#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২
বাসের ঝোঁক সামলাতে না পেরে ফাল্গুনী তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আষ্টেপৃষ্ঠে জায়গা করে নিয়েছে জাগ্রতর কোলে। জাগ্রতও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ফাল্গুনীকে। দুরত্ব এখন বহুদূরে। ফাল্গুনীর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে তার বুক পাঁজরে তীব্র গতিতে স্পন্দনকৃত হৃদয় বুঝি বেরিয়ে আসছে বুক চিড়ে।
জাগ্রত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফাল্গুনীকে দেখছে। চমকেছে এতোটাই যে ফাল্গুনীকে প্রশ্নে উথলানো দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে ভুলে গেছে সে। ফাল্গুনী তাড়াহুড়ো করে ওঠে পড়ে ধপ করে বসে যায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সিটটিতে। জাগ্রত বুঝতে পারছে না তার প্রতিক্রিয়া এখন কেমন হওয়া উচিত। একজন অপরিচিত পরপুরুষ এর ন্যায় নজর সরিয়ে নেওয়া উচিত নাকি মনের ভেতর বৃষ্টির পানির ন্যায় জমানো শত সহস্র প্রশ্ন আর অভিযোগ এর ধারা বহানো উচিত। সম্মোহনী রেখায় ভাঁজ হলো জাগ্রত। মায়া মিশেল কন্ঠে ডেকে ওঠলো,
‘ফাগুন’ বলে।
ফাল্গুনীর অন্তর কেঁপে উঠলো ডাক টি শুনে। ফাগুন! নামটা যে মনের ভেতর গভীর এক আঁচড় কেটে দিলো। তবে উত্তর সে দিলো না। বরফের ন্যায় জমে কঠিন হয়ে বসে রইলো। জাগ্রতর চোখ মুখে এতোক্ষণ যে অবাকের রেষ ছিলো হটাৎ তা গায়েব হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর তাচ্ছিল্য মুখভঙ্গিতে বলে ওঠলো,
‘তুমি বরিশালে যে! নিজের বাড়িতে বুঝি জায়গা হয়নি? ওখানেও মানিয়ে থাকতে পারনি সবার সাথে, তাই না? তা না হলে টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ি রেখে বরিশালে তোমার কি কাজ? আমার জানা মতে, সেখানে তো তোমার কোন আত্মীয়ের বাড়িও নেই।’
ফাল্গুনীর সোজা বুকে গিয়ে লাগলো কথাখানা। এসব কথার সম্মুখীন হওয়ার ভয়-ই সে পেতো। এতোক্ষণের নিরবতার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফাল্গুনী জবাব দিয়ে ওঠলো,
‘মানিয়ে চলার প্রশ্ন তখন আসে যখন আশেপাশে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বসবাস করে। সেই অভাবেই তো কোন একদিন মানিয়ে নিতে না পারার তকমা লেগেছিলো গায়ে। তবে তা নিজের বাড়িতে নয়। কেনোনা নিজের বাড়িতে কখনো মানিয়ে চলার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার বাড়িতে আমি থাকবো কি থাকবো না তা আমার সিদ্ধান্তঃ। আর তাছাড়া বরিশাল তো আর আপনি কিনে নেননি। সেখানে কে এলো কে গেলো তা দিয়ে আপনার কি কাজ? কই আমার তো আপনার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাহলে আপনার কেনো হচ্ছে?’
জাগ্রত দমে গেলো না। হাসি মুখেই বলে ওঠলো,
‘কারো মাথা ব্যাথা হওয়ার কারণ হতেও কিছু গুণের অধিকারী হতে হয়। তোমার ভেতর তার ছিটেফোঁটাও নেই। তুমি কারো মাথায় বড়জোড় বোঝা হতে পারো, ব্যাথা নয়।’
জাগ্রত কথা শেষ করে হটাৎ কিছু একটা ভেবে আবারও বলে ওঠলো,
‘বাই দা ওয়ে, তুমি একা একা নাইট শিফটে কেনো জার্নি করছো? এখনও বুঝি দিন দুনিয়ার হিংস্রতা সম্পর্কে জ্ঞান হয়নি? নাকি বলবে এখনও বয়স হয়নি পরিস্থিতি বোঝার? দিনের বেলায়ই আজকাল একটা মেয়ে যেখানে সেইফ নয় সেখানে তুমি এতো রাতে জার্নি করছো তাও আবার সম্পূর্ণ একা একা। আমার জায়গায় তো একজন অচেনা পরপুরুষ ও থাকতে পারতো। এভাবে কোন পরপুরুষ এর কোলে চড়ে বসে থাকতে?’
