#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত
পর্ব-০৬
রাত দশটার মতো বাজে। গত কয়েক রাত ঠিকমতো না ঘুমানোর কারণে আর আজকে অনেকটা পথ জার্নি করে আসার কারণে হিয়ার শরীরটা আজ ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসতে চাইছে যেন । এখনই ঘুমে আধার হয়ে আসছে তার দু চোখ। কিন্তু কোথায় ঘুমাবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। প্রত্যয় বিছানার মাঝ বরাবর শুয়ে মনের সুখে মুভি দেখছে আর কারো ফেসবুকে চ্যাটিং করছে। প্রত্যয় তার এসব কাজে এতোটাই মগ্ন যে, এই রুমে যে সে বাদেও আরো একজন মানুষ আছে তাতে সে কথা যেন তার একবিন্দু ও খেয়াল নেই। প্রত্যয়ের রুমে এক্সটা সোফা ও নেই যেখানে হিয়া ঘুমাতে পারবে। হিয়া বুঝতে পারছে না সে এখন কি করবে । সে কি প্রত্যয়কে ডাকবে? কিন্তু প্রত্যয় যে তার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে ইন্টারেস্ট না সেটা হিয়া আগেই বুঝতে পেরেছে। কারণ বাসর রাতে হিয়া যখন অনেক রাত অবধি প্রত্যয়ের জন্য অপেক্ষা করার পরেও প্রত্যয় এলো না। হিয়ার খুব ঘুম পাচ্ছিল তাই প্রত্যয়ের জন্য জায়গা রেখে বিছানার এক পাশে ঘুমিয়েছিল। সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল দেখলো, প্রত্যয় বিছানায় না শুয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। তখনই হিয়া বুঝতে পেরেছিল আসলে প্রত্যয় কি চায়। প্রত্যয় তার পাশে কখনোই হিয়ার মতো একটা মেয়েকে চায় না। সেটা তো হিয়ার জানা কথাই। হিয়াকে এভাবে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রত্যয় বললো,
-আপনি এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন হিয়া?
হিয়া আমতা আমতা করতে শুরু করলো। তার এখন ঠিক কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না। কি বলবে হিয়া যে, আমার খুব ঘুম পেয়েছে। একটু সরুন। আমাকে ঘুমোতে দিন। সেটা বলা কি ঠিক হবে? হিয়াকে এমন কাঁচুমাচু করতে দেখে প্রত্যয় হয়তো তার সমস্যাটা বুঝতে পারলো। তাই সে বিছানার মাঝখান থেকে সরে হিয়াকে ঘুমানোর জাগয়া দিলো। আর বললো,
-ওহ সরি। এখানে শুয়ে পড়ুন।
কথাটা বলেই প্রত্যয় আবারো ফোন ক্রল করতে মনযোগী হয়ে পড়ল। আর হিয়া এখানো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে । তার কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছে। কোন দিন কোন ছেলের হাত ধরেছে কি না সন্দেহ। আর আজ একটা ছেলের পাশে তাকে ঘুমাতে হবে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। হিয়া এখনো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে প্রত্যয় বাঁকা হেসে দুষ্টুমি ভরা কন্ঠস্বরে বলে উঠলো,
-আপনি কি আমার পাশে ঘুমাতে ইনসিকিউর ফিল করছেন হিয়া? ভয় নেই আমার নিজের উপর কন্ট্রোল আছে। আর তার প্রমাণ তো এই তিন দিনে আপনিও পেয়েছেন। তাই এতো বেশি ভাবনা চিন্তা না করে ঘুমিয়ে পড়ুন। আর যদি আমার নিজেকে নিয়ে কোনো ডাউট থাকে, আই মিন আপনার যদি মনে হয় আমার সাথে ঘুমালে নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারবেন না তাহলে তো আর আমার কিছু করার নেই। এমন মনে হলে আপনি চাইলে আলাদা ঘুমাতে পারেন।
