#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্বঃ১
শপিং মল ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করছিলো মেহরিন। কেনাকাটা প্রায় শেষ। অরেঞ্জ কালারের একটা গাউন তার বিশেষ পছন্দ হয়েছে। ভালোকরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেটা দেখছিলো। একপর্যায়ে থমকে গেলো। ব্যাঙের মত লাফিয়ে উঠলো হৃদপিন্ডটা। হাত থেকে গাউনটা কখন যে পড়ে গেলো সে নিজেও খেয়াল করলো না। স্থিরভাবে চেয়ে রইলো। সেই মুখ, সেই গাল, সেই হাঁটার ধরণ! অবিকল যেন সেই মানুষটা। মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। এতগুলো বছর পরে সে নিজেকে সামলে উঠেছিলো কিন্তু আবার সেই চিন্তা, সেই ক্ষত বুকের ভেতর তাজা হয়ে উঠছে। তার পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো সেই স্মৃতির জ্বালাপোড়াটুকু। মেহরিন হাত বাড়িয়ে সামনে দাঁড়ালো।
—“হেই! লিটল ম্যান? ক্যান আই টক টু ইউ?”
বাচ্চাটা থমকে গেলো। কয়েক মুহূর্তে মেহরিনের দিকে চেয়ে থেকে অবশেষে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। পেছন পেছন ছুটলো মেহরিনও। কিন্তু নাগাল পেলো না। ভালো করে চারপাশ ঘুরে দেখলো সে। নেই! অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। হতাশ হয়ে হাতের গাউনটা রেখে পেমেন্ট কাউন্টার এর দিকে এগোলো। বিল পেমেন্ট করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। গাড়ির কাছে আসতেই আবার দেখতে পেলো। বয়স্ক একজনের হাত ধরে গাড়িতে উঠছে বাচ্চাটা। বাচ্চাটাকে দেখতে বাঙ্গালী মনে হলেও লোকটাকে এই দেশী মনে হচ্চে। বাচ্চাটার হাতে আইস্ক্রিম। গালের চারপাশে লেগে আছে। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে বারবার গালের চারপাশে লেগে থাকা আইস্ক্রিম মুছছে সে।
মেহরিন এগিয়ে গেলো। কিন্তু এবারেও হাতছাড়া হয়ে গেলো। সে গাড়ির কাছে পৌঁছানোর আগেই ওদের গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো।
★
নিজের ঘরে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছে মাহমুদ। আজকে সারাদিন তার ব্যস্ত কেটেছে। বিছানায় লাফিয়ে উঠে তার পাশে শুয়ে পড়লো সুজান। হাত পা ছড়িয়ে বললো,
—“আই অ্যাম সো টায়ার্ড বাবা।”
মাহমুদ পাশ ফিরলো। ছেলের ছোট্ট শরীরটাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। বড় বড় সিল্কি চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
—“আই অ্যাম অলসো!”
—“তুমি কি এখন ঘুমাবে?”
—“না। বাবার কাজ শেষ হয় নি। সাড়ে পাঁচটায় আবার বেরোতে হবে।”
—“আসবে কখন?”
—“রাত হতে পারে। কেন তুমি বাবাকে মিস করবে?”
–“ইয়েস। আই উইল মিস ইউ!”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাহমুদ। কাজের চাপে ছেলেটাকে ঠিকমত সময় দিতে পারে না সে। ছেলেটা হয়েছে একেবারে এনার মত। কোন কিছু নিয়ে অভিযোগ নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো মাহমুদ। তাকে জরুরি একটা মিটিং এটেন্ড করতে হবে।
রেডি হয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো সে। সুজান খাটে শুয়ে বাবাকে দেখছে। এইটুকু বয়সে সে বুঝে গেছে তার বাবা খুবই কাজ পাগল মানুষ। কাজ ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। ফ্যামিলিও না। খাট থেকে নেমে নিজের ড্রয়িং খাতা খুলে ড্রয়িং করতে বসে গেলো। মন খারাপ হলে সে ড্রয়িং করে।
মাহমুদ ছেলের চুল ঝাঁকি মেরে বললো,
—“আসি বাবা?”
—“ওকে। স্টে সেইফ।”
—“তুমিও। বাবার পারমিশন ছাড়া বাইরে যাবে না কেমন?”
—“যাবো।”
মাহমুদ হাসলো। সে জানে সুজান বাবার বাধ্য ছেলে। তার পারমিশন ছাড়া একপা-ও বাসার বাইরে যাবে না সুজান। মাঝে মাঝেই বাবাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে সে। মাহমুদ ছেলের গালে চুমু খেয়ে বলল,
—“বাবার সাথে দুষ্টুমি হচ্ছে?”
সুজান খিলখিলিয়ে হাসলো। মাহমুদ পুনরায় তার চুলের হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
—“আসি। ”
★
মিটিং শেষে তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছিলো মাহমুদ। লিফটে উঠবে এমন সময় সোহাগ ডাক দিলো। থেমে গেলো সে। সোহাগ কাছে এসে বললো,
—” চলে যাচ্ছেন কেন মাহমুদ ভাই। আজকে আমরা সবাই মিলে একটা পার্টিতে যাচ্ছি। ”
—“গ্রেট নিউজ। কখন যাচ্ছো?”