জাগ্রতর আচমকা এমন উগ্রতা দেখে অবাক হলো ফাল্গুনী। সেও খানিক হাসি মুখেই প্রত্যুত্তর করে ওঠলো,
‘পরিস্থিতি বোঝার সামর্থ্য কতটুকু হয়েছে জানি না তবে যে কোন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বুদ্ধি ও মনোবল অবশ্যই হয়েছে। আর পরপুরুষ এর কথা বলছেন, আপনি বুঝি আমার জন্য পরপুরুষ নন? আপনি আমার আপন কেউ?’
‘ফাউল তর্ক করার অভ্যেস এখনো ভুলো নি দেখছি।’
‘আপনি দোষারোপ করা ভুলেননি
দেখছি।’
‘এখানেও ঝগড়া বাঁধাচ্ছো!’
‘আগের মতো আজও ঝগড়ার দায়ভার আমার ওপরেই চাপাচ্ছেন। শুনুন, আমি আপনার ঘরের বউ নই। তাই দোষ খোঁজা বন্ধ করুন। আর দয়া করে একটু চুপ থাকুন। মনে করুন আমাকে আপনি চেনেন না। আগে কখনো দেখা হয়নি আমাদের। আশা করি আর কথা বাড়িয়ে নিজের নির্লজ্জতার পরিচয় দেবেন না।’
ফাল্গুনীর এবার নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় এক প্রাণ বলে মনে হচ্ছে। ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে বেড়িয়ে আসছে অতীতের অধ্যায়। চার চারটি বছর সে পার করেছে একা। সম্পূর্ণ একা। বাকি জীবনটাও এবাবেই পার হয়ে যেতো। কেনো আবার দেখা হলো।
দুজনেই জখম হৃদয় নিয়ে চুপচাপ বসে আছে দুদিকে ফিরে। মুখোমুখি হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে দুই ঘন্টা। এই দুই ঘন্টায় কেউ কোন কথা বলে নি একে অপরের সাথে। অতিক্রম হয়েছে দীর্ঘশ্বাস এ ভরপুর আকাশ সমান এক বিশাল মূহুর্ত। কেউ কোন কথা খরচ করে লোকসান এর ভাগিদার হয়নি। আর না দৃষ্টি বিনিময়ে হয়েছে কোন আবেগ, ক্ষোভ বা অনূভুতির প্রকাশ। দুজনেই অপেক্ষায় আছে এক নতুন ভোরের। যে ভোরে বাস গিয়ে থেমে যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আর মুক্ত হয়ে গন্তব্যে পা বাড়াবে দুজন দু’দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস থেমে গেলো। ফেরিঘাটে এখনো পৌঁছাতে পারে নি বাসটি। ফেরিঘাট থেকে পাঁচ কি.মি. দুরে জ্যামের ধুলো-ধোঁয়ায় আটকা পড়েছে। এ কোন নতুন কিছু নয়। এ রাস্তায় এটি প্রতিনিয়ত হয়ে থাকে। তা যাত্রীগণ সবাই জানে। বাস থামতেই ভিড় করছে বিভিন্ন ফেরিওয়ালাদের দল। হাঁকিয়ে যাচ্ছে একেকজন একেক বস্তু ফেরি করার উদ্দেশ্যে। বাস থামছে আবার চলছে, আবার থামছে আবার চলছে। এভাবেই চার ঘন্টার বেশি অতিক্রম হয়ে গেলো।
চার ঘন্টা পর বাস পৌঁছে গেলো ফেরি ঘাটে। ফেরি ছাড়তেই ফাল্গুনী ওঠে যায়। এক প্রকার দৌড়ে চলে যায় চার তলা ফেরির ছোট পরিসরের ছাঁদখানায়। ছাঁদটা খালি। মানুষের আনাগোনা শুরু হয়নি এখনও।
ফাল্গুনীর পিছু পিছু এগিয়ে গেছে জাগ্রত। যাওয়ার আগে বার বার নিজের সাথে যুদ্ধ করে তারপরেই এগিয়েছে। মনটা যেনো দোমুখো কাল সাপ। দু’দিকেই বিষ ছোবল মারে। মনের বিষ হজম করে সিদ্ধান্তঃ নিয়েছে সব প্রশ্নের উত্তর আজই চাইবে সে। আজও কেনো এতো ঘৃণা চোখে নিয়ে বেড়ায় মেয়েটা তার প্রতি, তার উত্তর চাইবে। দোষ কি তার একাই ছিলো? সে বুঝি কোন দোষ করেনি? তবু তার দৃষ্টিতে শুধু সে একাই কেনো দোষী?