প্রত্যয়ের এহেন কথায় হিয়া তো তাজ্জব বলে গেল। আরেহব্বাহ লোকটা তার সাথে ফ্লাটও করছে। প্রত্যয়ের মতিগতি হিয়া ঠিক কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। বিয়ের পরেরদিন সকালে বললো, সে হিয়াকে স্ত্রী হিসাবে মানতে পারবে না। কারণ সে নোরাকে পছন্দ করে। অথচ তারপর হিয়াদের বাড়িতে গিয়ে এমন একটা ভাব করলো যেন তারা দুজন খুব হ্যাপি কাপল। আর এখন আবার ফ্লাটিং করছে। প্রত্যয় ঠিক কি চায়, তার মনে ঠিক কি চলেছে হিয়া মোটেও বুঝতে পারছে না। কিন্তু লোকটা কি বললো, তার পাশে ঘুমালে হিয়া নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারবে না। হিয়া আর কিছু না ভেবে ধুম করে তার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় শুয়ে পড়লো। হিয়া শোয়ার পর প্রত্যয় নিজ মনে মৃদু হাসলো। তার পর লাইটা অফ করে দিলো। আর ফোনটাও রেখে দিলো। সাথে সাথে আবছা আঁধারে তলিয়ে গেল পুরো রুম। নিস্তব্ধতায় ঘেরা কক্ষ। এয়ারকন্ডিশনের মৃদু শো শো শব্দ ব্যতিত আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হিয়া এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হলো। ঘুম ভাঙতেই হিয়া দেখলো। সে খুব শক্তপোক্ত ভাবে প্রত্যয়ের আলিঙ্গনে আবদ্ধ। হিয়া ভালো করে খেয়াল করে দেখলো সে নিজেই নিজের জায়গা ছেড়ে প্রত্যয়ের দিকে চলে এসেছে। আসলে হিয়ার ঘুমানোর স্টাইল খুব বাজে। সে বিছানায় উত্তর দিকে ঘুমালে সকালে উঠে দেখে দক্ষিণ দিকে ঘুমিয়ে আছে। তাছাড়া সে কোলবালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারে না। তাই এই অবস্থা। ঘুমের ঘোরে প্রত্যয়কেই হয়তো সে কোলবালিশ ভেবে জড়িয়ে ধরেছিল। প্রত্যয় তাকে এই অবস্থায় দেখলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে। এমনিতেই কাল রাতে লোকটা তাকে খোঁচা দিয়ে বলেছে, তার সাথে ঘুমালে হিয়ার নাকি নিজের উপর কন্ট্রোল থাকবে না। এখন এভাবে দেখলে নিশ্চিই হিয়াকে কথা শুনাতে ছাড়বে না। হিয়া তাড়াতাড়ি করে নিজেকে প্রত্যয়ের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে চাইলে প্রত্যয় তাকে আরো চেপে ধরলো। ঘুমের ঘোরে মুখ ডুবিয়ে দিলো হিয়ার চুলে। প্রত্যয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস হিয়ার কাঁধ ছুঁইছে। হিয়ার কেমন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। অচেনা অনুভূতিতে শিহরিত হয়ে উঠছে হিয়ার নরম দেহ। মন যমুনায় কেমন উত্তাল ঢেউ বইতে শুরু করেছে। ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রণয় স্রোতের কোন এক অচেনা সাগরে। দেহের অযাচিত কম্পন থামাতে সে প্রত্যয়ের পিঠের দিকের টিশার্টের এ অংশ মূঠো করে ধরলো। কিছুক্ষণ পর প্রত্যয়ের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই হিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে উঠে বসালো। বুকে হাত দিয়ে বার কয়েক দীর্ঘনিঃশ্বাস টেনে নিল অন্তঃস্থলে। এতোক্ষণ যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিলো।
_
হিয়া আজ থেকে আবার ভার্সিটিতে ক্লাস জয়েন করবে। হিয়া ফিজিক্স ডিপার্মেন্টের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। হিয়াদের বাসা জামালপুর। তার বাবা সেখানেই থাকে। তাই ভার্সিটির সুবাদে হিয়া ঢাকায় তার ফুপির বাসায় থাকতো। সেখান থেকে ভার্সিটির একদম কাছে ছিল। কিন্তু প্রত্যয়দের বাসা থেকে তার ভার্সিটি বেশ দূরে। প্রত্যয়ও আজ থেকে অফিসে যাবে। ব্রেকফাস্ট টেবিলে হিয়ার ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা শুনে মেহেরুন্নেসা বললেন,
