#নয়নতারা_১২
#জেরিন_আক্তার_নিপা
ওদেরকে নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে নয়নতারা ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে এলো৷ নক্ষত্রর সামনে দিয়ে ওদের সাথে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে নক্ষত্রকে কিছুই বলল না। না একবার ওর দিকে তাকাল। ঝিনুক নক্ষত্রের সাথে কথা বললে উল্টো নয়ন তাড়া দিয়ে ওকে নিয়ে গেল।
—-তুমি কিন্তু সন্ধ্যার আগেই চলে যাবে নক্ষত্র। পারলে কাজ শেষ করে বাড়িতে না এসে সোজা আমাদের ওখানে যাবে।’
—-হুম।’
নয়নতারা ঝিনুকের হাত টেনে বলে,
—-আপু চলো।’
ঝিনুক নয়নের এমন গাধামি আচরণে বিরক্ত হচ্ছে। যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে। নক্ষত্র যে এখন নয়নের স্বামী এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। নয়নটা নক্ষত্রকে দামই দিচ্ছে না। অত বাড়াবাড়ি ভালো না। সারাজীবন তো এক সাথেই থাকতে হবে। সম্পর্কটা যত তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায় ততই ভালো। কিন্তু এই গাধী দেখা যাচ্ছে তা চাচ্ছে না। নিজে আগ্রহ দেখাবে তো দূর নক্ষত্রকে অবহেলার সাগরে বাসিয়ে দিচ্ছে।
—-চলো না আপু। দেরি হচ্ছে তো।’
ঝিনুক ওকে ধমক দিল।
—-দাঁড়া নয়ন। নক্ষত্রকে বলে যাবি না। ওকে যেতে বল।’
মুখ গোমড়া করে নয়ন কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। ঝিনুক চোখ পাকালে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
—-তুমি তো যেতে বলেছ।’
—-আশ্চর্য কথা বলছিস তো! আমার বলা আর তোর বলা এক নাকি? তুই আবার বল।’
ইমন এবার তাড়া দিল।
—-আহ! হচ্ছে কী হ্যাঁ! নক্ষত্রকে না বললে ও নয়নকে আনতে যাবে না নাকি? নিজের বউকে বাপের বাড়ি রেখে দিবে। চলো এখন। নক্ষত্র যাবে। কি নক্ষত্র, যাবে না?’
নক্ষত্র হাসল। বলল,
—-যেতে তো হবেই।’
—-শুনেছ তো! এবার চলো তাহলে।’
দেখা গেল যাবার গরজ নয়নতারারই বেশি। সে-ই সবার আগে বেরিয়ে এলো। ওরা চলে গেলে নক্ষত্র শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ঘরে এসে নক্ষত্রর বেডের উপর চোখ গেল। কাল রাতে এই বিছানায় তারা শুয়েছিল। আজ সকাল পর্যন্তও এই ঘরেই ছিল। নয়ন যে এতটা অবুঝ হবে তা নক্ষত্র ভাবেনি। বয়স তো একেবারেই যে কম, তেমনও না। যথেষ্ট বড় হয়েছে সে। তবে বয়সের তুলনায় বোধবুদ্ধি একদমই হয়নি। কলেজ পার করে গেলেও কী হবে বুদ্ধি আর আচার-আচরণ এখনো হাইস্কুলের মেয়ের মতন। হঠাৎ করে নক্ষত্রর কাছে ঘরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। একদিনে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ নয়ন এই ঘরে ভালো করে চব্বিশ ঘণ্টাও কাটায় নি। নক্ষত্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। আজ আর ব্রেকফাস্ট করা হলো না তার।
সারাটা দিন নয়নতারা টইটই করে পুরো বাড়ি চক্কর কেটেছে। মাত্র একটা রাত বাড়ি ছেড়ে থেকেছে এতেই মনে হচ্ছে সে আজ এক বছর পর বাড়িতে এসেছে। নয়নতারা আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করছে। আগে সবাই তাকে ছোট ভাবত। এখন যেন হঠাৎ করে সে সবার চোখে বড় হয়ে গেছে। সবাই কেমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলছে তার সাথে। বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ি নিয়েই সব কথা হচ্ছে। শ্বশুরবাড়িতে কীভাবে চলতে হয়। শ্বশুর, শাশুড়ির সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়। নক্ষত্রর অবাধ্য হওয়া চলবে না। নক্ষত্র যেমন বলবে নয়নকে তেমনই করতে হবে।
কথাগুলো শুনে মনে মনে বিরক্ত হয়েছে নয়ন। কিন্তু মুখে কাউকে কিছু বলেনি। সে বাড়িতে ফিরে এসেছে এতেই সে খুশি। এবার আর যাবে না। লোকটা রাতে এলেও যাবে না। সে না গেলে তাকে জোর করে নিতে পারবে নাকি?
