পুনরায় শেষ পর্ব

#পুনরায়
#অরিত্রিকা_আহানা
#অন্তিমপর্ব
সোহাগ গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বযে নিউজফিড স্ক্রল করছিলো। হঠাৎ মেহরিনের নাম্বার থেকে ফোন আসতেই মুচকি হেসে রিসিভ করে ধীরেসুস্থে ফোনটা রিসিভ করলো সে। মুখে হাসির রেখেই বললো,
—“ইয়েস আই অ্যাম অন দ্যা ওয়ে!”
—“জি আপনি কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে পুরুষালি কন্ঠের একজন জিজ্ঞেস করলো প্রশ্নটি। আশাহত সোহাগ অবাক হয়ে নাম্বারটি চেক করলো। ঠিকই আছে, মেহরিনের নাম্বার। কিন্তু ওর ফোন থেকে কে কথা বলছে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
—“আমি সোহাগ। আপনি কে বলছেন? এটা তো মেহরিনের নাম্বার।”
—“জি এইমাত্র উনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমরা উনাকে নিয়ে হস্পিটালে যাচ্ছি। আপনি তাড়াতাড়ি….
হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো সোহাগের। ধাক্কা সামুলাতে হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। ওপাশ থেকে ভদ্রলোকের দ্বিধান্বিত কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। বিরতিহীন ভাবে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছেন তিনি।
—“হ্যালো,….হ্যালো আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?”
সোহাগ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল,
—“জি পাচ্ছি। সুজান?…সুজান কেমন আছে?”
সুজান ভদ্রলোকের সাথে ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রলোক আশ্বাস দিয়ে বললেন,
—“বাচ্চার কোন ক্ষতি হয় নি। আমি আপনাকে হাসপাতালের এড্রেস পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসুন।”

ফোন আসার আগে সোহাগ গাড়ি নিয়ে সামনের শপিং মল এর নিচে অপেক্ষা করছিলো। ওদের যাত্রা পথেই হুট করেই মাহমুদ গাড়ি থামাতে বলে পাশের এই বড়সড় শপিং মল টিতে ঢুকে যায়। সোহাগ কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। কেবল মুচকি হেসেছিলো। মাহমুদও প্রতিউত্তরে হেসেছিলো কেবল। মাহমুদ ভেতরে যাওয়ার আধঘন্টার মাঝেই হঠাৎ করে ফোনটা এলো। ভদ্রলোক হাসপাতালের এড্রেস জানালো। মেহরিন তাকে মেসেজ করে যেই এড্রেস দিয়েছিলো তার কাছাকাছি একটা হাসপাতালেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওকে। সোহাগের সাথে কথা বলার পর রেডি হয়ে সুজানকে নিয়ে ঘুরতে বেরচ্ছিলো সে। ঘুরতে যাওয়ার লোকেশনগা মেসেজ করে সোহাগকে পাঠিয়েছিলো। কিন্তু লোকশনের কাছাকাছি এসেই হঠাৎ করে অ্যাক্সিডেন্টটা হলো।
সোহাগ অসাড়ভাবেই কোনরকম মাহমুদের নাম্বারে কল দিলো। রিং হওয়ার আগেই হাসিমুখে শপিংমল থেকে বেরোতে দেখা গেলো মাহমুদকে। গাড়ি কাছে এগিয়ে আসতেই সোহাগের চেহারা দেখে অশনিসংকেত বেজে উঠলো তার বুকের ভেতর। উদ্বিগ্ন, অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ,
—“কি ব্যাপার সোহাগ? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোন সমস্যা?”
সোহাগ গাড়ি থেকে বেরিয়ে অপরাধির মত মুখ করে বলল,
—“মেহরিনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে মাহমুদ ভাই!”
মুহূর্তেই রক্তশূন্য হয়ে গেলো মাহমুদের মুখ। অজানা আতংকে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। আশেপাশের সমস্ত কিছু কাঁপিয়ে ঝাঁকি দিয়ে উঠলো সমস্ত শরীর। ব্যাপার খেয়াল করতে একসেকেন্ডও দেরী করে নি সোহাগ। লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে। এমন একটা খবর মাহমুদকে দিতে নিজেকে কেমন অপরাধি মনে হচ্ছিলো তার।
—“শান্ত হোন মাহমুদ ভাই।”
মাহমুদ ঘোরের মাঝে আছে যেন। আকস্মিক এমন আঘাত তার বোধশক্তিকে বিকল করে দিয়েছে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে, অস্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করলো কেবল,
—“সুজান?”
—“হি ইজ সেইফ!”
তাকে ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো সোহাগ। একটু আগে সে নিজেই স্থির হতে পারছিলো না কিন্তু মাহমুদের অবস্থা দেখে সব নিজের অস্থিরতা বেমালুম উধাও হয়ে গেলো। এইমুহূর্তে এই মানুষটা যে আঘাত পেয়েছে তার কাছে ওর নিজের অস্থিরতা কিছুই নয়। গাড়িতে বসে মাহমুদ ফ্যালফ্যাল করে হাতের রিং বক্সটার দিকে রইলো।

