#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত
পর্ব-০৫
তিমির রাতের শেষে এক নতুন ভোরের আগমন হলো এ শহরে। সাথে নিয়ে এলো কিছু নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা। আর প্রিয় মানুষগুলোর সাথে আরো একটা দিন বেঁচে থাকার তীব্র লিপ্সা।
খোলা জানালা ভেদ করে আলোক রশ্মি এসে চোখের উপর পড়তেই ঘুম ছুটে গেল প্রত্যয়ের। সে ঘড়িতে সময় দেখলো, সকাল ৬:৩৪ বাজে। প্রত্যয় আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলো। আজো হিয়া বিছানায় নেই। হিয়ার কথা মনে পড়তে প্রত্যয় তার পড়ার টেবিলের দিকে তাকালো। দেখলো হিয়া চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। প্রত্যয় বিছানা থেকে নেমে হিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। হিয়াকে বিছানায় গিয়ে ভালোভাবে ঘুমানোর জন্য ডাকাতে গিয়েও সে থেমে গেল। হিয়া সারা রাত শেষে একটু ঘুমিয়েছে। এখন ডাকলে তার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাবে। প্রত্যয় কিছু একটা ভাবলো। তার পর একটু অস্বস্তি হলেও সে হিয়াকে কোলে করে বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। হিয়ার ঘুম গভীর হওয়ার সে কিছুই টের পেল না। হিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তার উপর একটা কাঁথা টেনে দিয়ে প্রত্যয় চলে যেতে নিবে এমন সময় হিয়া ঘুমের ঘোরে তার বা হাতটা টেনে ধরলো। ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। হিয়া কি বলে শোনার জন্য প্রত্যয় তার আরেকটু কাছে গেল কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারলো না। তাই সে অতি সন্তর্পণে তার হাতটা হিয়ার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। আজ রাতেও বৃষ্টি হয়েছে। যার দরুন প্রকৃতি এখন কাঁচের মত ঝকঝক করছে। বাগাণের গাছগুলোর পাতা থেকে এখনো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে। অদূরে একটা কদম ফুলের গাছ ভর্তি হলুদ রঙের ফুল।গাছের মগডালে বসে একজোড়া শালিক পাখি তাদের ডানা ঝাপটাচ্ছে। সিগ্ধ সকালে প্রকৃতির কি সুন্দর একটা দৃশ্য! দৃশ্যটা দেখলে যে কারো মনের ভেতরটা মূহুর্তেই পুলকিত হয়ে উঠবে।
_
আজ ব্রেকফাস্ট টেবিলে হিয়ার একটা কল এলো। হিয়া ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তাকে কল করা ব্যক্তির নামটা দেখে মূহুর্তেই তার মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। প্রত্যয় অবাক দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। গত দুই দিনে হিয়াকে এতো খুশি হতে সে একবারো দেখেনি। সে মনে মনে ভাবলো, কে এমন ফোন করেছে? যার ফোন পেয়ে তার গোমরামুখো বউটি আজ এতো খুশি।
প্রত্যয়ের ভাবনার মাঝেই হিয়া হাত ধুয়ে ফোনটা নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
-হ্যালো দিয়ু কেমন আছিস?
-আমি তো বিন্দাস আছি। তুই কেমন আছিস সেটা বল।
-আমিও ভালো আছি।
-সারাজীবন বিয়ে করবি না, বিয়ে করবি না বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলতি। আর শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আমার আগেই করে ফেললি।
দিয়ার কথায় হিয়া অযথাই লজ্জায় নুইয়ে গেল। দিয়া আবার বললো, তা তোর বর? আমার একমাত্র দুলাভাই কেমন?
