#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ২১
,
,
সকালে ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে।
সারারাত ঘুম হয়নি ইরার।এদিকওদিক পাশ কাটতে কাটতেই রাত কেটেছে তার।
বুকের ভেতর কষ্টের দামামা বেজেছে।
কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে একাকার।
লাল টকটকে হয়ে চোখ জ্বালা করছে এখন।ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিলো তার।
ধীরপায়ে খাট থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে এলো ইরা।
তার আজ ভালো লাগছেনা।কিচ্ছু ভালো লাগছে না।
সে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালো।গ্রিলের ফাকে হাত ঢুকিয়ে মাথা ঠেকালো।
নিচের রাস্তায় চলাচলরত মানুষদের দেখতে লাগলো একদৃষ্টিতে।
সবাই কতো ব্যস্ত তাদের জিবনে।
একটা মেয়েকে তার বাবা কিভাবে কোলে নিয়ে হেটে চলেছে।পাশে হাটছে তার মা।কি হাস্যোজ্জল তাদের চেহারা!
মেয়েটা এটাওটা আবদার করতেই কেমন সব সামনে এগিয়ে দিচ্ছে তারা।
নিশ্চিয় তাকে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করার চেষ্টাও করে তারা।নিশ্চয়ই সবসময় আগলে রাখে!
ইরার চোখ ঘোলা হয়ে এলো হঠাৎ।
তার বাবা মা বেচে থাকলে তাকেও তো আগলে রাখতো।এমন একটা জিবন কি কাটাতে হতো তাকে?কতো আদুরে ছিলো সে!
চোখমুছে রুম থেকে বেরোলো ইরা।সিড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় লক্ষ করলো সোফায় বসা কিছু লোকজনকে।
তাদের সামনে নাস্তার ট্রে দিচ্ছে রহিমা খালা।
ইরা সেদিকে নামলো না।
সে ড্রয়িং রুমে না গিয়ে কিচেনে গিয়ে দাড়ালো।
রহিমা খালা ততক্ষণে মেহমানদের নাস্তা দিয়ে কিচেনে ফিরে এসেছেন।
ইরাকে দেখে তিনি বললেন,
—তুমি এইখানে কি করো?
আর চোখমুখের এই অবস্থা কেন?যাও যাও একটু সাজগোজ কইরা আসো।
ইরা অবাক হলো খুব। হঠাৎ সাজগোজ করবে কেনো?
সে বললো,
—কেনো?
—কেনো মানে?তুমি কিছু জানোনা?
ইরা মাথা নাড়ালো।সে কিচ্ছু জানেনা।বললো,
,—ড্রয়িং রুমে কারা এসেছে খালা?
—রিফাত আর তার বাবা মা।
—হঠাৎ এ বাড়িতে?তাও সকাল সকাল?
—তোমার বিয়ের কথা কইতে আইছে।
ইরা চমকে তাকালো।বিয়ের কথা?মানে?.সে তো শৌখিনের বউ?
পরক্ষনেই ডিভোর্সের কথা মনে পরলো।তাহলে কি শৌখিনও সিগনেচার করে দিয়েছে?এতো সহজে?
ইরা নিজের উপরই হেসে উঠলো।
সে সিগনেচার করবেইনা না কেনো?নিজেই তো ডিভোর্স পেপার রেডি করতে বলেছে।মিতালির সাথে নতুন করে সংসার করবে বলে।
সে বললো,
—কার সাথে বিয়ে?
—রিফাতের সাথে তোমার বিয়ে।
ইরার শরীর খারাপ লাগলো খুব।সে শৌখিনকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবেনা।
উহু,কখনোই পারবেনা।
আর রিফাততো স্বয়ং মিতালীর ভাই।
ইরা মাথা নিচু করে পাশে একটা টুল টেনে বসে রইলো।
তার ভালো লাগছেনা,কিচ্ছু ভালো লাগছেনা।
মাথাটা ঘুরছে খুব।
কি নিঃসঙ্গ, একা একা লাগছে!
একটু বাদেই কিচেনে ঢুকলেন রেহেনা বেগম।
ইরাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।বললেন,
—তুই এখানে ইরা?আর আমি তোকে সারা বাড়ি খুজে বেড়াচ্ছি।
ইরা ফুপুকে দেখে উঠে দাড়ালো।বললো,
—কেনো খুজছো ফুপু?
—কেনো মানে?তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে রিফাত জানিস?আমি তো ভাবতেই পারিনি।
কি যে খুশি হয়েছি,কি বলবো।
তোকে নিয়ে চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো।
এখন বিয়েটা দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হবো।
ইরা শুকনো গলায় বললো,
—আমার ব্যাপারে তাকে কিছু বলেছো ফুপু?
—কোন ব্যাপারে?
—আমার আর তোমার ছেলের বিয়ের ব্যাপারে?
রেহেনা বেগম মাথা নাড়েন।তিনি বলেছেন।
রিফাত আগে এ ব্যাপারে কিচ্ছু জানতো না।সে ইরাকে শুধু শৌখিনের মামাতো বোন হিসেবেই চিনতো।তবে তাদের যে বিয়ে হয়েছিলো এ কথা জানতোনা।
রেহেনা বেগমই সবটা বুঝিয়ে বলেছে তাকে।বলেছে শৌখিন কখনোই বিয়েটাকে মানেনি।এসব শুনেও রিফাত ইরাকেই বিয়ে করতে চেয়েছে।
সে পছন্দ করে ইরাকে।
অনেক অনেক পছন্দ করে।
মেয়েটার মধ্যে এক মায়া কাজ করে।
রেহেনা বেগম বলেন,
—সব জানার পরও রিফাত তোকেই বিয়ে করতে চায় ইরা।
ইরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ফুপুকে সে যদি বলে আমি বিয়েটা করতে চাইনা তাহলে ফুপু কষ্ট পাবে।সে এখন ইরার অভিভাবক।
ইরা তার উপরে কথা বলতে পারেনা।
তাছাড়া কি বলবে?রিফাতকে বিয়ে করবোনা তো তাকে বিয়ে করবো?কাউকে না?শৌখিনকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।যে ছেলে মাকে বলে ডিভোর্স পেপার রেডি করিয়েছে তার সাথে কিকরে থাকতে চাওয়া যায়?
