#পরীজান
#পর্ব ৬০ (অন্তিম পাতা)
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
শহরে ফেরার পর সব বন্ধুরা এক প্রকার আলাদা হয়ে যায়। শেখরের বেঈমানি করার জন্য প্রথমত শেখরের সাথেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে সবাই। নাঈম সে সময় জেলে ছিল। ছাড়া পাওয়ার পর ওদের কিয়ৎক্ষণের সাক্ষাৎ ছিল। নাঈম বাদে আসিফ মিষ্টি আর রুমি পাড়ি জমায় বিদেশে। নাঈম ই একমাত্র দেশে রয়ে যায়। ডাক্তারি পড়া শেষ করে সেখানে বছর দুয়েক কাটিয়ে রুমি সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশে আসার। এসেই সে নাঈমের সাথে যোগাযোগ করে। তখন নাঈম আর মুসকানের সদ্য বিয়ে হয়েছে। পরী আর শায়েরের ঘটনাটা তখন রুমি জানতে পারেনি। মুসকানের কোলে ছোট্ট শোভন কে দেখে হতবাক রুমি। প্রশ্নের তীর ছুড়ে দেয় নাইমের দিকে। নাঈম একে একে পরীর সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছুই বলে শুধু এটা বলে না যে পরী কেন শায়েরের থেকে আলাদা হল আর শোভন কেই বা কেন নাঈম নিজের কাছে রেখেছে? এসব হাজারো প্রশ্ন থাকলেও উত্তর নাঈম দেয়নি। সে শুধু রুমিকে বলেছিল যাতে ও পরীর সাথে যোগাযোগ রাখে। কেননা পুলিশ কেসে একসময় নাঈম নিজেও জড়িয়ে যেতে পারে। কিন্ত রুমিকে কেউ সন্দেহ করবে না। এই জন্যই পরীর পাঠানো সব চিঠি প্রথমে রুমির কাছে আসতো। আর রুমি সেই চিঠি পুনরায় লিখে তা নাঈমের কাছে পাঠাত। কোনদিন যদি এই চিঠি পুলিশের হাতে পড়েও যায় তবুও যেন হাতের লেখা শনাক্ত করতে না পারে। রুমি সামনে এলেও পরী যাতে কোনোভাবেই সকলের সামনে না আসে। শুধুমাত্র পরীকে আগলে রাখার জন্য সুরক্ষার জাল সব দিকে বিছিয়ে দিয়েছে শায়ের। যাতে তার পরীজান সুরক্ষিত থাকে। সেজন্য সে নিজে পুলিশের হাতে ধরা দিয়েছে। আর আজ নাঈম রুমির বাড়িতে এসেছে। পরীর লেখা সব চিঠিগুলো রুমির কাছেই ছিল। সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে এসেছে। সব চিঠি একসাথে জড় করে জ্বালিয়ে দিল সে। আর তখনই অনাকাঙ্খিত প্রশ্ন করে বসে রুমি যা ওর অজানা। নাঈমের কথাগুলোও বেশ অবাক করে রুমিকে। হিসেব টা সে মেলাতে পারছে না কিছুতেই। যদি আফতাব আর আখির জীবিত থাকেন তাহলে ওনারা এখন কোথায়? রুমি এবার বেশ কঠোর ভাবেই জিজ্ঞেস করে,’নাঈম এবার তো সত্যি বল? এতো ধোঁয়াশায় রাখিস না?’
