নয়নতারা পর্ব ১১

#নয়নতারা_১১
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নক্ষত্র সোফায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে যাচ্ছে। ঘুম আজ আসছে না তার। একবার হাত মাথার নিচে রাখছে। একবার কপালে উপর। আরেকবার দু-হাত ভাজ করে বুকের উপর। উঁহু, কোনোভাবেই ঘুম আসছে না। আজ তার চোখ থেকে ঘুম কোথায় গেল? সোফায় শুয়েছে বলেই কি এমন হচ্ছে? অন্ধকারে ঘরে নক্ষত্র একবার বেডের দিকে দেখল। দেখতে পেল না কিছুই। নয়নতারা বেডে শুয়েছে। এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছে। তার নিজের ঘুমের বারোটা বেজেছে আজ। আবার কয়েকবার এপাশ-ওপাশ ফিরে বাধ্য হয়ে উঠে বসল নক্ষত্র। নয়নতারাকে ডাকল,

—-তারা! এই তারা! ঘুমিয়ে গেছ?’

নয়নতারা ঘুমায়নি। তার চোখে ঘুম নেই। বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ছে। আজ নিজের ঘরে থাকার কথা ছিল তার। এখানে থাকবে সে এটা কখনো কল্পনাও করেনি। ইলা আপুর জন্যই এসব হলো। আপুকে সে কখনো ক্ষমা করবে না। আর না ওই বাজে লোকটাকে করবে। আপু পালিয়েছে এতে তার দোষ কোথায় ছিল? তাকে কেন লোকটা বিয়ে করল? বাবা মা নাহয় বাড়ির সম্মানের কথা ভেবে রাজি হয়েছে। লোকটা কেন রাজি হলো? এসব ভেবেই বুক ফেটে কান্না আসছিল তার। বালিশে মুখ চেপে কাঁদছিলও। তখনই নক্ষত্রর ডাক কানে আসে। নয়নতারা সাড়াশব্দ না করে চুপ করে পড়ে থাকে। ভেতরটা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। এই সময় কান্না আটকিয়ে চুপ থাকা তার জন্য কষ্টের। তবুও নড়াচড়া করে লোকটাকে বোঝাতে চায় না সে যে জেগে আছে।
নক্ষত্র প্রথমবার নয়নতারা সাড়াশব্দ না পেয়ে দ্বিতীয়বার ডাকল।

—-নয়নতারা! ঘুমিয়ে গেছে নাকি মেয়েটা? ঘুমোলে ঘুমাক। ডাকা ঠিক হবে না। সারাট দিন ওর উপর দিয়েও তো কম কিছু যায়নি। হঠাৎ করে এভাবে ওর জীবনটা নতুন মোড় নিবে এটা হয়তো ভাবতেও পারেনি। সবটা মেনে নিতে একটু সময় লাগবে। এমনিতেও বয়স কম। বুদ্ধিশুদ্ধিও কম। ছোট মেয়ে বলে বাবা মা সহ পরিবারের মানুষগুলো আদর দিয়ে দিয়ে একেবারে ননির পুতুল বানিয়ে ফেলেছে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেকে সামলাতে ওর একটু বেশিই কষ্ট হবে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নক্ষত্র। হাহ্, কী আর করার। রাগের মাথায়, জেদের বশে যা করে ফেলেছে তাতে তারই দোষ বেশি। কিন্তু তার নিজেরও তো কিছু করার ছিল না। সে-ও ঠকেছে। ইলার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার এই একটাই উপায় দেখেছে সে। একমাত্র নয়নতারাকে বিয়ে করলেই ও বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক শেষ হতো না। নয়নকে সে বিয়ে না করলে ইলা ফিরে এলেও ওই বাড়িতে যেতে পারত না সে। এখন যা খুব সহজে পারবে তখন সেটা পারত না। তাই তো নয়নতারাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো।
নয়নতারা চুপচাপ পড়ে থেকে নক্ষত্রের সব কথাই শুনেছে। এতে যেন কান্নাটা আরও বেড়েছে। লোকটা সব জেনেও ইচ্ছে করে তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন করেছে। সে জানে নয়নতারা এতে কতটা কষ্ট পাবে৷ জেনেও… শুধু আজ না। প্রথম দিন থেকেই জেনে-বুঝে তাকে ভয় দেখিয়েছে। কষ্ট দিয়েছে। এখনো তেমনই করছে। এই লোক কখনও ভালো মানুষ হতে পারে না। কান্নার তোড়ে নয়নতারার পিঠ ফোলে ফোলে উঠছে। বুকের ভেতর কতটা কষ্ট হচ্ছে তা শুধু সে-ই জানে।
নক্ষত্র আবার শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে বলল,

