নয়নতারা পর্ব ৯

#নয়নতারা_৯
#জেরিন_আক্তার_নিপা

ইলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। নক্ষত্র বলছে সে বিয়ে করতে এসেছে বউ নিয়ে ফিরবে। এই মুহূর্তে তার এই কথার মানে বোঝা কারোর জন্যই সহজ হচ্ছে না। কাকে বিয়ে করবে সে? ইলাকে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নক্ষত্রর বাবার ছেলের উপর ক্রমেই রাগ বাড়ছে। একে তো ছোটলোক পরিবারের বিয়ে করতে এসেছে। এখন মেয়ে পালিয়ে গেছে শুনেও ফিরে যেতে চাইছে না। দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? এই বাড়ির মেয়েদের মধ্যে মধু আছে নাকি? নক্ষত্রর মা স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেও ছেলেকে বোঝাচ্ছেন।

—চলো বাবা। আমরা ফিরে যাই। তুমি বিয়ে করতে চাইলে আজকেই করবে। কোন সমস্যা নেই। তোমার এক কথায় মেয়ের লাইন লেগে যাবে। আমার ছেলে ফেলনা নাকি? তোমাকে জামাই বানানোর জন্য কত মেয়ের বাবা আমাদের আগেপিছে ঘুরেছে। তুমি ওসবে পাত্তা না দিয়ে এরকম একটা ফ্যামিলিতে বিয়ে করতে চাইছিলে। যাদের মেয়ে মা বাবার মুখে চুনকালি মাখিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যায়।’

নক্ষত্র তার কথায় অটল। সে বিয়ে করবে। আজই করবে। এবং এই বাড়ির মেয়েকেই করবে। নয়নতারার বাবাকে ঘরে রেখে এসে সবাই নক্ষত্রর কাছে ইলার এই জঘন্য কাজের জন্য ক্ষমা চাইল। ইমনের বাবা বললেন,

—দেখো বাবা। ইলা এরকম কিছু করবে তা আমরাও জানতাম না। ওর এই কাজে তুমি যেমন অপমানিত হয়েছে। তেমন আমরাও কম হইনি। দেখা গেলে তোমার থেকে আমাদের কষ্ট, আমাদের অপমানটাই বেশি। তবুও তোমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাই বাবা। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দিও।’

নক্ষত্র উনার হাত ধরে শান্ত স্বরেই বলল,

—আপনারা ক্ষমা চাইবেন কেন? দোষ তো আপনারা করেননি। যে করেছে সে ভীতুর মত পালিয়ে করেছে। ইলা আমাকে সামনাসামনি বললে আমি বিয়ে ভেঙে দিতাম। ওর পালিয়ে যাওয়ার দরকার পড়ত না।’

ইলা আর নক্ষত্র যে দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইছিল এই কথা এখনো পরিবারের কেউ জানে না। তারা ভাবছেন, তাদের জন্যই ইলা এমন কাজ করেছে। ইলার হয়তো নক্ষত্রকে পছন্দ ছিল না। তাই বিয়ের দিন পালিয়ে গেছে।

—মেয়েটা আমাদের কথাটাও একবার ভাবল না!’

ইমনের বাবা পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে, ভাইয়ের অসুস্থতা দেখে অনেকটা ভেঙে পড়েছে। আজকের পর থেকে উনারা সমাজে মুখ দেখাবেন কীভাবে? ইমনের বিয়েতেও এমন একটা ঘটনা ঘটল। শেষে যেভাবেই হোক ঝিনুককে বিয়ে করিয়ে শেষ রক্ষা হয়েছে। লোকের কাছে হাসির পাত্র হওয়া থেকে সেবার বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু এবার? এবার বাড়ির সম্মান কীভাবে বাঁচাবেন তিনি? বাড়ির সবার বড় হয়েও আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগছে। ইলাটা এরকম করল? করতে পারল!
এতক্ষণ ধরে নক্ষত্রর মনে মনে যে কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল সে এবার তা সবার সামনে প্রকাশ করল।

—আমি নয়নতারাকে বিয়ে করব।’

নক্ষত্রর মুখে এই কথা শুনবে তা হয়তো কেউ আশা করেনি। নক্ষত্রর এমন প্রস্তাবে পুরো বাড়িটাই স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য কারো মুখে কোন কথা নেই। এটা কীভাবে সম্ভব? ইলার জায়গায় নয়নতারা! এরকমটা তো কল্পনাও করা যায় না। ইমন সবার আগে আপত্তি জানাল।