সোজা হয়ে বসে নাঈম তারপর অতীতের ঘটনা পুনরাবৃত্তি করতে থাকে,’এই জমিদার আফতাব মোটেও সুবিধার লোক ছিল না। ভ*য়ংক*র লোক তিনি। পূর্ব পুরুষদের সূত্র ধরেই ওনারা অ*ত্যা*চা*র চালিয়ে আসছে। আমি সবসময়ই ভাবতাম গ্রামের মানুষ এত ভয় পায় কেন ওই জমিদার মহল কে? কিন্ত এখন তা বেশ বুঝতে পারছি। মানুষের ভাল তিনি দেখতে পারতেন না। অত্যাচার করে অনেকের জমিজমা নিজের করেও নিয়েছেন। পুলিশ প্রধান ছিল ওনার হাতের মুঠোয় যে জন্য তার কাজ আরও সহজলভ্য ছিল। নিজের মেয়েকে পর্যন্ত খু*ন করে। বাকি দুজন কে হ*ত্যা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। কতটা বিকৃত মানসিকতার মানুষ!! পরীরা তিনবোন আফতাবের বিপরীত। কিন্ত জুম্মানের প্রতি তার কোন হিং*স্র*তা ছিল না। হয়তো ছেলে হয়ে জন্মই তার কারণ। পিকুল কে নিয়ে জুম্মান ভারতে পাড়ি জমায়। একথা আফতাবের কানে পৌঁছাতে আরো ক্ষিপ্ত হন তিনি। পরীর উপর তার রাগটা আরও বাড়তে থাকে। শহরে সে লোক পাঠায় পরীর খোঁজে।
শায়েরের কানে সব খবর পৌঁছে যায়। কিন্তু শায়ের ঠান্ডা মাথার মানুষ। ঠান্ডা মাথায় সে শতজনকে মে*রে ফেললেও কেউ টের পাবে না। আফতাব কোন বুদ্ধি না পেয়ে রুপালিকে ব্যবহার করে। পরী তখন জানত না যে পিকুল কে নিয়ে জুম্মান নিরুদ্দেশ। রুপালির চিঠি হাতে পেয়ে পরী পাগল প্রায়। আমি শায়ের কেউই তাকে আটকাতে পারছিলাম না। তার পর শায়ের আর আমি বুদ্ধি করলাম। আমরা ইচ্ছা করেই পরীকে জমিদার বাড়িতে পাঠালাম। আফতাব ভেবেছিল শিকার তার জালে পড়ে গেছে। কিন্ত সে নিজেই শিকার হয়ে গেছে তা জানতেও পারেনি। গভীর রাতে পরীকে তিনি হত্যা করার জন্য বাগান বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্ত সেখানে আগে থেকেই আমরা উপস্থিত ছিলাম। শায়ের শহর থেকে লোক ভাড়া করে এনেছিল। তাও আফতাবের অগোচরে। পরীকে পেয়ে আফতাবের মাথায় খু*নের নেশা চাপে। সেই খুশিতে সে একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে। সেটার সুযোগ আমরা নেই। ওখানে আফতাব আর আখির গুরতরভাবে আহত হয়। আফতাবের লোকজন তখন কম ছিল। মূলত আফতাব ভাবতে পারেনি শায়ের তার বিপক্ষে এভাবে রুখে দাঁড়াবে!! কয়েকজন রক্ষিরা মারাও যায়। বাকিগুলো প্রাণ নিয়ে ফিরে যায়। কিন্তু বিপত্তি তখনই ঘটে। যখন আফতাবের পোষা পুলিশ সেখানে চলে আসে। কিন্ত বুদ্ধিমান শায়ের সব সামলে নেয়। সে পুলিশ কে জানায় দুপক্ষের সংঘর্ষে আফতাব আর আখির আহত। তাদের দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে। আর আমি যেহেতু ডাক্তার তাই আমাকে চিকিৎসা করতে বলা হল। শহর থেকে ওষুধ আনলাম আর ওখানেই ওনাদের চিকিৎসা করলাম। কিন্ত আফতাব আর আখিরের সুস্থতার জন্য আমি কোন চিকিৎসা করিনি। আমি ওনাদের দিনদিন পাগল হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছি। এমন ওষুধ দিয়েছি যাতে আস্তে আস্তে ওনাদের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আর