নীল জ্যোৎস্নার রাত ও তুমি পর্ব ৩

#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত

পর্ব-০৩

এখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। নিয়ম মতো আজ প্রত্যয় আর হিয়া হিয়াদের বাড়িতে এসেছে। রাতের খাবার খাওয়ার পর এতোক্ষণ হিয়ার কাজিনদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো প্রত্যয়। এক প্রকার হিয়ার কাজিনরাই জেঁকে ধরেছিল তাকে। কাজিন সমাজে হিয়াই সবার বড়। সেই হিসাব মতো প্রত্যয় হচ্ছে তাদের প্রথম দুলাভাই। আর দুলাভাইয়ের কাছে এতটুকু আবদার তো করাই যায়। তবে হিয়া এতোক্ষণ তাদের সাথে ছিল। সে খাবার খাওয়া শেষে আধা ঘন্টা পরেই তার রুমে চলে এসেছে।

প্রত্যয় এসে হিয়ার দরজার সামনে দাঁড়াই ভেতরের দৃশ্যে যেন মৃদু বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেল তার শরীরে। হিয়া সদ্য গোসল করেছে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে লোশন মাখছিল। মাথার চুলগুলো ভালোভাবে মুছা হয়নি তাই তার ছোট ছোট চুল বেয়ে পানি পড়ছে যার দরুন তার পরনের কাঁচা হলুদ রঙের কামিজটা পিঠের দিকটা একদম ভিজে গেছে। গলার স্বর্ণের চেইনটা চিকচিক করছে। তাকে দেখতে মোহনীয় লাগছে। হিয়াকে এই রূপে দেখে প্রত্যয়ের কেমন গলা শুকিয়ে আসছে। মনে কোণে এক নিষিদ্ধ বাসনা উঁকি দিয়ে। তাই সে দ্রুত সে দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। বুকে হাত দিয়ে নিজের একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে প্রত্যয় নিজেই নিজেকে মনে মনে শাসিয়ে বললো,খবদার প্রত্যয় একদম ওদিকে তাকাবি না। আজ তোর কি হয়েছে বলতো? প্রথমে ছোট বোন এখন আবার বড় বোন। তোর চরিত্রে কি কোন সমস্যা দেখা দিলো নাকি? একদম তাকাবি না।

আবার পরমূহুর্তে নিজের মনকে বললো,
কেন তাকাবো। ছোট বোনের দিকে তাকানো ভুল ছিল কিন্তু বড় বোন তো আমার বিয়ে করা বউ। আমি তার দিকে তাকাতেই পারি।

মিনিট পরিমাণ সময় নিয়ে প্রত্যয় নিজেকে ধাতস্থ করে দরজায় টোকা দিয়ে বলল,

-আসতে পারি ভেতরে?

তার কথায় হিয়ার পেছন দিকে মৃদু হেসে বলল,
-হ্যা আসুন।

প্রত্যয় রুমে এসে হিয়াকে প্রথম যে কথাটা বললো সেটা হলো,
-আপনি শাওয়ার নিয়েছেন কেন এতো রাতে?

-হ্যা। আসলে বেশি রাত জেগে পড়লে মাথা ব্যথা হয় তো। শাওয়ার নিলে ভালো লাগে। আমি প্রায়ই এই সময় গোসল করি।

-ওহ।

হিয়া মৃদু হাসলো শুধু। তারপর আলমারি থেকে একটা কাথা বের করে বিছানায় রেখে প্রত্যয়কে বললো,

-আপনি শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে তো।

প্রত্যয় দাঁড়িয়ে ছিল। হিয়ার কথায় সম্মতি জানিয়ে বললো, হুম।
কয়েক মূহুর্ত পর আবার কিছু একটা ভেবে বললো,

-আপনি ঘুমোবেন না?

