নীলাম্বুর গহীনে পর্ব ১১

#নীলাম্বুর_গহীনে
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১১
( কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।)
.
.
” মুখে মুখে মনের খোঁজ নিলেই যে অপর মানুষটিকে ভরসা করা যায় এটাই বা কী করে শিউর দিয়ে বলছিস? আলগা পিরিত তো পাশের বাড়ির ভাবিও দেখায়। তাই বলে কী সেও আমার ভালো চায়? চোখের আড়াল হলেই তো মুখ ভেংচি কাটে। তাহলে মুখ দিয়ে মনের খোঁজ নেয়ার ব্যাপারটা কোনদিক থেকে তোর ভরসা পূর্ণ সম্পর্ক মনে হলো? ”
” তা ঠিক বলেছ।আসলে আমি সেভাবে ভেবে দেখিনি। যাই হোক তারপর কী হয়েছিল বলো।”
________________
অনার্স লেভেলের শেষ ক্লাস। অন্য স্টুডেন্টরা উপস্থিত না হলেও আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের প্রত্যেকে হুড়মুড়িয়ে সেদিন উপস্থিত হলো ভার্সিটিতে। আমাদের সবার মনেই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মাস্টার্সেও আমরা একসাথে এই কলেজেই ভর্তি হবো। তারপরও বন্ধুত্বের খাতিরে শেষ দিনের মিলনে সবার ছুটে আসা।
ক্লাস কোনরকমে শেষ করে সবাই যখন ডিপার্টমেন্টের সামনের মাঠে বসলাম। ওসমান বলে উঠল,
” এই তোরা বস। আমি আর সমুদ্র গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসি। ”
বলেই দু’জন চলে গেল। এই ফাঁকে আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম, দুষ্টুমি করছিলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওসমান আর সমুদ্র সিঙাড়া, চিপস, কোকাকোলা নিয়ে হাজির হলো। সবার হাতে যার যার শিঙাড়া, চিপস ধরিয়ে দিল ওসমান বলল,
” কোক প্রতি দুজনে একটি। তাই যে যার পার্টনারকে খুঁজে নেয়।”
ওসমানের কথা শুনে উপস্থিত থাকা সকলেই হেসে দিল। বলল,
” যেভাবে তুই পার্টনার খুঁজতে বললি, মনে তো হলো কীসের না কীসের পার্টনার যেন খুঁজতে বলছিস। ”
ওসমান মুখ ভেংচি কেটে বলল,
” তোমাদের মনে যদি কালায় ভরা থাকে আমার মুখের তো দোষ হবেই। তাই তোমাদের মনটা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধৌত করা অতীব জরুরী। ”
বলে ওসমান সহ সবাই হেসে দিলাম। সমুদ্র আমার পাশে বসে বলল,
” তোর পছন্দের চিপস এনেছি।”
” হুম, দেখলাম তো। ”
সমুদ্র আর কিছু বলল না। তবে আমার চোখ দুটো তাক করেছিল ওর দিকেই। যা দেখে আফরোজা বলে উঠল,
” ভার্সিটি লাইফের প্রথম চাহনিতে আজ অবধি পলক পড়ল না ইউশরার। অভাব শুধু একটি জিনিসেরই…. বৃষ্টি! এই বৃষ্টিটা এই মুহূর্তে ঝপঝপিয়ে নামলে একেবারে পরিপূর্ণ হতো। ভার্সিটি লাইফের প্রথম চাহনি এবং শেষ চাহনিরা পরিপূর্ণতা খুঁজে পেত। ”
আফরোজার কথা শেষ হতেই সমুদ্র আমার দিকে আড়চোখে তাকালো। আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতে লাগলাম। সমুদ্র মিটিমিটি হাসছিল।তবে লাজুক মায়ায় ভরা মুখটি চোখেও হারাচ্ছিল। হয়তো বলতেও চাচ্ছিল, এ লাজুক রাঙা ভাবটি আমার মুখশ্রীতে বেশ মানায়!
আমি বিষয়টি এড়ানোর উদ্দেশ্যে বললাম,
” শুনলাম, আমাদের ডিপার্টমেন্টের পিংকি না-কি প্রেগন্যান্ট। এটা কি সত্য?”
মুহুর্তের মাঝে সমুদ্রের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা হয়ে উঠল ক্রোধে পরিপূর্ণ। আগুন্তুক চাহনি আমার পানে ছুড়েই নামিয়ে নিল। ব্যাপারটিতে আমি বেশ ঘাবড়েও যাই। হঠাৎ করেই সমুদ্রের এতটা পরিবর্তন আমার যেন কেমন হযবরল লাগছিল। ওসমান বলল,
” আরে পিংকি যে প্রেগন্যান্ট এটা কী তুই আজ জানলি? ও তো আরও মাস পাঁচেক আগেই প্রেগন্যান্ট হয়েছে। আমাদের উপরের ব্যাচের শামীম শিকদার ছিল না, সেই এই কাজটা করেছে। আবার পিংকির স্ক্যান্ডালও ভাইরাল করেছে।”
” মানে! কী বলছিস এসব? আর বাচ্চা….বাচ্চার কী হবে?”
