নয়নতারা পর্ব ১০

#নয়নতারা_১০
#জেরিন_আক্তার_নিপা

নয়নতারা একটা বিশাল মাঠে কোমল ঘাসের উপর পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে। শিশির ভেজা ঘাস৷ পা ভিজে যাচ্ছে। ঘাসের উপরের শিশির বিন্দু গুলো পায়ে কাতুকুতু দিচ্ছে যেন। নয়নতারা ছুটছে। ছুটতে ছুটতে মাঠের মাঝখানে চলে এসেছে। তখনই পেছন থেকে কারো গলা পেল সে। একটা পুরুষ কন্ঠের ডাক পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল। মানুষটাকে চিনতে পারছে না সে। মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মানুষটাকে কেমন আবছা, কেমন ঝাপসা। অস্পষ্ট। কে ও? তাকে ডাকছে?

—নয়নতারা! এই তারা! আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?’

অচেতন অবস্থায় ঘোরের মধ্যে থেকেও নয়নতারা নক্ষত্রর ডাক শুনছে। শুধু স্বপ্ন আর বাস্তবটাকে গুলিয়ে ফেলেছে। সে ভাবছে সেই বিশাল মাঠে সে ছুটছে আর পেছন থেকে তার সাথী তাকে ডাকছে। সে পেছন ফিরে তাকায়। মানুষটার ডাকে সাড়া দেয়।
নক্ষত্র নয়নতারার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ওকে ডাকছে। গ্লাস থেকে পানি নিয়ে ওর চোখে মুখে হালকা ছিটা দিচ্ছে। তবুও নয়নতারার জ্ঞান ফিরছে না।

—কী হলো মেয়েটার? যেচে পড়ে এই মেয়েকে বিয়ে করে নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারলাম নাকি? এ তো আমায় জ্বালিয়ে মারবে। এত কোমল মেয়েকে আমি সামলাবো কীভাবে? একটুতে জ্ঞান হারায়। এর সেবাযত্ন করতে করতেই আমার জীবন পার হবে।’

নক্ষত্র এখন নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় ভুগছে। ভুল করে ফেলল নাকি সে? নয়নতারাকে বিয়ে করার কী দরকার ছিল? কিছুই দরকার ছিল না। জেদের বশে এসব করেছে। ইলা যার সাথেই যাক। যেখানেই যাক। একদিন না একদিন তো ফিরবেই। পাঁচ বছর পর ফিরুক। তবুও তো ফিরে আসবে। তখন নক্ষত্রকে নিজের ছোট বোনের স্বামী হিসেবে দেখে ও মেনে নিতে পারলেই হলো। ইলা তাকে না ভালোবাসুক। কয়েকটা দিন ভালোবাসা নাটক তো করেছে। সে থেকেই নিশ্চয় নয়নতারার সাথে নক্ষত্রর স্বাভাবিক সংসার ইলা সহ্য করতে পারবে না। নয়নতারাকে সে এতটা খুশি রাখবে যে ইলা দেখে হিংসে করবে। নিজের বোনের উপরই জ্বলবে। কেন সে নক্ষত্রকে ঠকিয়ে অন্য কারো হয়েছে এজন্য আফসোস করবে। সেদিনই নক্ষত্রর প্রতিশোধ পূর্ণ হবে। তাইতো সে নয়নতারাকে বিয়ে করেছে। তারাকে সে বিয়ে না করলে দু’দিন পর ইলার পরিবারের সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকত না। ইলার সাথে যোগাযোগ রাখার একটা ব্যবস্থা মাত্র নয়নতারা। তার বেশি কিছু না। নক্ষত্র এখন ওই পরিবারের জামাই। বাড়িতে নয়নের অবস্থান ভালো করেই জানে সে। নয়নের স্বামী হিসেবে তার খাতিরযত্নও কম হবে না। ইলার এই ঘটনার পর বাড়ির সবাই বড় জামাই থেকে ছোট জামাইকেই বেশি আদর করবে। এটাই স্বাভাবিক। নক্ষত্র অনেক দূরের কথা ভেবে নয়নতারাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তার এই সিদ্ধান্তে সে খুশি। ইলা তার মন নিয়ে খেলেছে। তাকে ঠকিয়েছে। ধোঁকা দিয়েছে। এত সহজে সে ইলাকে ছেড়ে দিবে কীভাবে? ইলার কথা মনে পড়লে এখন তার কষ্ট হচ্ছে না। বরং জেদ বাড়ছে। রাগটা আরও শক্ত হচ্ছে। ইলাকে সে সুখে থাকতে দিবে না। সে নিজে যতটা কষ্ট পেয়েছে। ইলাকেও ঠিক ততটা কষ্ট ফিরিয়ে দিতে পারলেই শান্ত হবে। তার আগে না।
নয়নতারা উপর চোখ পড়লে নক্ষত্র প্রতিশোধের কথা ভুলে গেল। আগে ওর জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