জাগ্রত ছাঁদে পৌঁছে গিয়ে ফাল্গুনীর পিছনে দাঁড়িয়েছে। ফাল্গুনী পিছু ফিরো দাড়িয়ে আছে। দেখতে পায়নি জাগ্রতকে। জাগ্রত কিছু বলবে এর মধ্যেই কয়েকজন যাত্রী উঠে আসে ছাঁদে। চারপাশে ঘুড়ে ঘুড়ে এদিক সেদিক ফিরে ছবি তুলতে থাকে তারা। জাগ্রত আর কিছু বলে ওঠতে পারে না। নেমে যায় নিশ্চুপ হয়ে। বাস একবার ছাড়ুক তারপর কথা বলবে সে।
ফাল্গুনী এসেছিলো কিছুক্ষণ একা থাকতে। কিন্তু এখন আর এখানে একা থাকা সম্ভব নয়। তাই সেও নেমে গেলো নিচে। তবে বাসের ভেতরে প্রবেশ করলো না তৎক্ষনাৎ। ফেরির এক কিনারায় দাঁড়িয়ে রইলো রেলিং ঘেষে। ভাবছে এতোটা পথ কি করে আজ অতিক্রম করবে সে!
হটাৎ ফাল্গুনীকে কেউ ডেকে ওঠলো নাম ধরে। ফাল্গুনী এদিক সেদিক নজর চালিয়ে তেমন কাওকেই খুঁজে পেলো না। হটাৎ তার চোখ যায় দোতলায়। সেখানে কেউ হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। হাত নাড়ানো বন্ধ করে সেখান থেকে সরে এসে উঁচু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে ছেলেটি। মানুষটিকে চিনতে পেরে ফাল্গুনী বিরক্ত হলো। রাগ হলো নিজের কপালের ওপর। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আর কার কার সাথে দেখা হবে আজ রাতে। সোহাগ এখানে কেনো! তার তো আগামীকাল যাওয়ার কথা ছিলো।
‘আরে ফাল্গুনী আমি তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যিই এটা তুমি তো? কি সোনায় বাধানো কপাল আমার বলো। স্বয়ং ওপরওয়ালাও চান আমাদের দেখা হোক তাই এতো দূর চলে এসেও দেখা হয়ে গেলো। পালাতে পারলে না তো!’