হিয়া লজ্জায় নত হয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
-ভালো ।
-এই হিয়ু বাই এনি চান্স তুই কি লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? এইটুকুতেই লজ্জায় নুইয়ে পড়লে হবে? তুই যা নিরামিষ।তোদের মধ্যে রোসান্স-টোমান্স কিছু নিশ্চয় এখনো হয়নি। কিন্তু আমার দুলাভাই বেচারা এভাবে আর কতোদিনই বা সহ্য করবে? কয়েক দিন পর তোকে ধরে চুমুটুমু খেয়ে নিলে তো লজ্জার চোটে তোকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। আমি আমার একমাত্র দুলাভাইয়ের ভবিষ্যত নিয়ে খুব চিন্তিত রে দিয়ু। আল্লাহ ই জানেন তার কপালে কি আছে। কয়েক দিন পর হয়তো পত্রিকায় শিরোনাম উঠবে,এক চুমুতে বউ উদাও।
দিয়ার কথা শুনে হিয়ার কান দিয়ে যেন গরম হাওয়া বের হতে শুরু করলো।মেয়েটা সাংঘাতিক লেভেলের ঠোঁটকাটা। একদম হিয়ার বিপরীত। হিয়া তাকে মৃদু ধমকের সুরে বললো,
-রাখতো তো ফালতু কথা।
-ফালতু কথা না রে বোন। ইট’স ট্রুথ। একদম সত্য কথা বলতেছি আমি। আমার একমাত্র দুলাভাইয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমার তো কষ্টে বুকটা ফাইট্টা যাইতেছে। তুই আমার বোন হয়ে এমন পুরুষ বিদ্রোহী কি করে হলি বলতো? ছেলে দেখলেই তোর এলার্জি শুরু হয়। এরকম হলে চলে?
-হুহ। আমাকে নিয়ে তোকে এতো বেশি ভাবতে হবে না। আর তুই বিদেশে থেকে দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছিস। এই তুই যে সারাদিন শুধু পার্টি, ক্লাব এসব করিস মামুনি তোকে কিছু বলে না?
হিয়ার কথায় দিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
-তোর মামুনি কি বলবো? সবাই তো আর তোর মতো নিরামিষ না বুঝলি। এসব করতে হয়। সারাদিন এতো বই পড়ে কি হবে? তার থেকে আমিই বিন্দাস আছি। খাচ্ছি, ঘুমুচ্ছি, পার্টি করছি। ভেরি বিউটিফুল লাইফ।
-হুহ। বিউটিফুল না ছাই। দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছিস তুই। মামুনির কাছে আজই তোর নামে কমপ্লেন করবো।
এভাবেই তাদের দুইবোনের খুনসুটি চলতে থাকলো। হিয়ার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হচ্ছে দিয়া। হিয়ার সাথে সারাদিনের যা ঘটে সে দিয়াকে সব বলে। আর দিয়াও সব হিয়াকে বলে। হিয়া চুপচাপ, পড়কুট স্বভাবের হলেও দিয়া তার সম্পূর্ণ বিপরীত। সে ছটফটে, চঞ্চল। আর পড়াশোনা তো সে একদম ই করে না। তাদের খুনসুটিময় কথাবার্তার মাঝে দিয়া হঠাৎ আবেগী কন্ঠে বলে উঠলো,
-এই হিয়ু সত্যিই ভালো আছিস তো তুই?
দিয়া এমন কন্ঠে হিয়ার বুকটা কেমন ধক করে উঠল। সে কি বলবে,দিয়াকে? সে কি আদৌও ভালো আছে? যেখানে তার স্বামী বিয়ের পরেরদিন সকালে বলে দিয়েছে, সে হিয়াকে নয় অন্য কাউকে ভালোবাসে। স্বামীর মুখের অন্য কাউকে ভালোবাসে জানার পরে আদৌও কি ভালো থাকা যায়?হিয়া চুপ করে আছে দেখে দিয়া আবার জিজ্ঞেস করল,
-কি হলো? কথা বলিস না কেন? তুই এই বিয়েতে রাজি হলি কেন? তুই তো বলেছিলি মাস্টার্স শেষ করে হায়ার স্টাডিজ করবি। নিজের পায়ে দাঁড়াবি। তাহলে মাঝ পথে হঠাৎ করে নিজের সিদ্ধান্ত কেন পাল্টে ফেললি?
