নীলাম্বুর গহীনে পর্ব ১০

#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১০
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
” কী রে? দুই ফ্লেভারের দুই আইসক্রিম আনলি যে? সবসময় না একই ফ্লেভারের দুটো আনিস! আজ আবার নতুন করে কী হলো? ”
” কী আর হবে! এমনি এনেছি। ”
বলেই ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিমটি আমার সামনে এগিয়ে ধরল সমুদ্র। আমিও খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আইসক্রিমটি নিলাম। প্যাক খুলে ছোট করে কামড় দিতেই দেখলাম সমুদ্র এখনো আইসক্রিম হাতে নিয়ে বসে আছে। বললাম,
” খাচ্ছিস না কেন? গলে যাবে তো…..”
সমুদ্র আইসক্রিমের প্যাক খুলে এক কামড় দিয়ে এগিয়ে ধরল আমার দিকে। আমি যেন ৪৪০ পাওয়ারের ভোল্টের একটা শকড খেলাম। অবাক চাহনি দিতেই সমুদ্র বলল,
” ইচ্ছে ছিল দুজনের আইসক্রিমে দুজনের ছোঁয়া থাকবে। তাই দুই ফ্লেভারের কেনা। একই ফ্লেভারের কিনলে তো স্বাদ একই পাওয়া যাবে। দুই ফ্লেভার হওয়ায় স্বাদটা আলাদা পাওয়া যাবে। তাই আজ ভিন্ন কিনলাম। ”
কিছুক্ষণ নিঃষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সমুদ্রের দিকে। ওর এই নতুন করে পরিবর্তন হওয়াটা ভালো লাগলেও আগের সমুদ্রকে খুব করে মনে পড়ছিল আমার। আমি যে সেই সমুদ্রে অভ্যস্ত। সেই সমুদ্রেই…. সমুদ্র বিলাসিনী। তাই সাত পাঁচ না ভেবে বললাম,
” তুই কী জানিস, এই তুই আসলে তুই না। এই তুই হলি একটা রোবট তুই। যার প্রাণ থাকা সত্ত্বেও নিষ্প্রাণ। যে কি-না নিজের ভালোবাসা প্রমাণ করতে আপ্রাণ বৃথা চেষ্টা করে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। কেন করছিস তুই এসব? মানুষের কথায়? তুই তো এরকম না। মানুষের কথা গায়ে লাগানো তো তোর কর্ম না। তাহলে আজ কেন অন্যের কথায় নিজের সত্ত্বাকে বিপর্যস্ত করছিস?”
” তোকে হারানোর ভয়ে! সবাই বলে আমি তোর সাথে যেরকম ব্যবহার করি এতে না-কি তুই কষ্ট পাস। মন খারাপ করিস। আবার এ-ও বলে যে, আমার এই ব্যবহারের জন্যে তুই একদিন আমায় ছেড়ে চলে যাবি। কিন্তু আমি তো তা কখনো চাই না।বিশ্বাস কর তোকে ছাড়া আমার একাকী জীবন ভাবা অসম্ভব। আমি ভরা বাতাসেও হয়তো দম নিতে ভুলে যাবো তুই হীনতায়। তাই একটু একটু করে চেষ্টা করছি নিজেকে বদলাতে। আর দশটা ছেলের মত গড়ে তুলতে।”
” মানুষের কথা কী সবসময় সত্য হয় সমুদ্র? তুই কি প্রমাণ পেয়েছিস? আর মানুষই বা জানবে কী করে যে, আমার মনের গহীনে তোকে ঘিরে কী চলছে? শুধু হাতে হাত রেখে হাঁটলে, মিষ্টি মিষ্টি কন্ঠে কবি ভাষায় কথা বললেই ভালোবাসার প্রমাণ হয় না সমুদ্র। কঠোর ভাষাতেও ভালোবাসার সূক্ষ্ম, শক্তিশালী স্তর পাওয়া যায়। যদি সে ভালোবাসা খাঁটি হয়। আর তোর মাঝে সেই খাঁটি ভালোবাসার ছোঁয়া আমি পেয়েছি। হোক সে কঠোর, উদাসীন, বেখেয়ালীপনার আড়ালে। খাঁটি পেয়েছি এতেই আমি সন্তুষ্ট। কারো কথায় নিজের সত্ত্বাকে পরিবর্তন করার কোনো প্রয়োজন নেই তোর।”
সমুদ্র মৃদু হাসল। বলল,
” একটা কঠিন থেকেও কঠিনতর পরীক্ষা হতে মুক্তি তো দিলি। এবার আরেকটা পরীক্ষা থেকেও মুক্তি দেয়। গলে যাওয়া আইসক্রিম ধরে রাখাও কিন্তু একটা পরীক্ষা। আর যে পরীক্ষায় বর্তমানে আমরা দু’জনই পরীক্ষার্থী। তাড়াতাড়ি কামড় দিয়ে বাকি তরল আইসক্রিম মুখে পুড়ার সুযোগ করে দেয়। আর হ্যাঁ, আইসক্রিম খাওয়ার সময় কিন্তু চাপা মনে খাস না যে, মানুষের বুদ্ধিতে আমি রোমান্স করছি। এই আইসক্রিম খাওয়ার বুদ্ধিটা পুরোই আমার। অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল। তবে একাকী ভরা সময় কাটানো হয়ে উঠছিল না বলেই ইচ্ছে পূরণ হচ্ছিল না। আজ যেহেতু দু’জন একাকী হয়েছি তাই আর কী ইচ্ছে পূরণের মোহে ছুটে গেলাম।”
” সিরিয়াসলি তোর প্ল্যান!”
” হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ, এটা পুরোই আমার প্ল্যান। এখানে কারো প্ল্যানের ছিঁটেফোঁটাও নেই। এক্কেবারে আমার খাঁটি নিজস্ব প্ল্যান। ”
” তোর নিজস্ব খাঁটি প্ল্যান! হা হা…..”
আমি দাঁত কেলিয়ে বেশ জোরে হেসে দিলাম সমুদ্রের কথা শুনে। আর সেই হাসি দেখে সমুদ্র বলল,
” হাসছিস ভালো কথা। কিন্তু আইসক্রিম টার দিকেও চোখ মেলে দেখ। গলে যাচ্ছে তো!”
” ও হ্যাঁ…! ”
সমুদ্রের প্রায় অর্ধ গলে যাওয়া আইসক্রিমে এক কামড় বসাতেই সমুদ্র ফিরিয়ে আমার আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে দিল। বলল,
” উফ! দু’জনের ছোঁয়ায় আইসক্রিমের স্বাদ যেন কয়েকশত গুণ বেড়ে গেল তাই না?”
” হুম তা ঠিক বলেছিস।”
বলামাত্রই সমুদ্রের আইসক্রিম গলে ধাপ করে নিচে পড়ে গেল। সমুদ্র আইসক্রিমের খালি প্যাক হাতে ধরেই আমার দিকে তাকালো। আমি নিজের আইসক্রিমটি সমুদ্রের দিকে এগিয়ে ধরে, চোখ মেরে বললাম,
” আজ হয়তো স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালাও চাইছে তোর মনের ইচ্ছে পূরণ হোক। নেয় ধর, এখান থেকে খা।”
বলতে বলতেই আমার আইসক্রিমের অর্ধেকাংশ টুপ করে নিচে পড়ে গেল। সমুদ্র হেসে বলল,
” আজ আইসক্রিমই আমাদের কপালে নেই রে। দেখছিস না এই সামান্য দুটো আইসক্রিম নিয়ে কতকিছু হচ্ছে? পড়তে পড়তেই শেষ। আমাদের খাওয়ার আর খবর নেই।”
” কে বলেছে শেষ? এই যে একটু আছে এটাই দুজন ভাগ করে খেয়ে নেব, সমস্যা কী? তোর ইচ্ছেও পূরণ হবে আর খাওয়াও হয়ে যাবে। ”
বলেই সমুদ্রের মুখে আমি আইসক্রিমটি ধরলাম। সমুদ্র এক কামড় দিয়ে ফিরিয়ে আমার মুখে ধরল। আমি কামড় দিতেই আইসক্রিম শেষ। দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। সমুদ্র আর কিছু বলল না। আগের ন্যায় আবার মাঝে কিছুটা গ্যাপ রেখে বসে রইলো আনমনে। অবশ্য আনমনে বললে ভুল হবে। সে হয়তো নিঃশব্দহীন গাছ গাছালির শব্দ তরঙ্গ খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নয়তো পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দ ভান্ডার আয়ত্ত্ব করতে মত্ত রয়েছে। তাই আমিও আর কথা বলে ওর সেই চেতনা শক্তির ব্যাঘাত ঘটাতে চাইলাম না। শব্দহীন ঠোঁট দুটো একত্রে করে তাকিয়ে রইলাম সমুদ্রের পানে। বেশ কিছুটা সময় এভাবেই কেটে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলাও হয়ে এসেছে। এখন বাসায় যাওয়াটা সুন্নত না, ফরজ হয়ে উঠেছে। নয়তো হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে আমাকে। তাই আস্তে করে বললাম,
” সমুদ্র, দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। বাসায় যাওয়া অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। চল এখন উঠি আমরা।”
সমুদ্র অন্যমনস্ক হয়েই বলল,
” উঠবি? চল উঠে পড়ি।”
” রাগ করেছিস? কী করব বল বাসায় তো…..”
” রাগ করব কেন? আমি কি আজ অবধি কোনো বিষয়ে তোর সাথে রাগ করেছি? এসব রাগ টাগ আমার ডিকশনারিতে নেই বুঝলি? চল বাড়ি চল।”
বলেই সমুদ্র বসা থেকে উঠে সামনে এগোতে লাগল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে মুচকি হেসে ওর পিছু নিলাম। সমুদ্র আমার ঠিক দু কদম সামনে। দু’জনই আগ পিছ করে হেঁটে যাচ্ছি। আচমকাই সমুদ্র থমকে গেল। পেছনে ফিরে বলল,
” উফফ….. একটা কথা তো ভুলেই গিয়েছি। ”
” কী কথা?”
