#নয়নতারা_২৪
#জেরিন_আক্তার_নিপা
খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। খাবার আসতে একটু দেরি হচ্ছে। রামিশা মা’র সাথে গল্প করছে। নক্ষত্র এই ফাঁকে একবার নয়নকে ফোনে ট্রাই করল। রিং হচ্ছে কিন্তু নয়ন কল তুলছে না। নক্ষত্র নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিল যে, নয়ন হয়তো এখন ফোনের কাছে নেই। ওর কল দেখতে পায়নি। দেখলে অবশ্যই কল ব্যাক করবে। খাবার এলো। রামিশা নক্ষত্রর প্লেটে খাবার সার্ভ করতে করতে বলল,
—-নাও শুরু করো। এদের খাবারের সুনাম আমি নিউইয়র্ক বসেও পেয়েছি। আমার সব ফ্রেন্ডসরা এখানেই আসে। ওদের এই আইটেমটা ভীষণ ভালো। নাও, নাও। জলদি জলদি খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে। সত্যিই ভালো নাকি শুধু পাবলিসিটি।”
ওরা খাওয়া শুরু করল। খাবার নক্ষত্রর গলা দিয়ে নামছে না। নয়ন একা বাড়িতে আছে। ও খেয়েছে তো? নাকি না খেয়ে বসে আছে। ওকে একা রেখে আসা ঠিক হয়নি। নয়ন চাপা স্বভাবের মেয়ে। ওর খারাপ লাগলেও বলবে না। নক্ষত্রর অনুশোচনা হচ্ছে। দূর! সে নয়নকে না নিয়ে কেন এলো। ওকে জোর করে নিয়ে আসতে পারত। নইলে আজ বাদই দিত। যেদিন নয়ন আসতো সেদিন এলেই হতো। রেস্টুরেন্ট তো আর কোথাও চলে যেত না। এখানেই থাকত। নক্ষত্র মনে মনে ভাবল,
—-তারা আমার বউ। ওকে একা বাড়িতে রেখে আমি ফ্রেন্ডের সাথে খেতে এসেছি! বউয়ের থেকে ফ্রেন্ডকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। তারাকে জেলাস ফিল করাতে গিয়ে ওর সাথে অন্যায় করে ফেললাম। হ্যাঁ একটু বাড়াবাড়ি তো হয়েছেই। তারা হয়তো এসবে জেলাস না হয়ে কষ্ট পাচ্ছে। ওকে বোঝা উচিত ছিল আমার।”
নক্ষত্র সবার আগে নাকেমুখে খেল। মা রামিশাকে রেখেই উঠে দাঁড়াল। নক্ষত্রর মা অবাক হয়ে বলল,
—-নক্ষত্র কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
নক্ষত্র সোজাসাপ্টা উত্তর দিল।
—-বাড়িতে মা। তারা একা আছে। ভয় পাবে ও।”
নক্ষত্রর মা, রামিশা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। নক্ষত্র নয়নকে নিয়ে এতটা ভাবে! ওর এতো কেয়ার করে! রামিশার ভয় হতে লাগল নক্ষত্র আবার নয়নতারাকে ভালোবাসতে শুরু করেনি তো।
রামিশা কাতর মুখে তাকাল। নরম গলায় বলল,
—-ডিনার শেষ না করেই চলে যাবে?”