—না। ইলার অপরাধের জন্য নয়নকে অত বড় শাস্তি দেওয়া যায় না।’

নক্ষত্র বলল,

—শাস্তি হবে কেন? আমি ওকে ভালো রাখব। যেমন ইলাকে রাখতাম। তেমনই।’

—তবুও এটা হয় না। নয়নকে আমরা এখন বিয়ে দেব না। নয়নের বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? তুমি এছাড়া আমাদের যা করতে বলবে করব। তবুও তোমার এই কথায় রাজি হতে পারব না।’

ঝিনুক জানে নক্ষত্র ইলাকে ভালোবাসে। এটা জেনেও এই অবস্থায় সে মরে গেলেও নক্ষত্রর সাথে নয়নের বিয়ে হতে দিবে না। আজ নক্ষত্রর সাথে নয়নের বিয়ে হলে নয়ন কখনো সুখী হবে না। নক্ষত্র ইলার প্রতিশোধ নয়নের উপর দিয়ে তুলবে। তাই ঝিনুকও নিজের স্বামীর পক্ষ নিয়ে কথা বলল,

—হ্যাঁ। নয়নের এটা বিয়ের বয়স না। আর তাছাড়া ইলার জন্য পছন্দ করা ছেলের সাথে নয়নের বিয়ে কোন আক্কেলে দেব আমরা?’

নক্ষত্র হাসল। ঝিনুক কেন বাধা দিচ্ছে তা সে ভালো করেই জানে। কিন্তু নয়নের উপর দিয়ে ইলার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সে নয়নতারাকে বিয়ে করবে না। তার মাথায় তো অন্য প্ল্যান কাজ করছে। যেভাবেই হোক সে নয়নতারাকে বিয়ে করবেই।

—তারা এইচএসসি দিয়েছে। বিয়ের জন্য ওর এই বয়স কম না। বাংলাদেশ ৬০% মেয়েদের ইন্টারের পরই বিয়ে হয়ে যায়। আর আমি কথা দিচ্ছি তারাকে আমি অসুখী করব না।’

ঝিনুক তীক্ষ্ণ চোখে নক্ষত্রর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নক্ষত্রকে বুঝতে চেষ্টা করছে সে। কী চাইছে এই ছেলে? নয়নকে বিয়ে করার জন্য এরকম মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? ও তো ইলাকে ভালোবাসে। নয়নকে সে ওরকম চোখে কখনোই দেখেনি। তাহলে এই বিয়ে করার পেছনে ওর আসল উদেশ্য কী?
বাড়ির লোকেরা যদি জানত নক্ষত্রর সাথে ইলার আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। তাহলে হয়তো কখনো ওর সাথে নয়নতারার বিয়ে দিতে রাজি হতো না। যেহেতু ওরা আসল সত্যিটা কেউ জানে না। তাই সবাই রাজি হয়ে গেল। একমাত্র ইমন, ঝিনুক আর নয়নতারার বাবাই রাজি না। বাবা দরকার পড়ে সমাজ ছেড়ে চলে যাবে তবুও নিজের ছোট মেয়ের সাথে এই অন্যায় করবে না। নয়নের নিজের কোন মতামত নেই? বোনের জন্য তার জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত এভাবে নেওয়া হবে কেন?
নয়নতারা যখন জানল নক্ষত্র তাকে বিয়ে করতে চাইছে তখন তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। কী করবে সে? এরকম কিছু সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। বিয়ের মানে কী? যে মানুষটার সাথে তার বিয়ে হবে তাকে কি নয়নতারার পছন্দ হতে হবে না? মানুষটাকে সে আগে জানবে, বুঝবে, ভালো করে চিনবে তারপর না বিয়ে। ভার্সিটিতেও তো পা রাখেনি সে। এখনই বিয়ে! তাও ওই লোকটাকে যার সাথে আপুর বিয়ে হতে যাচ্ছিল। আপু পালিয়ে না গেলে লোকটা এতক্ষণে তার দুলাভাই হতো।

নক্ষত্রর সাথে কিছুক্ষণ আগেই নয়নের বিয়ে হয়ে গেল। নয়নতারা আজ থেকে নক্ষত্র চৌধুরীর ওয়াইফ। বাবাকে ফুপু, জেঠু রাজি করিয়েছে। ইমনও মেনে নিয়েছে। মানতে পারেনি একমাত্র ঝিনুক। তবুও পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তেমন কিছুই করতে পারেনি সে। তাই বলে এই নয় যে নয়নতারাকে জলে ফেলে দিবে ওরা। ঝিনুক নক্ষত্রকে একা ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলেছে।

—আপনি তো ইলাকে ভালোবাসেন। তাহলে কেন নয়নকে বিয়ে করতে চাইছেন?’

