#পরিত্রাণ
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১৩
ড্রয়িংরুমে জড়সড় হয়ে বসে আছে আরিয়া। মুখখানা শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। চোখ কোটরে বসে গেছে। গতকাল রাত থেকে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছে অনিলা চৌধুরীর। অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন! সারারাত তাঁর পাশে জেগে বসে ছিলো আরিয়া। কিন্তু অবস্থা ক্রশম খারাপ হচ্ছে দেখে বাধ্য হয়ে রুমুর কাছে ছুটে এসেছে সে। তাঁর আসার খবর শুনে হাতের কাজ রেখে নিচে নেমে এলো রুমু!
তাকে দেখে সসংকোচে উঠে দাঁড়ালো আরিয়া। রুমু এগিয়ে এসে স্নেহভরে তার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বললো,’কি হয়েছে আরিয়া? তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন?’
-‘মা ভীষণ অসুস্থ ভাবি। কালকে রাত থেকে কথা বন্ধ হয়ে গেছে। খাবার, পানি কিচ্ছু মুখে নিচ্ছে না।’, বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো আরিয়া।
-‘বলো কি? ডাক্তার ডাকো নি?’
ধীরে ধীরে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো আরিয়া। ডাক্তার দেখানোর মত যথেষ্ট টাকাপয়সা তাঁর হাতে নেই। টিউশনির টাকা এখনো হাতে আসে নি। রুমু কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললো,’কিন্তু আমি তো টাকা পাঠিয়েছিলাম?’
-‘চুরি হয়ে গেছে।’ আবারো ডুঁকরে কেঁদে উঠলো আরিয়া। টাকাগুলো নিয়ে বাজারে যাওয়ার পথে ব্যাগ থেকে চুরি হয়ে গেছে। ফলে এই মাসের বাজার, ওষুধপত্র কিচ্ছু কেন হয় নি।
রুমু কাছে গিয়ে সোফা বসিয়ে দিলো তাঁকে। শান্ত করার চেষ্টা করে বললো,’ঠিক আছে, তুমি কেঁদো না। আমি এক্ষুনি আসছি।’
অতঃপর আরিয়াকে নিচে বসিয়ে রেখে উপরে চলে গেলো রুমু। আজকে সকাল থেকেই অনিক, ইউসুফ সাহেব দুজনেই বাসায়। রুমু একা সামলাতে পারবে না। তাই অনিলা চৌধুরীর অসুস্থতার কথা তাদেরকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিলো।
★
অনিক কিছুতেই যেতে রাজী নয়। এতকিছুর পরেও ঐ মহিলার মুখ দেখার কোন ইচ্ছে তাঁর নেই। কিন্তু রুমু অনুনয় বিনয় করছে। বারবার করে বলছে, অন্তত আরিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তাদের যাওয়া উচিৎ। বেচারী এইটুকুন মেয়ে, অসুস্থ অনিলা চৌধুরীকে নিয়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছে। অনিলা চৌধুরী শরীফের সাথে পালিয়ে যাবার পর থেকে দুপক্ষের আত্মীয়স্বজনই বয়কট করেছেন তাদেরকে। শরীফের মৃত্যুর পরেও সেটা বহাল আছে। আত্মীয়স্বজনের কাছে থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই দম্পতি। ফলে অনিলা চৌধুরী এই দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই।
অনিক গম্ভীর গলায় বললো,’তোমার যদি যেতে ইচ্ছে করে তবে তুমি যাও। মানবসেবা করো, আমি কিছুতেই যাবো না।’
-‘প্লিজ?..চলো না?’
-‘একই কথা বারবার কেন বলছো রুমু? তুমি জানো, তোমার অনুরোধ রাখতে না পারলে আমার খারাপ লাগবে।’
উপায়ন্তর না পেয়ে রুমু চট করে অনিকের পায়ের কাছে বসে পড়ে বললো,’আমি তোমার পায়ে পড়ছি অনিক। আরিয়ার কথাটা একবার ভাবো। উঠো রেডি হও!’
