নীল জ্যোৎস্নার রাত ও তুমি পর্ব ৮ ও শেষ

#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত

শেষ পর্ব

হিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না মেয়েটা প্রত্যয়ের গার্লফ্রেন্ড’ই কিন্তু প্রত্যাশা তাকে সত্যিটা বলতে চাইছে না। তবে হিয়াও তাকে আর এ নিয়ে জোর করলো না। আর জোর করবেই বা কোন অধিকারে? প্রত্যয়তো তাকে বিয়ের পরেরদিনই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সে হিয়াকে তার স্ত্রী রূপে মেনে নিতে পারবেনা। যেখানে সে কোনদিন প্রত্যয়ের কাছ থেকে স্ত্রীর অধিকার পাবে কি-না সেটাই হিয়ার জানা নেই। সেখানে অযথাই এসব নিয়ে বারাবারি করার কোন মানেই হয় না। তাছাড়া হিয়া নিজেও তো কখনো এই সম্পর্কের গভীরতা চায়নি। বাবার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে বাধ্য হয়ে সে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলো। তবুও হৃদমাঝারে কেন এতো দহন? কেন মানতে ইচ্ছে করে না লোকটা তাকে নয় অন্য কোন রমণীকে ভালোবাসে। এই বাইশ বছরের জীবনে তো কম পুরুষ আসেনি তার জীবন তবুও সে কখনো কোন ছেলের প্রতি আকর্ষিত হয়নি। আর সেখানে মাত্র সাত দিনেই সে প্রত্যয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে। হয়তো সে প্রত্যয়কে ভালোবাসতেও শুধু করেছে। হিয়া মনে মনে ভেবে নিয়েছে, সে এখানে আর থাকবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে হোস্টেলে চলে যাবে। কারণ সে যত প্রত্যয়ের সান্ধিয্যে থাকবে ততো প্রত্যয়ের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়বে কিন্তু এটা তো ঠিক নয়। আর এ সম্পর্ক ও হবার নয়। হিয়া ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ভালোবাসায় এতো যন্ত্রণা তা জানার পরেও কেন ভালোবেসে ফেললো প্রত্যয়কে? কেন? হিয়ার এখন নিজের উপরই ভীষণ রাগ হচ্ছে। নিজের চোখে বাবা-মায়ের পরিণতি দেখার পরেও এমন ভাবনায় জড়িয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক নয়। কিন্তু ভালোবাসা কি আর ঠিক বেঠিকে চলে? ভালোবাসা কি আর এসব নিয়ম মানে? ভালোবাসা নিজেই তো আস্ত একটা নিয়ম। আর সেই নিয়মেই আমাদেরকে চলতে হয়।

_

কথায় আছে ,সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা। দেখতে দেখতেই হিয়া-প্রত্যয়ের বিয়ের দুই মাস পার হয়ে গেছে। হিয়া এখনো প্রত্যয়দের বাড়িতেই আছে। সে হোস্টেলে যায়নি। হিয়া অবশ্য যেতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রত্যয়ই তাকে আটকিয়েছে। সে হিয়াকে হোস্টেলে যেতে দেয়নি। এমনকি প্রত্যয় নিজেই প্রতিদিন হিয়াকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসে , নিয়ে আসে। এই দুই মাসে তারা বেশ ক্লোজ হয়ে গেছে। এখন তাদের মধ্যে সম্পর্কটা বন্ধুর মতোন। তবে হিয়া এতো দিনে প্রত্যয়কে ভীষণ ভাবে ভালোবেসে ফেলছে। কিন্তু কখনো বলা হয়ে উঠেনি। আসলে প্রত্যয় মানুষটাই এমন। তার ব্যবহারে ভালোবাসাটা আপনাআপনি তার প্রতি এসে যায়। শুধু বিয়ের পরেদিন সকালের কথাগুলো ব্যতিত… সে হিয়াকে ভীষণ কেয়ার করে। হিয়ার একটু কিছু হলেই সে কেমন অস্থির হয়ে উঠে। হিয়া তখন অবাক হয়ে তাকে দেখে। ভালোবাসে না তবুও কেন এতো অস্থিরতা? বাবার পরে কেউ তাকে এভাবে কেয়ার করবে হিয়া সত্যিই কখনো ভাবেনি। হিয়া বাবার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। তার বাবা তার জন্য সঠি মানুষটাকেই নির্বাচন করেছিল। এই মানুষটি সাথে দেখা না হলে সে হয়তো কখনো জানতোই না বাবা ব্যতীত কেউ তাকে এভাবে কেয়ার করতে পারে। প্রত্যয়ের পরিবারের মানুষগুলো ও খুব ভালো। তারাও হিয়াকে ভীষণ ভালোবাসে। হিয়া সত্যিই খুব খুশি। প্রত্যয় না হয় তাকে নাই ভালোবাসলো বন্ধু তো হয়েছে। এতেই চলে যাবে…