—চল বাবা নক্ষত্র। আজ থেকে তোর কপালে সোফায় শোয়াই লেখা আছে। ওই বেডে আর ঘুমাতে পারবি না তুই। অন্তত যতদিন তোমার বউ নামের ওই প্রাণীটা এই বাড়িতে আছে। ততদিনের জন্য বেডে ঘুমানোর আশা ছেড়ে দাও। বিয়ে করেছ বাবা, এবার ঠেলা তো তোমাকেই সামলাতে হবে। কাল থেকে বিয়ে করার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবে। কপালে যে আরও কী কী লেখা আছে কে জানে? এই মেয়েকে নিয়ে রীতিমতো আমাকে ভুগতে হবে।’

পরের দিন সকালে বেশ বেলা করে নক্ষত্রর ঘুম ভাঙল। সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতে নিলে ঘাড়ে, কাঁধে, কোমরে, পিঠে ব্যথা অনুভব করল। হায় আল্লাহ! পুরো শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। এত বড় শরীরটা এতটুকু সোফায় আঁটে কীভাবে? রাতে কীভাবে শুয়েছিল কে জানে? এখন তো প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভব করছে। নক্ষত্রর চোখ ফাঁকা খাটে গেল। কোথায় গেল তারা? ঘুম ভেঙে উঠে গেছে তবুও তাকে ডাকল না! তখনই বাইরে চেনা একটি মেয়ে কন্ঠ শুনতে পেল। ঝিনুকের গলা মনে হচ্ছে। সকাল সকাল শ্বশুরবাড়ির লোক চলে এলো নাকি। নক্ষত্র তাড়াহুড়ো করে উঠল। বালিশটা ছুড়ে বেডে রেখে গেঞ্জি ঠিক করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ির মানুষই এসেছে। ইমন, ঝিনুক, বাবলু, জাহিদ। নয়নতারা ওদের পেয়ে যেন হাতে আশাকের চাঁদ পেয়ে গেছে। এতটা খুশি হয়েছে ও। নয়নতারা ঝিনুকের গলা জড়িয়ে আছে। তার গলা ভার। চোখও ভেজা ভেজা দেখা যাচ্ছে।

—-আপু!’

নয়নতারা কেঁদে ফেলার আগে ঝিনুক হেসে বলল,

—-সকাল সকাল তোকে দেখতে চলে এলাম নয়ন। তুই তো জানিস না তোকে ছাড়া বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এতদিন বুঝিনি কেন তোকে নিয়ে সবাই এত মাতামাতি করত। তুই তো আমাদের বাড়ির প্রাণ। তুই চলে এসেছিস পরে পুরো বাড়িটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।’

নয়নতারা এবার কেঁদেই ফেলল। ঝিনুক হাসছে। বলছে,

—-পাগল মেয়ে কাঁদছিস কেন?’

—-আমি তোমাদের অনেক মিস করেছি আপু।’

ইমন নয়নের মাথায় হাত রাখল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-আমরাও রে।’

—-বাবা-মা, জেঠু-জেঠিমা, চাচ্চু-চাচী, ফুপু আকিব ভাইয়া ওরা সবাই কেমন আছে? আকিব ভাইয়া এলো না কেন?’

—-সবাই ভালো আছে। তুই কেমন আছিস রে নয়ন? এখানে তোর কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?’

