#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৮
‘সে আসে নি কাকী। সে এলে এতোক্ষণ তোমরা কু’ড়া’ল ছু’ড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে না। হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকতে!’
আঁখির রুদ্ধ কন্ঠের কথা শেষ হতে না হতেই বাড়িতে পুলিশের আগমন হলো। সাথে উপস্থিত হলো নতুন এক জোড়া পা। আর সে পা জোড়ার মালিক হলো নিসান। আঁখির একমাত্র অপেক্ষার সুমিষ্ট ফল।
পুলিশ দেখার সাথে সাথেই ছু’ড়ি আর কু’ড়া’ল আড়াল করে নিলো সুভাষ চন্দ্র। সাবধানে হাসির হাতে চালান করে দিলো দুটোই। হাসি জিনিস দুটো হাতে নিয়ে স্বামীর পিছনে দাঁড়িয়ে রইলো স্তম্ভের ন্যায়। পুলিশের ভয়ে ওগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য তাড়াহুড়ো করে সরে গেলো না ওখান থেকে। বাড়ির বাকি সদস্যরাও ভী’তি’গ্র’স্ত। আঁখির ঠাকুমা গোলাপি রাণীর তো হাড়ে মাংসে কাঁ’প’ন ধরে গেছে। যেনো পুলিশ এসেছে শুধুমাত্র তার জন্যেই আর দড়ি শুধু তার কোমরেই উঠবে।
পুলিশের সাথে আসা ছেলের মুখাবয়ব দেখে অত্যন্ত অবাক হলো জাগ্রত। মনে পড়লো এটা তো সেই বাসের ছেলেটা যে ফাল্গুনীর সাথে বসে কথা বলছিলো শেষ মুহুর্তে। অযুহাত খোঁজ এর গল্প শুনিয়েছিলো ছেলেটি। এই ছেলে এখানে কেনো আর পুলিশ সাথে নিয়ে কি করছে তা ভেবেই চেয়ে রইলো নিসান এর দিকে।
নিসান এর নজর এখনো জাগ্রতের উপর পড়ে নি। আসতেই তার নজর স্থির হয়ে গেছে আঁখির উপর। যেনো বহুকাল এর তৃষ্ণা অনুর্বরতায় এক ফোঁটা বৃষ্টির আগমনী হলো আঁখি আর নিসান হলো এক তৃষ্ণাদগ্ধ প্রাণ। তাই সে চেয়ে আছে তৃষ্ণার্ত চোখে তার অনন্তকালের তৃষ্ণা জুড়াতে। কিন্তু আঁখি মোটেও তাকাচ্ছে না। তার দৃষ্টি সেই যে মাটি ছুঁয়েছে তারপর আর উঠেনি সেই দৃষ্টি। তবে একপলকের জন্য চোখে পড়েছিলো ওই কালো রঙের কাঁদা মাখানো জুতো জোড়া। পুলিশের উপস্থিতি আর চিরচেনা এক জোড়া পা দেখে নিজের অপেক্ষার অবসানকাল বুঝে নিয়েছে আঁখি।
এরমধ্যেই একজন পুলিশ এগিয়ে এসে বাড়ির সবাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
‘এখানে সুভাষ চন্দ্র আর গোলাপি রাণী কে?’
পুলিশের গম্ভীর কণ্ঠের প্রশ্নের উত্তর বাড়ির কেউ দিলো না। সবার জবাবহীন ভয়াল নজরে পুলিশ বিরক্ত হলো, ধমকে আবারও জিজ্ঞেস করলো একই কথা। এবার উত্তর এলো। তবে উত্তর এসেছে একটু পিছন থেকে।
‘এই হচ্ছে আপনাদের কাঙ্ক্ষণীয় মানুষ দুজন। ইনি সুভাষ চন্দ্র আর ইনি গোলাপি রাণী।’
পুলিশের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সবার ভিড় গলিয়ে এগিয়ে আসলো ফাল্গুনী। আসতে আসতে হাতের ইশারায় নিশ্চিত করলো দুজনের পরিচয়।
ফাল্গুনীর হটাৎ সামনে আসায় আশ্চর্য হলো দুজন ব্যাক্তি। সে দুজন হলো নিসান আর জাগ্রত। দুজন যেনো নিজের সামনে ফাল্গুনীকে নয় পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যকে দেখছে। তাদের দৃষ্টিতে এমনটাই মনে হলো ফাল্গুনীর। অবশ্য আড়াল থেকে পুলিশের সাথে আসা নিশানের মুখাবয়ব দেখে ফাল্গুনী নিজেও আশ্চর্য হয়েছিলো কয়েক মুহূর্ত আগে। বাসের সেই ছেলেটা আর ফোনে কথা বলা নিসান নামের ছেলেটা যে একজন ব্যাক্তিই তা বুঝতে পেরে অবাক-খুশি দুটোই হয়েছে। আর জাগ্রতকে তো সেই প্রথম থেকেই দেখে যাচ্ছিলো আড়ালে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সামনে আসেনি।
পুলিশ অফিসার সুভাষ চন্দ্রকে বললেন,
‘আপনার মেয়ের নাম আঁখি?’