—“এখুনি। আপনিও যাচ্ছেন। ”
—“আমার সময় হবে না। তোমরা যাও।
—” আমি সুজানকে নিয়ে আসার জন্য বাসায় বলে দিয়েছি। আব্বাস তাকে নিয়ে আসছে।”
আব্বাস সুজানের কেয়ারটেকার। মাহমুদের অনুপস্থিতিতে সে-ই সুজানের দেখাশোনা করে। দুবাই তে তিনমাসের একটা ট্রেনিং এ এসেছে মাহমুদ। সুজানকে কিছুতেই রেখে আসা যায় নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে তাকে নিয়ে আসতে হলো মাহমুদের। এই তিনমাস আব্বাদ সুজানের দেখাশোনা করবে। তারপর আবার দেশে ফিরে যাবে ওরা। মাহমুদ বলল,
—“ভালো করো নি।”
—“খুবই ভালো করেছি। ”
মহমুদ বিরক্ত হলো। এসব পার্টিতে যেতে তার একদম ভালো লাগে না। কিন্তু এদের বাড়াবাড়িতে মাঝেমাঝেই তাকে এটেন্ড করতে হয়।
—“খবর যখন দিয়ে দিয়েছো। আর কি করার চলো।…সুজান কি এখানে আসছে? না ডিরেক্ট পার্টিতে?”
—” পার্টিতে।”
★
টেবিলের এক কোনায় বসে আছে মাহমুদ। দলের বাকিরা সুজানকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। সুজান ইতোমধ্যে বেশ জমিয়ে ফেলেছে। বাবার সাথে এসব পার্টিতে এটেন্ড করার সুযোগ তার খুব একটা হয় না। কদাচিৎ যদি সুযোগ পায় খুব খুশি হয় সে।
দুবাই এর ফরেন মিনিস্টার এর মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে এই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। অতএব দারূণ জাঁকজমক আয়োজন। মাহমুদ বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ভালো লাগছে না। হাত বাড়িয়ে সুজানকে ডাক দিলো সে,
—“সুজান। এদিকে আসো বাবা!”
★
বান্ধবীদের কয়েকজনের সাথে নিচে নামছিলো মেহরিন। এখানকার ফরেন মিনিস্টার এর মেয়ে সোফিয়া তার বান্ধবী। কেক কাটার সময় হয়ে গেছে। সোফিয়াকে নিয়ে নিচে নেমে এলো সবাই।হঠাৎ সেই পরিচিত কন্ঠস্বর কানে আসতেই থমকে গেলো মেহরিন। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। বান্ধবীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে সামনে অগ্রসর হলো। আবারো সেই বাচ্চাটাকে চোখে পড়লো। তার সামনে হাটুমুড়ে কেউ একজন বসে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে বাচ্চাটা। পিছন ফিরে থাকায় সেই ব্যক্তির চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবুও চিনে ফেললো মেহরিন। আচমকা বুকের ভেতর ধাক্কা অনুভব করলো সে যার বেগ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মাথা ঘুরতে শুরু করলো তার। কি করবে সে? মূর্তির মত পলকহীন ভাবে চেয়ে রইলো সামনের দুজনের দিকে। বাচ্চাটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দ্বিধায় পড়ে গেলো মেহরিন। সে কি যাবে? কথা বলবে? একটার অন্তত চোখের দেখা দেখবে? না! থাক। কি দরকার পুরোনো স্মৃতিগুলোকে আবার জাগিয়ে তোলার। মানুষটা ভালো আছে। সংসারী হয়েছে আর কি চাই মেহরিনের। এইটুকুই তো চেয়েছিলো সে।আড়ালে সরে গেলো মেহরিন।
★
নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করছে মেহরিন। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। হঠাৎ পিঠে টোকা পড়তেই চমকে উঠলো সে। সামনের মানুষটার দিকে অসহায় ভাবে চেয়ে রইলো। রায়হান হাসি মুখে বললো,
—“কি ব্যাপার? তুমি ঠিক আছো?”
শরীরের কাঁপুনিটুকু থামার সময় নিল মেহরিন। ধাতস্থ হয়ে নরম গলায় বললো,
—“আমি ঠিক আছি।”
—“সিউর?”
—“হ্যাঁ।”
—“ওকে। দেন লেটস এঞ্জয়?”
মেহরিনের অস্থির লাগছে। এখানে আর একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইছে না। ঝাপিয়ে কান্না আসছে তার। ধরে আসা কন্ঠে বললো,
—“আই এম সরি রায়হান। আমার বাসায় যেতে হবে!”
রায়হান ওর চেহারা দেখে আন্দাজ করে নিলো কিছু একটা হয়েছে। ঘাটাঘাটি করলো না সে। বলল,
—“চলো।”
সারারাস্তা গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদেছে মেহরিন। রায়হান বাধা দিলো না। এই মুহূর্তে মেহরিনকে কিছু জিজ্ঞেস করা সংগত হবে না নিশ্চই। তাকে স্বাভাবিক হওয়ার সময় দেওয়া উচিৎ। বাসায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো সে। বাসায় ঢুকেই বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো মেহরিন। কান্নার বেগ ক্রমাগত বাড়লো। একসময় চিৎকারে পরিনত হলো। নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না সে। দুটো ঘুমের ওষুধ একসাথে খেয়ে মরার মত বিছানায় পড়ে রইল সে।
(