—ইলার চিন্তা পরে। আগে ওর বোনকে দেখতে হবে। এই মেয়েকে বাপ মা কীভাবে তৈরি করেছে? এতটা নরম! হায় আল্লাহ! আমার কপালে তুমি এই মেয়েকে লিখে রেখেছিলে! একে! আমার সাথে এ মানাবে কীভাবে? কোথায় আমি! কোথায় তারা। এ তো আমার এক ধমক শুনে জীবন দিয়ে দিবে।’

পিটপিট করে চোখ খুলছে নয়নতারা। জ্ঞান ফিরেই চোখের সামনে সেই মুখটাকে দেখতে পেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসতে চাইল। নক্ষত্র তার বাহু শক্ত করে ধরে ফেলল। নয়নতারা বুঝতে পারছে না সে এখন কোথায় আছে। নক্ষত্র চোখ গরম করে বলল,

—উঠছো কেন হ্যাঁ? কতক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলে জানো? এই মেয়ে তোমার সমস্যা কী হ্যাঁ? এভাবে হুটহাট জ্ঞান হারাও কেন? আমার কত শখ একদিন জ্ঞান হারিয়ে দেখব কেমন লাগে। কিন্তু আফসোস আজ পর্যন্ত সেই শখ পূরণ হলো না। আর তুমি মিনিটে মিনিটে জ্ঞান হারাও। কীভাবে পারো? আমাকেও একটু বলো তো।’

নয়নতারা অবাক চোখে আশেপাশে দেখছে। নিজের বাড়িতে নেই সে। এই ঘর তার অচেনা। গাড়িতে উঠেছিল সে। আজ তার বিয়ে হয়েছে। তাহলে এখন সে শ্বশুরবাড়িতে আছে!

—যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি! বিয়ের দিনেই মেয়ের কিছু হলে তোমার বাবা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাত।’

নক্ষত্রকে এতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে নয়নতারার রাগ হচ্ছে। লোকটা একটা অসভ্য, বাজে। ছোটলোক। আপু পালিয়ে গেছে বলে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। বিয়ের জন্য লোকটা যেন মরে যাচ্ছিল। একবার তার দিকটা ভাবার প্রয়োজন মনে করল না। নয়নতারা বসতে বসতে ঘৃণাভরা চোখ নক্ষত্রর দিকে চাইল। নক্ষত্র তা বুঝলেও কিছু বলল না। তার উপর তারার রাগ করাটাই স্বাভাবিক। এই বেচারির দিকটা সে একটুও ভাবেনি। তারার যে বয়ফ্রেন্ড নেই এটা নক্ষত্র নিশ্চিত। তবুও তো বিয়ে নিয়ে বেচারির কিছু স্বপ্ন ছিল। যা নক্ষত্র সব মাটি করে দিল।
নয়নতারা ছলছল চোখে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই নক্ষত্র ধমকে উঠল,

—আর কোনোদিন যদি আমাকে না বলে অজ্ঞান হয়ে যাও না, তাহলে দেখো কী করি তোমায়! গাড়িতে থেকে রুমে কোলে করে এনেছি। উহ কী ভারী! দেখতে পাটকাঠি মনে হলেও ওজন আছে। আমার কোলে উঠতে হলে এবার থেকে ডায়েট কন্ট্রোল করবা। বুঝছো? নইলে জ্ঞান হারালে আমি কোলে তুলতে পারব না।’