আকস্মিক রুমু এমন কান্ডে তব্দা খেয়ে গেলো অনিক! কাজ হাসিল করার জন্য আর কি কি করতে পারে এই মেয়ে আল্লাহই জানে! তৎক্ষণাৎ ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে সজোরে ধমক দিয়ে বললো,’বেশি বোঝো না? মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়ে গেছে? খুব দরদ? ঠিক আছে চলো, যাবো আমি! তারপর দেখো তোমার কি করি? পায়ে ধরেছো না আমার? এখন থেকে রোজ দুবেলা নিয়ম করে আমার পা ধরে বসে থাকবে তুমি।’
অনিকের রাগ গায়ে মাখলো না রুমু। অনিক যাওয়ার জন্য সম্মতি দিয়েছে শুনেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য মুখ খুলছিলো তখুনি দরজার বাইরে থেকে গলা খাঁকারি দিলেন ইউসুফ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিলো রুমু, ‘আসুন বাবা!’
পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন ইউসুফ সাহেব। তার পরনে বাইরে যাওয়ার পোষাক। ভেতরে ঢুকেই অনিকের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,’কি হয়েছে তোর?’
প্রশ্নটা যদিও তিনি করার খাতিরে করেছেন তবে উত্তরটা তিনি জানেন। তবুক অনিকের জবাবের অপেক্ষা না করে পুনরার প্রশ্ন করলেন তিনি,’মুখটা এমন বানিয়ে রেখেছিস কেন? তোর বাপ যেখানে যেতে রাজি হয়েছে সেখানে তো যেতে আপত্তি কোথায়?’
অনিক বুঝতে বাকি রইলো না রুমু ইউসুফ সাহেবকেও যাওয়ার জন্য রাজী করিয়ে ফেলেছে। রাগে গজগজ করে বললো,’নাটকের শেষ নেই। এখন আবার মহান হওয়ার ভূতে পেয়েছে!’
কথাটা সে রুমুকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। রুমু এবারেও পাত্তা দিলো না। অনিলা চৌধুরীর ইস্যু নিয়ে অনিক যে তাঁকে ঝাড়বে এটা সে খুব ভালো করেই জানে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে অনিক যাই বলুক না কেন সে নিরব থাকবে! বিরক্ত হয়ে অনিক নিজেই চুপ করে যাবে।
অনিক বিরক্তমুখে চেইঞ্জ করতে ঢুকে গেলো। ইউসুফ সাহেব রুমুর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন,’ওকে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে মা? হিতে বিপরীত হবে না তো?’
রুমু মুখভার করে বললো,’কি করবো বাবা? এই অবস্থায় আমি কিংবা আপনি কেউই ডাক্তার- হস্পিটাল নিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে পারবো না। আপনার শরীরও তো ভালো নয়। মা-কে যদি হস্পিটালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়?’
রুমুর কথায় যুক্তি আছে! আরিয়া বর্ণনা অনুসারে অনিলা চৌধুরীর যেই অবস্থা তাতে তাঁকে হস্পিটালে ভর্তি করানো ছাড়া কোন উপায় নেই। ইউসুফ চৌধুরীর এখন আর আগের মত সেই শক্তি নেই যে তিনি দৌড়াদৌড়ি করবেন, ইচ্ছে কিংবা রুচিও নেই। এদিকে রুমুর অলরেডি সাত মাস চলছে। তার পক্ষেও ছোটাছুটি করার সম্ভব হবে না। যতই খারাপ হোক অনিককে মা! সে নিয়ে যেতে পারে। এই নিয়ে দুচারটা কথাও উঠবে না। তাই এইমুহূর্তে অনিককে নিয়ে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো! অনিকের বেরোনো পর্যন্ত চুপচাপ খাটের ওপর বসে অপেক্ষায় রইলেন তিনি।
★
বাসায় মায়ের কাছে পাশের বাসার এক মহিলাকে বসিয়ে রেখে এসেছে আরিয়া। অনিক চেইঞ্জ করে বেরোতেই আর দেরী করলো না তাঁরা। বাসা থেকে বারবার ফোন আসছিলো অনিলা চৌধুরীর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে। আরিয়াকে তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। আরিয়ার অনুরোধে যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি টানছিলো ড্রাইভার।