ওনারা পাগল হয়ে যান। ওনাদের সম্পূর্ণ পাগল করতে আমাকে অনেক কসরত করতে হয়েছে। একসাথে সব ওষুধ প্রয়োগ করলে মৃ*ত্যুর ঝুঁ*কি থাকত। তাই আস্তে আস্তে সব করতে হয়েছে। ওই মৃ*ত রক্ষি গুলোকে কবর দেওয়া হয় বাগান বাড়িতে। এবং পরবর্তীতে পরীর মা’কে দিয়ে শায়েরের বিরুদ্ধে কেস লেখাই যাতে সবাই জানে শায়ের দোষী। পুলিশ শায়ের কে খুঁজবে আর অন্যদিক দিয়ে পরীরা দেশ ছাড়বে। তখন এছাড়া কোন উপায় ছিল না। কারণ যদি কোন পর্যায়ে পুলিশ সত্য জেনে যায় তাহলে পরীসহ সবাই বাংলাদেশে আটকে পড়বে। সবার সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শায়ের নিজেকে বিপদের মধ্যে রেখে সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। সেদিন পরী আর শায়েরের চোখের ভাষার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী আমি ছিলাম। আমার সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিল ওদের কে এভাবে আলাদা হতে দেখে। তবুও ওই মুহূর্তে কিছু করার ছিল না। শোভনকে আমি নিয়ে যেতে দেইনি কেননা ভারতে যাওয়ার পথটা ছিল দূর্গম। সবাইকে ভারত পাঠিয়ে রয়ে গেলাম আমি শায়ের আর শোভন। পুলিশ বাগান বাড়ির কবর খুড়ে কিছু লা*শ পায়। এবং সেসব লা*শের ময়নাতদন্ত করে জানা যায় যে ওখানে আফতাব,আখির,রুপালিসহ কয়েকজন রক্ষিদের লা*শ ছিল। যেহেতু লা*শগুলো কঙ্কাল ছিল তাদের চেহারা বোঝার কোন উপায় নেই। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট গুলো আমি নিজেই বদলে ফেলেছিলাম।
এখানে আফতাবের পোষা পুলিশ টাও আমাদের সাহায্য করেছিল। সে ভেবেছিল আমরা আখির আর আফতাব কে বাঁচানোর জন্য এতকিছু করছি কিন্ত সে ভাবতেও পারেনি যে তার ভাবনা যেখানে শেষ শায়েরের ভাবনা সেখানে শুরু। উল্টো সে নিজেই বিপদে পড়ে গেল। তবে আমাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে গ্রামের লোকজন। সবাই না জানলেও কিছু কিছু লোক জানতো। তারা আগে যেমন চুপ ছিল এখনও সেরকমই চুপ। পুলিশের কাছে কেউ মুখ খোলেনি। তারাও চেয়েছিল আফতাবের শাস্তি হোক।’
লম্বা শ্বাস নিল নাঈম। রুমি মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছিল। মনে মনে সে আরো কিছু প্রশ্ন গুছিয়ে রেখেছে। নাঈমের কথা শেষ হতেই রুমি তার প্রশ্নের তীর ছুঁড়ে মারল,’বুঝলাম, কিন্ত শোভন কে কেন মায়ের থেকে আলাদা রাখলি? পরে তো পরীর কাছে পাঠাতে পারতি! আর শায়ের এই পদক্ষেপ আরও আগেও নিতে পারত! এতো দেরি করার কারণ টা কি?’
নাঈম এবার বেশ বিরক্ত হল,’গাধি একটা,ওতটুকু ছেলেকে কীভাবে ভারতে পাঠাতাম? কোন কারণ তো দেখাতেই হত। মা বাবা ছাড়া একটা ছেলেকে ভারত নিয়ে যেতে হলে আবার না জানি পুলিশ কেসে পড়তে হত। তাছাড়া ততদিনে শায়েরের পরিকল্পনায় শোভন এসে যুক্ত হয়। পরীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারেনি।’
-‘আর আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর?’