_

আজ বাসায় শুধু হিয়া আর প্রত্যয় আছে। প্রত্যয়ের মা-বাবা প্রত্যয়েদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে। আর প্রত্যাশা তার বান্ধবীর বাসায়। রাত আটটা! প্রতিদিনের মত হিয়া স্টাডি রুমে বসে পড়ছিল। তার এখন ইনকোর্স পরীক্ষা চলছে। আর একটা পরীক্ষা আছে। তাই শেষ। হিয়া খুব মনযোগ দিয়ে আগামী কালের পরীক্ষার জন্য পড়ছিল হঠাৎ করেই কারেন্ট চলে গেল। হিয়া টেবিল ল্যাম্পের সুইচ টিপলো কিন্তু বাতি জললো না। ও ল্যাম্পটা তো নষ্ট হয়েছে। মনেই তো ছিল না। হিয়া নিজের মোবাইল খুঁজলো কিন্তু পেল না। হয়তো রুমের ফেলে এসেছে। হিয়া চেয়ারে থেকে উঠতে যাবে তখনই প্রত্যয় একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। মোমবাতিটা পড়ার টেবিলের উপর রেখে বললো,

-আজ রাতে বোধহয় আর কারেন্ট আসবে না। সকালে মাইকিং করেছে। আর জেনারেটরেও কি না প্রবলেম হয়েছে।

কারেন্ট আসবে না শুনেই যেন হিয়ার মাথায় একটা বাজ পড়লো। কাল তার পরীক্ষা আর আজ রাতে কি-না কারেন্ট আসবে না। তাহলে হিয়া পড়বে কি করে?এই মোমবাতি দিয়ে আর কতোক্ষণ পড়া যাবে। প্রত্যয় হয়তো হিয়ার মনের ভাবটা বুঝতে পারলো তাই হিয়াকে শান্ত করতে সে বললো,

-রিল্যাক্স হিয়া। এই কয়েকদিন আপনি অনেক পড়েছেন তাই আজ না পড়লেও আমি জানি আপনার পরীক্ষা ভালোই হবে।

এই বলে প্রত্যয় হিয়ার দিকে তাকালো কিন্তু দেখলো হিয়া এখনো মুখ চোখা করেই বসে আছে। তাই প্রত্যয় আবার বললো,

-হাইস্কুলে আমাদের একজন স্যার ছিল। সে কি বলতো জানেন? বলতো, পরীক্ষার আগের রাতে তোমারা বেশি পড়বে না। আগে সব পড়া শেষ করে রাখবে। পরীক্ষার আগের রাতে নিজেকে রিল্যাক্সে রাখবে। তাতে তোমাদের পরীক্ষা ভালো হবে। এই কয়েকদিন তো অনেক পড়াশুনা করেছেন তাই আজকে আর পড়তে হবে না। আজকের রাতের আকাশটা কতো সুন্দর দেখছেন?

হিয়া যেন আস্বস্ত হলো প্রত্যয়ের কথায় যা তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠল। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রত্যয়ের দিকে তাকিয়ে রইল খানিক। মানুষটা হিয়ার জীবনে আসার পর থেকে একটু একটু করে যেন তার জীবনটা পাল্টে যেতে শুরু করেছে। পড়কুট হিয়া থেকে সে হয়ে উঠেছে প্রত্যয়ের প্রেমে মাতোয়ারা হিয়া। সামনের যুবকটি কি জানে হিয়া যে প্রতিমূহুর্ত তার প্রণয়ের সমুদ্রে ডুবে মরছে। না সে জানে না। হিয়ার ভীষণ ভয় হয়। প্রত্যয়ের সাথে থাকলে কবে না সে প্রত্যয়কে সব বলে দেয়। সে পরাবে না প্রত্যয়ের প্রত্যাখানের কষ্ট সইতে। তখন তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যাবে। তার থেকে বরং হিয়ার মনের কথা মনেই থাক। তবুও তো সে প্রত্যয়ের সান্ধিয্যে থাকতে পারবে। হিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই প্রত্যয় বললো,

-কফি খাবেন হিয়া? সেদিন তো আপনি আমাকে খাইয়েছিলেন। আজ আমি আপনাকে কফি বানিয়ে খাওয়াবো।

-আপনি পারেন?