” কী হবে তা জানি না। তবে শামীম সিকদারের মুখে যতটুকু শুনলাম, এটা তার বাচ্চা না। পিংকি এরকম আরও অনেকের সাথে সময় কাটিয়েছে। ওদের থেকে কেউ একজন এই বাচ্চার বাবা হবে। ”
” আর পিংকি…পিংকি কী বলে?”
” পিংকি আর কী বলবে! ওর তো একটাই কথা এই বাচ্চার বাবা শামীম। আর শামীম ছাড়া ও কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। এখন কার কথা বিশ্বাস করব বল। কারো সাথেই তো ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলামেশা করিনি যে, স্বভাব চরিত্র বিবেচনা করে দোষারোপ করব। তাই এসব ঝামেলা থেকে দূরেই আছি।”
” ও…..কিন্তু আমার কেন যেন পিংকির কথা সত্য মনে হচ্ছে। শামীমের কথানুযায়ী যদি ধরিও পিংকি খারাপ, তাহলে শামীমই বা কোনদিক থেকে ভালো। ”
” মানে? আমি ঠিক বুঝলাম না তোর কথা।”
” সে যদি সত্যিকার অর্থে ভালো হতো, সে তো কখনোই ওইরকম সিচুয়েশনের ভিডিও করত না। আর না ভাইরাল করত। এতে কী স্পষ্ট না যে, পুরো টাই তার প্রি প্ল্যান করা ছিল। ”
” কথাটা তো ঠিক বলেছিস। এভাবে তো আমি আগে ভেবে দেখিনি ব্যাপারটা।”
” তুই ভেবে দেখ……”
আমার কথা শেষ হবার আগেই সমুদ্র বলে উঠল,
” এসব বাজে বিষয় নিয়ে তোর এত মাথা ঘামানোর কী আছে বুঝলাম না তো। আর তোকেই বা এসব খবর নতুন করে দিয়েছে কে? এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি, বিশ্লেষণ করার কারণ কী?”
আমি থ মেরে গেলাম সমুদ্রের কথা শুনে। আরও বলল,
” তোকে আমি একদিন বলেছিলাম, আউল ফাউল বিষয়ে মাথা না ঘামাতে। এসব বিষয়ে ইন্টারেস্ট না পোষণ করতে। আর তুই এখানে বিশ্লেষণ করতে বসেছিস।”
আমি কিছুটা ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম,
” তুই কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছিস সমুদ্র। আমার কোনোকালেই এসব বিষয়ে ইন্টারেস্ট ছিল না, আর এখনো নেই। আমি জাস্ট দোষ গুণের কথা বলছিলাম।”
” কিসের দোষ গুণের কথা বলিস? কোন জোড়েই বা বলিস। শামীম খারাপ বুঝলাম, পিংকি কোন দিক থেকে ভালো? এতই যদি ভালো হয় শুতে গিয়েছিল কেন? না শুলে বুঝি হতো না? যে মেয়ে বিয়ের আগে শুতে সে আবার কীসের ভালো?”
সমুদ্রের আচমকা চড়া মেজাজ দেখে আমিসহ সবাই চুপসে যায়। ওসমান বলে উঠে,
” কীরে তুই এই সামান্য ব্যাপারে এতটা রিয়েক্ট করছিস কেন? এরকম চড়া মেজাজের কোনো মানে আছে? আর ইউশরা এমন কী-ই বা বলেছে যে এভাবে চড়া হতে হবে?”
” দেখ ওসমান, তুই ভালো করে জানিস আমি কোন ধাঁচের ছেলে। এসব নিয়ে নিজেও ঘাটাঘাটি করি না, আর না কাউকে করার সুযোগ দেই। সেই জায়গায় ইউশরার তো প্রশ্নই উঠে না।”
” হয়েছে হয়েছে বাদ দেয়। ইউশরার ভুল হয়ে গিয়েছে। আর কক্ষনো এরকম ভুল হবে না। তুই এখন মাথা ঠান্ডা কর। আজকের দিনটা এভাবে নষ্ট করে দিস না।”
সমুদ্র আর কিছু বলল না। তবে আমার দিকেও আর তাকালো না। গুমোট মুখে বসে রইলো সবার সাথে।
দেখতে দেখতে কেটে গেল ৫ মাস। পরীক্ষা শেষ রেজাল্টও দিয়ে দিয়েছে। দিন দুয়েকের মাঝে মাস্টার্সে ভর্তির ফরমও বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু সমুদ্রের মাথায় কোনো চিন্তা নেই। ভবিষ্যত, বিয়ে, চাকরি কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই। সে তার আগের মতই বিন্দাস জীবনে দিন কাটাচ্ছে। এদিকে আমি পড়েছি হাজারো কথার বেড়াজালে। সবার আঙুল উঠছে সমুদ্রের বেখেয়ালিপনার মাঝে। যেখানে বিয়ে হওয়ার কথা আরও ২ মাস আগে সেখানে সমুদ্র বিয়েতে একেবারেই অমত। সমুদ্রের বাবা অবশ্য বারবার বলেছে তারাই সব দেখভাল করবে কিন্তু সমুদ্র