-‘শায়ের কেন এত দেরি করল তাই তো? শায়ের ইচ্ছা করলে আফতাব আর আখির কে আরও আগে সরিয়ে দিতে পারত কিন্তু শায়েরের বিরুদ্ধে উপযুক্ত কিছু প্রমাণ ওই পুলিশ টির কাছে ছিল। আফতাবও কম চালাক ছিল না। ওই প্রমাণের জন্য শায়ের চুপ করে থাকত। আর শায়েরের কাছেও আফতাবের বিরুদ্ধে প্রমাণ ছিল। এই কারণেই শায়ের আর আফতাব দুজন দুজনকে মারার ইচ্ছা পোষণ করেও মারতে পারত না। ওই পুলিশের কাছ থেকে সব প্রমাণ আনা মুখের কথা ছিল না। সেজন্য ধীরে ধীরে সব করতে হয়েছে। সব কাজ শেষে শায়ের গোপনে ভারত চলে যেতে পারত কিন্তু তা হল না। সব গোপনে থাকলে জমিদারের সব সম্পত্তি সরকারের কাছে চলে যেত। সেখানেই বিপদ বাঁধে। পরিকল্পনা পরিবর্তন হয় আবারও। তিনবছর পার হয়ে গেছে। তখন শায়ের ধরা দিল পুলিশের হাতে। তদন্তে সময় লাগল প্রায় দুবছর। শায়েরের ফাঁ*সির হুকুম দেওয়া হল। শায়ের আবেদন করে তার ফাঁ*সির দিন দশ মাস পিছিয়ে দিল। শায়েরের শেষ ইচ্ছা পূরণ করল কোর্ট। ওই দশ মাসে জুম্মান ছেলে হিসেবে সব সম্পত্তি এসে বিক্রি করে আবার চলে গেল। জুম্মান চলে যাওয়ার পর এগিয়ে গেল সময়। শায়েরের ফাঁ*সির দিন ঘনিয়ে আসছিল। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম কিন্ত শায়ের উল্টে আমাকে সাহস দিচ্ছিল। মাঝেমধ্যে শায়েরের সাথে ছদ্মবেশে দেখা করতাম। মুসকানের অফিসের বসের সাথে কথা বলে ওদের টিমকে নূরনগর পাঠাই। সেখানেও আমার একজন লোক ছিল যে পরীর ওই খাতাটা মুসকানের নজরে আনে। তারপর বাকি সব মুসকানই করে দেয়। আমার আর কিছু করা লাগে না। তারপরের ঘটনা তোর জানা।’
কথা বলার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না রুমি। শায়েরের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। এতকিছু শুধুমাত্র পরীর জন্য!! একটা মানুষ ঠিক কতটা ভালবাসলে এতকিছু করতে পারে!!! নিজের জীবন সংকটে ফেলতে পারে!! শায়ের কে না দেখলে হয়তো কোনদিন জানতে পারত না।
-‘ভালোবাসা কাউকে পরিপূর্ণভাবে গড়তে পারে আবার কাউকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়। এমন ভালোবাসার সৃষ্টি হওয়ার দরকার ছিল কি?’
রুমির কন্ঠে প্রকাশ পাচ্ছে ব্যকুলতা। যদি কোন নারী দেখে একটা পুরুষ কোন এক নারীর প্রতি ভিশন আকৃষ্ট হয়ে আছে তাহলে সেটা সে সহ্য করতে পারে না। রুমির কাছেও সেরকম মনে হচ্ছে। এমন ভালোবাসা তো সবার জীবনে আসে না। যদি মুসকান জানতে পারে তাহলে কি হবে? মুসকানের কথা ভেবেই রুমি জিজ্ঞেস করে,’আর মুসকানের কি হবে?
ওকে ঠকালি কেন?’