নয়নতারা একেবারে চুপসে গেল। তার মনের কোন রাগই প্রকাশ করার উপায় পেল না। লোকটা কী ভীষণ বাজে! তাকে মোটা বলে অপমান করছে।

—যাও ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এসো।’

এই বলে নক্ষত্র নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নয়নতারা কিছুই বুঝতে পারছে না। এরকম বিয়ে সবার হয়না। হলেও তাদের স্বামী এরকম বলে? বিয়ের দিন থেকেই ধমক দেয়? মোটা বলে ডায়েট কন্ট্রোল করতে বলে? নক্ষত্র এমন দেখাচ্ছে যেন সে না, নয়নতারা নিজে তাকে জোর করে বিয়ে করেছে। সব চোটপাট তার উপর। নিজের দোষ যেন কিছুই নেই।
একটু পরেই নক্ষত্র খাবার নিয়ে ঘরে আসে। নয়নতারা এখনো বিছানায় বসে আছে। নক্ষত্র তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ পাকায়। এবার নয়নতারা নক্ষত্রর কিছু বলার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। নক্ষত্র মনে মনে হাসে। এই মেয়েকে কড়া হাতেই সামলাতে হবে। নইলে একে আদর দিলে বেঁকে বসবে। তখন একে সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে। তার থেকে ভালো সে-ই শক্ত ব্যবহার করুক। তাতে নয়নতারা ভয় পেয়ে নিজের মনের ঝাল তার উপর মেটাতে পারবে না। সে চোখের ইশারায় ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়ে বলল,

—দুই মিনিটে চোখমুখ ধুয়ে এসো। যাও।’

বাধ্য মেয়ের মত নয়নতারা নক্ষত্রর কথা মেনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। নক্ষত্র হেসে ফেলল। যাক একে সামলানোর পদ্ধতি বুঝে গেছে। এখন আর সমস্যা হবে না। নক্ষত্র একবার তার ঘরটাকে ভালো করে দেখল। নানান রকমের ফুল, ক্যান্ডেল দিয়ে সাজানো বাসরঘর। ইলাকে এই ঘরে তোলার স্বপ্ন রেখেছিল সে। নক্ষত্র আজ সকালেও ভেবেছিল যে, ইলার জায়গায় নয়নতারা তার সাথে আজ রাতে এই ঘরে থাকবে? শুধু আজই না। যতদিন তারা একসাথে থাকবে ততদিন নয়নতারা এই ঘরে থাকবে। নক্ষত্র ইলার উপর রাগ করলেও মনের মধ্যে একটা কষ্ট যে থেকেই যায়। তার ইলাকে ভালোবাসায় কি কোন কমতি ছিল? সে তো মন থেকেই ইলাকে ভালোবেসে ছিল। ইলাকে নিয়েই জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের স্বপ্ন সাজিয়েছিল। চাইলেও কি এত সহজে সব ভুলে যাওয়া যায়? বাইরে সে যতই দেখাক তার কিছু আসছে যাচ্ছে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে কতটা কষ্ট পাচ্ছে তা কেউ বুঝবে না। কেউ না। ইলার জায়গায় নয়নকে দেখা তার পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না। নয়নতারাকে সে আগলে রাখবে তবে কখনও ভালোবাসতে পারবে না। নয়নতারা বেরিয়ে এসেছে। নক্ষত্র একবার ওর দিকে তাকাল। তারপর খাবারের প্লেট সোফার উপর রাখল। নয়নতারাকেও সোফায় বসতে বলল। নক্ষত্র নিজের হাতে বেড থেকে সব ফুল ঝেড়ে ফেলে দিল। যেখানে যত ফুল লাগানো ছিল সব ছিড়ে ফেলল। বড় হার্ট আঁকা বেডশিটটা এক টানে তুলে ফেলল। নয়নতারা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে সব দেখছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে নক্ষত্র তার ঘরটাকে আবার আগের রূপ দিল। এখন কেউ বলবে না এটা বাসরঘর। সব সময় এই ঘরে সে যেমন থাকত ঠিক তেমন হয়ে গেছে ঘরটা। এবার সে নয়নতারার দিকে দেখল।

—এখনো দাঁড়িয়ে আছো! তোমাকে না আমি খেতে বলেছি। খাচ্ছ না কেন?’