-না। আমি এখন ঘুমাতে পাড়বো না। আসলে কয়েক দিন পর আমার ইনকোর্স পরীক্ষা তো। সিলেবাস এখনো শেষ হয়নি। আমার পড়তে হবে। আপনি বরং শুয়ে পড়ুন। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। আর রাত ও অনেক হয়েছে। তাই আপনি শুয়ে পড়ুন।

এই বলে হিয়া তার পড়ার টেবিলের কাছে চলে গিয়েও আবার ফিরে এলো। প্রত্যয় এখন একই ভাবে দাড়িয়ে আছে। হিয়া বললো,

-আপনার আর কিছু লাগবে আমাকে বইলেন।

প্রত্যুত্তরে প্রত্যয় হালকা হেসে ‘হুম’ বললো। হিয়া তার বিপরীতে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে। আবার পড়ার টেবিলের কাছে চলে গেল।

হিয়ার রুমটা বিশাল। মনে হচ্ছে দুইটা রুমকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে এই রুমটা তৈরি করা হয়েছে। একপাশে থাকার ব্যবস্থা। মানে খাট আসবাব সবকিছু। আর আরেক পাশে তার স্টাডি রুম। দুই পাশের দেয়ালের সাথে লাগোয়া বুক সেল্ফ। তাতে বইয়ে ঠাসা। মেয়েটা এতো পড়াশোনা করে?

প্রত্যয় ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানার একসাইডে শুয়ে পড়লো। ঘরের আলো জ্বালানো থাকলে তার ঘুম আসে না। যদিও হিয়ার এই লাইটের প্রয়োজন নেই। ও টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়েই পড়তে পারবে। তবুও প্রত্যয় আলোটা নেভালো না। সে চোখের উপর হাত রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু ঘুম আসছে না। কেন জানি অস্থির অস্থির লাগছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? হিসাব মতো আজ প্রত্যয় আর হিয়ার একসাথে প্রথম রাত। আর হিয়া কি-না বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। ইতিহাসে হয়তো এই প্রথম কোন নব বধূ বাসর রাতে বইয়ের পাতায় মুখ লুকিয়ে বসে আছে। প্রত্যয় নিজেও পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। বইপড়া তার ও প্রিয় শখ। কিন্তু হিয়ার মতো এতোটা পড়কুট স্বভাবের সে ছিল না।

প্রত্যয়ের সাথে হিয়ার যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিনও হিয়া বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে ছিল। তাদের বিয়ের কথা চলাকালীন সময়ে প্রত্যয়ের মা তাকে বলে হিয়ার সাথে দেখা করার জন্য। প্রত্যয় তো প্রথমে এই বিয়েতেই রাজি ছিল না। তারপরেও মায়ের জোরাজুরিতে সে হিয়ার সাথে দেখা করতে রাজি হয়। তারা একটা কফিশপে দেখা করতে চায়। প্রত্যয় যেদিন কফিশপে হিয়ার সাথে দেখা করতে যায় সেদিন তার সাথে নোরাও আসে। হিয়া বরাবরের মতোই বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে ছিল। আর বার বার করে হাত ঘড়িটা দেখছিল। তার চোখ মুখে ছিল তীব্র বিরক্তি। ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে এখানে ইচ্ছে করে আসেছি। সে বিরক্ত হয়ে নোরাকে কি যেন বলছিল আর তার বিনিময়ে নোরা মিষ্টি করে হাসছিল। তাই দেখে প্রত্যয় ভেবেছিলো তার হবু বউটি হয়তো নোরাই। কারণ হবু বরের সাথে দেখা করতে এসে কেউ এমন করে বইয়ের পাতায় মুখ লুকিয়ে বসে থাকে না। নোরা সেদিন নীল রঙের একটা থ্রি পিস পড়ে গিয়েছিল। তাকে দেখছে সদ্য প্রস্ফুটিত নীল রঙের গোলাপ ফুলের মতোই মোহনীয় আর সিগ্ধ লাগছিলো। আর প্রত্যয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল নোরার দিকে। পাশে কে আছে তার যেন সেই খেয়ালই ছিল না। হঠাৎ করে অফিস থেকে একটা জরুরী কল আসায় প্রত্যয় সেদিন তাদের সাথে শুধু দেখা করেই চলে আসে। রাতে এসে তার মা-বাবাকে জানায়, সে এই বিয়েতে রাজি। তারা দুইজন খুব খুশি হয়। অনুভূতিটা সম্পূর্ণই ছিল তার দিক থেকেই। নোরা এসবের কিছুই জানতো না। তার মা তাকে ফোনে হিয়ার সাথে কথা বলতে বললেও সে নাম্বার নেয়নি। সে বলেছে, তাদের মা কথা হবে সব বিয়ের পরে হবে। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে প্রত্যয় জানতে পারলো তার সাথে যার বিয়ে হবে সে নোরা না। কিন্তু সেই মূহূর্তে কিছুই আর তার হাতে ছিল না। তাই হিয়ার সাথেই তার বিয়েটা হয়।