ঝিনুক নয়নের কনুই টেনে ধরে ওর ঘরে নিয়ে গেল। নয়নকে ছেড়ে দিয়ে কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। নয়ন কিছুটা ভয় পেয়েছে।
—-মাথার তার ঠিক আছে তোর? নাকি দুই একটা ছিঁড়ে গেছে?’
নয়ন বোঝার চেষ্টা করল ঝিনুক আপু কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আপুর কথাই এমন ত্যাড়া।
—-তোর বিয়ে হয়ে গেছে। এটা তো মানিস তুই নাকি?’
—-হুম।’
—-তোর ইচ্ছা না থাকলেও, তুই রাজি না থাকলেও নক্ষত্র এখন তোর স্বামী। এটা মানিস তো? নাকি মানিস না?’
নয়নতারা মাথা নাড়ল। ঝিনুক কিছুটা নরম হলো।
—-তাহলে তখন আসার সময় নক্ষত্রের সামনে এমন করলি কেন নয়ন? তুই কেন বুঝতে চাইছিস না, এখন তুই আগের নয়ন নেই। আগে তুই এই বাড়ির সবার ছোট সদস্য ছিলি। বয়সে বড় হলেও আমরা তোকে বড় মনে করিনি। ছোট ভেবে সব সময় তোর সব ভুল ক্ষমা করে দিয়েছি। তুই বড় ধরণের কোন অন্যায় করে ফেললেও তা এড়িয়ে গেছি। কিন্তু এখন তুই আমাদের বাড়ির মেয়ের পাশাপাশি ওই বাড়ির বউ। বাড়ির বউয়ের দায়িত্ব কতটা জানিস তুই? আমাকেই দেখ না। এটা কি শুধুই আমার শ্বশুরবাড়ি? আগে মামার বাড়ি পরে শ্বশুরবাড়ি। মানুষগুলো সবাই আমার আপন। ছোটবেলা থেকে চেনা। তবুও বিয়ের পর আমি ওদের মনের মতন চলার চেষ্টা করি। আগে দুষ্টুমি ফাতরামি করলেও এখন সবসময় সতর্ক থাকি, আমার দ্বারা যেন কোন ভুল না হয়। আমি জানি আমি কোন ভুল করলেও কেউ আমাকে কিছু বলবে না। তবুও নিজের দায়িত্ব থেকে এমনটা করি।’
ঝিনুক থেমে দম নিল। সে যা বোঝাতে চাইছে নয়ন তা বুঝতে পারছে কি-না তা বোঝার চেষ্টা করল।
—-তুই তো নতুন বউ। তাও কী একটা পরিস্থিতিতে তোর বিয়ে হয়েছে সেটা তো জানিসই। ইলার কাণ্ডে এমনিতেই তোর শ্বশুর শাশুড়ি ক্ষেপে আছে। এখন তুইও যদি এমন অবুঝের মত করিস, তাহলে নক্ষত্র বেচারা কতদিন বাবা মা’কে ম্যানেজ করবে? সে বেচারা নিজেও একদিন তোর উপর বিরক্ত হয়ে উঠবে। এখনই হয়তো বিরক্ত হচ্ছে। শুধু নিজের ইচ্ছেতে বিয়েটা করেছে বলে কিছু বলতে পারছে না। তবে পুরুষ মানুষ বেশিদিন মেয়েদের রঙঢঙ সহ্য করবে না।’
নয়নতারা কিছুই বলতে পারল না। ঝিনুক ওর হাত ধরে কোমল গলায় বলল,
—-নয়ন বোন আমার, সারাটা জীবন এখন তোকে নক্ষত্রর সাথেই কাটাতে হবে। তুই ওকে অতটা অবহেলা করিস না, যাতে পরে ওর মন থেকে তোর জন্য মায়াটুকুও উঠে যায়। ভালোবাসা তোদের মধ্যে নেই। কিন্তু একটা সম্মান তো আছে। সেই সম্মান থেকেই তুই নক্ষত্রর সাথে এরকম ব্যবহার আর কখনো করিস না। ও তোর স্বামী। তোর সুখ দুঃখের সাথী। পারলে ওকে নিজের মায়ায় বেঁধে ফেল। তোর ভালোবাসা দিয়ে ওকে জয় করে নে।’
এবারও নয়নতারা চুপ করে রইল। ঝিনুক আপুর কথা সে একটু একটু বুঝতে পারছে। আপু তাকে নক্ষত্রর সাথে মানিয়ে নিতে বলছে। কিন্তু সে কীভাবে মানাবে ওই লোকটার সাথে?