কিন্তু বাসা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই অর্ধেক রাস্তায় থাকাকালীন পুনরার কল এলো আরিয়ার নাম্বারে। ফোন রিসিভ করতেই পাশের বাসার সেই মহিলা বিলাপের সুরে বললেন,’তোমার মা আর নেই আরিয়া!’ চমকে উঠলো সবাই! অনিলা চৌধুরী আর নেই! খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলো আরিয়া। রুমু এবং ইউসুফ চৌধুরী মিলে তাকে শান্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। অনিক চুপচাপ বসে রইলো। আরিয়াকে কিছুতেই শান্ত করার গেলো না। বাকিটা পথ সে চিৎকার করে করে কাঁদলো।
ছোটবেলা থেকেই আত্মীয়স্বজন কাউকে কাছে পায় নি আরিয়া। বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে বেশ আদর যত্নে বড় হয়েছে। তাই বাস্তবতা সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিলো না। বাবা মারা যাওয়ার পরই প্রথম জীবন পথে চলার সংগ্রাম অনুভব করলো সে। তারপর মায়ের অসুস্থতা সেই সংগ্রামকে আরো বেশি কঠিন করে দিলো। এখন মাও চলে গেলেন! আরিয়ার বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও হারিয়ে গেলো! কি করে একা থাকবে আরিয়া? কাঁদতে কাঁদতে গলা ফাটিয়ে ফেললো সে। বলা বাহুল্য, নিজেদের কুকীর্তির ইতিহাস মেয়ের কাছে গোপন করে গিয়েছেন অনিলা চৌধুরী এবং শরীফ দম্পতি! আরিয়াকে বলা হয়েছিলো বিয়ের পর ইউসুফ সাহেবের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তাকে ডিভোর্স দেন অনিলা চৌধুরীর। তারপর হঠাৎ করে শরীফের সাথে দেখা হয় তাঁর। মন, মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় দুজনের। তারপর প্রেম! প্রেম থেকে বিয়ে! শরীফ তখন বেকার থাকায় পরিবারে কেউ মেনে নেয় তাদের। আলাদা বাসা নেন দুজনে। ছোট থেকে এসব জেনেই বড় হয়েছে সে। অনিকের ব্যপারে বলা হয়েছিলো, ডিভোর্সের সময় অনিক নিজইচ্ছায় তার বাবার সাথে থাকতে চাওয়ায় তাকে নিয়ে আসতে পারেন নি অনিলা চৌধুরী! তাই আরিয়ার চোখেও আর দশটা ছেলেমেয়ে মত বাবা মায়ের জন্য রয়েছে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস! কিন্তু সে তো আর জানে না তার বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার স্তম্ভগুলোকে মিথ্যে, কপটতা এবং ভণ্ডামি দিয়ে গড়ে তুলেছেন শরীফ এবং অনিলা চৌধুরী! হয়ত একদিন সেই স্তম্ভগুলো ভাঙ্গবে! সেদিন আরিয়া বুঝতে পারবে কতটা মিথ্যে দিয়ে গড়া ছিলো তার সমস্ত পৃথিবীটা!
★
রাত দশটা! বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে অনিক। অনিলা চৌধুরীকে মাটি দিয়ে কিছুক্ষন আগে বাসায় ফিরেছে তারা। আরিয়াকে সাথে করে নিয়ে আসা হয়েছে। এসেছে থেকেই কাঁদছে সে। রুমু তার সঙ্গেই আছে। ইউসুফ চৌধুরীও আসার পর থেকে মুড অফ করে ছিলেন। বয়স হয়েছে, এখন আর মানুষের মৃত্যু দেখতে ভালো লাগে না! আপন, পর শত্রু যাই হোক না কেন! কিছুক্ষন সময় নিয়ে নিজেকে স্থির করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছেলের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। আলতো করে টোকা দিয়ে বললেন,’আসবো বাবা?’