সোহাগের কথায় মহা বিরক্তিতে ছেয়ে গেলেও হাসি মুখে চেয়ে রইলো শুধু ফাল্গুনী। প্রত্যুত্তর করলো না। সোহাগ টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো। ফাল্গুনী হাসি বজয় রেখেই হু হা করে করে গেলো। কথা বাড়ানোর মতো মন মানসিকতা তার এখন নেই।
এদিকে জাগ্রত বাসের জানালায় বসে দেখে যাচ্ছিলো ফাল্গুনীকে। অপেক্ষা করছিলো ফেরি পার হয়ে বাস ছেড়ে দেওয়ার। বাসে বসে কথা এড়িয়ে আর যাবে কই? হটাৎ করে ফাল্গুনীর পাশে একটা ছেলে দেখে অবাক নজরে চেয়ে রইলো। সবথেকে বেশি অবাক হলো ফাল্গুনীকে এতো হেসে হেসে কথা বলতে দেখে। হাসি যেনে সরছেই না মুখ থেকে।
জাগ্রত সিট থেকে ওঠে দাড়ালো। ধপাধপ্ নেমে গেলো বাস থেকে। বসে থাকতে পারলো না চুপচাপ। নেমে গিয়ে ফাল্গুনী যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকটায় পা বাড়ালো।
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩
জাগ্রত সিট থেকে ওঠে দাড়ালো। ধপাধপ্ নেমে গেলো বাস থেকে। বসে থাকতে পারলো না চুপচাপ। নেমে গিয়ে ফাল্গুনী যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকটায় পা বাড়ালো। কিছুদূর যাওয়ার পর তার মনে হলো, কেনো এলো সে! আর ওখানে গিয়েই বা কি করবে। অযথা উঠেই বা কেনো এলো, ভাবলো আবার ফিরে যাবে বাসে। কিন্তু আচমকাই ফাল্গুনীর চোখে চোখ পড়ে গেলো। ফাল্গুনীকে চেয়ে থাকতে দেখে সোহাগ ও তাকিয়েছে জাগ্রতর দিকে। এবার ফিরে গেলে কেমন দেখাবে ভেবে আর ফিরে গেলো না জাগ্রত। এগিয়ে গেলো ফাল্গুনীর দিকে আর পাশ কাটিয়ে চলে গেলো দোতলায়। অঙ্গভঙ্গি এমন, যেনো সে তাঁদের চেনে না। দেখেও নি কোনদিন।
ফাল্গুনী নিজেও অতি স্বাভাবিক ভাবে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। সোহাগ কে বুঝতে দেয়নি কিছু। প্রথমে জাগ্রতকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ফাল্গুনী। শ’ঙ্কায় ছিলো কোন বি’প’ত্তি না সৃষ্টি হয়। সোহাগ আছে সাথে। যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলে তার সামনে তাহলে লজ্জায় মাথা কা’টা যাবে। এদিকে সোহাগের বকবকানির কোন থামাথামি নেই। মাথাটাও দপদপ করছে ব্যাথায়। একসাথে এতো মানসিক চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না।
‘ফেরিতে ওঠার পর কিছু খেয়েছিলে তুমি?’
সোহাগের কথায় ঘোর কাটে ফাল্গুনীর। ছোট্ট করে জবাব দেয়, ‘না খাইনি।’।
‘সেকি, রাতের এখন ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে? ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই। চলো খাবে চলো। আমিও তেমন ভারি কিছু খাইনি। খাবো বলেই ওঠেছিলাম দোতলায়। তারপর তোমায় দেখে নেমে এলাম নিচে। ফেরি ওপারে পৌছাতে আর বেশি সময় নেই। চলো জলদি। দুজনে আজ ইলিশ দিয়ে ভাত খাবো। ইলিশ ভাজা আর ইলিশ ঝোল দুটোই নেবো কি বলো?’