—তুমি কি ভাবছ আমি ইলার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি?’

—সেরকমটা ভাবা কি ভুল?’

—না। ভাবতেই পারো। তবে তারাকে আমি কখনো কষ্ট দেব না। ইলার শোধ আমি ওই বেচারি তারার উপর কীভাবে নেব বলো? ইলার সাথে তারার তো কোন মিলই নেই। বোনের কাজে কি ওর কোন হাত আছে? ইলার পালানোর পেছনে তোমাদের হাত আছে? নেই তো। তাহলে তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র তারাকেই কেন কষ্ট দেবার জন্য বেছে নেব?’

—তাহলে বিয়েটা কেন? নয়ন তো আপনাকে ভালোবাসে না।’

—বিয়েটা হলে তোমাদের পরিবারের সম্মানটাই অনেকটা বাঁচবে। আমার তেমন কোন লাভ হবে না।’

—আমাকে কথা দিন। আপনার কাছে নয়ন কোনোদিন অবহেলা পাবে না। ওকে আপনি কষ্ট দিবেন না? ভালো রাখবেন আমাদের নয়নকে?’

—আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব। জেনে-বুঝে সজ্ঞানে কখনও ওকে কষ্ট পেতে দেব না। সব সময় ওকে ভালো রাখার চেষ্টাই করব।’

নক্ষত্রের কথায় ঝিনুক বিশ্বাস করল। নক্ষত্র বুঝদার মানুষ। সে ইলার জন্য নয়নকে কষ্ট দিবে না। ইলাটা কেন যে এরকম করল! ওর জন্য বেচারি নয়নকে কতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। মেয়েটার উপর দিয়ে কী যাচ্ছে, ওর মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারবে না নয়ন। বড্ড চাপা স্বভাবের মেয়ে যে। নক্ষত্র তার বাবা মা’র কোন কথাই শুনল না। সে নিজের মন মত সব করে গেল। যে মেয়ে পালিয়ে গেছে তার ছোট বোনকে বিয়ে করার মানে কী?

নয়নতারা কথা হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ তার জীবনের মোড় এভাবে ঘুরে যাবে সে কখনো ভাবেনি। আজ তার বিয়ে হয়েছে এটাই তো এখনো
বিশ্বাস হচ্ছে না। বিদায় নেবার সময় সবাই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। সে নিজেও কাঁদল। সবার মাঝে সে বারবার বাবাকেই খুঁজেছে। কিন্তু বাবাকে দেখতে পায়নি সে। বাবা তার সামনে এলো না। নিজের পরিবার, নিজের আপনজন, নিজের চেনা পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ অজানায় পা বাড়ানোর সময় তার বুক কাঁপছিল। পায়ে জোর পাচ্ছিল না। সে সময় একজন তার হাতটা শক্ত করে ধরল। তাকে গাড়িতে নিয়ে বসাল। নয়নতারা গাড়িতে বসেও ফেলে যাওয়া চেনা মুখ গুলোকে দেখতে থাকল। সবাইকে রেখে কোথায় যাচ্ছে সে? কার সাথে যাচ্ছে? যাকে সে চিনে না। বুঝে না। মনের কোন মিল নেই। তার সাথে? সে লোকটা তার স্বামী? নক্ষত্র পুরোটা পথ নয়নতারার হাত ধরে রাখল। ছাড়ল না একবারও। সে তার জেদ থেকেই নয়নতারাকে বিয়ে করেছে। তাই বলে তারার অনাদর সে কখনো করবে না। অন্তত যতদিন ওরা একসাথে থাকে ততদিন তারা তার জন্য কোন কষ্ট পাবে না। এটা নিজের কাছেই তার প্রতিজ্ঞা।
গাড়িতে নয়নতারা জ্ঞান হারালো। নক্ষত্র নয়নতারার মাথাটা সাবধানে তার কাঁধের উপর রাখল। এসি চালু করে দিল। বাসায় পৌঁছেও নয়নতারার জ্ঞান ফিরেনি। সে নয়নতারাকে কোলে করে গাড়ি থেকে নামিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। বাবা মা আগে থেকেই তার উপর রাগ করে চলে গেছে। সে নয়নকে নিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে এলো। ফুল দিয়ে সাজানো বেডের মাঝে নয়নতারাকে শুইয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here