-‘কে বলেছে আমি মুসকান কে ঠকিয়েছি? সে আমার স্ত্রী! সব অধিকার আমি ওকে দেব।’
-‘তাহলে তুই কেন পরীর জন্য এতকিছু করলি? শায়ের তো ভালোবেসে করেছে! তুই এখনও পরীকে ভালোবাসিস তাই না?’
নাঈম হাসল,’শায়েরের মতো করে পরীকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না রুমি। আমি যা করেছি তা সামান্য। আমি শত চেয়েও পরীকে পাব না। হাশরে ও পরী শায়ের দুজন দুজনকে চাইবে আমি চাইলেও পাব না। আমি তখন নাহয় মুগ্ধ চোখে তা দেখে নেব!! দিন শেষে আমার ভালোবাসা সুখে থাকুক তার ভালোবাসার মানুষের সাথে।’
-‘এই গল্পে তোর মত চরিত্র থাকা খুব কঠিন নাঈম। ভালোবাসা কেউ ছাড়তে চায় না আর তুই হাসিমুখে ছেড়ে দিলি।’
-‘একটা গল্পে সব চরিত্রের সুখ লেখা অসম্ভব। এজন্যই আল্লাহ আমার চরিত্রে সুখ লেখেনি। তবে একজন দায়িত্ব বান স্বামী হব।’
রুমির বাসা নির্বিঘ্নে ত্যাগ করে নাঈম। সে আজ সব পিছু টান থেকে মুক্ত। শায়ের ভাল থাকুক পরীকে নিয়ে। বাকি জীবনটা ওদের আনন্দময় কাটুক। সাত বছরের কষ্ট, না পাওয়ার তৃষ্ণা মিটুক। শায়েরের মত ভালোবেসে কেউ আগলে রাখতে পারে না আবার নাঈমের মত ভালোবেসে কেউ ত্যাগ করতেও পারে না। ভালোবাসার এই দুটি রূপ ভিশন ভ*য়ংক*র। কারণ ভালোবেসে আগলে রাখা যেমন কঠিন তেমনি ভালোবাসার মানুষ কে ত্যাগ করাও কঠিন। তবে পরীর সন্তান যে কিছু সময়ের জন্য নাঈম কে পিতা হিসেবে জেনে এসেছে এটাই ওর কাছে অনেক। অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে না’ই বা পেল। এই জীবনে তাই নাঈমের আর কোন আফসোস নেই। সে নতুন করে মুসকানের হাত ধরে অগ্রসর হতে চায়। সবশেষে বলা যায় পৃথিবীর সকলের গন্তব্য একটাই। তা হলো প্রকৃত ভালোবাসা।
—-
শুভ্র রঙের শাড়িটি যেন পরীর দেহেই শোভা পায়। লাল পাড়ের সাদা রঙের শাড়ির পড়ে খাটের উপর পা ছড়িয়ে বসে আছে পরী। খাটের অপর প্রান্তে হেলান দিয়ে বসে আছে শায়ের। গভীর রাত তখন। ঘরের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শোভন মালা আর জেসমিনের কাছে ঘুমিয়েছে। পরীর চোখে ঘুম নেই। একে অপরের দিকে নির্জীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শায়ের পরী। ঘরের জানালা টা খোলা। শনশন করে ঠান্ডা বাতাস ঘরে এসে ঢুকছে। যদিও বাতাস সামান্য,শীতকাল বলেই বাতাস টা বেশ গায়ে লাগছে। শীত নিয়ন্ত্রণ বস্ত্র নেই দুজনের কারো শরীরে। শীতটা যেন দুজনেই খুব করে উপভোগ করছে। পরী খেয়াল করল তার কপোলদ্বয় এই ঠান্ডার ভেতরও গরম হয়ে আসছে। পরে বুঝল এগুলো অশ্রুকণার গরম আভা। বেশ কিছুক্ষণ যাবত ধরেই অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে আর তার স্বামী যেন এতে ভিশন আনন্দ পাচ্ছে!! পরীর খোলা ঘন চুলগুলো হালকা দুলছে। সেও দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে শায়েরের চোখে। অনেক সময় পার হওয়ার পর শায়ের মুখ খুলল,’জানালাটা বন্ধ করে দেই? অনেক তো শীত উপভোগ করলেন। এর বেশি নিলে শরীর খারাপ করবে।’
-‘এতদিন তো শরীর আমার খারাপই ছিল। আচানক ওষুধ মিলে গেল। আর খারাপ করবে না।’
শায়ের উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল। তারপর পরীর সামনে বসে ওর এক পা কোলের উপর রাখল। মসৃণ ফর্সা পায়ে হাত বুলালো বলল,’আমি হীনা খুব কষ্টে ছিলেন কি?’