‘আপনি ব্যাাস্ত হবেন না। এসবের কোন প্রয়োজন নেই। গাড়িতে বমি হয়েছিলো গলা বোধহয় ছিলে গেছে। এখন খেতে পারবো না কিছু। গলায় জ্বালা করবে, কষ্ট হবে ভীষণ। আপনি যান খেয়ে আসুন। আমার তেমন খিদে নেই।’
‘আরে সেটা আগে বলবে তো। দাঁড়াও এক মিনিট আমি এক্ষুনি আসছি। এখান থেকে কোথাও যেও না কিন্তু। এখানেই দাঁড়াবে।’
সোহাগ ফটাফট পা চালিয়ে ফেরির শেষ মাথায় চলে গেলো। ফেরি তে ওঠার পর প্রথমেই সেখানে ডাবের সন্ধান পেয়েছিলো সে। ফেরি তে প্রায় সবধরনের খাবার এর জিনিস এবং জরুরি দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। বড় ফেরি হলে তো কথাই নেই। ডাব বিক্রেতা দুই পাশে দুই বাধি ডাব নিয়ে বসেছে। আকার আর আয়তন ভেদে দুই রকমের দর নির্ধারিত করা আছে। সোহাগ বেছে বেছে বেশ বড় এবং কচি একটি ডাব বাছাই করে কাটতে বললো ডাব বিক্রেতাকে। দর হলো সত্তর টাকা। সময়টা মধ্যরাত তাই দামও একটু চড়া। দিন হলে পঞ্চাশ টাকায় অনায়াসে দিয়ে দিতো।
জাগ্রত দোতলায় খানিক আড়াল হয়ে হয়ে বসে আছে। না চাইতেও নজর রেখে যাচ্ছে ফাল্গুনীর গতিবিধির উপর। নিজের মনকে শাসিয়েও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি নিজের দৃষ্টি সীমানার। বারেবার শুধু আলোর গতিতে ছুটে চলে গেছে ফাল্গুনী বরাবর। এ সীমার সীমানা ঘাঁটি যেনো ফাল্গুনীতেই শেষ।
ফাল্গুনী যখন ক্ষনে ক্ষনে হাসছিলো আর কথার জবাব দিচ্ছিলো সোহাগের সাথে, জাগ্রত তখন অতীত হাতড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাদের দুজনার একসাথে কোন হাসিখুশি মুহুর্তের প্রতিচ্ছবি। যেখানে জাগ্রতর কথায় এমন মিষ্টি করে হেসেছে তার ফাগুন। কিন্তু হায়! সে খুঁজে পায়নি এমন কোন মুহূর্ত। এক বছরের সংসার ছিলো দুজনের। তিনশো পঁয়ষট্টিটি দিন। একটি দিনও এমন যায়নি যেদিন দুজনে সামনাসামনি হয়ে হেসে দুটো কথা বলেছে। ভাগ করে নিয়েছে হৃদয় নিঙড়ানো অনুভূতি। তবু কেনো এতো পিছুটান। কেনো?
ফাল্গুনীর ভীষণ অস্থির লাগছে। তার মনের ভেতর শুধু জাগ্রতকে নিয়ে ঘাটাঘাটি হচ্ছে। কোনভাবেই ওই মানুষটার চিন্তা মাথা থেকে অপসারণ করতে পারছে না। সোহাগ কে নিয়ে আরও বেশি চিন্তা। সোহাগকে তার সাথে দেখে আবার উল্টো পাল্টা না ভেবে নেয় জাগ্রত। তাহলে আবার তার দোষ গুণের ময়নাতদন্ত নিয়ে বসবে। তখন যেভাবে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো মনে হচ্ছিল গোল বাঁধাতেই আসছে। তারপর হটাৎ পাশ কাটিয়ে চলে গেলো দোতলায়। দোতলায় বসে আবার নজর রাখছে কি না এদিকে সেটা নিয়েই এখন চিন্তা হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে প্রচন্ড। চোখ তুলে ওপর দিকে চেয়ে দেখতেও মনে সায় দেয় না। যদি চোখে চোখ পড়ে যায়। তাহলে কি হবে? না তাকিয়েও শান্তি লাগছে না। মনটা খুব নিশপিশ করছে।