তখনই নক্ষত্র নিচে নেমে এলো। ওদেরকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে লম্বা করে সালাম দিল। ইমন এখনো নক্ষত্রকে নেমে নিতে পারেনি। ওর সব রাগ নক্ষত্রের উপর। ঝিনুক আগে যেমন নক্ষত্রের সাথে আন্তরিক ছিল। এখন তেমন নেই। একটা কাঠিন্য চলে এসেছে ওর আচরণে। সে সালাম নিল ঠিকই উল্টো আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।

—-কেমন আছেন আপনারা? বোনকে মিস করে চলে এসেছেন! ভালোই হলো। সকাল সকাল বাপের বাড়ির মানুষদের পেয়ে তারারও মন ভালো হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না প্লিজ।’

নক্ষত্র কাজের লোককে ডেকে ওদের চা নাস্তা দিতে বলল। কেউ না বসলেও নিজে একাই সোফায় বসে পড়ল। ওদের কাউকে দেখে মনে হচ্ছে না ওরা এই বাড়িতে বসতে এসেছে। বা খাবার দিলেও কিছু খাবে। তবুও শ্বশুরবাড়ির লোক, আপ্যায়নে কৃপণতা করবে না। নক্ষত্র অমায়িক হেসে বলল,

—-আমার বাবা কাল রাতেই নিউইয়র্ক গেছে। মা মনে হয় এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। উনার ঘুম দশটার আগে ভাঙবেও না৷ আপনারা বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

ইমনের মুখ থমথম করছে। পারলে সে ঘুসি মেরে নক্ষত্রের মুখের নকশা পাল্টে দেয়। কী মনে করে নিজেকে আটকে রাখছে সে। যতই হোক ছোট বোনের হাজবেন্ড। নয়ন কিছু না বললেও ওর স্বামীর গায়ে হাত তোলা যাবে না। ঝিনুক কাটকাট গলায় বলল,

—-আমরা আপনার বাড়িতে বসতে আসিনি। আর না আপনার বাবা মা’র সঙ্গে আলাপ করতে এসেছি। আমরা নয়নকে দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়ে গেছে। এবার ফিরে যাব।’

ওদের যাবার কথা শুনেই নয়নতারা কুঁকড়ে উঠল। ইমনের সাথে মিশে গিয়ে ওর দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে অনুরোধের স্বরে মিনমিন করে বলল,

—-আমাকেও তোমাদের সাথে নিয়ে যাও। প্লিজ ভাইয়া। আমি বাড়ি যাব। এখানে থাকব না আমি। সবাইকে ছেড়ে থাকলে আমি মরেই যাব। আমাকে রেখে যেও না।’

ইমন অসহায় ভাবে নয়নের মুখের দিকে দেখল। পারলে সে নিজেও নয়নের সাথে কেঁদে ফেলবে। এই ছোট্ট বোনটার জীবনে কখনও এরকম কিছু ঘটবে তা কি তারা ভেবেছিল? কী থেকে কী হয়ে গেল! ইলাটা কারো কথা না ভেবে স্বার্থপরের মত নিজের পথ ধরল। বলির পাঁঠা বানিয়ে দিয়ে গেল বেচারি নয়নকে। এক নিমিষে সম্পর্ক এরকম রূপ নিবে তা অকল্পনীয় ছিল।
নক্ষত্র চুপচাপ বসে সবই দেখছিল। ওদের সাথে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠত তার। আজ ওর বাড়িতে দাঁড়িয়েও ওকে মানুষ গুলো ঘৃণা করছে। অথচ ইলার সাথে বিয়ে ঠিক হবার সময়ও সবাই কত খুশি ছিল। ইমন তাকে জামাই জামাই করে সম্মোধন করত। ঝিনুকের সাথে তো সেই প্রথম দেখা থেকেই একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আজ ঝিনুকও তাকে খুব একটা পছন্দ করছে না। কেন? কারণ সে ইলার জায়গায় নয়নতারাকে বেছেছে। ইলা তাকে ঠকানোতেই নক্ষত্র এমনটা করেছে। শখ করে তো আর করেনি। এই কথাটা কেউ মানতে চাইছে না। একটা মানুষের ভুলের কারণে গোটা পরিবারকেই ভুগতে হচ্ছে।
ইমন বলল,