সুজান মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মাহমুদকে দেখে তার হাত ছাড়িয়ে দৌঁড়ে বাবার কাছে এলো সে। ভদ্রলোক জানালেন মেহরিনকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। কি অবস্থা ডাক্তাররা এখনো কিছু জানায় নি। সোহাগ চলে গেলো ঐ ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে। সুজানের কাছ হাটুমুড়ে বসলো মাহমুদ। সুজান কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,
—“বাবা,…মা?”
ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার পরিস্থিতে ছিলো না মাহমুদ। যন্ত্রের মত কেবল কথা গুলো শুনে যাচ্ছিলো। সুজান বাবার দুহাত ঝাঁকি দিয়ে, জড়িয়ে ধরে বললো,
—“আমরা মাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। মা খুব ভালো।…খুব ভালো!”
—“কিচ্ছু হবে না তোমার মায়ের। ”
—“সত্যি বলছো?”
হাউমাউ করে কান্নাটা ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না মাহমুদ। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলো সে। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললো,
—“আমাকে সহ্য করবার ক্ষমতা দাও খোদা। আমার ছোট ছেলেটার জন্যে হলেও আমাকে সহ্য করবার ক্ষমতা দাও। আমি ছাড়া ওর কেউ নেই।”

দুঘন্টা বাদে ডাক্তার হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন। মাহমুদ নিশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে আছে উনার মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। বয়স্ক ডাক্তার ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে কোন ভনিতা না করেই বললেন,
—“থ্যাংক টু দ্যা অলমাইটি। সি ইজ সেইস নাউ।”
গাড় অন্ধকার সরে গিয়ে দিগ্বিজয়ী হাসি ফুটে উঠলো মাহমুদের চেহারায়। খুশিতে আত্মহারা হয়ে সুজানের গালে চুমু খেয়ে বলল,
—“কান্না বন্ধ করো বাবা। ডাক্তার কি বলেছে শুনেছো? তোমার মা ভালো হয়ে গেছেন। আর কোন ভয় নেই। ভালো হয়ে গেছেন তোমার মা।”
বাপ ছেলে দুজনের মুখেই ভুবনজয়ী হাসি। সোহাগ তার চোখের কোনে লেগে থাকা পানিটুকু মুছে মুচকি হাসলো। খুশির বাধ ছাড়িয়ে সেই প্রথম বাস্তবে ফিরে এলো। হাসি মুখে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
—“আমরা কি পেশেন্ট এর সাথে দেখা করতে পারি?”
—“মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। এখন স্ট্রেস না দেওয়াই ভালো। পেশেন্ট ঘুমোচ্ছে।”
মাহমুদ অস্থির কন্ঠে বললো,
—“আমরা কোন স্ট্রেস দেবো না। শুধু বাইরে থেকে দেখেই চলে আসবো।”
—“ঠিক আছে। আমি নার্সকে বলে দিচ্ছি। আপনাদের ভেতরে নিয়ে যাবেন।”