হটাৎ এক দারুণ বুদ্ধির আগমন হলো ফাল্গুনীর মস্তিষ্কে। দেড় হাত দুরে পার্ক করে রাখা আছে একটি বাইক। সেই বাইকের সম্মুখভাগে থাকা লুকিং গ্লাসটি দিয়ে অনায়াসে দোতলায় নজর হাঁটকানো যাবে। দোতলায় যথেষ্ট মাত্রায় আলোর উপস্থিতি বিদ্যমান তাই বিষয়টা খুব একটা কঠিন হবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাল্গুনী দুই পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বাইকটির কাছে। সজাগ নজরে আশপাশটা একটু দেখে মনে মনে ভাবলো, ‘কে জানে বাইকটির মালিক কে আর কোথায় আছে। এসে দু’টো ঝারি না মারলেই হয়।’ বাইকের লুকিং গ্লাসটি ঘুড়ানোর উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই আচমকা উপস্থিত হলো সোহাগ। ফাল্গুনীর দিকে ডাব এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘ঝটপট এটা শেষ করতো। এটা খেলে গলাও জ্বলবে না আর পেট ও ভরবে।’
অকস্মাৎ সোহাগের উপস্থিতিতে ভড়কে গেছে ফাল্গুনী। যেনো চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে সে। মুখে রেডিমেড হাসি ঝুলিয়ে দ্রুত ডাব নিয়ে নিলো সোহাগের হাত থেকে। ভদ্রতা সূচক সোহাগ কে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলো ডাব একটা কেনো, তার নিজের জন্য কেনো আনেনি। সোহাগের দিকে খেয়াল না রেখেই ডাবে থাকা সরু পাইপটি মুখে নিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ। ডাবের ঠান্ডা জল গলা ছুঁয়ে তারপর বুক বেয়ে পেটে চলে যাওয়া টের পাচ্ছে ফাল্গুনী। খালি পেটটা যেনো মুহুর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেলো। কিন্তু মস্তিষ্ক ঠান্ডা হলো না। সেই এক চিন্তা মস্তিষ্ক জুড়ে মাছির মতো ভনভনিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে জাগ্রত তাকে দেখছে। চোখ লাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। বাইকের ছোট আয়নাটাও যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে, জাগ্রতের রাগী চোখের রক্তিম দৃষ্টির সহিত সাক্ষাৎ করাতে।
সোহাগের ফোনে হটাৎ মেসেজ টোন বেজে ওঠে। সোহাগ পকেট থেকে ফোনটি বের করে নিয়ে খানিক ব্যাস্ত হয়ে গেলে ফাল্গুনী স্বস্তির শ্বাস নেয়। এক হাতে ডাব ধরে রেখে খেতে খেতেই আরেক হাত রাখলো আয়নায়। অতি সন্তর্পণে ছোট আয়নাটি একটু একটু করে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দোতলায় নজর চালালো। কিন্তু চোখে পড়লো না সেই চেনা মুখাবয়বটি। এ কোনা থেকে ও কোনা কোথাও নেই মানুষটা। ফাল্গুনীর মন এবার শান্ত হলো। ভাবলো যাক জাগ্রত তাহলে নজর রাখেনি তার ওপর। আবার কেনো জানি একটু মন খারাপ ও হলো। মনে হলো কেনো রাখলো না নজর! নিজের চিন্তা ভাবনার ওপর নিজেই বিরক্ত হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নাটা টেনে সোজা করলো। কিন্তু ঘটে গেলো আর এক বিপত্তি! এক টানে আয়নাটা সোজা করায় কেচ করে শব্দ করে উঠেছে। ফাল্গুনী ভেবেছে আয়নাটা ভেঙে গেছে। ভয় পেয়ে হাত আলগা করে নিলে অসাবধানতায় অন্য হাতে ধরা ডাব পরে যেতে নেয় আর সোহাগ তা ধরে ফেলে। এদিকে ফাল্গুনীও ঝটপট হাত বাড়ায়। সোহাগ আর ফাল্গুনী দুজনের চার হাত মিলে ধরে নেয় ডাবটি।