—-আমরা আবার আসব নয়ন। প্রতিদিন এসে তোকে দেখে যাব৷ আজ থাক। অন্য একদিন নাহয় তোকে নিয়ে যাব। তোর তো এখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না। নাকি হচ্ছে? হলে আমাকে বল। আমি সমাধান করে দেব।’

শেষের কথাটা ইমন নক্ষত্রের দিকে চেয়ে বলেছে। নয়নতারা ইমনের কথা শুনতে নারাজ। সে জেদ ধরে বসেছে, ওদের সাথে বাড়ি ফিরবেই সে। তাকে এখানে রেখে কেউ যেতে পারবে না। নক্ষত্র এক ধ্যানে কিছুক্ষণ নয়নতারার দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু নয়নতারা ভুলেও ওর দিকে চাইছে না। হয়তো ভয় পাচ্ছে নক্ষত্র যদি তাকে যেতে না দেয়। ভাই বোনকে পেয়ে নয়নতারা সাহস পেয়েছে। তাইতো নক্ষত্রকে পাত্তা দিচ্ছে না। ওর মতামতের পরোয়াই করছে না৷ নক্ষত্র না করলেও সে আজ বাড়ি যাবে। যাবেই যাবে। নক্ষত্রও ব্যাপারটা বুঝল। তাই আর না করল না৷ নিজেই বলল,

—-তারা যেহেতু যেতে চাচ্ছে তাহলে ওকে নিয়ে যান৷ আমি গিয়ে নাহয় রাতে নিয়ে আসব।’

ঝিনুক কিছু বলতে গেলে নক্ষত্র সমর্থনযোগ্য হাসল।

—-কিন্তু…

—-আমার পরিবারের কেউ কিছু বলবে না। তারাকে সাথে করে নিয়ে যান।’

ঝিনুক বেচারি নরম মনের মানুষ। নক্ষত্রর উপর আর রাগ ধরে রাখতে পারল না।

—-তুমি যাবে না? বর ছাড়া বিয়ের পরের দিন বউ একা বাপের বাড়ি যাবে নাকি! তুমিও চলো। নিয়মও তো এটাই।’

ঝিনুককে ঠিক সেই আগের মত কথা বলতে দেখে নক্ষত্রর ভালো লাগল। যাক একজন তো আর তার উপর রেগে নেই। হেসে সে বলল,

—-যাব তো। তারাকে গিয়ে নিয়ে আসব।’

—এখন চলো।’

ইমন, নয়নতারা দু’জনই এবার ঝিনুকের উপর বিরক্ত হচ্ছে। লোকটাকে এত জোড়াজুড়ি করছে কেন সে? না গেলে না গেল। এটা তো আরও ভালো। এত সাধাসাধি করার কী আছে। ঝিনুক আপুটাও না! সত্যিই বেশি বেশি করে।
নক্ষত্রর ইমনের দিকে চেয়ে ঝিনুকের কথার উত্তর দিল,

—-আমি ওখানে গেলে অনেকেই খুশি হবে না। আর সবথেকে বড় কথা, আমার কিছু কাজ আছে। রাতে যাব আমি।’

—-আচ্ছা যেও তাহলে। নয়নকে গিয়ে নিয়ে এসো।’

নয়নতারার মনের কথা শুধু সে নিজেই জানে। একবার বাড়িতে যেতে পারলে তাকে আবার এখানে নিয়ে আসার সাধ্য কার আছে? আল্লাহ আল্লাহ করে একবার শুধু যেতে পারুক। তারপর জীবনে আর এই বাড়ির মুখ দেখবে না। লোকটা তাকে আনতে গেলেও সে আসলে তো!
বাড়িতে যাবার কথা শুনেই নক্ষত্র নয়নতারার মুখের ঝিলিক দেখে ওর মনের কথা বুঝে নিয়েছে। তারা মনে মনে কী প্ল্যান করছে এটা তার কাছে স্পষ্ট। মেয়েটা সত্যিই পিচ্চি।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here