‘হ স্যার। এইযে এইডা আমার মেয়া স্যার।’
‘আপনি আর আপনার মা আঁখির উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছেন বিয়ের জন্য। একে তো ওর পারমিশন না নিয়েই বিয়ে ঠিক করেছেন তারপর বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন। আপনার মেয়ে কোন নাবালিকা নয় সে কলেজ পড়ুয়া আঠারো বছরের সাবালিকা। তাই আইনত তার নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। আর বিয়ে ঠিক করেছেন তো করেছেন ওই বউ মরা বিধবাটার সাথেই করতে হয়েছে? কু’লা’ঙ্গা’র বাপ কোথাকার! মেয়েকে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করানো হচ্ছে নাকি ব্যাবসা কার্যক্রম?’
পুলিশের জোড়ালো ধমকে ভীতচিত্তে সুভাষ চন্দ্র বলে ওঠলো,
‘আপনি এগলা কি কন স্যার? আমি কি নিজের লাভের নিগে ওরে বিয়া দিতাসিলাম? ওই পোলা কতো ভালো আছিলো, দেখতে শুনতে কোনদিকে খারাপ না। পোলার তিনতলা বাড়ি আছে, বাজারে হুন্ডার শোরুম আছে নিজস্ব। কোন ভাড়া দেওয়া লাগে না। খালি বউ ডা কয় মাস আগে মইরা গেছে গা। বয়স ও বেশি না, ত্রিশ বত্রিশ বছর হইবো। পোলায় যেমন কিছু নিতে চায় নাই তেমন কিছু দিতেও চায় নাই। তাইলে এনে আমার লাভ বা ব্যপসার কতা আইলো কেন? আর আমার মেয়ারে আমি আমি ভালও বাসমু আবার ভুল করলে শাষন ও করমু। এনে দোষের কিছু নাই। আপনি ওই পোলারে ধরেন। ওই পোলা আমার মেয়ারে নিয়া এক রাইত রাইখা ছাইড়া দিছে। আমি কেস করমু ওই পোলা…’
সুভাষ চন্দ্রকে থামতে হলো পুলিশ অফিসারের জোড়ালো ধমকে। পুলিশ অফিসার বাড়ির সবাইকে শাসাতে লাগলেন এবং এর মধ্যেই উপস্থিত হয়ে গেলেন এলকার চেয়ারম্যান ও কিছু সংখ্যক নেতা। তাদের খবর দেওয়ার ব্যাবস্থা করেছে ফাল্গুনী। বাড়িতে ঢোকার আগেই চেয়ারম্যান কে ফোনে সমস্ত টা জানিয়ে তারপর বাড়িতে পা রেখেছে।
ব্যাপারটা এবার ক্রমশই জোড়ালো হলো ও গুরুত্ববহতা পেলো চেয়ারম্যানের আগমনে। চেয়ারম্যানকে দেখে সুভাষ চন্দ্র ও বাড়ির লোকজন আরও বেশি ভীতিবিহ্বল হয়ে পড়লো। গোলাপি রাণী তো কোমর চেপে বসেও পরেছেন মাটি লেপ্টে। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে যাচ্ছেন অবিরত।
চেয়ারম্যান যেহেতু পুরো বিষয়টা জেনেই এসেছেন তাই কাউকে মুল ঘটনা সম্পর্কে কোন কিছু জিজ্ঞেস করে সময় নষ্ট করলেন না। ফাল্গুনির থেকে ঘটনা শোনার পর লোক দিয়ে খবর নিয়েছেন ঘটনার সত্যতা কতটুকু। তাই এসেই পুলিশ অফিসারের সাথে অল্প কিছু কথা বলে সুভাষ চন্দ্র কে কাছে ডাকলেন। এর মধ্যে চারপাশে চেয়ার আর টুল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে বসার জন্য। সুভাষ চন্দ্র চেয়ারম্যান এর সামনে গিয়ে দাড়ালে চেয়ারম্যান বললেন,