-বাবার জন্য। তবে এতো ভাবিস না, সে খুব ভালো।
দিয়ার সাথে কথা বলা শেষে হিয়া পেছন ঘুরেই দেখলো তার পেছনে প্রত্যয় দাঁড়িয়ে আছে। হিয়া একটু অপ্রস্তুত হলো। প্রত্যয় সব শুনে ফেলেনি তো? হিয়া ঠোঁটে কোণে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল।বিনিময়ে প্রত্যয়ও মুচকি হাসলো। প্রত্যয় এই মাত্র এলো। হিয়াদের কথা সে কিছু শুনতে পায়নি।
_
বিদায় খুব নিষ্ঠুর একটা শব্দ! বিদায় নিতে কেই বা চায় তবুও বিদায় নিতে হয়। মনের মাঝে এক পাহাড় সম কষ্টকে লুকিয়ে রেখে নিজের চেনা মানুষ, চেনা পরিবেশ সবকিছুকে ফেলে অচেনা একটা মানুষের হাত ধরে আমাদের পাড়ি দিতে অচেনা এক রাজ্যে। বিয়ের পর প্রতিটি মেয়ের জীবনেই এই দিন আসে। নিজের পরিবারকে ফেলে রেখে পাড়ি দিতে হয় অন্য এক পরিবারে। সে যেমন আনন্দের, তেমনি কষ্টের এক অনুভূতি! ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে হিয়াকে এই বিয়েতে রাজি হতে বাধ্য করায় হিয়া এতো দিন বাবার উপর অভিমান করে ছিল। তবে আজ যেন সব অভিমান বাদ ভেঙ্গেছে। বিদায় বেলায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। হিমেল সাহেব মেয়ে কান্না দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন,
-কাদছিস কেন মা?বাবার উপর এখনো অভিমান করে আছিস? কিন্তু আমি যা করেছি তার তোর ভালোর জন্যই করেছি। দেখবি তুই খুব সুখি হবি। খুব ভালো থাকবি। আমি আর কয়দিনই বা আছি। আমার যে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা ছিল। আমি মরে যাওয়ার পর তোকে কে দেখতো? তাইতো তোকে জোর করেছি। আর রেখে থাকিস না বাবার উপর।
হিয়া কান্না করতে করতেই কোনমতে বললো,
-আ আমি রে গে নেই তোমার উপর।
হিমেল সাহেব হিয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তারপর হিয়ার চোখ মুছে দিয়ে বললেন,
-তাহলে এখন কান্না থামিয়ে একটু মিষ্টি করে হাস তো দেখে আমি চোখ স্বার্থক করি।
বাবার কথায় হিয়া মিষ্টি করে হাসলো। তখন প্রত্যয় এসে বললো,
-কান্নাকাটি শেষ হলে এবার আসুন হিয়া। আমাদের অনেকটুকু পথ যেতে হবে তো। রাত হয়ে যাবে।
হিয়া মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। হিমেল সাহেব প্রত্যয়ের হাতে হিয়ার ডান হাতটা হাত তুলে দিয়ে বললো,
-আমার বড় আদরের মেয়ে হিয়া। আমার একমাত্র অবলম্বন। খুব যত্নে ওকে বড় করেছি। এখন তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওকে তুমি আগলে রেখো । ছোট থেকে খুব ভালোবাসার কাঙাল আমার মেয়েটা।
প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল,
-আপনি কোন চিন্তা করবেন না আংকেল। আপনি যখন হিয়ার সুখের দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কথা দিলাম, আমার কারণে কখনো ওকে কোন কষ্ট পেতে দিবো না। আপনার রাজ্যের রাজকন্যা আমার রাজ্যে রাণী হয়েই থাকবে।
প্রত্যয়ের কথা শুনে হিমেল সাহেব মনে মনে খুব খুশি হলেন। সঠিক মানুষটির হাতেই তাহলে মেয়েটাকে তিনি তুলে দিতে পেরেছেন। হিয়া অবাক হয়ে তাকালো প্রত্যয়ের দিয়ে। আর প্রত্যয় মৃদু হাসলো শুধু। প্রত্যয় আবার তাড়া দেওয়া শুরু করলো। তারপর সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হিয়া পাড়ি জমালো তার নতুন রাজ্যে। যে রাজ্যের রাণী সে আর প্রত্যয় তার রাজা।
~চলবে, ইনশাআল্লাহ।
.
গল্পটা আপনাদের কাছে কেমন লাগছে?