প্রত্যয়ের হঠাৎ করেই মন হলো সে হিয়াকে ভীষণ ভুল একটা কথা বলে ফেলেছে, সে নোরার প্রেমে পড়েছিলো এই কথাটা সত্যি নয়। সত্যি এটাই সে শুধু নোরার প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল। যেমন একটা সুন্দর ফুল দেখলে সবাই মুগ্ধ হয়। বিস্ময় নিয়ে বলে, ফুলটা কি সুন্দর ঠিক তেমন। তবে অনুভূতিটা প্রেম কিংবা ভালোবাসা নয়। তা না হলে আড্ডার মাঝে আজ যখন শুনলো, নোরার বয়ফ্রেন্ড আছে তার একটুও খারাপ লাগেনি। বরং সে যেন একটা অপরাধবোধে থেকে মুক্তি লাভ করেছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই প্রত্যয় কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে জানে না। মাঝ রাতে হঠাৎ করেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মোবাইলের পাওয়ার বাটন অন করে সময় দেখলো রাত ৩ টা বাজে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরে আলো নেই। হিয়া টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে এখনো পড়ছে। তা দেখে প্রত্যয় মনে মনে ভাবলো,

-মেয়েটা এখনো জেগে আছে? সামন্য ইনকোর্স পরীক্ষার জন্য এতো পড়তে হবে নাকি? এভাবে রাত জাগলে তো শরীর খারাপ করবে।

প্রত্যয় বিছানা থেকে নেমে হিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।

-হিয়া।

হিয়া পেছনে তাকিয়ে প্রত্যয়কে দেখে অবাক হলো। তার পর হঠাৎ করে একটা মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি? এতো রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়লেন যে কোন সমস্যা?

-হুম আমার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। এক কাপ কফি হবে?

হিয়া বললো- মেশিনের কফি হলে চলবে?

-হ্যা চলবে।

হিয়ার পড়ার টেবিলের বিপরীত পাশেই কফি মেশিন। হিয়া উঠে গিয়ে মেশিনের সুইচ টিপে এক কাপ কফি প্রত্যয়ের দিকে এগিয়ে দিল। আরেক কাপ নিজের জন্য ও নিয়ে। তার মাথাটাও ধরেছে। কফি খেলে হয়তো ভালো লাগবো। প্রত্যয় বললো,

-আমরা কি বৃষ্টি বিলাস করতে করতে কফিটা উপভোগ করতে পারি। এইটুকু সময় হবে আপনার?

হিয়া দ্বিধাহীন ভাবেই সম্মতি জানালো। এখন হিয়ার খোলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে তারা দুজন। ব্যালকনিতে বাহারি রকমের ফুলের গাছ। যদিও বেশি আলো না থাকার কারণে সেগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে ফুলের মিষ্টি সুবাস নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। সমগ্র পৃথিবী আধারে তলিয়ে। বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে। কি মধুময় চির ছন্দ। প্রত্যয় আর হিয়ার মাঝে মাত্র কয়েক হাতের দূরত্ব। দুজনের দৃষ্টিতে অজস্র না বলা কথা। কিন্তু কেউ ই কিছুই বলতে পারছে না। তাই নিশ্চুপ হয়েই কাটলো তাদের প্রথম সঙ্গটুকু।

_

সকাল বেলা হিয়ারা সবাই ব্রেকফাস্ট করছিল। তখনই কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থেকে একজন লোক এলো। হিয়ার নামে একটা পার্সেল এসেছে। নোরা গিয়ে পার্সেলটা নিয়ে এলো। হিয়া তাকে জিজ্ঞেস করল, কে পাঠিয়েছে রে?

নোরা বললো, কে পাঠিয়েছে তা তো লেখা নেই। শুধু লেখা,
তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা রইল।

~চলবে, ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here