‘মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে ঠিক করেছিস, মেয়ে রাজি না হওয়ায় তাকে কুকুর পিটানো পিটিয়েছিস, বিয়েও আবার ঠিক করেছিস বউ মরা এক ছেলের সাথে যে কিনা বউ মরে যাওয়ার পর দু মাসও শোক ধরে রাখতে পারে নি। মেয়ে জানিয়েছিলো সে একজন ছেলেকে পছন্দ করে এবং সেই ছেলে যথেষ্ট যোগ্য। ভালো শিক্ষিত ও ভালো চাকরি ও করে। তাকে ছাড়া অন্যকাউকে বিয়ে করতে চায় না সে কথা শুনে মেয়েকে আরও মেরেছিস। মেয়ে বিয়ে করবেনা তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো তারপরের দিন আবার ফিরেও এসেছে বাড়িতে। তারপর আরও হিংস্র জানোয়ার এর মতো আচরণ করেছিস, হাত-পা বেঁধে মেরে ঘর বন্দী করে রেখেছিস মেয়েটাকে। মেয়েটাকে নিজের পায়ে একলা দাঁড়ানোর মতো অবস্থাও রাখিস নি জানোয়ার কোথাকার। আর কাল যখন খবর পেয়েছিস তোর মেয়ের পছন্দ করা সেই ছেলে আসছে তোর মেয়েকে তোর জেলখানা থেকে বের করতে তখন আবার ছু’রি কু’ড়া’ল গোছ করে ভাইয়ে দের নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছিস খু’নো’খু’নি করতে। এলাকার মাস্তান হয়ে গেছিস? হ্যাঁ? এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলিস আজ তোর হাত ভেঙে গুড়িয়ে যদি না দিয়েছি তবে….’
‘মাফ করেন আমারে, আমি ভুল করছি মেয়ারে শাসন কইরা, আমি ওই পোলার লগেই বিয়া দিমু আমার মেয়ারে। মেয়ার হাতে ধইরা মাফ চাইয়া নিমু আফনে আমারে মাফ করেন চাচা, মাফ করেন আমারে। কিন্তু আমি তো কাউরে মারতে যাই নাই চাচা। এইডা আফনেরে মিথ্যা কইছে কেউ। এই পোলা তো আইলোই এই কেবল। ওইযে পুলিশ সাথে নিয়া আইছে হেগোরে জিগাইয়া দেহেন আফনে।’
চেয়ারম্যানের পায়ের কাছে বসে পা ধরে কথা গুলো রসিয়ে রসিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো সুভাষ চন্দ্র। সুভাষ চন্দ্র তার কুকীর্তি অস্বীকার করতে দেরি করলেও ফাল্গুনীর তা প্রমাণ করতে দেরি হয় নি। সাথে সাথেই নিজের ফোনে ধারণ করা একটি ভিডিও চালু করে চেয়ারম্যানের সামনে তুলে ধরেছে। যাতে জাগ্রত আসার পর গোলাপি রাণীর বাকবিতণ্ডা থেকে শুরু করে নিসান এর পুলিশ আসা পর্যন্ত পুরো ঘটনার দৃশ্যপট তোলা আছে। চেয়ারম্যান পুরো ভিডিও দেখে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে ধমকে উঠলেন সুভাষ চন্দ্রের নাম ধরে। অন্যায় করে আবার পা ধরে মিথ্যে বলার জন্য কিছুক্ষণ ধমকাধমকি করলেন উচ্চ স্বরে। তারপর নিসান কে ডাকলেন কাছে। জোরালো ভারী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আজকেই এবং এক্ষুনি বিয়ে করতে বলা হলে বিয়ে করবে তুমি আঁখিকে?’