বাবার গলা শুনে বারান্দা থেকে উঠে এলো এলো। মুখে কৃত্রিম হাসি টানার চেষ্টা করে বললো,’এসো।’
ইউসুফ চৌধুরী ঘরে ঢুকে খাটের ওপর বসলেন। ছেলের ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,’তোর কি মন খারাপ?’
অনিক জবাব দিলো না। তার মন খারাপ! কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে চায় না সে! ইউসুফ চৌধুরী ছেলেকে নিজের পাশে টেনে বসিয়ে বললেন,’মন খারাপ! আমি জানি। মায়ের কথা মনে পড়ছে?’
এবার কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাভরে হাসলো অনিক। বললো,’মায়ের কথা? আমি তো চেহারাই ভুলে গিয়েছিলাম!’
-‘তবে?’
অনিক নিরুত্তর রইলো। মিথ্যে বলেছে সে। এতক্ষন যাবত সে অনিলা চৌধুরীর কথাই ভাবছিলো সে। কি ভাবে একটা মানুষ চাইলেই সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে! সমস্ত সম্পর্কগুলোকে মিথ্যে করে দিতে পারে! মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ককে কলুষিত করে দিতে পারে! কিভাবে ঘৃণায় পরিপূর্ণ করে দিতে পারে আরেকটা মানুষের হৃদয়! ইউসুফ চৌধুরী সস্নেহে ছেলের বাহুতে হাত রেখে বললেন,’তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই খুব আপসেট।’
অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’হয়ত। কিন্তু তুমি যেরকম ভাবছো আমি মোটেও সেরকম ভাবে আপসেট নই।’
-‘তবে?’
-‘রক্তের টানটা বড় খারাপ জিনিস বাবা। চাইলেও উপেক্ষা করা যায় না। ঐ মহিলার জন্য আমার খারাপ লাগছে ভেবে আমার নিজেকে খুন করে ফেলতে মন চাইছে, কিন্তু আমি কিচ্ছু করতে পারছি না। এর জন্যই আফসোস হচ্ছে।’
শেষ বয়সে অনিলা চৌধুরী কম কষ্ট করেন নি। খাওয়াদাওয়া, চিকিৎসা, ওষুধপত্র এমনকি ভালো একটা থাকার জায়গাও পান নি। দোচালা টিনের বস্তি টাইপ একটা ঘরে বসবাস করে গেছে মা মেয়ে! হয়ত এটাই তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি ছিলো! কিন্তু চোখের সামনে তার দুর্দশা দেখে ভেতরে ভেতরে কিঞ্চিৎ দুঃখ অনুভব করেছিলো অনিক! যদিও তার ভেতরের ঘৃণা সামান্যতমও কমে নি কিন্তু তবুও খানিকটা সহানুভূতি তৈরী হয়েছিলো। ইউসুফ চৌধুরী ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে অনিলা চৌধুরীর প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করে বললেন,’আরিয়ার ব্যপারে কি ভাবছিস? উপযুক্ত মেয়ে একা বাইরে রাখাটা ঠিক হবে?’ অনিক জবাব দিলো না। ইউসুফ সাহেব নিজের কথার রেশ ধরে বললেন,’আমি ভাবছি ওকে এখানে রেখে দেবো? বউমাও তাই বলছিলো!’
অনিক এবারে কিছু বললো না। মনে মনে সে ইউসুফ চৌধুরীর প্রস্তাবে সমর্থণ করলেও মুখে কিছুই বললো না। মানবিক দিক থেকে বিচার করলেও আরিয়াকে একা বাসায় রাখা নিরাপদ নয়। কিন্তু তাই বলে অনিলা চৌধুরীর কৃতকর্মগুলো তো ভুলে যাওয়ার মত নয়! কে জানে এই মেয়েও হয়ত মায়ের মতই স্বার্থপর হবে! গম্ভীর গলায় বললো,’যেখানে খুশি রাখো, কিন্তু ও যেন আমার সামনে কখনো না আসে।’
ইউসুফ চৌধুরী হাসলেন। বললেন,’বাচ্চাদের মত জেদ করছিস তুই। যে দোষ করেছে সে তো চলেই গেছে। মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। তাঁর ওপর রাগ করছিস কেন?’
