পথে হলো দেরি পর্ব ২৩

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ২৩

,
,
ইরা চোখ মেলে নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করলো।মাথাটা ভার লাগছে খুব।উঠে বসার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলো।শরীরে শক্তি নেই।
প্রচন্ড দুর্বল লাগছে।চারপাশে চোখ বুলালো একবার।
হাতে তার স্যালাইন লাগানো।
তাহলে কি বাড়িতে ডাক্তার এসেছিলো?
ফুপু শাম্মি ই বা কোথায়?
ইরা দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত এগারোটা।
এতোটা সময় ইরা ঘুমিয়ে ছিলো?সেই যে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে মাথা ঘুরে পরে গেলো আর কিচ্ছু মনে নেই ইরার।
সেখানে মিতালি আর মুগ্ধ ছিলো।
ইরার বুকটা ছ্যাত করে উঠলো।
মিতালি?হ্যাঁ মিতালিই তো।
সেতো শৌখিনের ভালবাসা ছিলো তাহলে মুগ্ধকে কেনো বিয়ে করলো?
তবে কি শৌখিন তাকে সবটা বলেছিলো?সে ইরাকে সত্যিই ঠকায়নি?সে বিশ্বাসঘাতক ছিলোনা?সব নিছকই ইরার ভুল ছিলো?
ইরা নিজের মাথা চেপে ধরলো।
সে এতো বড় ভুল করলো?এতো বড় ভুল?
কিন্তু ডিভোর্সের পেপারটা?সেটা তো ভুল ছিলোনা।
ইরা বুক কাঁপতে লাগলো।
গা ঘেমে উঠলো খুব।
শাম্মি প্রবেশ করলো।শাম্মির হাতে ফলমুলের ট্রে।
শাম্মি এসেই ইরার সামনে ট্রে নামিয়ে রাখলো।
উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে খুব।
সে গড়গড় করে একনাগাড়ে বললো,

—যা ফল এনেছি সব ফল খাবি,একটা ফলও যদি প্লেটে থেকেছে তো তোর একদিন কি আমার একদিন।ফাজিল মেয়ে!না খেয়ে খেয়ে কি অবস্থা করেছিস শরীরের?সে খেয়াল আছে?
তুই তো বুঝবি তোর ভালোটা?তাছাড়া তুই কি এখন একা?নিজের কথা না ভাবিস বাচ্চাটার কথা তো ভাববি?

ইরা চমকে তাকালো?
বললো,

—বাচ্চা? কার বাচ্চা?

শাম্মি অবাক হয়ে বললো,

—তুই জানতি না?আমি তো ভেবেছি তুই সব জানতি?হয়তো আমাদের বলিসনি।

অজানা আশংকায় ইরার বুক কেঁপে উঠলো।সে কি জানবে?কিসের কথা বলছে শাম্মি?
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

—কি জানবো আমি?

—তুই প্রেগন্যান্ট ইরা!

ইরা চোখ বড়বড় করে তাকালো।তার একটা হাত আপনাআপনি পেটে এসে ঠেকলে।
খুশিতে তার চোখ বেয়ে জলের ধারা নামলো।
কে বলেছে মানুষ শুধু দুঃখ পেলেই কাঁদে? কে বলেছে অশ্রু মানেই কষ্টের প্রতিরুপ?
এই যে ইরা এখন কাঁদছে, এটা যে তার সুখের কান্না,আনন্দের কান্না!
তার গর্ভে শৌখিনের সন্তান? শৌখিনের?
কিন্তু শৌখিন কি এসব মেনে নেবে?
সে যদি অস্বীকার করে?
সে তো ডিভোর্স দিয়েছে ইরাকে।

ইরা মুখটা গম্ভীর করে ফেললো।তার ভয় হতে লাগলো খুব।শাম্মি হয়তো বুঝতে পারলো ইরার মনের অবস্থা।
সে হাত বাড়িয়ে ইরার হাতের উপর হাত রাখলো।চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলো।
বললো,

—এতো চিন্তা করছিস কেনে বলতো?কিচ্ছু হবেনা দেখিস,সব ঠিক হয়ে যাবে।

ইরা ভীতু কন্ঠে বললো,
—কিকরে সব ঠিক হবে?উনি যে আমায় ডিভোর্স দিয়েছেন?

—তোকে কে বললো?

–কেউ বলেনি।কিন্তু আমি জানি।
উনি ফুপুকে ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে বলেছিলেন।আমি সইও করেছিলাম।
উনিও নিশ্চয়ই পরে সই করেছেন।

শাম্মি মাথায় হাত দিয়ে বসলো।বললো,

—এতক্ষণে সবটা বুঝতে পারলাম।

—কি বুঝলি?