-প্রত্যয় তুই ও তো আজ অফিসে যাচ্ছিস। তাহলে যাওয়ায় পথে হিয়াকে একটু ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাস। মেয়েটা একা একা এতোদূর যাবে।
প্রত্যয় খেতে খেতে বললো,
-প্রত্যাশাও তো কলেজে যাবে। ওই তো হিয়াকে নিয়ে যেতে পারবে। আর তাছাড়া আমার কাজ একটু তাড়া আছে আম্মু। বিয়ের জন্য অফিস থেকে কতো গুলো দিন ছুটি নিতে হয়েছিল। এখন অনেক কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে।
তখন পাশ থেকে প্রত্যাশা বলে উঠলো,
-আজ তো আমি কলেজ যাবো না ভাইয়া আমার ক্লাস নেই।
হিয়া কিছু বললো না শুধু চুপচাপ ওদের কথাগুলো শুনলো। তা নিজেকে ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে। আজ তার জায়গায় নোরা হলে হয়তো প্রত্যয় এভাবে কাজের বাহানা দিতো না। বরং হয়তো নোরাকে ভার্সিটিতে দিয়ে আসার বাহানায় তাকে নিয়ে একটু আলাদা সময় কাটাতে চাইলো। ব্রেকফাস্ট সেরে হিয়া রুমে গিয়ে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে এলো। শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো। হিয়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলো তখন কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এসে হিয়ার সামনে দাঁড়ালো। জানালার কাঁচ খুলতেই হিয়া দেখতে পেল গাড়ির ভেতরে প্রত্যয়। প্রত্যয় নিজের পাশের সিটের দরজা খুলে হিয়াকে ভেতরে আসতে বললো ।
প্রত্যয়ের কথায় হিয়া ভদ্রতাসূচক হেসে বললো,
-থ্যাংকস। তবে আমি একাই যেতে পারবো। আমার কোন সমস্যা হবে না।
হিয়ার এমন কথায় প্রত্যয় দাঁত চেপে বললো,
-হিয়া আপনি কি জানেন আপনি শান্তশিষ্ট, ইনোসেন্ট দেখতে হলেও অসম্ভব জেদী একটা মেয়ে। এতো বেশি না বুঝে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসুন।
শেষ কথাটা কেমন আদেশের সুরে বললো প্রত্যয়। হিয়ার ও এতোটা পথ একা যেতে হবে ভেবে ভেতরে ভেতরে একটু ভয় লাগছে। এই দিকের রাস্তা সে খুব একটা চিনে না। তাই সে আর তর্ক না করে গাড়ি উঠে বসলো। প্রত্যয়ের এতো কাছে বসে হিয়া ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছে। খুব লজ্জা লাগছে। বারবার শুধু সকালের সেই ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তাই হিয়া অস্বস্তি থেকে বাঁচতে জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে শহর দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর প্রত্যয় এক মনে ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। সারা রাস্তা কেউ কারো সাথে কথা বললো না। প্রত্যয় হিয়ার ভার্সিটির সামনে এসে গাড়ি থামালো। হিয়া নেমে যাওয়ার সময় পেছন থেকে প্রত্যয় তাকে জিজ্ঞেস করল,
-আপনার ক্লাস কখন শেষ হবে হিয়া?
হিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,জ্বী?
-আপনার ক্লাস কখন শেষ হবে?
হিয়া অকপটে জবাব দিল, দুইটায়।
_
ক্লাস শেষে বাইরে এসে হিয়া দেখলো প্রত্যয় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হিয়া তো ভীষণ রকম অবাক হলো। তার মানে এই জন্যই প্রত্যয় তখন জিজ্ঞেস করছিলো তার ক্লাস কখন শেষ হবে। ভাবতেই হিয়ার ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠল।
~চলবে, ইনশাআল্লাহ।