পরিত্রাণ পর্ব ১০

#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১০

মানুষ যখন কোন সম্পর্ক থেকে পরিত্রাণ পেতে চায় তখন পরিবার এবং তথাকথিত সমাজিক ভয়ভীতি, তার সব পথ বন্ধ করে দেয়। আবার যখন সেই মানুষটাই নিজেকে সামলে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চায় তখন পুরো সমাজ মিলে তাকে কোণঠাসা করে রাখতে ষড়যন্ত্র রচনা করতে শুরু করে দেয়। রুমুর ক্ষেত্রেও তাই। সে যখন নিজেকে অনিকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলো তখন পিতার অনুরোধ, সমাজের ভয়ে তাকে বাধ্য করেছিলো অনিকের কাছে ফিরে যেতে। নতুন করে শুরুর করার চেষ্টা করতে! আবার ফিরে এসে সে যখন সবকিছু ঠিক করতে চাইছে তখন সবাই মিলে উঠেপড়ে লেগেছে অনিকের সাথে তাঁর সম্পর্কটা ভাঙ্গার জন্য! বিশেষ করে তার বাবা আফিস ইকবাল। তাঁর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত সবাই ছিঃছিঃ করছেন তাঁকে। সবার মুখে শুধু একটাই কথা, বাবা হয়ে তিনি কি করে নিজের মেয়েকে একটা চরিত্রহীন ছেলের সাথে বিয়ে দিলেন? নিজের মেয়ের এতবড় সর্বনাশ তিনি করলেন কি করে!
নিজের চারপাশে কিছু সুশীল সমাজ এবং পারিপার্শ্বিকতার চাপে আসিফ ইকবালের মন মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। মেয়ের প্রতি করা অন্যায়ের আত্মগ্লানিতে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছিলেন তিনি। ভুলটাকে শুধরাতে হঠাৎ করেই রুমুকে বোঝাতে শুরু করলেন, এখনই উপযুক্ত সময়, রুমু চাইলেই নিজের জীবনটা ঠিকভাবে গুছিয়ে নিতে পারে! ইউসুফ চৌধুরীর বলার মত কোন মুখ নেই। অনিক নিজেই সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছে! তাই রুমু চাইলেই সব ঠিক করতে পারে। এবার আসিফ ইকবাল তার সঙ্গে থাকবেন। কোনমতেই মেয়েকে আর একা ছাঁড়বেন না তিনি। কিন্তু রুমু এসব শুনতে নারাজ! বাবার কথার জবাবে সে জানপ্রাণ দিয়ে আসিফ ইকবালকে বোঝাতে চেষ্টা করলো অনিক মোটেও খারাপ ছেলে নয়। ওর ভেতরে শুধু একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স কাজ করছে। যার ফলে ও নিজেকে ভীষন ছোট ভাবে, কারো সাথে ঠিকভাবে মিশতে পারে না। আসিফ ইকবাল তবুও বারবার করে রুমুকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন অনিকের চরিত্রের দোষ আছে। এমন ছেলে কোনমতেই রুমুর উপযুক্ত হতে পারে না। শুনে রুমু উল্টো ক্ষেপে গেলো। জীবনে প্রথমবারের মত বাবার মুখের ওপর গলা চড়িয়ে কথা বললো সে। বাবার কথার জবাবে গম্ভীর গলায় বললো,’তুমি নিজে আমাকে জোর করে অনিকের কাছে পাঠিয়েছিলে। ওকে ঠিক করার দায়িত্ব নিতে বলেছিলে। একবার অন্তত চেষ্টা করে দেখতে বলেছিলে? প্রয়োজনে কঠোর হতে বলেছিলে, মোমের মত গলে যেতে বলেছিলে। আমি তাই করেছি! অনিককে অনেক অপমান করেছি আমি। অনেক হয়েছে মান অপমানের খেলা! কিন্তু এবার তোমার মেয়ে মোমের মত গলে গিয়েছে বাবা। ফিরে আসার কোন পথ নেই। তাই দয়া করে আর কখনো এসব কথা আমাকে বলো না তুমি। আমার শ্বশুরমশাই কিংবা অনিকের সাথেও এইব্যপারে কোন আলোচনার দরকার নেই। আমি চাই না এসব কথা তাঁদের কানে যাক! তাঁরা শুনলে ভীষণ কষ্ট পাবে! বিশেষ করে আমার শ্বশুরমশাই! এমনিতেই অনিকের ব্যপারে খুব টেনশনে আছেন তিনি। নতুন করে আর কোন ঝামেলার দরকার নেই!