—ভাইয়া তোকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলো কিন্তু সেটা অনেক আগে।
মা সেই কথা ধরে ডিভোর্স পেপার তৈরি করেছিলো।উনি ভেবেছিলো এই সম্পর্কে থেকে তোরা দুজনেই কষ্ট পাচ্ছিস।কিন্তু তোদের সম্পর্ক যে ডেভেলপ হয়েছে সেটা আমাদের কেনো বলিসনি?
তাহলে তো মা এমনটা করতো না বল?

ইরা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।তার মাথাটা আবার ঘুরছে।কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।
নিজের দুগালে ইচ্ছে মতো চড় বসাতে ইচ্ছে করছে।কেনো এতো বেশি বুঝতে গেলো সে?কেনো শৌখিনকে সবটা জিজ্ঞেস করলো না?
উল্টো শৌখিনকে বিশ্বাসঘাতক, চরত্রহীন আরও কতোকিছু বলে দিলো।
এখন তাহলে কি হবে?কি করবে ইরা?
উপায় না পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ফেললো সে।
নাক টানতে টানতে শাম্মিকে বললো,

—এখন কি হবে?আমি তো সব এলোমেলো করে দিয়েছি?কি করবো এখন?
তাছাড়া উনি তো রাগ করে ডিভোর্সও দিয়ে দিয়েছেন।

শাম্মি ইরার কাঁধে হাত রাখলো।মুচকি হেসে বললো,

—আরে কাঁদছিস কেনো? ভাইয়া তো সই করেইনি।
শুধু তুই একাই সই করেছিলি।

ইরা চোখমুছে শাম্মির দিকে তাকালো।মুখের কোনে তারও হাসি ফুটে উঠেছে।বললো,

—সত্যি?

—সত্যি।
এবার চোখমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেতো।আর পেট ভরে খেয়ে নে।তাড়াতাড়ি!

—তাড়াতাড়ি কেনো?

—কারন তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে।

ইরা এগিয়ে এসে উত্তেজিত হয়ে বললো,

—কি সারপ্রাইজ?

—বলা যাবেনা।বললে কি সারপ্রাইজ থাকলো নাকি?

ইরার কৌতুহল হলো খুব।কি এমন সারপ্রাইজ থাকতে পারে?কি হতে পারে?
সে বললো,

—বলনা প্লিজ, প্লিজ প্লিজ প্লিজ!

শাম্মি মুখটা অসহায় বানালো।সারপ্রাইজের কথা সে বলতে চেয়েছিলো না।ভেবেছিলো ইরাকে চমকে দেখে।
অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দে ভরিয়ে তুলবে তাকে।কিন্তু এমনভাবে জোর করলে না বলে থাকা যায়?

ইরা শাম্মির হাত ঝাকালো।বললো,

—কি হলো বলনা!

শাম্মি বললো,

—আজ ভাইয়া আসছে।

ইরা প্রায় লাফিয়ে উঠলো।

—কিহ?সত্যি?
কিভাবে?মানে উনি তো বাড়ি ফিরবেননা বলেছিলেন?

—হ্যাঁ বলেছিলো।কিন্তু আমরাও তো কম যাইনা।
ফোন করে বলেছি তুই খুউউব অসুস্থ।
তোর অসুস্থের কথা শুনেই ব্যাগ্র হয়ে বললো সে আসছে।আজই আসছে।
আর কয়েকঘন্টা লাগতে পারে হয়তো।

ইরা খুশিতে শাম্মিকে জড়িয়ে ধরলো।
বললো,

—থ্যাংকস্ এ লট শাম্মি।
তুই আমার কতো বড় একটা উপকার করলি তুই নিজেও জানিস না।
থ্যাংকিউ সো মাচ্।