‘আমি যে-কোন মুহুর্তে যে-কোন শর্তে আঁখিকে বিয়ে করতে প্রস্তুত। তবে আমার কিছু কথা আছে।’
‘নির্ভয়ে বলো।’
‘আঁখিকে আমি বিয়ে করে আমার সাথে আজকেই নিয়ে চলে যাবো। ও আর কখনোই এই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করবে না আর না এই বাড়িতে কখনো আসবে। আপনি আঁখিকে জিজ্ঞাসা করুন ও রাজি কি না? ওর ওপর কোন জোর জবরদস্তি নেই। ও ওর সিদ্ধান্ত নির্ভয়ে জানাক। আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা প্রকাশ করেছি মাত্র। ও যাই বলুক বা যাই করুক আমি ওকেই বিয়ে করবো। বিয়ের সিদ্ধান্তে কোন নড়চড় হবে না।’
আঁখিকে নতুন করে আর জিজ্ঞেস করতে হলো না কিছু। নিজে থেকেই বলে উঠলো,
‘উনি যা বলবেন তাই হবে, আমি উনার সব কথা শুনতে প্রস্তুত। এ বাড়িতে মা ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ কোনদিন ছিলো না তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মতও কেউ নেই।’
চেয়ারম্যান বিয়ের ব্যাবস্থা করতে বলেছেন দুজন কে। কিছুক্ষণের মধ্যে চেয়ারম্যান ও পুলিশের উপস্থিতিতে পাশের মন্দিরে বিয়ে হবে নিসান আর আঁখির। এখন আলোচনা চলছে সুভাষ চন্দ্রের শাস্তি নিয়ে। একজন সাবালিকা মেয়েকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে তারপর ঘরবন্দী করে রাখা আবার জাগ্রতকে নিসান ভেবে খু’নো’খু’নি করার জন্য উদ্যমী হওয়া। সব মিলিয়ে তাকে পুলিশে দেওয়া হবে নাকি এখানেই অল্প কিছু শাস্তির ব্যাবস্থা করে একটা সুযোগ দেওয়া হবে তা আলোচনা হচ্ছে সবাইকে নিয়ে।
আলোচনা বৈঠকের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো ফাল্গুনী। আচমকা জাগ্রত ফাল্গুনী কে টেনে নিয়ে গেলো রাস্তার দিকে। ফাল্গুনী জোড়াজুড়ি না করে জাগ্রতর সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে অনায়াসে এসে দাঁড়ালো রাস্তার এক পাশে। দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই জাগ্রত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো একগাদা।
‘ওরা ছু’ড়ি কু’ড়া’ল নিয়ে আমার দিকে তেড়েফুঁড়ে আসছিলো আমায় কু’পি’য়ে মারবে বলে আর তুমি আড়ালে দাঁড়িয়ে সেটা ভিডিও করছিলে? তোমার হাত কাঁপে নি? যদি ওরা আমায় সত্যি সত্যি মেরে ফেলতো তাহলে বুঝি খুশি হতে? ভিডিও টা আরও বেশি পোক্ত হতো আর ওই লোকগুলোকে জেলের ভাত খাওয়াতেও বেশ সুবিধা হতো তাই না? তুমি আসলেই একটা পাষাণ। মন বলতে কিছু নেই তোমার ভেতরে।’
~ চলবে
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৯
“ওরা ছু’ড়ি কু’ড়া’ল নিয়ে আমার দিকে তে’ড়ে’ফুঁ’ড়ে আসছিলো আমায় কু’পি’য়ে মারবে বলে আর তুমি আড়ালে দাঁড়িয়ে সেটা ভিডিও করছিলে? তোমার হাত কাঁপে নি? যদি ওরা আমায় সত্যি সত্যি মে’রে ফেলতো তাহলে বুঝি খুশি হতে? ভিডিও টা আরও বেশি পোক্ত হতো আর ওই লোকগুলোকে জেলের ভাত খাওয়াতেও বেশ সুবিধা হতো তাই না? তুমি আসলেই একটা পাষাণ। মন বলতে কিছু নেই তোমার ভেতরে।”
“আপনি এখন এসব বলার জন্য আমায় টেনে নিয়ে এসেছেন? ওখানে কতো মানুষজন ছিলো সে খেয়াল আছে?”