—-খেলাম তো রামিশা।”
—-আরও ম্যেনু ছিল। তোমার জন্য স্পেশাল ডিশ অর্ডার করেছি। সবার শেষে ওইটা আসবে।”
নক্ষত্র রামিশার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত মুখে হাসল।
—-সরি রামিশা৷ আজ যাই। আরেকদিন তারাকে সাথে নিয়ে এসে তোমার সেই স্পেশাল ডিশ ট্যাস্ট করব। আজ আমাকে যেতেই হবে।”
নক্ষত্র গাড়ির চাবি মা’কে দিয়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। রামিশা অপমানে থমথমে মুখে বসে রইল। নয়নতারার উপর রাগে চোখে পানি এসে গেছে তার। শেষ পর্যন্ত না এসেও ওই মেয়ে জিতে গেল। নক্ষত্র ওর জন্য রামিশাকে ফেলে চলে গেল। বন্ধুর থেকে বউ বড় হয়ে গেল নক্ষত্রর কাছে। নক্ষত্রর মা রামিশাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু রামিশা কারো সান্ত্বনা মানলে তো! তার অন্ততে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে নয়নতারা নামের মেয়েটাকে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়ার শপথ নিয়েছে।
—-আমি ওই মেয়েকে এতো সহজে ছাড়ব না আন্টি। ওর জন্য নক্ষত্র আমাকে ইনসাল্ট করেছে। আমার থেকেও ওই মেয়ে ওর কাছে বড় হয়ে গেছে। ওই মেয়েকে আমি শান্তিতে বাঁচতে দেব না। ওর জীবন যদি নরক বানিয়ে না ছেড়েছি তাহলে আমার নামও রামিশা চৌধুরী না।”
—-রিল্যাক্স মাই ডিয়ার। তোমার সাথে তোমার আন্টিও আছে। নক্ষত্রর আচরণে তুমি আপসেট হইয়ো না প্লিজ। ওই মেয়ের উপর রাগ করতে পারো। প্রতিশোধও নিতে পারো। আমি তোমাকে হেল্প করব।”
—-তুমি আমার সাথে থাকবে তো আন্টি। আমি ওই মেয়েকে জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।”
—-অফকোর্স মাই ডল। আমি তোমার সাথেই আছি।”
নয়ন ফোন ঘরে চার্জে বসিয়ে রেখে এসেছে। তাই নক্ষত্রর কল তুলতে পারেনি। সে আসলে রিংই শুনেনি। শুনলে অবশ্যই ছুটে যেত। নক্ষত্র তাকে রেখে রামিশার সাথে গেছে। এতে প্রথমে নয়নের খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু পরে সে নিজেকে বোঝাল।
—-তোর ছোটবেলার এতবছর ওর তোদের বাড়িতে এসে যদি তোকে ডিনারে ইনভাইট করতো। আর তোর বর না যেত। তখন কি তুই সেই বন্ধুর সাথে যেতি না নয়ন? না গিয়ে এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করতি। তুইও মরে গেলেও বরের লেজ ধরে বসে থাকতি না। অবশ্যই যেতি। উনি তো আমাকেও সাথে যেতে বলেছিলেন। কত সাধাসাধি করলো। তুই নিয়েই তো গেলি না। তোকে কি জোর করে নিতে পারতো। নিজের বন্ধুর বেলা ষোলো আনা। আর উনার বন্ধুর বেলা এক আনাও না। এটা কি ঠিক হচ্ছে নয়ন তুই-ই বল। বন্ধুত্ব এক জায়গায়। বউ আরেক জায়গায়। বউয়ের ভালোবাসা অন্যরকম। বন্ধুর ভালোবাসা আরেকরকম। তোরই যাওয়া উচিত ছিল। মানুষটা কত করে সাধলো। তুই জেদি কত পাষাণ মন তোর। মুখের উপর না করে দিলি কীভাবে হ্যাঁ।”
নয়ন নিজের সাথে কথা বলছে। নক্ষত্রকে বুঝতে চেষ্টা করছে। যা শুধু এখনকার নয়নই পারে। আগের নয়ন হলে কান্নাকাটি করে, রাগ করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকত। নয়ন একা একাই হাসল।
—-দেখেছিস বিয়ের পর কত বড় হয়ে গেছিস তুই। কত বুঝতে শিখেছিস। আগে কখনও এভাবে ব্যাপার গুলো ভাবতি? না তো। কিন্তু এখন তো ভাবছিস। দোষ আসলে তোরই নয়ন। স্বামীকে বুঝতে শিখ একটু। তবেই না উনিও তোকে বুঝবে। তুই সাথে গেলে হয়তো উনিও মনে মনে খুশি হতো।