চূড়ান্ত হতাশ হলেন আসিফ ইকবাল! এত করে বোঝানোর পরেও মেয়ে তাঁর সিদ্ধান্তে অটল! শেষমেশ বাধ্য হয়ে রুমু অগোচরে অনিকের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন! তিনি শতভাগ নিশ্চিত এই ব্যপারে অনিক কোনরকম আপত্তি করবে না। করবে কি করে? মাতালটা তো সারাদিনই মদ নিয়েই পড়ে থাকে। আর করলেই বা কি? আসিফ ইকবাল এসবের কেয়ার করেন নাকি? নেহায়েত ইউসুফ চৌধুরী তাঁর বন্ধু, বিপদের সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাই এতদিন মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছেন। নিজে রুমুকে বলেছিলেন অনিকের দায়িত্ব নিতে। কিন্তু এখন সব শেষ! যেই ছেলে অন্য মেয়ের সাথে…ছিঃছিঃ! যদিও রুমু বেশ কয়েকবার আসিফ ইকবালকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো ছবিতে অনিকের সাথে যে মেয়েটাকে দেখানো হয়েছে সে একটা বিদেশি মেয়ে! অনিকের সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই, কিন্তু আসিফ ইকবাল বিশ্বাস করলেন না। তাঁর ধারণা বাবা কষ্ট পাবে ভেবে রুমু তাঁকে মিথ্যে বলছে! তাই তিনি এবার ফাইনাল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।অনেক হয়েছে আর না! আর সুযোগ দেওয়া যায় না অনিককে। বন্ধুত্ব, ঋণ শোধ, সমাজের ভয় সব কিছুর মাঝখানে তিনি ভুলেই গেছিলেন তিনি একজন বাবা। মেয়ের প্রতিও তাঁর কিছু দায়িত্ব আছে?

অনেক্ষন যাবত রিং হচ্ছে কিন্তু অনিক ফোন ধরছে না। ফোনটা আননোন নাম্বার থেকে এসেছে। প্রথম তিনবার রিং হয়ে কেটে গেলো। চতুর্থ বারের সময় বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো অনিক। আননোন নাম্বার যেহেতু জরুরী কলও হতে পারে। সালাম দিয়ে ওপাশের মানুষটার পরিচয় জানতে চাইলো সে।

ফোন রিসিভ হতেই আসিফ ইকবালের ভরাট কন্ঠস্বর শোনা গেলো,’হ্যালো। আমি আসিফ ইকবাল বলছি, রুমুর বাবা!’

নিমিষেই মুডটা খারাপ হয়ে গেলো অনিকের। এই লোকটাকে একদম সহ্য করতে পারে না সে। হিটলার টাইপের মানুষ! কথায় কথায় অনিকের খুঁত বের করার চেষ্টা করে! এখন আবার কি ভজন শোনাবে কে জানে! তথাপি নিজের সমস্ত বিরক্তি চেপে পুনরায় সালাম দিলো সে। বিনয়ী গলায় বললো,’জি, মি.আসিফ ইকবাল বলুন! কেমন আছেন আপনি?’