-‘ঐ মহিলা তাঁর মা, এই একটা কারণই রাগ করার জন্য যথেষ্ট! তাছাড়া আমার মনে হয় ওর প্রতি যথেষ্ট সিমপ্যাথি দেখানো হয়েছে। অসহায় ভেবে থাকতে দিচ্ছো, ওর খাওয়া পড়ার টাকাও নিশ্চয়ই তুমি দেবে, তাহলে আর আমাকে কেন? আমি এসবের থেকে দূরে থাকতে চাই। তুমি প্লিজ আমাকে ওর ব্যপারে কোনরকম ফোর্স করো না!’
ইউসুফ সাহেব আর বাড়াবাড়ি করলেন। অনিলা চৌধুরীর ওপর জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণার পরিমাণ তাঁর দিক থেকেও কম নয়। নেহায়েত রুমুর অনুরোধে বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিলো ইউসুফ সাহবকে। কারণ তিনি না গেলে অনিককে কিছুতেই রাজী করানো যেতো না। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আরিয়ার প্রতি খুব বেশি রাগ করে উঠতে পারছেনা ইউসুব সাহেব। তাঁর এখনো মনে আছে, আরিয়ার জন্মের পর দুটো গরু জবাই দিয়ে অনুষ্ঠান করে গ্রামের লোকজনদের খাইয়েছিলেন তিনি। আকিকা দিয়ে অনিকের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছিলেন আরিয়া! ফুটফুটে ছোট্ট আরিয়া এখন কত বড় হয়ে গেছে! এখনো কি আদুরে লাগে দেখতে! পুরোনো কথা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ইউসুফ সাহেব ! আরিয়া তার মেয়ে নয়! সে কেবল অনিলা চৌধুরীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক আর অনিকের বোন! এটাই ইউসুফ চৌধুরীর কাছে কাছে সবচেয়ে বড় সত্যি! এই প্রসঙ্গে আর ভাবতে চাইলেন না তিনি।প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন,’এবার থেকে বাবার অসিফে বসবি তো?’
এই প্রশ্নের জবাবে অনিকের মুখে স্পষ্টত লজ্জা ফুটে উঠলো। সময়ে অসময়ে অফিসে বসার অনুরোধে এতকাল যাবত সে কম অপমান করে নি ইউসুফ সাহেবকে। তাই আজকে হঠাৎ ইউসুফ চৌধুরীর মুখে অফিসে যাওয়ার কথা শুনে বেশ লজ্জা পেলো সে। বাবার মুখের দিকে চেয়ে লাজুক কন্ঠে জবাব দিলো,’বসবো।’
ছেলের লাজুক মুখ দেখে সকৌতুকে হাসলেন ইউসুফ চৌধুরী। মুচকি হেসে সাবধানি গলায় বললেন,’ভেবে বলছিস তো? মনে রাখিস এখন কিন্তু আর তোর বাবা নেই, বউমা তোর বস? সব ক্ষমতা কিন্তু তাঁর হাতে দিয়ে দিয়েছি?’
জবাবে অনিকও মুচকি হেসে বললো,’তবে তুমি ডুবেছো। তোমার বউমার যা স্বভাব, কবে দেখা যাবে দানপত্র করে সব আমার নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছে!’
ইউসুফ চৌধুরী হো হো করে হেসে উঠে বললেন,’সে তো আমার মা! আমার মেয়ে! আমার ঘরের লক্ষ্মী! আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ! তা সে কোথায়?’
-‘সান্ত্বনা বাটছে!’
ইউসুফ চৌধুরী হাসলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,’যাই আমি।’
★
আরিয়াকে শান্ত করে রাত সাড়ে বারোটার দিকে রুমে এলো রুমু। অনিক শুয়ে পড়েছে। রুমের বাতি নেভানো। ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো রুমু,’ঘুমিয়ে পড়েছো?’ তার ভীত কন্ঠস্বর শুনে অনিক মুচকি হাসলো। ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো স। রুমুও আবারো ফিসফিস করে ডাক দিলো,’এই, ঘুমিয়ে পড়েছো?’