আমার জন্য যদি উনি না যেতেন তাহলে বন্ধুর চোখে ছোট হতে হতো।”
নয়ন ওদের ফেরার অপেক্ষায় হলরুমে বসে আছে। নিজের সাথে কথা বলতে বলতে দোতলায় কিছু আওয়াজ পেল সে। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। বাড়িতে কেউ নেই। কিসের আওয়াজ হলো ওটা। আলো আছে দেখেই হয়তো নয়ন ভয় পাচ্ছে না। সে ভাবল তার মনের ভুল। আর ঠিক তখনই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে। চোখের সামনে কিচ্ছু দেখতে পারছে না নয়ন। নিজেকেও না। এবার একটু একটু ভয় হতে লাগলো তার। কাজের লোকগুলোকে ডাকতে লাগল। ওরা রাতে এখানে থাকে না। ওদের থাকার আলাদা ঘর আছে পেছনে। কেউ নেই জেনেও নয়ন ডাকল।
—-কেউ আছো? আলোটা জ্বালো না কেউ। শুনছো আমার কথা। সোলায়মান। রাহেলা আপা। শুনছো…
আবার শব্দটা হলো। নয়ন ভয়ে অন্ধকারে ঘামতে লাগল। হাত পা কাঁপছে ওর। ছোটবেলা থেকে কখনও অন্ধকারে থাকেনি নয়ন। যখন তার পাঁচ বছর বয়স তখন তার দাদা মারা যায়। রাতে মারা গিয়েছিল দাদা। সেদিন বাড়িতে কান্নার রোল পড়েছিল। নয়ন ছোট ছিল। ও জাগলেও বুঝবে না দাদা মারা গেছে। তাই কেউ তাকে ঘুম থেকে জাগায়নি। তাকে একা ঘরে রেখেই মা বাবা দাদার কাছে গিয়েছিল। সেদিনও কারেন্ট ছিল না। মা বাবার হয়তো তার কথা মনে ছিল না। না থাকাটাই স্বাভাবিক। বাবা মারা গেছে। এই মুহূর্তে নয়নের বাবা মেয়েকে মনে রাখতে পারলেন না। কান্নার শব্দে নয়নের ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার ঘরে নিজের পাশে কাউকে পায়না সে৷ বাইরে থেকে সবার কান্নার শব্দ একসাথে মিশে অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেই মুহূর্ত নয়ন বাবা বলে এক চিৎকার দিয়েই জ্ঞান হারায়। পুরো একদিন পর ওর জ্ঞান ফিরে। দাদাকে কবর দেওয়া হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু বাড়ি থেকে শোকের ছায়া দূর হয়নি। দাদার শোক ভুলে তাকে নিয়ে সবার কান্না। মেয়েটার কী হলো? ওকে একা রেখে আসার জন্য সবাই তার মা’কে দোষ দিল। মা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজের ছোট্ট মেয়ের পাশে পাথর হয়ে বসে রইল। বাবা তাকে এক মুহূর্তের কোন কোল থেকে নামায়নি। বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল। একদিন পর নয়নের জ্ঞান ফিরে কাউকে চিনতে পারেনি সে। সবাইকে দেখেই ভয় পেত। কেউ তার সামনে এলেই চোখ বুজে চিৎকার করত। শুধু বাবাকে ভয় পায়নি সে। মা’র সাথেও যায়নি। কিন্তু বাবার কাছে গিয়েছে। অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখানোর পর নয়ন সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে অন্ধকারে তার ভয়টা রয়েই গেল। সে কারণে একা থাকত না কখনও সে৷ ইলা আপুর সাথে ঘুমাতো। সন্ধ্যার পর কোথাও যেত না। ভুলেও রাতের বেলা একা ঘর থেকে বের হয়নি। সবাই নয়নের ভয়ের কথা জানতো। এই ঘটনার পর থেকেই বাবা তাকে চোখের আড়াল হতে দিত না। মা, দাদী বাড়ির সবাই তাকে চোখে চোখে রাখত। একদিন পর জ্ঞান ফিরে পরিবারের মানুষ গুলোর খুশি ফিরিয়ে দিয়েছিস সে। সেই মানুষগুলো এতটা বছর তাকে আগলে রেখেছে।
—-বাবা! বাবা! কোথায় তুমি? ও বাবা!”