—-কী রে, কিছু বলছিস না কেন?’
—-ইলা আপুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, ঝিনুক আপু?’
—-ওই হারামিটার নাম আমার সামনে একদম নিবি না। পরিবারের একটা মানুষের কথা ভেবেছে ও! আল্লাহ জানে কার পাল্লায় পড়ে নক্ষত্রর মত একটা ছেলেকে ঠকাল। ও জাহান্নামে যাক। তা দেখার বিষয় আমাদের না। নিজে থেকে নাকি কার বাইরে উঠে গিয়েছে। বাবলু ওকে ডেকেছে পরেও দাঁড়াল না। কী এমন হিরের টুকরো পেয়ে গেছিল সে! থাক বাদ দে ওর কথা। ইলার নাম শুনলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে। বেচারা নক্ষত্র! ওর দিকটা আমরা কেউ ভাবছি না। উল্টো তোকে বিয়ে করায় ও সবার চোখে খারাপ হয়ে গেল। আরে ও বেচারাও তো কষ্ট পেয়েছে।’
নয়নতারা এতক্ষণ অন্য কিছু ভাবছিল। সে বলল,
—-আপু কি পালিয়ে গিয়ে অন্য কাউরে বিয়ে করে নিয়েছে?’
—-কেমন ফালতু প্রশ্ন করছিস নয়ন! আমি কী করে জানব। ইলা কি আমাকে বলে গেছে? নাকি পর সাথে আমার যোগাযোগ আছে? বিয়ে করেছে নাকি অন্য কিছু তা আমি জানব কীভাবে? ওর কথা জানতে চাইছিস কেন তুই? বোনের জন্য দরদ উথলে উঠছে নাকি?’
—-ইলা আপু ফিরে এলে ওকে উনার সাথে বিয়ে দিলেই তো সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে।’
এই মেয়ের গাধামি দেখে ঝিনুকের নিজের গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে। সে নিজে পুকুরে ঝাঁপ দিবে? নাকি এই গাধীটাকে ধাক্কা দিবে? এই মেয়ে বলছে কী এসব!
—-তুই ইলাকে খুঁজে নক্ষত্রর সাথে ওর বিয়ে দিয়ে সবকিছু আগের মত ঠিক করতে চাস? আল্লাহ! তোকে আল্লাহ কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছে রে! এখন যে নক্ষত্র তোর বর সেটার কী হবে? ডিভোর্স দিবি? নাকি দুই বোন সতীন হবি?’
—-উনি তো আপুকেই বিয়ে করতে চাইছিল। আপু পালিয়ে না গেলে করতও।’
ঝিনুক চেঁচিয়ে উঠল।
—-চুপ! আর একটা কথা বলবি না তুই। থাপ্পড় দিয়ে কানে কালা বানিয়ে ফেলব তোকে। গাধার জাত গাধা। তুই সিক্স, সেভেন এর বাচ্চা? ইন্টার পাস করেছিস। এখনো দুধের শিশু না তুমি। তোমার বয়সের মেয়েরা বিয়ে করে দুই তিন বাচ্চার মা হচ্ছে। স্বামী সংসার সামলিয়ে গুছিয়ে সংসার করছে। আর তুই বলছিস ইলাকে খুঁজে নিজের স্বামীর ঘাড়ে ঝুলাবি! পাগলেও তো স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চাইবে না। তুই তো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। আর কোনদিন যদি ভাবিস তুই নক্ষত্রকে ছেড়ে চলে আসবি, তাহলে চড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দেব আমি। আজ রাতে নক্ষত্র এলে কোন প্রকার নাটক না করে চুপচাপ ওর সাথে চলে যাবি। এখন এটা তোর বাড়ি না। অসহ্যকর মেয়ে! তাকে আমি কী বুঝাই, আর সে কী বলে। ইলা ফিরে এলেও যে নক্ষত্র বেহায়ার মত ওকে গ্রহণ করবে এমনটা ভাবছিস কেন? ওকে কি মেরুদণ্ডহীন মনে হয় তোর? ফাজিল মেয়ে, বাড়াবাড়ির সীমা আছে। তুই একেবারে অবুঝ না। নিজের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মর। আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দূর হ।
চলবে___