শাম্মি ও জড়িয়ে ধরলো খুশিতে।এতোদিন পর তার মনটা হালকা লাগছে খুব।

💮💮

শাম্মি চলে যেতেই ইরা কষ্ট করে উঠে দাড়ালো।খুশিতে শরীরেও যেনো শক্তি ফিরে এসেছে তার।ধীরপায়ে হেটে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো।
কাবার্ড খুলে একটা কালো রংয়ের শাড়ি বের করলো।
শৌখিন মেয়েদের শাড়ি পরা পছন্দ করে।
ইরাও আজ শাড়ি পরবে।
শৌখিনের রাগ ভাঙাতে হবে যে।
শাড়ি পরে খাটে বসে ফলের ট্রে হাতে তুলে নিলো।
একটু খেয়েই আর খেতে পারলোনা।শাম্মি এতোবেশি ফল এনেছে যে এতো খেতে ইরার সপ্তাহ পেরিয়ে যাবে।ইরা একটু খেয়ে বাকীটা পাশের সেন্টার টেবিলের উপর রাখলো।
আবার হেটে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ালো।
আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেরই খারাপ লাগলো ইরার।সে নিজের যত্ন এখন একেবারেই নেয়না।
চিন্তায় চিন্তায় চোখের নিচে কালির রেখাও দেখা যাচ্ছে।
ইরা কি এই অবস্থায় শৌখিনের সামনে যাবে?উহু।কখনোই না।
সে ঠিকমতো চুল আচড়ে চোখে কাজল টানলো।
কপালে ছোট্ট কালো টিপ পরে নিলো।
আর সাজার সময় পেলোনা সে।
দরজায় করাঘাতের শব্দে ইরার বুকের ধুকপুকানি আরও বেড়ে গেলো যেনো।
সে শাড়ির আঁচল খামচে দম খিচে দাড়িয়ে রইলো।
শুধু মনে হলো,এখন শৌখিন আসলে সে কি বলবে?কি দিয়ে বলা শুরু করবে?
কিভাবে ক্ষমা চাইবে?
শৌখিন ক্ষমা করবে তো?
ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে কেউ ভেতরে প্রবেশ করলো।
ইরার উৎফুল্ল চোখ সেদিকে দৃষ্টি ফেলতেই মুখে হতাশা নামলো তার।
শৌখিন আসেনি,এসেছে রেহেনা বেগম।
ইরার দিকে তাকিয়ে তিনি মুচকি হাসলেন।
ইরা সেদিকে লক্ষ করে নিজের দিকে তাকালো এবং সাথে সাথে লজ্জায় নুয়ে পরলো।
সে আজ শাড়ি পরেছে,সেজেওছে খানিকটা।
এই সাজ তো শৌখিনের জন্যই।
কিন্তু রেহেনা বেগম দেখে কি ভাবলেন?
ইরা লজ্জায় গুটিশুটি মেরে দাড়িয়ে রইলো।
রেহেনা বেগম এগিয়ে এসে ইরার মাথায় হাত বুলালেন।
টেনে খাটে এনে বসালেন।নিজেও পাশে বসলেন।
বেশকিছুক্ষন চুপ করে রইলেন।
তিনি বলার মতো কথা খুজে পাচ্ছেন না।একটা ভুল শোধরাতে গিয়ে তিনি আরেকটা ভুল করে ফেলেছিলেন।ভাগ্যিস সেদিন শৌখিনটা সই করেনি।নয়তো কি হতো?
তিনি ইরার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,

—তোর ফুপু আবারও ভুল করে ফেলেছে ইরা,তাকে ক্ষমা করে দিস।

ইরা হাতটা শক্ত করলো।বললো,

—এভাবে কেনো বলছো ফুপু,তুমি আমাদের ভালো চেয়েছো,খারাপ তো চাওনি।

—ভালো চাইতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছি যে?

—এখন নাহয় শুধরে নাও।

রেহেনা বেগম মুচকি হাসলেন।ইরার থুতনিতে হাত রেখে বললেন,

—তোকে আজ খুব মিষ্টি দেখাচ্ছে ইরা।একদম মায়ায় মোড়ানো পরীর মতো লাগছে।
আমার ছেলেটাকে তোর মায়ায় আটকে রাখতে পারবিনা?আমার সংসারে সুখ ঢেলে দিতে পারবিনা?

ইরা মাথা নিচু করে মিষ্টি হেসে বললো,

—আমি আমার সর্বাত্বক চেষ্টা করবো।

এমন সময় দরজায় বেল বেজে উঠলো।
রেহেনা বেগম উঠে দাড়ালেন,
বললেন,

—শৌখিন এলো বোধ হয়।

কথাটা বলে তিনি আর দাড়ালেন না।রুম থেকে বেরিয়ে পরলেন।
ইরাও বসা থেকে দাড়িয়ে পরলো।
তার হঠাৎ হাত পা কাপছে খুব।
গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।
এমন লাগছে কেনো কে জানে?অতিরিক্ত উত্তেজনায় নাকি?
তাহলে শৌখিনের সামনে দাড়ালে কি হবে?

,

,

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here