সেগুলো মানতে নারাজ। তার এক কথা, সে চাকরি নিয়েই বিয়ে করবে। তবে তার বলা অবধি ছিল শেষ। চাকরি খোঁজার বিন্দু পরিমাণ চেষ্টা তার মাঝে কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। ওদিকে বাবা সবার কথার তালে পড়ে সমুদ্রের বাবাকে বিয়ের জন্য জোড়াজুড়ি করলে অবশেষে সমুদ্রের বাবাও ছেলের সিদ্ধান্তের কাছে অপারগতা স্বীকার করে। যার ফলে বাবা রেগেমেগে ঘটক লাগিয়ে দেয় বিয়ের জন্য। অবশ্য এখানে বাবার দোষ আমি কোনোমতেই দিতে পারিনি। কেননা আমাদের সময়ে একটি মেয়েকে যেখানে সিক্স পাশ না হতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো, সেখানে আমি অনার্স পাশ করে মাস্টার্সে ভর্তি হবার কাবিল হয়ে গিয়েছিলাম। পুরো এলাকায় একটা ডাক পড়ে গিয়েছিল আমায় নিয়ে। আখ্যায়িত করেছিল বুড়ি মেয়ে নামে। যা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুভাবেই আমার বাবা মায়ের কানে এসে পৌঁছাতো। যার ফলে শুরু হয়েছিল বসার ঘরে আগের ন্যায় বিভিন্ন পাত্রের আনাগোনা। দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না আমার।
চলে এলো মাস্টার্সের ভর্তির দিন। সেদিন যতটা না ভর্তির জন্য ভার্সিটি যাওয়া আমার জরুরী ছিল, তার থেকেও বেশি জরুরী ছিল সমুদ্রের সাথে দেখা করাটা। ভার্সিটি পৌঁছেই সবার সাথে সাক্ষাৎ করেই সমুদ্রকে টেনে ক্ষানিকটা দূরে নিয়ে গেলাম। বললাম,
” কী পেয়েছিস আমাকে? খেলার পুতুল? আমি তোদের সবার হাতের খেলার পুতুল তাই না? যার যখন ইচ্ছে হবে সেভাবেই আমাকে নিয়ে খেলবি? ইচ্ছে ফুরিয়ে গেলেই মাঝ রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিবি তাই না?”
সমুদ্র কোনো প্রকার উত্তেজনা ছাড়া খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
” কেন? কী হয়েছে? কেউ কী তোকে কিছু বলেছে? ”
যদিও আমার হাসি আসছিল না, তারপরও কীভাবে যেন হেসে ফেললাম। তবে তাচ্ছিল্যের হাসি। বললাম,
” কেন…..তুই মনে হয় কিছুই জানিস না।আর হ্যাঁ, তুই যে জিজ্ঞেস করলি কেউ কিছু বলেছে না-কি! আচ্ছা, এখনো বুঝি কিছু বলার বাকী রয়েছে সমুদ্র? ”
” আমি কিন্তু তোর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছি না ইউশরা। যা বলার পরিষ্কার করে বল। আমি এসব আধোভাঙা কথা কখনোই বুঝি না।”
” তুই কী জানিস আমার জন্য পাত্র খুঁজছে? ”
” তোর বাসার পাশে কী আমার বসবাস যে তোর সব খবরাখবর আমি রাখব কিংবা জানব? ”
” ওহ্! ”
” হুম…… তা কবে থেকে পাত্র খোঁজা শুরু করল? ”
” যেদিন তোর বাবা অপারগতা স্বীকার করেছে সেদিন থেকেই। আর কত ঘরে বসিয়ে রাখবে আমাকে? কত ঘরের অন্ন ধ্বংস করাবে? কম দিন তো পার হলো না। আর আমার বয়সও নিশ্চয়ই বাড়া ছাড়া কমছে না। বয়সের ছাপ পড়ে যাচ্ছে মুখ জুড়ে।তারউপর নানান মানুষ নানান কথা তো রয়েছেই। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তোর উদাসীনতাকে নিয়ে। যা আমার পরিবার আর সহ্য করতে পারছে না। ”
” ওহ্! ”
” বিয়ে হওয়ার কথা ছিল অনার্স কমপ্লিট হওয়ার সাথে সাথে। একদিক দিয়ে তুই জব নিবি অন্যদিক দিয়ে বিয়ে। কিন্তু তুই…..তুই কী জব নেয়ার জন্য কোথাও গিয়েছিস? নূন্যতম চেষ্টা করেছিস? করিসনি… বরং বলেছিস মাস্টার্স কমপ্লিট হওয়ার পর বিয়ে করবি বলেছিস। এরকম লং টাইম রিলেশন কে মেনে নেবে বলতো? সবকিছুর মাঝেই মানানসই একটা শব্দ আছে। এটা কেন তুই ভুলে যাস?”
” ওহ্! ”
” কী ওহ্ ওহ্ করছিস? মুখে কথা নেই? না-কি কথা বলার ইচ্ছা নেই?”
.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here