“যাদের আমি চিনি না জানি না তাদের খেয়াল করে আমি কি করবো? আমি তোমায় চিনি তোমায় জানি তাই খেয়াল করে টেনে এনেছি তোমার খেয়াল রাখার জন্য। এবার খামখেয়ালি না করে আমার কথার জবাব গুলো দাও।”
“ভেতরে এমন একটা সিচুয়েশন আর আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আমার সাথে এ ধরনের কথা নিয়ে ঝগড়া করছেন।”
জাগ্রত এবার মাথায় হাত দিয়ে হাসফাস করে বলে উঠলো,
“সমস্যাই তো এখানে। তোমার জায়গায় এখানে অন্যকেউ হলে আমার লাস্ট কথাগুলো তার কাছে ঝগড়া নয় রসিকতা মনে হতো। কিন্তু তোমার মনে হচ্ছে ঝগড়া। আমি একটা বিয়ে করে নিয়ে এলেও তোমার মনে হবে আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে ঝগড়া করার জন্য বিয়ে করেছি আর বাটি হাতে রাস্তায় বসে গেলেও তোমার মনে হবে আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে ঝগড়ার উদ্দেশ্যেই ভিক্ষে করতে নেমেছি। আসলে তুমি ঝগড়া ছাড়া কিছু চেনোই না। তুমি স্বপ্নেও…”
“আপনি একটু চুপ করবেন! কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেলেন আপনি? ভেতরে এখন কি হচ্ছে, সামনে কি হবে সেই চিন্তায় আমার মাথা ফেটে পড়ছে আর আপনি আমাকে এখানে এনে ফাজলামো শুরু করেছেন।”
“ওদের চিন্তা তোমায় করতে হবে না। এতোক্ষণে এটুকু নিশ্চয়ই বুঝে গেছো ওদের সম্পর্ক আমাদের মতো ঠুনকো নয়। আমি তো কিছুক্ষণ ধরে দেখছি ওদের। তাতেই ভরসা হচ্ছে ওদের সম্পর্কের জোর দেখে। তুমি তো বোধহয় আরও আগে থেকে চেনো, তোমার ভরসা নেই ওদের ভালোবাসার উপর? আঁখি মেয়েটা তো নিসান এর এক কথায় পরিবার ও ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো। মেয়েটা কতো ভরসা করে আর ভালোবাসে ছেলেটাকে। এমন দুজনকে নিয়ে তোমার মতো কাউকে না ভাবলেও চলবে।”
“আমার মতো মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি খুব খারাপ? আমি স্বার্থপর? আমি আপনার কথা শুনতাম না? আমি ভালোবাসিনি আপনাকে?”