-আলবাত পারি। আপনি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন আমি কফি বানিয়ে আনছি।

এই বলে প্রত্যয় চলে গেল কফি বানাতে। আর হিয়া এসে এই স্টাডি রুমের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক ব্যালকনি নয় এটা একটা মিনি ছাদ। ছাদে হারেক রকমের ফুলের গাছ। আর বসার জন্য একটা কাঠের সুন্দর দোলনাও আছে। হিয়া দোলনায় বসলো। আজকের আকাশটা সত্যিই খুব সুন্দর। আকাশে ফিনিক তারার মেলা। আর মাঝখানে রূপলী থালার মতো গোলাকার ছাদ। আশে পাশের বিল্ডিংগুলোতেও আজ আলো নেই। হিয়া দোলনা থেকে উঠে ছাদের কার্নিশে এসে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি উজ্জ্বল নক্ষত্র খচিত ওই আকাশের দিকে। রাতের আকাশ এতো সুন্দর হয়? শুধু বইয়ের পাতায় পড়া হয়েছে কখনো এভাবে দেখা হয়নি। প্রত্যয় এখনো আসছে না কেন? পাঁচ মিনিটের কথা বলে গেল। আর এখন তো পনের মিনিট হতে চললো। হিয়ার ভাবনার মাঝেই প্রত্যয় এলো। হাতে দুটো কফির মগ। একটা হিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। হিয়াও মুচকি হেসে কফির কাপটা হাতে নিলো। কফির কাপে এক চুমুক দিতেই হিয়া ভীষণ অবাক হলো। সে অবাক দৃষ্টিতে প্রত্যয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-লেবু চা। আপনি জানলেন কি করে এটা আমার ফেভারিট?

-প্রত্যাশা বলছিলো সেদিন।

-কিন্তু কফির মগে এনেছেন কেন?

হিয়ার কৌতুহলী কন্ঠে প্রত্যয় মাথা চুলকে বোকা হেসে বললো,
-তা না হলে তো আপনার এই অবাক হওয়া ফেসটা দেখতে পারতাম না।

হিয়া তাকালো প্রত্যয়ের দিকে। আর প্রত্যয়ের দৃষ্টি ওই সুবিশাল আকাশের দিকে। হিয়া কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো‌।

এমন এক নীল জোৎস্নার রাতে জোৎস্না বিলাস করার খুব ইচ্ছে ছিল। আর সাথে থাকবে প্রিয় মানুষটি।—প্রত্যয় বললো।

প্রত্যয়ের কথাটা শুনে হিয়ার বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠলো। ভালোবাসা হারানোর ভয়ে ভেতরটা কিলবিলয়ে হয়ে উঠলো। সে কেমন অসহায় দৃষ্টিতে প্রত্যয়ের দিকে তাকালো। প্রত্যয় হিয়ার দিকেই চেয়ে ছিলো। দুজনার চোখাচোখি হতে সে মুচকি হাসলো। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,