-‘উত্তরটা আপনি জানেন তবুও জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
জবাব না দিয়ে কেবল হাসল শায়ের। পরী পুনরায় বলে উঠল,’ঘুমাবেন না? নাকি সারারাত আমাকে দেখবেন শুধু?’
-‘আপনি কি চান?’
-‘আমি আপনার ইচ্ছা জানতে চেয়েছি। আমার থেকে কষ্ট বেশি আপনি পেয়েছেন। জানেন আমি ভিশন ভাগ্যবতী। পিতার স্নেহ আমি পাইনি। কতশত মেয়ের কাছে তার পিতা কোন এক রাজ্যের রাজা আর সে রাজকুমারী। কিন্তু আমার কাছে তা শুধু গল্প মাত্র। তবুও আমার আফসোস হয়না। আপনি আছেন বলে। কি এমন জাদু করলেন আমাকে? আমার তো এত ভালোবাসা সহ্য হচ্ছে না।’
পরীর বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কাছে টেনে আনে শায়ের। শক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,’সত্যিকারের ভালোবাসা সব পরিস্থিতিতেও পাশে থাকে। যেমন আমি ছিলাম আর সারাজীবন থাকব। এজন্যই আমার ভালোবাসা আপনাকে সহ্য করতে হবে।’
-‘আপনাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমার নেই মালি সাহেব। আপনি আমার স্বামী। যদি আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা দেওয়ার হুকুম থাকত তাহলে আপনার পায়ে সিজদা দিতাম। তাহলে কি করে আপনাকে দূরে ঠেলে দেই বলুন তো? শুধু আমি কেন মনের মত পুরুষ পেলে পৃথিবীর কোন নারীর ক্ষমতা নেই সেই পুরুষ কে ছেড়ে যাওয়া।’
দম ফেলে ভাল করে শায়েরের মুখে চোখ বুলায় পরী,’শখের শাড়িটি নারীরা ছাড়ে না তাহলে শখের পুরুষ কে ছাড়ে কীভাবে? শাড়ির মতোই শখের পুরুষ টিকে গায়ে জড়িয়ে রাখে।’
-‘শুনেছি সময়ের সাথে সাথে নাকি সব পাল্টে যায় অভ্যাস,ভাল লাগা এমনকি অপেক্ষার রঙ ও পাল্টে যায়। কিন্ত আমার তো কোন কিছুই বদলায়নি। আমি আজও সেই পরীজানে আসক্ত। তাহলে কি ভেবে নিব সত্যি ভালবাসলে কিছুই বদলায় না?’
জবাব না দিয়ে পরী শরীর এলিয়ে দিল বিছানায়। শায়ের ও এক মুহূর্ত দেরি না করে তার ভর ছেড়ে দিল পরীজানের শরীরে। তার পরীজানের গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। পরী অনুভব করল সাত বছরে ফেলা আসা অনুভূতি। সেই অনুভূতির দল আবার ফিরে এসেছে। তার মালি সাহেবের প্রতিটি নিঃশ্বাস তাকে অতীত মনে করিয়ে দিচ্ছে। পরী আবারও সেই গরম আভা টের পাচ্ছে। তবে এই চোখের জল পরীর নয় স্বয়ং শায়েরের। পরীকে শক্ত করে সে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘আপনাকে ভিশন ভালোবাসি পরীজান।’
-‘আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি।’
-‘তাজমহল দেখতে যাবেন?’
