুই ওই কথাগুলো নিজে থেকে বলেছিস? ”
” কেন বিশ্বাস হচ্ছে না? ”
” সত্যি বলছি, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই এসব বলবি আমি তো দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। আমি কী বলব তাও বলতে পারছি না।”
” কুল কুল, এত উত্তেজিত হোস না। যা বলেছি বলেছি, সেগুলো বারংবার বলে আমায় অস্বস্তিতে ফেলিস না।”
” কিন্তু….”
” বাদ দেয় না রে!”
আমি মুচকি হেসে চুপ হয়ে গেলাম। ওমনি একটি আইসক্রিম ভ্যান সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সমুদ্র বলল,
” আইসক্রিম খাবি?”
” খাওয়াবি? খাওয়া…..তবে ভ্যানিলা। ”
” তুই যে ভ্যানিলা পছন্দ করিস সে কী আমি জানি না?”
” তবুও বললাম। তোর তো আবার কিছুই মনে থাকে না।”
” খোঁচা দিলি?”
” যদি খোঁচা ভেবে থাকিস তাহলে তাই দিয়েছি। মিথ্যে বলব না।”
সমুদ্র একগাল হেস এগিয়ে গেল আইসক্রিমের ভ্যানের কাছে। একটি ভ্যানিলা আর একটি চকলেট আইসক্রিম নিয়ে ফিরল। আমার কিছুটা কাছ ঘেঁষে বসল।ভিন্ন দুটো আইসক্রিম সমুদ্রের হাতে দেখতেই চোখ দুটো কুচকে গেল।সেই কুচকে যাওয়া চোখ দুটো ছোট ছোট করে আইসক্রিমের প্যাকের দিকে তাকালাম। বললাম,

.
.
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here