আসিফ ইকবাল ‘থ’। অনিক তাঁকে নাম ধরে ডেকেছে ? এ-কি কলিযুগ এলো! জামাই শ্বশুরের নাম ধরে ডাকে? এই ছেলের তো কোন ক্লাসই নেই! হায়হায় নিজের মেয়ের এতবড় সর্বনাশ কি করে করলেন তিনি! রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,’আমার ভালো থাকা দিয়ে তুমি কি করবে, বেয়াদব ছেলে! তোমাকে যেই জন্য ফোন করেছি তার উত্তর দাও!’

-‘জি বলুন।’

-‘বলার জন্যই তো ফোন করেছি। তোমার ভাগ্য ভালো তুমি আমার সামনে নেই। থাকলে ঠাস করে তোমার গালে চড় বসিয়ে দিতাম আমি।’

অনিক জবাব দিলো না। ফোনটা কেটে দিতে মন চাইছে তাঁর! বসে বসে এই লোকটার ঝাড়ি খাওয়ার কোন ইচ্ছে তাঁর নেই! কিন্তু তাতে আসিফ ইকবাল আরো ক্ষেপে যেতে পারেন। তাই বাধ্য হয়ে শুনে গেলো সে। আসিফ ইকবাল আবারো ধমকে উঠে বললেন,’তুমি কি অফিসে আছো? নাকি মদের আড্ডাখানায়?’

অনিক লজ্জিত কন্ঠে বললো,’জি, আমি অফিসেই আছি!’

-‘তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।’

-‘জি বলুন, আমি শুনছি।’

আসিফ ইকবাল গলা পরিষ্কার করে নিলেন। লম্বা দম নিয়ে শুরু করলেন,’আমি জানতে চাইছি এত ঘটনা ঘটানোর পরেও কোন মুখে তোমরা আমার মেয়েটাকে কেন আটকে রেখেছো? তোমার জন্য তো আমি কোনজায়গায় মুখ দেখাতে পারছি না। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবার কাছে ছোট হয়ে আছি। এরপরেও তোমার শান্তি হয় নি? আমাকে মেয়েটাকে কি অন্তত রেহাই দাও?’

অনিক দ্বিধায় পড়ে গেলো। নতুন করে কি আবার কিছু ঘটেছে? নাকি পুরোনো ঘটনার জের ধরেই আসিফ ইকবাল তার ওপর এমন ক্ষেপে আছেন? শান্ত কন্ঠে বললো,’আপনি দয়া করে একটু শান্ত হোন প্লিজ! আমি কি আবার কোন ভুল করেছি? কিছু কি হয়েছে?’

-‘কি হয়েছে তুমি জানো না? অবশ্য জানবে কি করে সারাদিন মদের বোতল নিয়ে পড়ে থাকলে তো জানার কথা নয়। টিভিতে, নিউজপেপারে যে তোমার কাণ্ডকারখানা নিয়ে ছবি ছাপা হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই জানো? নাকি তাও জানো না?’

অনিক নিরুত্তর রইলো। আসিফ ইকবাল থেমে রইলেন না। ক্রমাগত বলে গেলেন,’কি হলো কথা বলছো না কেন? না জানলে আমাকে বলো,তোমার অফিসে খবরের কাগজ পার্সেল করে পাঠাচ্ছি। পাঠাবো?’

-‘জি জানি।’

-‘জানোই যখন, তখন তুমি ভাবলে কি করে তোমার মত একটা মদখোর মাতাল, চরিত্রহীন কাছে আমি আমার মেয়েকে ফেলে রাখবো?’

-‘আমি তো এখন আর মদ খাই না!’

-‘না খেলে এসব কুকীর্তি ঘটালে কি করে? টিভি নিউজপেপারে ছবি কি হাওয়া থেকে উঠে এসেছে? লজ্জা করে না তোমার সাফাই দিতে? তোমার কোন মানসম্মান না থাকতে পারে আমার মেয়ের তো মানসম্মান আছে?
অতঃপর অনিককে কোনরকমের প্রতিউত্তর করার সুযোগ না দিয়ে একনাগাড়ে তাঁকে কথা শুনিয়ে গেলেন আসিফ ইকবাল!

এই পরিস্থিতিটা যে একজন বাবার জন্য কতটা লজ্জাজনক তা অনিক জানে! গণমাধ্যমে যেসব অশ্লীল কথাবার্তা ছড়ানো হয়েছে, তাতে আসিফ ইকবালের মাথা গরম হওয়াটাই স্বাভাবিক! নিঃসন্দেহে তাঁর রাগ অমূলক নয়! পিতা হিসেবে মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাঁর চিন্তা হতেই পারে! যদিও একটু বেশিই খেপে আছেন। তথাপি অনিক প্রতিউত্তর করলো না। ধৈর্যসহকারে ফোন কানে রেখে নিরবে আসিফ ইকবালের করা অপমানগুলো হজম গেলো সে। তাঁর মনে হচ্ছে ফোনের ওপাশ থেকে আসিফ ইকবাল ভূমিকম্প ঘটিয়ে ফেলছেন। ফুলস্টপ, দাঁড়ি, কমা সব বাদ দিয়ে একের পর এক বাক্যবিস্ফোরণ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অনিক শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে গেছে কিন্তু তিনি বলে বলেও হাঁপান নি। এতদিনে অনিক বুঝতে পারছে রুমু এত এনার্জি পায় কোথা থেকে! হিটলার বাপের গুন কিছুটা মেয়েও পেয়েছে!

-‘কি হলো কথা বন্ধ কেন? লজ্জা লাগছে? ঘটানোর সময় লজ্জা লাগে নি? আমার মেয়েকে ফেলনা পেয়েছো? তুমি কি ভেবেছো তোমার এসব বদমাইশি সহ্য করার জন্য আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি? কক্ষনো না! ভেবেছিলাম তুমি ঠিক হবে কিন্তু না আমার ধারণা ভুল ছিলো। রুমুকে জোর করে তোমার কাছে পাঠানো ছিলো বাবা হিসেবে আমার নেওয়া সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত! আজই উকিলের সাথে ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা করছি আমি! আমিও দেখবো কতদিন তোমরা আমার মেয়েকে আটকে রাখতে পারো?

অনিক একফোঁটাও জবাব দিলো না। ঝিম মেরে শুনে রইলো সব। ভেবেছিলো রাগ ঝাড়তে পারলে আসিফ ইকবাল কিছুটা শান্ত হবে। কিন্তু না! তাঁর সাড়াশব্দ না পেয়ে আসিফ ইকবাল আবারো সরোষে চেঁচিয়ে উঠে বললেন,’এই ছেলে কথা বলছো না কেন? ভালোয় ভালোই বলছি, আমার মেয়েকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। নইলে আমি তোমাদের নামে জালিয়াতির মামলা করবো!’

এবার অনিক মুচকি হাসলো! ফোনটা তার পাশে শুয়ে থাকা রুমুর কানে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’এই ধরো, তোমার বাবা! আমাকে হুমকি দিচ্ছেন তোমাকে ডিভোর্স না দিলে নাকি তিনি আমার নামে মামলা করবেন! কথা বলো!’

আসিফ ইকবাল হতভম্ভ! রুমু? রুমু কি করে এলো? অনিক তো বলেছিলো সে অফিসে? একি বাঁদর ছেলে! রুমুর সামনে এভাবে ফাঁসিয়ে দিলো তাঁকে। রাগে ক্ষোভে বাক্যহারা হয়ে গেলেন তিনি। ফোন কানে নিয়ে রুমু মিথ্যে শাসনের ঢংয়ে অনিককে চোখ পাকালো। অনিক মিটিমিটি হাসছে! আচ্ছা জব্দ হয়েছে বুড়োটা! আসিফ ইকবালের গলা শুনে সে প্রথমেই বুঝে গিয়েছিলো ভদ্রলোক নিশ্চই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর কাছে ফোন করেছে। এবং ধরেই নিয়েছিলো উদ্দেশ্য যাইহোক না কেন অনিক একা আছে শুনলে কোনমতেই অনিকের ঝাড়ার সুযোগ হাতছাড়া করবেন না তিনি। হলোও তাই, অনিক অফিসে আছে শুনে আসিফ ইকবাল এতদিনের চেপে রাখা সমস্ত রাগ ঝেড়ে দিয়েছেন। অনিকও তাই সুযোগ বুঝে ফাঁসিয়ে দিয়েছে তাঁকে। রুমু হাসি চেপে রেখে বললো,’হ্যালো বাবা? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?’

রুমুর গলা শুনে আসিফ ইকবাল থতমত খেয়ে গেলেন। তারমানে সত্যিই অনিক অফিসে নেই! মিথ্যে বলেছিলো তাঁকে! মেয়ের প্রশ্নের জবাবে গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু ভেতরের রাগ কোনভাবেই চেপে রাখতে পারলেন না। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,’শুনছি আমি। তুমি শুনেছো তো? তোমার অসভ্য, মাতাল স্বামী আমাকে নাম ধরে ডাকছে ! নিজের শ্বশুরকে পর্যন্ত নাম ধরে ডাকছে সে। এরপরেও তোমার মনে হয় এই ছেলে শোধরাবে?

রুমু জবাব দিলো না। কি বলবে সে? ভাগ্যিস আসিফ ইকবাল জানেন না অনিক নিজের বাবাকে নাম ধরে ডাকে।জানতে নিশ্চয়ই ভয়ানক ক্ষেপে যেতেন তিনি। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে মিষ্টি হেসে বললো,’সেসব বাদ দাও। আগে বলো,কেমন আছো তুমি?’

-‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’

-‘আমি ভালো আছি। মা কেমন আছে?’

-‘তোমারও মাও ভালো আছেন।’

-‘অনিক বলছিলো তুমি নাকি ওকে কি বলছিলে? মামলা না কি যেন?’

মনে মনে অনিকের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে আসিফ ইকবাল বললেন ,’ওসব কিছু না এমনি তোমাদের খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোন করেছি!’
বাবার নরম গলা শুনে নিঃশব্দে হেসে ফেললো রুমু। বললো,’কথা বলবে ওর সঙ্গে?’

আসিফ ইকবাল সঙ্গে সঙ্গে বারণ করে দিয়ে বললেন,’এখন থাক। আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি!’

-‘ঠিক আছে তাহলে রাখি বাবা?’

রুমু ফোন রেখে দিচ্ছিল। আসিফ ইকবালের থামিয়ে দিলেন,’শোনো?’

-‘হ্যাঁ কিছু বলবে?’

-‘তুমি ঐ বাড়িতে থাকছো ঠিক আছে। আমি মানছি! কিন্তু বাবার একটা উপদেশ মাথায় রেখো, ঐ ছেলের কাছ থেকে সাবধানে থেকো মা। হি ইজ ভেরি ডেঞ্জারাস! ওকে একদম বিশ্বাস করো না! কথাগুলো তোমার ভালোর জন্যই বলেছি। হ্যাঁ একসময় আমি নিজেই তোমাকে বলেছিলাম সম্পর্কটা ঠিক করার চেষ্টা করতে কিন্তু তাই বলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে বলি নি। সে যা করেছে তার পরে ওকে আর কিছুতেই আমি ক্ষমা করা যায় না।অন্তত আমি ক্ষমা করবো না। আর যাই হোক আমার মেয়ে একটা চরিত্রহীন, মাতালের জন্যে নিজের জীবনটা শেষ করে দেবে এইটা আমি সহ্য করতে পারবো না। বাবা হিসেবে নিশ্চয়ই আমি আমার মেয়ের খারাপ চাইতে পারি না! আশাকরি তুমি আমার কতগুলো বুঝবে তুমি। তাই কখনো যদি তোমার মনে হয়, তুমি সিদ্ধান্ত বদলাবে তাহলে একবার শুধু বাবাকে বলো। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো। একবার যেই ভুল আমি করেছি দ্বিতীয়বার আর সেই ভুল হবে না!


রুমু ফোন রাখতেই অনিক হেসে উঠে বললো,’ভদ্রলোক বোধহয় ভয়ানক খেপে আছেন আমার ওপর। তাই না?’

বাবার কথাগুলো খুব খারাপ লেগেছে রুমু। বাবা ভালো নেই! রুমুর জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। কিন্তু রুমু কি করতে পারে?
বাবা যদি অনিককে ভুল বুঝে রুমুর ওপর কোন ভুল সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায় তাহলে সেই ক্ষেত্রে রুমুর কি করণীয়? তবে সিদ্ধান্তটা যদি একা রুমুকে নিয়ে হতো তাহলে রুমু নিঃসন্দেহে বাবার আদেশ মাথা পেতে গ্রহণ করতো। কিন্তু বাবার সিদ্ধান্তের সাথে যে অনিকও জড়িয়ে আছে! অনিককে কি করে ছাড়বে সে! মনটা খারাপ হয়ে গেলো রুমুর! অনিকের কথার জবাবে কড়া মেজাজে চেঁচিয়ে উঠে বললো,’ভদ্রলোক, ভদ্রলোক আবার কি? বাবা বলতে পারো না? আমার বাবাকে বাবা বললে তোমার গায়ে ফস্কা পড়বে? কোন সাহসে তুমি আমার সামনে আমার বাবাকে নাম ধরে ডাকো! ছোটলোক কোথাকার!

নিমিষেই অনিকের হাসিহাসি মুখটা চুপসে গেলো। বিষণ্ণতার কালো ছায়া নামলো শান্ত সুন্দর চোখজোড়ায়! হতবাক হয়ে বলল,’এভাবে কথা বলছো কেন তুমি? কি হয়েছে তোমার?’

-‘কিভাবে কথা বলবো? ছোটলোককে ছোটলোক বলবো না তো কি বলবো? দুনিয়ার কোন মেয়ের জামাই তার শ্বশুরকে নাম ধরে ডাকে? তাও আবার মুখের ওপর? আমার বাবার কোন সম্মান নেই? তোমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে কি তিনি পচে গেছেন?’

অনিক জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে মলিন মুখে বসে রইলো। এদিকে রুমু কোনভাবেই আত্মসংবরণ করতে পারছে না। পুনরায় ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,’বাবা কতটা কষ্ট পেয়েছেন তুমি জানো? তোমার জন্য আমাকে কতগুলো কথা শুনতে হয়েছে তার হিসেবে রাখো তুমি?’

অনিককে এবারেও চুপ করে থাকতে দেখে রাগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলো রুমু। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে তাঁর! অনিক এমন কেন? কিন্তু দরজার কাছে যেতেই সঙ্গেসঙ্গে হাত চেপে ধরলো অনিক। জোর করে টেনে ওকে খাটের ওপর বসিয়ে নিজে ওর সামনে হাটুমুড়ে বসলো। রুমুর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনুতপ্ত কণ্ঠে বললো,’আমাকে রেখে কেন বেরিয়ে যাচ্ছো তুমি?’

রুমু রাগে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’আমার হাত ছাড়ো, তোমার সাথে একঘরে আমি থাকবো না। যার কাছে আমার ইমোশনের কোন মূল্য নেই তার কাছে আমি থাকবো না।’ অনিক ছাড়লো না। স্থিরদৃষ্টিতে রুমুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে! তার চোখে সীমাহীন বিস্ময়, হতাশা, বিষন্নতা! রুমু কি তবে বদলে গেছে? অনিক যতদিন রুমু কাছে ধরা দেয় নি ততদিন তো রুমু ছুটে এসেছিলো অনিকের কাছে। ভালোবাসার দাবি জানিয়েছিলো, অধিকারবোধ দেখিয়েছিলো! তবে আজ কেন রুমু তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে? তবে কি রুমু অনিককে ভালোবাসে নি? যদি বেসেও থাকে তবে এ কেমন ভালোবাসা? নিজের ওপর করুণা হচ্ছে অনিকের! সবাই কেন তাঁকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’আই অ্যাম সরি! আমি জানি আমার জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে তোমাকে, নানান লোকের নানান অপমান সহ্য করতে হয়েছে। অনেক সহ্য করেছো তুমি! সহ্য করতে করতে হয়ত বিরক্ত হয়ে গেছো! তাই কথাগুলো বলছো। কিন্তু বিশ্বাস করো, জীবনে এই প্রথমবারের মত আমি কারো জন্য অপমান সহ্য করেছি! তোমার বাবা কিন্তু আমাকে কম অপমান করেন নি! অনেক অপমান করেছেন। হয়তবা এরচেয়ে বেশি অপমানের যোগ্য আমি কিন্তু তাই বলে কোনদিন কারো অপমান মাথানিচু করে সহ্য করি নি। দোষের পাল্লা যতই ভারী থাকুক না কেন অপমানের পালটা জবাব দিয়েছি। ইউসুফ চৌধুরী কখনো কারো কাছে আমার মাথা নত হতে দেন নি! কিন্তু আজকে শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি সব অপমান মুখ বুঝে সহ্য করেছি রুমু! আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার কি হয়েছে? আমি তো এমন ছিলাম না! আমি কি করে এতটা বদলে গেলাম! তুমি আমার কি করে দিয়েছো বলোতো? হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান টু মি?
ইজ ইট রিয়েলি লাভ? ইফ ইট ইজ..দ্যান আই হেইট দিজ কাইন্ড অফ লাভ! যেই ভালোবাসা আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে সেই ভালোবাসাকে আমি ঘৃণা করি! কিন্তু তোমাকে আমি বড্ড ভালোবাসি রুমু! তুমি চলে গেলে আমি থাকতে পারবো না!’

বাধভাঙ্গা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে রুমুর চোখ দিয়ে! একটা মানুষ ভেতর থেকে কতটা অসহায় হলে এমনভাবে আকুতি করতে পারে! সেই অসহায় মানুষটাকে নতুন করে আবার কষ্ট দিয়েছে রুমু!
তাঁর হৃদয়টাকে শীতল থেকে শীতলতম করে দিয়েছে অনিকের সহজ,সরল স্বীকারোক্তি! দুহাতের অনিকের মাথাটা টেনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বললো,’আমার ভুল হয়েছে গেছে অনিক। খুব ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। বাবা তোমার নামে খুব খারাপ কথা বলছিলো তাই মেজাজ সামলাতে পারি নি! সরি! আর কক্ষনো এমন হবে না।’ রুমুর হাতের ওপর হাত রেখে চুপ করে রইলো অনিক! রুমু তাঁর দুগালে হাত রেখে কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বললো,’আর কখনো তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবো না, তোমার ওপর রাগ করবো না! আই প্রমিস!’
এবার অনিক দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে মিষ্টি হেসে বললো,’তুমি আমার ওপর রাগ করলে আমার কষ্ট হয় না রুমু। কিন্তু তুমি আমাকে ঘৃণা করলে আমার অনেক কষ্ট হয়! নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।আমি আর নিজেকে ছোট মনে করতে চাই না।’ রুমু তাঁকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। কান্নারত কন্ঠেই বললো,’এসব কি বলছো তুমি? আমি কেন তোমাকে ঘৃণা করতে যাবো! আমি তোমাকে কক্ষনো ঘৃণা করতেই পারি না। তোমার মা, বাবা, তোমার অতীত, পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। আমার যাবতীয় মাথাব্যথা শুধু তোমাকে নিয়ে, আমার মানুষটাকে নিয়ে! তোমার বর্তমান নিয়ে! রুমুর কোলে মাথা রেখে ক্লান্তির শ্বাস ফেললো অনিক। তার চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি! নাহ! ভালোবাসা সত্যিই মধুর!
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here