নয়নতারা সেই সকালে যে খেয়েছিল। তারপর আর খাওয়া হয়নি। তবুও এখন খাবারের দিকে তাকিয়ে খিদে হলো না। উল্টো গলার কাছে কিছু পাক খেতে লাগল। নক্ষত্র ওকে টেনে সোফায় বসাল। নিজের হাতে নয়নতারার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে বলল,

—নাও খাও।’

নয়নতারা মুখ খুললো না। নক্ষত্র নয়নতারার হাবভাব দেখে বুঝল এখন নরম হলেই মেয়েটা কেঁদে ফেলবে। তাই না চাইলেও এই মুহুর্তে তাকে কঠোর হতে হলো। ধমক দিয়ে বলল,

—হাঁ করে না কেন? কতক্ষণ তোমার মুখের সামনে খাবার ধরে রাখব আমি? আমার হাত ব্যথা করছে।’

ভয়ে ভয়ে নয়নতারা কয়েক লোকমা মুখে নিল। এই কয়েক লোকমা চিবিয়ে গিলতে অনেকটা সময় নিল। নয়নতারা মাথা নামিয়ে খাচ্ছে। নক্ষত্র তার মুখ দেখতে না পারলেও মনের অবস্থা ঠিকই বুঝতে পারছে। বুঝলেও তার কিছু করার নেই। জেদের বশে যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তা এখন ফেরানো যাবে না। বিয়ে হয়ে গেছে। এখন সে চাইলেও নয়নতারাকে এত সহজে মুক্তি দিতে পারবে না। অন্তত কয়েকটা মাস নয়নতারার এখানে থাকতেই হবে। তারপর নাহয় অন্য কোনো ব্যবস্থার কথা ভাবা যাবে। নয়নতারা চাইলে সে ডিভোর্স দিতে আপত্তি করবে না। জোর করে মেয়েটাকে এই সম্পর্কে আটকে রাখবে না সে। এমনিতেই তারার উপর অনেক অন্যায় করে ফেলেছে সে। নক্ষত্র অন্যমনস্ক ছিল। খেতে খেতে হঠাৎ নয়নতারা ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল। তার কান্নায় নক্ষত্রর হুঁশ ফিরল। নয়নতারাকে কাঁদতে দেখে তারও কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছে সে। নক্ষত্র কিছু না বলে নয়নতারা মাথা তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু গলায় বলল,

—কাঁদে না। উঁহু, আমি তোমার চোখে পানি আসতে দেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এইতো কয়টা দিন। একটু সময় দাও। আমি তোমাকে মুক্ত করে দেব। কথা দিচ্ছি।’

নয়নতারা হয়তো কান্নার ঘোরে নক্ষত্রর কথাগুলো শুনলোই না। বাড়ির কথা ভীষণ মনে পড়ছে তার। আসার সময় বাবাকে দেখেনি সে। মা, জেঠু-জেঠি, ছোট চাচা-চাচী, ফুপু, ঝিনুক আপু, ইমন ভাইয়া, আকিব ভাইয়া, বাবলু, সজিব ওদের সবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ওরা এখন কী করছে? তার কথা মনে করছে? তার যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমনই কি ওদেরও কষ্ট হচ্ছে? ইাল আপু কোথায়? ওকে খুঁজে পেয়েছে তো। নয়নতারার অনেক জানার ইচ্ছে করছে, ইলা আপু এমনটা কেন করল? আপুর জন্যই তো তার সাথে এমনটা হয়েছে। আপু না পালালে এরকম কিছুই হতো না। সে বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে থাকত।

চলবে___

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here