-জীবনে প্রথম প্রেমে পড়ি যখন আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। মেয়েটার নাম ছিলো নিধি। নিধি আমার থেকে এক ব্যাচ নিচে পড়তো। আমার এক ফ্রেন্ডের কাজিন ছিল সে। সেই ফ্রেন্ডের বার্থ ডে’তেই তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। আর প্রথম দেখতেই আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। তাকে পাওয়ার জন্য পাগলামিও করেছি অনেক। যে আমার পেছনে শত সুন্দরী মেয়েরা ঘুরতো কিন্তু পাত্তা দিতো না আর সেই আমিই ছ্যাছড়ার মতো নিধির পেছন পেছন ঘুরেছি। অবশেষে নিধিও হার মানতে বাধ্য হয়। সে মেনে নেয় আমার ভালোবাসা। তারপর শুরু হয় আমাদের প্রণয়ের গল্প। কিন্তু নিধি পুরো একটা সাইকো ছিলো। প্রথম প্রথম সবকিছু ঠিকই ছিলো। নিধির সাথে আমার রিলেশন ভালোই যাচ্ছিলো। আসলে আমি তখন নিধির দোষগুলো দেখতে পেতাম না। কথায় আছে না,প্রথম প্রথম প্রেমিকার চুলের উকুন ও জোনাকি মনে হয়। ঠিক সেই রকম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে নিধির সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে লাগলো। আমার ফেসবুক পাসওয়ার্ড,ওয়াস’আপ সবকিছু তার কাছে থাকতে হবে। সে ব্যবতীত আমি আমার বন্ধুদের ও সময় দিতে পারবো না। কোন মেয়ের সাথে কথা বলা যাবে না। এমনি প্রত্যাশাকে নিয়ে সিনক্রিয়েট পর্যন্ত করেছে। কয়েক মাসে আমার জীবটা একদম বিষিয়ে উঠছিলো। দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তেইশ ঘন্টাই আমাদের ঝগড়া হতো। দিনে কমপক্ষে একশোবার নিধি আমার সাথে ব্রেকআপ করতো। আবার নিজেই কান্নাকাটি করতো। আমি না ওকে ছাড়তে পারছিলাম আর না ধরে রাখতে পারছিলাম। কখনো আমি রাগ করে যদি ফোন না ধরতাম ও আমাদের বাসায় এসে পর্যন্ত সিনক্রিয়েট করতো। ও কারণে পরিবারের সবার সাথে আমার সম্পর্ক প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিধি আমার জীবনটা পুরো দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তারপর অবশ্য সে নিজেই চলে গেছে। আমারই এক ক্লাসমেটের সাথে ওর অ্যাফেয়ার হয়। নিধির সাথে আমার যেদিন ব্রেকাপ হয় সেই দিনটা ছিল আমার সবথেকে খুশীর দিন। যেন জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছি। নিধির সাথে রিলেশনশিপে আমার ঢের শিক্ষা হয়েছিলো। তাই ব্রেকাপ হবার পরেই ভেবেছিলাম, আর কখনো রিলেশনে জড়াবো না এমনকি বিয়েও করবো না। কিন্তু আম্মু-আব্বুর জোরাজুরিতে, তাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলে বাধ্য হয়ে সেদিন ক্যাফেতে আপনার সাথে দেখা করতে রাজি হই। ভেবেছিলাম বাসায় এসে বললো, পাত্রী পছন্দ হয়নি আমার। কিন্তু সেদিন ক্যাফেতে নোরাকে দেখেই আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেদিন আপনি পাশে বসে থাকলেও আমি আপনাকে খেয়ালই করিনি যেন। নোরাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তবে সেটা ভালোবাসা ছিল না। যাই হোক বাসায় এসে বলি, আমি বিয়েতে রাজি। আব্বু-আম্মুও খুব খুশি হন। তারপর সবটাই তো আপনার জানা। বিয়ের আগে আম্মু আমাকে আপনার ফোন নাম্বার দিয়েছিল। আপনার সাথে দেখা করতে বলছিলো। কিন্তু আমার ইচ্ছা করেনি। সবটা বিয়ের পরের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। বিয়ের আগের দিনই আমি জানতে পারি যে, বিয়েটা নোরার সাথে না আপনার সাথে হবে। কিন্তু আমার তখন আর কিছুই করার ছিল না।

এইটুকু বলেই থামলো প্রত্যয়। হিয়ার দিকে একপলক তাকালো সে। কিন্তু হিয়া অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এসব কিছুতো হিয়ার জানাই ছিল। প্রত্যয় যে তাকে ভালোবাসে না সেটা তো হিয়া খুব ভালো করেই জানে। তবুও কেন বারবার একই কথা বলে সে হিয়াকে কষ্ট দেয়। হিয়ার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে কিন্তু সে কাদতে পারছে না। এর মাঝে প্রত্যয় আবার বলা শুরু করলো,

– কিন্তু আপনার সাথে থাকার পর আমি বুঝেছি সব মেয়েরা একরকম হয় না। আপনি আলাদা। সবার থেকে আলাদা। আপনার সাথে থাকতে থাকতে কখন যে একটু একটু করে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি জানা নেই আমার। শুধু জানি আমি আপনাকে ভালোবাসি হিয়া। ভীষণ ভালোবাসি।

প্রত্যয়ের কথায় হিয়া অবাক হয়ে পুলকিত দৃষ্টিতে তাকালো প্রত্যয়ের দিকে। প্রত্যয় তার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁট মৃদু হাসির রেখা। হিয়ার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রত্যয় কি সত্যিই বলছে কথাগুলো। নাকি সবই তার ভ্রম। এর মাঝে প্রত্যয় হিয়ার সামনে হাটু গেড়ে বললো,

-আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা তুমি নও হিয়া। তবুও কখন, কিভাবে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি জানি না। শুধু জানি ভালোবাসি তোমায়। হবে কি আমার নীল জোৎস্নার রাত?