এদিকে দোতলায় জাগ্রত দাড়িয়ে আছে একটি পিলারের খানিক পিছন দিকে। ফাল্গুনীর গতিবিধির ওপর প্রথম থেকেই নজর ছিলো তার। ফাল্গুনী যে বাইকের লুকিং গ্লাসের সাহায্যে দোতলায় তারই সন্ধান করার চেষ্টায় আছে তা সে আন্দাজ করে নিয়েছে। তার আন্দাজ ভুল হলেও হতে পারে তা সে ভাবলেও সাবধান বশত পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেছে। যাতে সে ফাল্গুনীর চোখে না পড়ে যায়। তারপর সাবধানে একজন লোকের পিছনে দাঁড়িয়ে আড়চোখে নিচের দিকে চাইতেই তার চোখ যেনো কপালে ওঠে যায়। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে ফাল্গুনীর সাথে একজন অন্য পুরুষকে এতোটা কাছাকাছি এসে দুজনের চার হাত প্রায় এক করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। প্রচন্ড রাগ আর অস্থিরতায় দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ফাল্গুনী আর সোহাগ এর চার হাত মিলে একটি ডাব ধরে এতোটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অবসহন হয় না জাগ্রতর। বিষিয়ে ওঠে ভেতরটা। ছুটে গিয়ে অচেনা ছেলেটাকে রক্তাক্ত করে দিতে ইচ্ছে করে। ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে সেই হাত যা ফাল্গুনীর হাত স্পর্শ করেছে। আর ফিরে তাকায় না নিচের দিকে। ওখান থেকে সরে এসে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখান থেকে দেখা যাবে না ফাল্গুনীকে। অপেক্ষায় থাকে পারে পৌছাবার আর তারপর বাস ছেড়ে দেওয়ার। অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয় অপলক।
ফাল্গুনী সোহাগের হাতে ডাব ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নেয়। খানিক অপ্রস্তুত হয়ে ডাব ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে,
‘আমি আর খেতে পারছি না। ডাব টি অনেক বড়। আমার পেট ভরে গেছে।’
‘আর একটু খাও। তোমায় তো দুর্বল মনে হচ্ছে। ডাবটা তো ঠিক মতো ধরেও রাখতে পারছো না। তোমার কি খারাপ লাগছে?’
‘না না তেমন কিছু নয়। হাত ফস্কে গেছিলো একটু। আপনি একটু বেশিই বলছেন।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে বাকিটুকু আমিই খেয়ে নিচ্ছি। তুমি তো আর নিজে থেকে আমায় খেতে বলবে না। তোমার ভাগেরটাই নাহয় খেলাম।’
ফাল্গুনী মনে পড়ে সে তো একা একাই এতোক্ষণ খেয়ে যাচ্ছিলো। সোহাগকে তো জিজ্ঞেস ও করে নি সে নিজের জন্য কেনো আনে নি। নিজের বেখেয়ালি আচরণে বড্ড খেদ হয়। দুঃখ প্রকাশ করে বলে ওঠে,
‘সরি। আপনাকে জিজ্ঞেস করবো খেয়াল ছিলো না। আপনি একটা ডাব কেনো এনেছেন? নিজের জন্য আনেন নি যে, আপনিও তো কিছু খাননি বললেন। আমিও আছি এক! আপনাকে জিজ্ঞেস না করে একা একাই খেতে শুরু করে দিয়েছি।’
‘থাক থাক আর মুখ ভার করতে হবে না। আমি এটাই খেয়ে নিচ্ছি।’
‘আমার এঁটো টা খাবেন কেনো? আরেকটা নিয়ে আসুন না।’
‘এঁটো কিভাবে হলো? তুমিকি ডাবের ভেতরে ঢুকে খেয়েছো নাকি? আর তুমিই তো বলো খাবার নষ্ট করা নাকি মোটেও উচিত নয়। তাহলে কি এটা ফেলে দেবো?’
‘আচ্ছা তাহলে দিন আমি বাকিটা খেয়ে নিচ্ছি। আপনি আরেকটা নিয়ে আসুন।’
‘ফাল্গুনী! তুমি না বললে বাসে তোমার বমি হয়েছে। এখন আবার জোর করে বেশি খেলে বাসে উঠে আবারও বমি হবে। আর ফেলে দেওয়াও ঠিক হবে না। তার থেকে বরং আমিই খেয়ে নিচ্ছি।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে পাইপ টা ফেলে দিন। ওটা তো এঁটো। উঁচু করে খেয়ে নিন।’
ফাল্গুনী কথা শেষ করে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো অন্যমনস্ক হয়ে।
সোহাগ ফাল্গুনীর খাওয়া পাইপ দিয়েই অনায়াসে বাকি জলটুকু খেয়ে নিলো। ফাল্গুনীর সে খেয়াল নেই। সে মজে আছে অন্য চিন্তায়।
~চলবে
~চলবে