পাশফিরে জবাব দিলো অনিক,’হ্যাঁ! ডাকছো কেন?’ তাঁর কঠস্বরে খানিকটা ধমকের সুর ছিলো। রুমু ইতস্তত করে বললো,’এভাবে কথা বলছো কেন? আরিয়া কাঁদছিলো তাই দেরী হয়ে গিয়েছে!’
-‘তো? আমি কি করবো? আমাকে কেন ঘুম থেকে তুললে?’
-‘না, তুমি তো এমনিতে এত সকাল ঘুমাও না। আজকে হঠাৎ শুয়ে পড়লে তাই?’
-‘এখন থেকে সকাল সকালই ঘুমাবো। নইলে ভোরবেলা উঠতে দেরী হয়ে যায়!’
কথা শেষ করে আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো সে। অন্ধকারে যদিও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না তবে রুমুর কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখতে খুব ভালো লাগছে তাঁর। দুপুরের রাগ এখন মিটিয়ে নিতে চাইলো! এদিকে তার নির্লিপ্ত স্বভাব দেখে রুমু বেশকিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,’তুমি কি আমার ওপর রেগে আছো?’
-‘হ্যাঁ!’
রুমু থতমত খেয়ে গেলো। অন্তত ভদ্রতা করেও তো ‘না’ বলতে পারতো অনিক। এর মানে কি অনিক বোঝাতে চাইছে তাঁর রাগের মাত্রা খুব বেশি? কিন্তু রুমু কনফিউজড! অনিকের মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না সে রুমুর ওপর খুব রেগে আছে? নাকি অন্ধকারে রুমু বুঝতে পারছে না?
যাইহোক অনিকের রাগের বিপরীতে আগে থেকে গুছিয়ে রাখা কথাগুলো গড়গড় করে বলতে শুরু করলো সে। বিজ্ঞেস ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললো,’শোনো, তুমি আমার ওপর রাগ করো আর যাই করো,আমি যা করেছি আমাদের ভালোর জন্যই করেছি। সামনে বাবার ইলেকশন। এইমুহূর্তে এরকম একটা ফুটেজের খুব দরকার ছিলো বাবার। সবাই দেখলো বাবা কত ভালো মানুষ, কতটা বিনয়ী তাঁর ছেলে আর ছেলের বউ। এতকিছুর পরেও প্রাক্তন স্ত্রীর দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন।’
মনে মনে আবারো রুমুর বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না অনিক। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য হাজারটা যুক্তি তাঁর মাথায়
সবসময় স্টক থাকে। রুমু নিজেও জানে অনিক তাঁর এইসব হাবিজাবি কথাবার্তা মোটেও বিশ্বাস করে না তবুও সে বলে। মাঝেমাঝে এই উল্টোপাল্টা কথাবার্তা শুনেই সাময়িকভাবে অনিকের রাগ শান্ত হয়ে যায়! তবে আজকে তেমন কিছুই ঘটলো না। কারণ এইমুহূর্তে অনিক রেগে নেই, রেগে থাকার ভান করছে কেবল! অনিক দেখতে চায় কতদূর পর্যন্ত সে নিজের এসব বদ যুক্তি চালিয়ে যেতে পারে? হাই তুলে বললো,’তোমার এসব ফালতু যুক্তি শুনতে আমি মোটেও ইন্টারেস্টেড নই রুমু। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাবো। তুমিও শুয়ে পড়ো।’
বক্তৃতায় আগ্রহ না পেয়ে রুমু নিরাশ হয়ে শুয়ে পড়লো। যাহ! অনিক কি সত্যি সত্যিই রেগে আছে নাকি? কিন্তু রুমু তো নিজেও বুঝতে পারছে না সে ভুল না সঠিক? অনিলা চৌধুরী কিংবা আরিয়ার জন্য যে তার খুব ভালোবাসা এমনটা নয়। আরিয়ার জন্য একটু একটু খারাপ লাগে তাই হয়ত মানবিক দায়িত্ববোধ নামক অসহ্যকর শব্দটা তাকে এসব করতে বাধ্য করছে। কিন্তু এখন যে অনিক রেগে গেলো? এবার কি হবে?
.
.
.
চলবে