-‘কেন? কী আছে ওই তাজমহলে?’
-‘ভালবাসা।’
-‘আমার না প্রয়োজন ধনরত্ন আর না দেখার প্রয়োজন। আমার আপনিই সব।’
-‘ভালোবাসা আছে বলেই বলছি। কিছু তো আছে ভালোবাসায় নাহলে একটা লা*শের জন্য কেউ তো আর তাজমহল বানায় না।’
পরী মৃদু হেসে শায়েরের ঘন চুলে হাত বুলিয়ে দিল। শায়ের আবার ওকে বুঝিয়ে দিল ভালোবাসার আরেক নাম চোখের জল। শায়েরের কথাটাই ঠিক ছিল। শায়ের বলেছিল ওর ভালোবাসায় কাঁদবে পরী। তাই আজও চোখের জল পড়ছে পরীর। বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলেও মনমিলন হয়েছে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে। শুধু চোখের দেখাটাই যে হয়নি। চক্ষু তৃষ্ণা যে বড় তৃষ্ণা। শায়েরের বুকের যে সমুদ্র শুকিয়ে গিয়েছিল আজ সে সমুদ্রে নোনাজল থৈ থৈ করছে। এইতো ভালোবাসা। শায়েরের পরীজানের ভালোবাসা।
পরীর তখন খুব ভাল লাগে যখন সে চোখের সামনে ছেলে স্বামীকে একসাথে আসতে দেখে। যা সে চেয়েছিল। একটা ছোট্ট সুন্দর সংসার। যা ভালোবাসায় ভরপুর। ছেলের মুখের আম্মিজান ডাকটা পরীকে ফের মাতৃত্বের অনুভূতির সাথে সাক্ষাৎ করায়। তখন সে ছেলের গালে মাতৃ স্নেহ দিয়ে তাকে কাছে টেনে নেয়। হেসে বলে,’আমার রাজকুমার।’
শোভন ও পাল্টা জবাব দেয়,’আমি তোমার সিংহ শাবক আম্মিজান।’
পরী কপালে ভাঁজ ফেলে ছেলের কথার মানে বোঝার চেষ্টা চালায় কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। শোভন তখন হেসে বলে,’আম্মিজান আপনি তো শেরনি। আপনার ছেলে তো শের হবেই।’
শোভনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হাসে পরী। পরী বোঝে তার অভিরূপ এই ছেলে। মা যেমন তে*জী হিং*স্র ছিল। ছেলেও ঠিক সেরকম।
রাতে যখন কোন খারাপ স্বপ্নে পরীর ঘুম ভাঙে। আগের মতোই শায়ের তখন পরীকে বুকে টেনে নেয়। আদরে ভুলিয়ে দেয় খারাপ সময় গুলো। অতীতের সমস্ত রশিগুলো ছিড়ে ফেলে দিয়ে ভবিষ্যতের রশি টেনে সামনে এগোয় দুজনে।
কার্শিয়াং এ এভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছে পরী শায়ের। সূর্যদ্বয়ের আগ মুহূর্তে পরী ছুটে যায় পাহাড়ে। তার প্রিয় শীতের সাথে মনমিলন ঘটাতে। কুয়াশার চাদর গায়ে মেখে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে। শিশিরের ঘর ভাঙে তার চরণ তলে। সূর্য কে টেনে আনে ধরায়। ঠিক তখনই পেছন থেকে সেই মধুমাখা কন্ঠটি শুনতে পায়। সে গলা ছেড়ে ডাকছে,”পরীজান” বলে।
___________________(সমাপ্ত)___________________
লেখিকাকে ধন্যবাদ শেষ পর্যন্ত শায়ের আর পরীজান কে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য