ফুপুর দিকে তাকায় ইরা।
ফুপুকে কি খুশিখুশি দেখাচ্ছে।
হয়তো ইরার জন্য কিছু করতে পারার খুশি।হয়তো ভেবেছে এতেই ইরা খুশি থাকবে।
কিন্তু সত্যি কি তাই?
ইরা বলে ওঠে,
—রিফাত ভাইয়ের সাথে আমি আলাদা কথা বলতে চাই।
রেহেনা বেগম আনন্দিত হন।ইরাও কি তাহলে রাজি এ বিয়েতে?
তিনি সানন্দে বলে ওঠেন,
—ঠিক আছে।আমি ব্যবস্থা করছি।
💮💮
—কেমন আছো ইরা?
ইরা পেছন ফিরে তাকালো।সে ছাদে দাড়িয়ে তার ফুলের টবগুলো দেখছিলো।কি নির্জিব হয়ে গেছে গাছগুলো।একেবারে ইরার মতোই ভেঙে মুষড়ে পরেছে।
বেশকিছুদিন হলো যত্ন ও করা হয়নি ঠিকমতো।
ফুলগাছের যত্ন করবে কিভাবে,?ইরা নিজের যত্নই তো ভুলে গেছে।
সে রিফাতের কথার প্রতুত্তরে সৌজন্যসূচক হাসি হাসলো।
কেউ কেমন আছো জিজ্ঞেস করলে বলতে হয় ভালো আছি।কিন্তু ইরা কি বলবে?সে কি সত্যি ভালো আছে?
তবে মিথ্যা কেনো বলবে?
সে পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললো,
—বসুন রিফাত ভাই।
রিফাত হেসে বললো,
—এখনো আমায় ভাই বলবে ইরা?আর কিছুদিন পরই তো…
কথাটা পুরো করলো না রিফাত।তবে ইরা বেশ বুঝতে পারলো কথাটা।এবং বুঝতেই বুক ফেটে কান্না আসতে চাইলো।রিফাত ততক্ষণে চেয়ারে গিয়ে বসেছে।ইরাকেও পাশের চেয়ার টেনে দিলো সে।
হাত দিয়ে ইশারা করলো বসার জন্য।
ইরা ধীরপায়ে হেটে চেয়ারে বসলো।
বললো,
—আপনাকে আমার কিছু বলার আছে।
–কোন ব্যাপারে?
—আমার আর আপনার বন্ধুর ব্যাপারে।
রিফাত বাধা দিলো।
—আমি কিচ্ছু জানতে চাইনা ইরা।আমি জেনেছি সবটা আন্টির কাছে।
তোমাদের বিয়েটা তো কোন বিয়েই না,এটা তো যাস্ট একটা এক্সিডেন্ট!
—কিন্তু আমার কাছে এক্সিডেন্ট না।
—মানে?
—আমি মন থেকে মানি এই বিয়েটাকে।আমি স্বীকার করি শৌখিন আমার স্বামী।
—কিন্তু শৌখিন তো মানেনা।
সে তো তোমায় ডিভোর্স দিতে চায়।শুনলাম তুমি নাকি ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার ও করে দিয়েছো?
ইরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।বললো,
—হ্যাঁ।
—তাহলে সমস্যা কোথায়?
—আমি জানিনা,আমি শুধু জানি ওনাকে ছাড়া আমি কাউকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারবোনা।
কক্ষনো না।
রিফাতের মুখে অমাবস্যা নামলো।সে ইরাকে ভালবেসে ফেলেছিলো।
মেয়েটার মায়ায় পরেছিলো।কিন্তু জোর করে তো আর মন পাওয়া যায়না।
বললো,
—শৌখিনকে ভালবাসো?
ইরা টলমলে চোখে বললো,
—খুব!
—তাহলে এতো দুরত্ব কেনো তৈরি করছো?
—ভালবাসার মানুষটাকে ভালো রাখার জন্য।তার ইচ্ছেটা পুরনের জন্য।
তাকে তার ভালবাসার মানুষের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য।
রিফাত চমকে তাকালো।ভালবাসার মানুষ?কার? শৌখিনের?
শৌখিনের ভালবাসার মানুষ?ইরা ছাড়া অন্য কাউকে ও ভালবাসে?
ইরাকে নয়?
রিফাত কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো।এতক্ষণের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাবার সপ্ন তার ভেঙে গেছে।সে বুঝে গেছে ইরা শৌখিনকে ভালবাসে। খুব ভালবাসে!
তাকে ছাড়া আর কাউকে সে মেনে নিতে পারবেনা।
তবুও ক্ষীন আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—আমি কি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো ইরা?
ইরা শুকনো গলায় জবাব দিলো,
—না।
রিফাত আর কথা বাড়ালোনা।
সে মৃদুপায়ে হেটে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো।
,
,
চলবে…..
(রাতে আরেক পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো)