পরিত্রাণ পর্ব ১১

#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১১

অফিসের বাকি কাজগুলো বাসায় সেরে ফেলবে ভেবে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে অনিক। রাতের খাবার শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো জরুরী কাজগুলো সেরে ফেলার জন্য। হাতের কাজ গুছিয়ে রুমুও এসে ঢুকলো। অনিককে ব্যস্ত দেখে ডিস্টার্ব করলো না। বেশিকিছু তাঁকে কাজ করার সুযোগ দিয়ে বারান্দায় কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করলো সে। অনিকের কাজ ইতোমধ্যে প্রায় শেষ। রুমু রুমে এসে ফ্রেশ হতে ঢুকে গেলো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা অনিকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ডান হাতের আঙ্গুলে তুড়ি বাজিয়ে বললো,’এই যে মি. অনিক চৌধুরী? দেখুনতো কেমন লাগছে আমাকে?’

রুমুর পরনে অনিকের নাইট স্যুট। ওয়াশরুম থেকে অনিকের নাইট স্যুট পরে বেরিয়েছে সে। ঢোলা ফুলহাতা শার্ট আর ঢোলা ট্রাউজার। শার্ট অল্পের জন্য হাটু ছুঁই! ছুঁই! বোতাম লাগানোর পড়েও কাধের দিকে নেমে যাচ্ছে বারবার। রুমু তুড়ির শব্দ শুনে ল্যাপটপ থেকে চোখ তুললো অনিক! মিনিট খানেক রুমুর দিকে চেয়ে থেকে হেসে ফেললো! ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ উঁচু করে মিষ্টি হেসে বললো,’হঠাৎ আমার জামাকাপড়গুলোকে ধন্য করার মুড হলো যে?’

-‘এমনি! বলো না, কেমন লাগছে?’

আনিক দুষ্টু হেসে বললো,’বলবো? ভেবে বলছো তো?’

-‘হ্যাঁ বলছি। তুমি বলো কেমন লাগছে।

-‘ দেখো আমি কিন্তু আবারো বলছি, কাকে জিজ্ঞেস করছো সেটা ভেবে বলছো তো? মাতালদের ভাষা কিন্তু খুবই খারাপ?’

রুমু ঠিক হলিউডের নাইকাদের স্টাইলে অনিকের কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে তাঁর পায়ের ওপর বসলো। অনিক মুচকি হেসে রুমুর চুলের গোড়ায় আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে বললো,’উদ্দেশ্যটা কি বলোতো? চরিত্র হনন করবে নাকি?’

-‘করতেও পারি!’

-‘বাহ! ভালো উন্নতি হয়েছে দেখছি তোমার!’

-‘হ্যাঁ। এবার বলো কেমন লাগছে?

-‘বলেই ফেলি তাহলে, কেমন লাগছে তোমাকে?’

-‘এবার কিন্তু চুল টেনে দেবো একদম!’

রুমুর কথা শেষ হতে না হতেই অনিক তাঁর কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো! শুনতে শুনতেই লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে গেলো রুমুর। কানে হাত দিয়ে ফেললো সে! কল্পনাতীত অসভ্য কথাবার্তা বলেছে অনিক! অনিকের হাতে কিল মারতে মারতে কপট রাগের ভান করে বললো,’অসভ্য! ছোটলোক! আমি ….?’ বলতে গিয়েও লজ্জায় থেমে গেলো সে।

-‘তুমি কি?’ দুষ্টুভাবে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নটা করলো অনিক!

জবাবে রুমু আরো কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলো। মার খেয়ে অনিক আরো জোরে জোরে হাসলো। বললো,’আমার কি দোষ! আমি তো আগেই বলেছিলাম মাতালদের ভাষা ভালো নয়। তুমিই তো শুনতে চাইলে!’

-‘তাই বলে নিজের বউকে কেউ এসব বলে?’

-‘তবে কার বউকে বলবো?’

রুমু লজ্জায় ঠিকমত কথা বলতে পারছে না। অসভ্যটা কি সব শুনিয়েছে রুমুকে! আর জীবনে এসব পরবে না রুমুর! ইশস! নিজের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে তাঁর! এভাবে কেউ কারো সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে পারে এটা যেন সে স্বপ্নেও ভাবে নি। তাঁর লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে অনিক দুষ্টু হেসে বললো,’যদি তুমি অনুমতি দাও তাহলে কিন্তু অন্যের বউকেও বলতে পারি? ইফ ইউ পারমিট মি, আই ক্যান সে এনিথিং!’

-‘আচ্ছা? এই তোমার ‘আই হেইট গার্লস’ এর নমুনা?’

রুমুর খোঁচা শুনে হো হো করে হেসে ফেললো অনিম। ছোট বাচ্চাদেরকে মানানোর ভঙ্গিতে
রুমুকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,’ইউ নো হোয়াট, মিসেস অনিক চৌধুরী? খোঁচা দেওয়া আর ড্রামা করা এইদুটোর ব্যপারে ওস্তাদ আপনি! এই দিক দিয়ে আপনার সাথে কেউ পেরে উঠবে না।

রুমু হাসলো। তার কোমর চেপে ধরে রাখা অনিকের হাতের ওপর হাত রেখে বললো,’তাহলে এবার,সত্যি করে বলো আমাকে কেমন লাগছে?’

-‘বললাম তো।’

-‘না। এগুলো না। ভালোকিছু বলো।’

-‘তবে তুমি ভালো কিছু পরে এসো। আমার নাইট স্যুট পরে জিজ্ঞেস করছো কেমন লাগছে! এটা কিছু হলো? আমি যদি তোমার শাড়ি পরে এসে জিজ্ঞেস করি কেমন লাগছে, তখন তুমি কি বলবে? তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে অনিক, আমি তো চোখ ফেরাতেই পারছি না। লালশাড়িতে তোমাকে টুকটুকে পরীর মত লাগছে এসব বলবে..’ হাসির জন্য কথা শেষ করতে পারলো না অনিক।

-‘তাহলে শাড়ি পরি?’

-‘পরতে পারো। তবে ট্রান্সপারেন্ট হলে ভালো হয়। এতে একটা লাভ আছে।’

-‘কি লাভ?

-‘ কাল সকালে দেখবে নিউজ বেরিয়েছে তোমার নামে,” অনিক চৌধুরীর পর এবার নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়লেন তার স্ত্রী রোমানা চৌধুরী! বিশ্বস্ত মাধ্যম থেকে জানা গেছে গতকাল রাত বারোটার দিকে নিজ বাসভবনে স্বচ্ছ শাড়ি পরে বরের সামনে হাজির হয়েছিলেন তিনি। দেশের জনগণ তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে তার এই কর্মকান্ডের প্রতি! আমরা এই দম্পতির যথাযথ শাস্তি চাই!’

রুমু রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো। অনিক হাসলো না। গম্ভীর থাকার ভান করে বললো,’তো এখন কি সিদ্ধান্ত নিলে শাড়ি কি পরবে?’

-‘না পরবো না। কিচ্ছু পরবো না। আমি জানি শাড়ি পরলেও তুমি অসভ্য কথাবার্তা বলবে।’

-‘কিচ্ছু পরবে না? গুড! ভেরি গুড! কিচ্ছু না পরলে তো আরো ভালো। নেহায়েত আমি ভদ্র বলে শাড়ি পরতে বলেছিলাম তোমার যদি অন্য খেয়াল থাকে দ্যান আই ডোন্ট মাইন্ড!’

রুমু উঠে গেলো বাতি বাতি নিভাতে। ডিম লাইটা অন করে বাতি নিভিয়ে দিয়ে বললো,’কথাবার্তার কি শ্রী! সাধে কি আর তোমাকে ছোটলোক বলি? আমি কখন বললাম আমি কিছু পরবো না? বলেছি শাড়ি পরবো না।’

-‘শাড়ি না পরলে কি পরবে? পার্মানেন্টলি আমার জামাকাপড় পড়ার প্ল্যান করছো নাকি? তবে আমি কি পরবো? তোমার শাড়ি?’

এবারেও রুমু না হেসে পারলো না। চোখ পাকিয়ে বললো,’তোমাকে শাড়ি না। আমার ব্লাউজ আর পেটিকোট পরিয়ে ঘোরাবো। ওগুলো পরে বেলি ডান্স করবে তুমি!’

অনিক হাসিমুখে বললো,’বলেছিলাম না মাতালের যোগ্য বউ তুমি? দেখলে অল্প কয়েকদিনেই তোমার কথাবার্তা কেমন আমার লেভেলে চলে এসেছে! আর কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলে আমি আশাবাদী, মদ খাওয়াটাও শিখিয়ে নিতে পারবো তোমাকে। ওয়েল ডান অনিক! ভেরি ওয়েল ডান!’

কথা শেষ করেই খাটের ওপর পা টানটান করে শুয়ে পড়লো অনিক। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভানও ধরে ফেললো। সে জানে কথাটা সে মজা করে বললেও এইমুহূর্তে ভাষণ দিয়ে তার কান ঝালাপালা করে দেবে রুমু! তাই চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো।

কিছুই করলো না রুমু। চুপচাপ অনিকের পাশে শুয়ে খানিকটা রাগের সুরে বললো,’নিজের জানটা মাটি করে ফেলছি তাকে খুশি করতে তারপরেও মদের নাম তাঁর মুখে থাকবেই। এমন কপাল আমার!’

নাহ! আজকে বোঝা যাচ্ছে বাক্যবিস্ফোরণ হবে না! এটা তো আদুরে বকুনি! মুচকি হেসে দুজনের গায়ের ওপর কাথা টেনে দিয়ে রুমুর গায়ের ওপর হাত পা তুলে দিলো অনিক। রুমু সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,’ধরবে না আমাকে তুমি।মদখোর, মাতাল, একটা! ‘
অনিক ছাড়লো না। রাগ ভাঙ্গানোর অযুহাতে আলতো করে রুমুর গালটা টেনে দিয়ে বলল,’মদখোর, মাতাল যাই বলো না কেন মদের চাইতে কিন্তু তোমার নেশা বেশি শক্তিশালী! মদ মানুষকে মাতাল করে দেয়। বাট ইউ হ্যাভ মেইড মি মোর ইনটক্সিকেটেড দ্যান অ্যালকোহল! তুমি আমাকে মদের চাইতে বেশি নেশাগ্রস্ত করে দিয়েছো।’
মুখটিপে হাসলো রুমু! ভদ্রমাতালটা লাইনে এবার লাইনে এসেছে! তথাপি কাঠ হয়ে শুয়ে রইলো। অনিক ফিসফিস করে বলল,’আরেকটু কাছে আসো না।’ অতঃপর রুমুর আসার অপেক্ষা না করে সে নিজেই দুহাতে কাছে টেনে নিলো রুমুকে। রুমুও দুহাতের আঁকড়ে ধরে গভীর ভালোবাসায় চুমু খেলো তাঁর কপালে। লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললো,’আরো কাছে আসতে চাই! খুব কাছে!’ হাসলো অনিক! আরো কাছে টেনে নিলো রুমুকে! খুব কাছে!…


সপ্তাখানেক পরের ঘটনা অফিসে থেকে বাসায় ফিরলো অনিক। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বসার ঘরে সতেরো আঠারো বছরের এক সুন্দরী তরুনী দেখতে পেলো সিঁড়ি বেয়ে উপরের উঠার সময় মেয়েটার দিকে একনজর চোখ পড়লো তাঁর। অসম্ভব সুন্দরী! বিশেষ করে তাঁর চোখদুটি! টানাটানা কাজল কালো চোখে কোথায় যেন বিষন্নতার ছাপ! চোখ নামিয়ে ব্যস্তভাবে উপরে উঠে গেলো অনিক! রুমু মেয়েটার সাথে গল্প করছিলো, অনিককে দেখে উপরে যেতে পেছন পেছন সেও ছুটে গেলো।

রুমে ঢুকে টাইয়ের নট খুলছিলো অনিক। দরজায় দাঁড়ানো রুমুকে দেখে মিষ্টি হেসে বললো,’যাক, এসেছো তাহলে? আমি তো ভাবলাম মেহমান রেখে আসার সময়ই হবে না তোমার!’

রুমু দরজা থেকে সরে কাছে এগিয়ে গেলো অনিকের। দুহাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,’কবে এমন হয়েছে?’
অনিক কপালে কপাল ঠেকিয়ে আলতো করে রুমুর কপালে বাড়ি দিলো। বললো,’হয় নি। হতেও তো পারে। তাই আগে থেকে সাবধান করে দিলাম! মেয়েটাকে কে?’

-‘আরিয়া!’

-‘আরিয়া? কোন আরিয়া?’

-‘তোমার বোন!’

আকস্মিক,বজ্রাহত, বিস্ফোরিত নয়নে রুমুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো অনিক! আরিয়া? তার বোন? সেই ছোট্ট ফুটফুটে আরিয়া? এতদিন বাদে? যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না অনিক। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,’কি বলছো তুমি?’

-‘হ্যাঁ। ও তোমার বোন আরিয়া। মা অসুস্থ। তাই ওকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে!’

বিগত দুইবছর যাবত শয্যাশায়ী অনিলা চৌধুরী। আরিয়ার বাবা শরীফ সাহেব মারা গেছেন চারবছরের মতন হয়েছে। তিনি মারা যাওয়ার পর তার জমানো টাকা দিয়েই এতদিন সংসার চলেছে। কিন্তু এখন আর চলছে না! আরিয়ার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। অনিলা চৌধুরীও বিনাচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট পাচ্ছেন। শরীফের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁর কোন সন্তান হয় নি। আরিয়াকে নিয়েই তাদের সংসার জীবন কেটেছে। কিন্তু শরীর মারা যাওয়ার পর একা হয়ে পড়েছেন মা মেয়ে। আরিয়াকে নিয়ে টেনশন হয় অনিলা চৌধুরীর। মা, মেয়ে দুটিতে ছাড়া আপন বলতে আর কোন পুরুষ নেই। তাই নিরুপায় হয়ে অনিকের কাছে চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন তাঁকে।

রুমু চিঠিটা অনিকের দিকে বাড়িয়ে দিলো। অনিক নিলো না। দুহাতে মুখ ঢেকে সোফায় বসে পড়লো সে। সুন্দর হাসিখুশি মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। তীব্র ব্যথার চাপ ফুটে উঠলো চোখেমুখে! চারপাশটা ওলটপালট হয়ে ঘুরছে তাঁর! উদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে! এতগুলো দিন যেই মানুষটার জন্য সে নিজের জীবনটাকে ধ্বংস করতে বসেছিলো সেই মানুষটা আবার তাঁর জীবনে এসে হানা দিয়েছে। কি করবে অনিক! তার প্রতি করার সকল অন্যায়, অবিচাপ ভুলে গিয়ে অনিক কি ভাববে, যতই খারাপ হোক না কেন মা তো মা-ই! ঐ মহিল তার মা! রক্তের সম্পর্ক আছে তার সাথে! আরিয়া তাঁর বোন! রুমুকে সামনে বসিয়ে দ্বিধান্বিত, অসহায় কন্ঠে বললো,’আমি কি করবো রুমু? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। ঐ মহিলা কেন আবার আমার জীবনে ফিরে এসেছে!’

রুমু মিষ্টি করে হাসলো। অনিকের অগোছালো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বললো,’পুরুষমানুষ এমন ভেঙ্গে পড়লে চলে? এসেছে তো কি হয়েছে? তুমি তোমার মত থাকো না! তোমার মন যা করতে মন চায় তুমি তাই করো। মা, তোমার ওপর অন্যায় করেছেন। তোমার যদি মনে হয় তুমি তাকে ক্ষমা করতে পারবে না তাহলে করো না!’

যত সহজভাবে রুমু কথাগুলো বললো সে নিজেও জানে কাজটা করা ততটা সহজ নয়। সন্তানের জন্য বাবা, মা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে! ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ,কর্তব্য সকম ছেলে মেয়ের জন্য সমান। তেমনি কষ্টগুলো সমান।! তবুও অনিকের সামনে নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করলো সে।

অনিক পূর্বের ন্যায় বসে রইলো। কাঁপাকাঁপা হাতে অনিলা চৌধুরী দেওয়া চিঠিটা খুললো সে।
বাবা অনিক,
আমি তোমার মা অনিলা চৌধুরী। আশাকরি ভালো আছো। নিশ্চয়ই ইউসুফ তোমাকে যথাযথ ভাবে মানুষ করেছে। কিন্তু আমি ভালো নেই বাবা। আরিয়ার বাবা মারা গেছে চারবছরের মত হয়েছে। আজকে দুইবছর বিছানায় পড়ে আছি। পা দুটো প্যারালাইজড! নড়তে চড়তে পারি না। সংসারে বড়ই অভাব অনটন। তোমার বোনের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। তাই বাধ্য হয়ে তোমার কাছে চিঠিটা লিখতে হলো। যদি সময় হয় তুমি একবার এসে আমাকে দেখে যাও। তোমার সাথে অনেক কথা আছে আমার।
ইতি তোমার মা!

ব্যস এইটুকুই ছিলো অনিলা চৌধুরীর চিঠি! চিঠিটা পড়ে অনিক হতাশভাবে হাসলো! অনুশোচনা বোধের ছিঁটে ফোটাও নেই! নেই কোন অপরাধবোধ! কত স্বার্থপর একজন মহিলা! তার নির্লজ্জতা দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে অনিকের ! চিঠিটা পুনরায় ভাঁজ করে রেখে দিলো সে। রুমু নরম গলা জিজ্ঞেস করলো,’আরিয়ার সাথে একবার দেখা করবে? বেচারি সেই বিকেল থেকে বসে আছে?’

অনিক গম্ভীর গলায় বললো,’তোমার কি মনে হয় রুমু? এতকিছুর পরেও আমার দেখা করা উচিৎ? শুধুমাত্র নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার জন্য? যেই মহিলার জন্য আমি সারাজীবন ইউসুফ চৌধুরীর প্রতি অবিচার করে এসেছি, নিজের প্রতি অবিচার করেছি। তাকে আমি এত সহজে কি করে ক্ষমা করে দেই? নিজের কাছে তো নিজেই ছোট হয়ে যাবো?

-‘কিন্তু আরিয়া তো তোমার মতই পরিস্থিতির স্বীকার!’

-‘সেটা তাঁর মায়ের কারণে?’

-‘তোমার বোন নয়?’, কোমল গলাহ প্রশ্নটা করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনিকের মুখের দিকে চেয়ে রইলো রুমু। অনিক মুখ ফিরিয়ে নিলো। সে বুঝতে পারছে তার ভেতর থেকে টান আসছে! রক্তের টান! মানুষ যতই অস্বীকার করার চেষ্টা করুক না কেন রক্তের টান থাকবেই! কিন্তু বিবেক কোনভাবেই সায় দিলো না।

রুমু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। উভয়সংকটে পড়েছে অনিক! একদিকে তাঁর সারা জীবনের জমানো কষ্ট। অন্য দিকে মা, বোন! মা যতই খারাপ হোক না কেন বোনকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না !

-‘একবার অন্তত আরিয়ার সাথে দেখা করে এসো অনিক।’

নিজেকে দুর্বল করতে চায় না অনিক। মায়ের প্রতি তার যেই ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা, দ্বেষ আছে বোনের প্রতি সেটা নেই। তাই নিজের ওপর ভরসা করলে পারলো না। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আরিয়ার সাথে কথা বললে দুর্বল হয়ে পড়বে যে। তাই রুমুর কথার জবাবে সরাসরি না করে দিয়ে বললো,’আমি পারবো না। ওকে চলে যেতে বলো। ড্রাইভারকে বলো ওকে পৌঁছে দিতে।’

রুমু উঠলো না। আরো কিছুক্ষন নিরবে বসে রইলো। যদি অনিকের মত পরিবর্তন হয়! তাঁকে হতাশ করে দিয়ে অনিক ফ্রেশ হতে চলে গেলো। রুমুও মুখ কালো করে নিচে নেমে গেলো। আরিয়া ভীতসন্ত্রস্ত মুখে যেমনি বসে ছিলো তেমনিই বসে আছে। রুমু কাছে গিয়ে বললো,’তোমার ভাইয়া ফ্রেশ হচ্ছেন। আর পাঁচমিনিট বসো।’

আন্দাজের ওপর ঢিলটা ছুঁড়লো রুমু। তার মন বলছে অনিক নিচে নামবে! বেশিক্ষণ নিজের কঠোরমূর্তি ধরে রাখতে পারবে না।

আরিয়া উশখুশ করে বললো,’আমার যে অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে?’

-‘হোক। আজকে থাকবে তুমি।’

-‘জি না। আমি থাকতে পারবো না। মা বাড়িতে একা আছেন। আমি না গেলে তাঁকে রাতের খাবার খাওয়ানোর মত কেউ নেই।’

রুমু কিছুক্ষন নিরব থেকে বললো,’ঠিক আছে। তবে ড্রাইভারকে বলবো, তোমাকে পৌঁছে দিতে!’

-‘তার কোন দরকার নেই। এখন তো সবে সন্ধ্যা। আমি চলে যেতে পারবো।’

উঠে দাঁড়ালো আরিয়া। সেই সময় উপরতলার সিঁড়ি দিয়ে ধীরপায়ে নেমে আসতে দেখা গেলো অনিককে। রুমুর মুখে প্রথমে হাসি ফুটে উঠলেও পরোক্ষনেই মিলিয়ে গেলো। অনিককে অনেক বেশি রাগান্বিত মনে হচ্ছে। আরিয়া মনে মনে ধারণা করে নিলো এই তার ভাই! রুমুকে ভয়ার্ত চোখে অনিকের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সে নিজেও ঘাবড়ে গেলো। নিচে নেমে অনিক গম্ভীর গলায় বললো,’এখনো যাও নি তুমি?’

-‘জি?’ প্রশ্নটা শুনে চমকে উঠলো আরিয়া। সরাসরি অপমান করা হয়েছে তাঁকে!

-‘বলছি অন্ধকার তো হয়ে গেছে। তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে না?’

-‘জি!’

-‘তবে? ব্যাগ নাও। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।’

টেবিলের ওপর থেকে হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আরিয়া। ড্রাইভারকে দিয়ে পৌঁছে দেওয়ার কথায় রুমুকে না করলেও ভাইয়ের মুখের ওপর না করার সাহস তাঁর হলো না। মানুষটাকে দেখতে কি খুব গম্ভীর মনে হয়! তাই ভয়ে ভয়ে সম্মতিসূচক মাথা দোলালো সে।

-‘আর একটা কথা। এই বাড়িতে আর কখনো আসবে না তুমি। আর অনিলা চৌধুরীকে বলবে তাঁর জন্য হয়ত তাঁর ছেলে অনিক বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু আমার জন্য আমার মা মরে গেছে!’

অনিকের কথাগুলো তীব্রভাবে আঘাত করলো আরিয়াকে। লজ্জা, ভয়, অপমান মিশ্রিত চোখে অনিকের দিকে চেয়ে রইলো সে। অভিমানী চোখে দেখা দিলো দুফোঁটা জল। অনিক আর দাঁড়ালো না। কথা শেষ করেই উপরে চলে গেল সে। আরিয়াও চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

রুমু অপ্রস্তুত মুখে আরিয়ার দিকে চেয়ে আছে। বেচারির মুখটা নিমিষেই ছোট হয়ে গেছে। চোখদুটো আগের চাইতে বেশি করুণ লাগছে। মোলায়েম কন্ঠে বললো,’দুটো মিনিট একটু সময় দেবে ভাই? আমি এলে নাহয় যেও?’
আরিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। রুমু দ্রুতপায়ে উপরে উঠে গেলো। ফিরে এসে টিফিন ভর্তি খাবার আর কিছু টাকা গুঁজে দিলো আরিয়ার হাতে। এখান থেকে গিয়ে নিশ্চয়ই মেয়েটাকে মায়ের জন্য রান্না করতে হতো। তাই খাবার দিয়ে দিলো রুমু। আরিয়া অবশ্য প্রথমে নিতে চাইলো না। সদ্যই ভার্সিটিতে পদার্পণ করেছে সে। আত্মসম্মান বোধটা একটু বেশিই। ছোট হলেও ভাইয়ের অবহেলা খুব গায়ে লেগেছে তাঁর! কিন্তু রুমু জোর করে টাকাগুলো দিয়ে বললো,’তোমার ভাইয়ার ওপর রাগ করো না আরিয়া। সে দুঃখী মানুষ। একদিন তোমাকে সব বলবো! এখন টাকাটা রাখো। টাকাগুলো আমার তরফ থেকে উপহার হিসেবে দিচ্ছি তোমাকে।’

আরিয়া মৌনমুখে টাকাগুলো নিলো। সে হয়ত জানে না তাদের মত দরিদ্র মানুষদের খুব বেশি আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই। তাদের আত্মসম্মান বোধ কেবল খানিকটা জোরাজুরির আগ পর্যন্তই! কেউ সামান্য দুঃখিত হলে কিংবা দুঃখিত হবার নাটক করলেই তারা সুড়সুড় করে আত্মসম্মানের জলাঞ্জলি দিয়ে বসে। তাছাড়া সে যতই না করুক এইমুহূর্তে টাকার খুব দরকার ছিলো! মায়ের ওষুধ, মাসের বাজার, নতুন সেমিস্টারের বই, কিছুই কেনা হয় নি। টাকাটা কাজে লাগবে। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো সে। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ারঠিক পূর্ব মুহূর্তে রুমু হঠাৎ জানালা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে বললো,’তোমাদের এড্রেসটা আমাকে দিয়ে যাও তো ভাই। আমি একবার গিয়ে মাকে দেখে আসবো।’ মাকে দেখে আসার কথাটা রুমু আরিয়ার মন ভালো করার জন্যই বলেছে। কাজেও দিলো কথাটা। আরিয়া হাসিমুখে একটা কাগজ বের করে ঠিকানা লিখে দিলো তাঁকে।
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here