অবশেষে দুদিন বাদে আজ মেহরিন সম্পূর্ণ সচেতন। এই দুইদিন দুর্বল শরীরে কেবল ঘুমিয়েছে। চেতনা ফিরতেই প্রথমে সুজানের কথা জিজ্ঞেস করলো। আকুতি ভরা কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো,
—“আমার ছেলে! আমার ছেলে!…সুজান!”
নার্স ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
—“আপনার ছেলে বাইরেই আছে। ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। চিন্তা করার কিছু নেই।”
সুজানকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো মাহমুদ। ভেতরে ঢুকেই সুজান দৌঁড়ে মায়ের কাছে চলে গেলো। ওকে বুকে জড়িয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলো মেহরিন। তারপর চোখ মুছে ওর দুগালে অজস্র চুমু খেয়ে বললো,
—“তুই আমার ছেলে। আমার কাছে থাকবি। আমার ছেলে তুই!”
সুজান বাধ্য ছেলের মত তার বুকের সাথে মিশে রইলো। ওকে আরো শক্ত করে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরলো মেহরিন। মাহমুদ মুগ্ধ নয়নে সেই দৃশ্য অবলোকন করলো। এর চেয়ে পবিত্র কোন ভালোবাসা বুঝি আর হয় না। এমন নিখাদ, নিষ্পাপ, সরল ভালোবাসার কাছে পৃথিবী অন্য সব ভালোবাসা তুচ্ছ। তাকে দেখতে পেয়ে মেহরিন খানিকটা ভয় পেলো। আবারো সেই আতংক মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো, মাহমুদ কি সুজানকে নিয়ে চলে যাবে? মাহমুদকে শোনাতেই যেন অস্ফুটসরে উচ্চারণ করলো সে,
—“আমার ছেলে!”
মাহমুদ হাসলো। সস্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিগলিত কন্ঠে বললো,
—“তোমারই তো ছেলে!”
মাহমুদের এমন আদুরেপনাতে সব ভয় দূর হয়ে গেলো মেহরিনের। অনুতপ্ত কন্ঠে বললো,
—“আমি বিয়ে ক্যান্সেল করে দিয়েছি মাহমুদ!”
—“জানি আমি। ওসব এখন না থাক। আমিও ফ্লাইট ক্যান্সেল করে দিয়েছি।”
—“যাবে না?”
—“যেতে আর দিলে কই?”
হাসি ফুটে উঠলো মেহরিনের মুখে। খুশিতে সুজানের গালে নিবিড় ভাবে চুমু খেলো সে। মাহমুদ আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—“পুত্রমাতা কি শুধু পুত্রকেই আদর সোহাগ করবেন নাকি পুত্রের বাবাকেও কিছু আদর যত্ন করা হবে?”
মেহরিন লজ্জা আরক্তিম হয়ে তার বুকের আলতো চড় মারলো সাথে সাথেই মাহমুদ ওর হাতখানা টেনে নিয়ে বুকের জড়িয়ে ধরে বললো,
—“আমি আল্লাহর কাছে শুধু সহ্য শক্তি চেয়েছিলেন মেহরিন। তোমার কিছু হলে মরে যেতাম আমি। একদম মরে যেতাম। তখন আমার ছেলেটার কি হতো?”
মেহরিন অভিমানী গলায় বললো,
—“দূরে সরিয়ে দিয়ে তো খুব সুখেই ছিলে।”
মাহমুদের চোখে কোন রাগ, অভিমান নেই। আছে শুধু ভয়। মেহরিনকে হারানোর ভয়। ছলছল চোখে চেয়ে অপরাধির মত বললো,
—“কি করতাম আমি? কোন অধিকারে তোমার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম? আমি ভেবেছিলাম তুমি রাহাতকে বিয়ে করে সুখি হতে চেয়েছিলে। তাই নিজের ভালোবাসাটা লুকিয়ে রেখেছিলান। কিন্তু তুমি তো জানতে, তুমি স্বেচ্ছায় গিয়ে দাঁড়ালে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই, তবুও কেন এত কষ্ট দিলে!”
মাহমুদের চোখে পানি। ব্যস্ত ভাবে শার্টের কোনা দিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করলো সে। মেহরিন তৃপ্ত চোখে চেয়ে রইল তার প্রেমিক পুরুষটির দিকে। এই মানুষটাকে আর কষ্ট দেবে না সে। সহ্যের চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট ভোগ করে ফেলেছে মানুষটা। এতটা কষ্ট বোধহয় তার পাওনা ছিলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মাথাটা মাহমুদের কাধে এলিয়ে দিলো সে। চোখ বন্ধ রেখেই টের পেলো তার হাতে রিং পরিয়ে দিচ্ছে মাহমুদ। হাসলো মেহরিন। অবশেষে এতগুলো বছর বাদে পুনরায় তার ভালোবাসার মানুষটা তার কাছে এসে ধরা দিয়েছে। দুজনের মাঝখানে সুজানকে টেনে নিলো সে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here