” দাঁড়া বলছি।”
সমুদ্র খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই প্যান্টের একবার এ পকেট তো একবার ও পকেটে হাত দিয়ে কী যেন খুঁজতে লাগল। ডানে বামে মিলিয়ে দু পকেট খুঁজেও যখন তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেল না, তখন পেছনের পকেটে হাত দিতেই সেই জিনিসটি পেয়ে গেল। পকেট থেকে বের করে সামনে আনতেই আমার চোখ দুটো ছানাবড়ার মত হয়ে গেল। একটি স্বর্ণের আংটির বক্স সমুদ্রের হাতে। আমি বড় বড় চোখ করে সমুদ্রের দিকে তাকাতেই সমুদ্র কোনোরকম ভনিতা ছাড়া আমার বাম হাত নিয়ে আঙুলে পড়িয়ে দিল। বলল,
” কদিন আগে তোর জন্য এই আংটি টা কিনেছিলাম। কিন্তু বিভিন্ন ব্যস্ততায় বারংবার মনে করা সত্ত্বেও তোকে দিতে ভুলে যাই। ফলস্বরূপ দৈনন্দিনের জন্য আংটি টি স্থান পায় আমার এই ব্যাগে। ভাগ্যিস এখন মনে পড়েছে তাই তোকে দিতে পারলাম। নয়তো আরও কতদিন, মাস যে এই ব্যাগেই পড়ে থাকত আল্লাহ জানে।”
আমি পুরো বাকরুদ্ধ ছিলাম। মুখগহ্বর দিয়ে টু শব্দটা বের করার শক্তি পাচ্ছিলাম না। আংটি টি স্বর্ণের তার জন্য নয়। সমুদ্র আমার কথা মনে করে কিছু কিনেছে এটা ভেবে। কারণ ওর কাছ থেকে এসব আশা করা কিংবা পাওয়া মোটেও সহজতর ছিল না। আমার চোখের সাদাংশ চিকচিক করে নোনা স্রোতে বরে উঠছিল। কিন্তু সমুদ্র সেসব দিকে লক্ষ্য না করে বলল,
” কী রে দাঁড়িয়ে পড়লি যে? চল…..বাড়ি যেতে হবে তো।”
বলেই নিজ গতিপথ ধরে এগোতে লাগল সমুদ্র। আমি কিঞ্চিৎ হেসে আংটি টিতে স্পর্শ করে তাতে চুমু খেয়ে সমুদ্রের গতিপথ অনুসরণ করতে লাগলাম।
______________________
রুবাইয়া হা হয়ে তাকিয়ে আছে ইউশরার মুখের দিকে। চোখমুখে বিরাজ করছে বিরক্তির ছাপ। বলল,
” মা, সমুদ্র এতো আন রোমান্টিক ছিল? এরকম দিনেও কেউ এভাবে কথা বলে?তারউপর আবার সেগুলো তোমার স্মৃতির পাতায় গেঁথেও রয়েছে? এটা কীভাবে সম্ভব? আর সমুদ্র যেমনই হোক না কেন, কিন্তু তুমি তো তার থেকেও বেশি রসহীন ছিলে। নয়তো এরকম দিন কারো মনে থাকে? তুমি যখন বললে তোমার স্মরণীয় দিনের কথা, আমি তো মনে মনে কতকিছু ভেবেছিলাম। খুশি হয়েছিলাম। মনের আনাচেকানাচে ঘুরপাক করিয়েছি সহস্র কথার সমাহার। কিন্তু এখন……এখন তো আমার মাথাই ঘুরে গেছে তোমাদের কান্ড দেখে।”
ইউশরা স্মিত হাসল। বলল,
” সম্পর্কের মাঝে রস থাকলেই বুঝি স্মৃতির পাতায় সমস্ত কিছু গেঁথে রয়?রসবিহী স্মৃতি হয় না?”
” হলে হতে পারে যদি তোমাদের মত রোবট দুটি মানুষ হয় তবে। এছাড়া অসম্ভব! ”
” এটা ভুল রুবাইয়া। রসে পূর্ণ সম্পর্কের বাইরেও একটা না, অসংখ্য সম্পর্ক আছে। হয়তো তুই সেই সম্পর্কের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তবে এর থেকে মধুর সম্পর্ক আমার জানামতে আর নেই। যেখানে তুই কুঁড়োতে পারবি সহস্র স্মৃতিমালা , চোখ বুজে নিতে পারবি ভরসা পূর্ণ নিঃশ্বাসের হাজারো ছোঁয়া। কিন্তু রসে পরিপূর্ণ সম্পর্কে তা কখনোই নিতে পারবি না। একটা সম্মান হারানোর ভয় সর্বদা তোর মাঝে কাজ করবে। যে ভয় কি-না রসহীন সম্পর্কের মাঝে হাতড়িয়েও খুঁজে পাবি না।”
” কিন্তু তারপরও এরকম সম্পর্ক কী আদৌ ভরসার যোগ্য মা?যেখানে কি-না অপর মানুষটির মনের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন বোধটুকুও কাজ করে না?”
.
.
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here