হিয়া এখনো চুপ করে আছে। তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে। এসব কি সত্যিই হচ্ছে নাকি সে স্বপ্ন দেখছে।

-কি হলো কিছু বলছো না কেন? ভালোবাসো না আমায়?

হিয়া এবারো কিছু বলতে পারলো না। স্বপ্ন নয়, সবকিছু সত্যিই। আজ হিয়ার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন।সত্যিই প্রত্যয় তাকে ভালোবাসে। হিয়ার গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। এটা কষ্টের কান্না নয় খুশির কান্না। হিয়ার কান্না দেখে প্রত্যয় উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে হিয়ার চোখের পানি মুছে দিলো।

কাদছো কেন হিয়া? ভালোবাসো না আমায়? কিন্তু তোমার চোখে তো ভালোবাসা দেখেছি আমি।–খানিকটা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো প্রত্যয়

হিয়া কান্নারত কন্ঠেই উত্তর দিলো,
-আমিও ভালোবাসি আপনাকে‌। ভীষণ ভালোবাসি।

প্রত্যয় মুচকি হেসে হিয়ার বাম হাতটা নিয়ে অনামিকা আঙ্গুলে একটা হিরার আংটি পরিয়ে দিলো। হিয়ার হাতে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে বললো,

-বাসর রাতে দেয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষটিকে এই আংটিটা পরাতে। তাই আজ দিলাম।

___________

পরিশিষ্ট:

ছাদের দোলনায় প্রত্যয়ের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে হিয়া। প্রত্যয়ের হাতে গিটার। একটু আগেই তারা ঝগড়া করেছে। তার কারণে হিয়া রাগ করে ছাদে এসে বসে ছিল। আর প্রত্যয় এসেছে তার প্রিয় গান শুনেয়ে হিয়ার রাগ ভাঙাতে। প্রত্যয় বললো,

-হিয়া?

-হুঁ।

-তোমার কাজিনদের কাছ থেকে শুনেছি তুমি নাকি খুব ভালো গান গাইতে পারো। আমাকে একটা গান শুনবে?

-কে বলেছে? রাফি? মিথ্যা বলেছে ও। আমার গানের গলা একদম ভালো না।

-ভালো না হলে কি আর করার। গাও না একটা গান। তোমার বর ই তো শুনবে। এখানে তো আর কেউ নেই যে তোমার শাকচুন্নীর মতো ভয়েস শুনে জ্ঞান হারাবে।

-কি বললে তুমি? আমি শাকচুন্নী?

বলেই হিয়া মারতে গেল প্রত্যয়ের দিকে। হিয়াকে ক্ষেপাতে তার খুব ভালো লাগে। প্রত্যয় মুচকি হেসে হিয়ার মাথার পেছনে হাত দিয়ে তার মুখটা নিজের কাছাকাছি এনে হিয়ার নাকের ডগায় একটা চুমু দিয়ে বলল,

-অবশ্যই না। তুমি আমার মিষ্টি বউ।

কথাটা শুনে হিয়ার রাগ একদম গলে গেল। সে আহ্লাদী হয়ে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।

একটা গান শোনাও না। আমি জানি তোমার গানের গলা খুব সুন্দর। সবাইকে গান শুনিয়েছো। শুধু আমি বাদে।—প্রত্যয়।

-ওহ। আগে তোমার শাস্তি শেষ হোক তারপর দেখা যাবে তোমাকে তোমাকে গান শোনাবো কি-না?

হিয়ার কাছে হার মেনে প্রেয়সীর মান ভাঙাতে প্রত্যয় নিজেই আবার গান ধরলো,

কি নামে ডাকবো তোমায়,
নীল জোছনা,
এল চিলতে রোদ্দুর হয়ে আর হেসোনা।
যদি তোমায় ছুঁতে পারি
দেব মেঘের সাথে আড়ি
শুধু মন আকাশে, হাওয়ায় মিশে
ছুটে আসোনা।
কি নামে ডাকবো তোমায়,
নীল জোছনা।

~(সমাপ্ত)

!
!
!
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here