নয়ন আবার আগের স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। ঘেমে ভিজে গেছে সে। অন্ধকার হাতড়ে ঘরের দিকে যাচ্ছে সে। কিছুর সাথে পা লেগে পড়ে গিয়ে কপালে ব্যথা পেল। কেটে গেছে, রক্ত বের হচ্ছে এই খেয়াল নয়নের এখন নেই। আরও কয়েকবার হুঁচট খেয়ে। পড়ে গিয়ে উঠে নয়ন সিঁড়ি বেয়ে ঘরে চলে এলো। সেই মুহূর্তেই নক্ষত্র নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে আসে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখতে পায় না। নয়নের কথা ওর মনে পড়ে। চিৎকার করে নয়নের নাম ধরে ডাকে,
—-তারা! তারা, কোথায় তুমি? ভয় পেয়ো না। আমি চলে এসেছি। কোথায় তুমি তারা?”
নক্ষত্র ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালে। ছুটে উপরে চলে আসে। নক্ষত্রর গলা নয়নের কানে এসেছে। কিন্তু জবাব দেবার শক্তি পাচ্ছে না সে। গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না। ঘরে যেতে পারেনি নয়ন। দরজার সামনে পড়ে গিয়েছিল। এখনও এখানেই বসে আছে। নক্ষত্র সিঁড়ি দিয়ে উঠেই ওকে দেখতে পেল। ছুটে এসে ওর পাশে বসল। ফোনের আলোয় নয়ন শুধু নক্ষত্রর মুখটা দেখতে পেল। নক্ষত্রকে দেখে ওর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। নক্ষত্র নয়নের কপালে রক্ত দেখে পাগল হয়ে গেছে। কপাল কাটল কীভাবে? নক্ষত্র নয়নকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
—-কারেন্ট কখন গেছে? কতক্ষণ ধরে তুমি অন্ধকারে আছো?”
নয়ন কোন উত্তর দিতে পারল না। ঘোরের মধ্যে আছে সে। থরথর করে কাঁপছে। তার ঘামে নক্ষত্রর শার্ট ভিজে যাচ্ছে। দাদা মারা যাবার সেই অন্ধকার রাতের কথা আবার স্মৃতিতে ফুটে উঠেছে। নক্ষত্রকে চিনতে পারলেও তার ভয় কাটছে না। নক্ষত্র শার্ট খামচে ধরে কী যেন বিড়বিড় করে যাচ্ছে নয়ন। নক্ষত্র অনেকবার অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। নয়ন কোনো উত্তর দিতে পারল না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে নক্ষত্রর। নয়নকে একা রেখে গিয়েছিল কেন সে? নয়নের বাবার কাছে ও কথা দিয়েছিল। নয়নের খেলায় রাখবে। ওর কিছু হতে দিতে না। নিজের কথা রাখতে পারল না নক্ষত্র।
—-তারা! কথা বলো না তারা। ভয় পেয়েছ। ভয় কিসের পাগলি? দেখো আমি চলে এসেছি। আমি আছি তো তোমার পাশে। কথা বলো তারা প্লিজ। এই তারা! এই…
নক্ষত্রর বুকে নিজের সব ভার ছেড়ে দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে নয়ন। নক্ষত্র ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুইলে দিল। নয়নের মুষড়ে পড়া মুখের দিকে তাকিয়ে টুপ করে নক্ষত্রর চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ে গেল।
—-সব দোষ আমার। তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি আমি। আমি তোমার যোগ্য না। তোমার বাবার কাছে কী জবাব দেব আমি? কোন মুখে উনার সামনে দাঁড়াব? তোমার খবরই বা ওদের কীভাবে দেব? তুমি ঠিক হয়ে ওঠো তারা। প্লিজ। নইলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারব না আমি। প্লিজ তারা ঠিক হয়ে যাও তুমি। প্লিজ।”
চলবে___