শেষ কথাটায় দুজনেই থমকে গেছে। একজন নিজের শ্রবণেন্দ্রিয়কে বিশ্বাস করতে পারছে না এমন কথা শুনতে পেয়ে। আরেকজন তো চোখ বন্ধ করে নিয়েছে রাগে আর কষ্টে। মুখ ফস্কে এমন কথা বেরিয়ে যাওয়ায় রাগ হচ্ছে নিজের ওপর আর কষ্ট হচ্ছে জাগ্রতর মুখ থেকে শোনা শেষ কথায়। জাগ্রত কিছু বলবে করে মুখ খুলতেই ফাল্গুনী হাওয়ার বেগে জায়গা ত্যাগ করে নিলো। দাঁড়ালো না এক মুহুর্তও। জাগ্রত হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর নিজ মনে কিছু ভেবে পা বাড়ালো বাড়ির ভেতরে।
________________
আঁখি আর নিসান এর বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এলাকার মন্দিরে। এলাকার কিছু সাধারণ মানুষ, চেয়ারম্যান, কিছু সংখ্যক নেতা ও পুলিশের উপস্থিতিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে নির্বিঘ্নে। আঁখিকে সম্প্রদান করেছে আঁখির ভাই শুভ। আঁখির বাবাকে এলাউ করে নি নিসান। মন্দিরের আশেপাশেও বাড়ির কাউকে আসতে মানা করে দিয়েছে। শুধুমাত্র আঁখির মা আর ভাই ছিলো সেখানে।
বিয়ে শেষ হতে হতে বেলা প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। এখনও সকালের খাওয়া হয়নি কারও। চেয়ারম্যান খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিতে চাইলেন সবার। নিসান হাত জোড় করে অনুমতি চাইলো এই দায়িত্বটা নিজে নেওয়ার জন্য। কিন্তু চেয়ারম্যান তা মানলেন না। তিনি নিজ খরচে সবার খাওয়ার ব্যাবস্থা করলেন।
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো নিসান আর আঁখি খাওয়া দাওয়া করার কিছুক্ষণ পরেই রওয়ানা করবে নিসান এর বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিসান এখানে আর এক মুহুর্তও থাকতে চায় না আঁখিকে নিয়ে তাই এমন সিদ্ধান্ত। চেয়ারম্যান সব ব্যাবস্থা করে দিয়ে চলে গেছেন নিজ কাজে। পুলিশরাও চলে গেছে বিয়ে সম্পন্ন হলে। তবে ফাল্গুনী তাদের মধ্যে একজনের কাছে বিরিয়ানির কয়েকটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে তাদের চলে যাওয়ার আগে।
খাবারের ব্যাবস্থা করা হলে সবাইকে খাবার পরিবেশনে হাত লাগিয়েছে নিসান, জাগ্রত। দুজনের পরিচয় ঘটেছে বিয়ের কিছুক্ষণ আগে। মন্দিরের পাশের বাড়িতে করা হয়েছে এই আয়োজন। সেই বাড়ির কয়েকজন মানুষ, কিছু সংখ্যক নেতা, আর নিজেদের জন্য এই আয়োজন। আঁখি আর ফাল্গুনী এক ঘরে আলাদা
খেতে বসেছে। দুজনের মনে চলছে দু রকমের ঝড়। ফাল্গুনীর মন খেয়ে যাচ্ছে তখন জাগ্রতকে বলা শেষ কথার জন্য। জাগ্রতর সামনাসামনি হতে পারছে না কিছুতেই। আর আঁখির মনে চলছে পরবর্তীতে কি হবে তা নিয়ে অসংখ্য চিন্তা ভাবনা। মনে ভয় হচ্ছে নিসান কে নিয়ে। নিসান তো একবারও জানতে চাইলো না ওইদিন কার সাথে সে পালিয়েছিলো। সবাই তো নিসান এর কথা জানে আর সবাই তো নিসানকেই দোষারোপ করেছে সব কিছুর জন্য। কিন্তু নিসান কেনো এখনো কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। তার তো হাজারও প্রশ্ন করার কথা ওই রাত নিয়ে।
আঁখির ঘোর ভাঙলো নিসান এর ডাকে। নিসান এসেছে ঘরে। সাথে জাগ্রতও আছে। জাগ্রত এসে ফাল্গুনীর দিকে শুধু চেয়ে রইলো কিছু বললো না। নিসান আঁখির দিকে চেয়েও দেখলো না, সরাসরি ফাল্গুনীকে জিজ্ঞেস করলো,
“ফাল্গুনী, কিছু লাগবে? সবাইকে দেওয়া হয়েছে। এবার আমি আর জাগ্রত দা বসে পড়বো। তোমাদের দিয়ে তারপর বসি।”
“কিছু লাগবে না নিসান দা। আপনারা বসে পড়ুন।”
নিসানকে না করার পরে নিসান এর চোখ এবার আঁখির দিকে গেলো। আঁখি ও আগে থেকেই তাকিয়ে ছিলো। তাই চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। আঁখিকে নতুন করে জিজ্ঞেস করতে হলো না কিছু। সে মাথা নেড়ে না করে দিলো চোখাচোখি হতেই। নিসান সাথে সাথেই বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। থেকে গেলো জাগ্রত, ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে আছে সে অপলক। যেনো কোন ঘোড়ে ডুবে আছে। মনে মনে ভাবছে ফাল্গুনীর বলা তখনকার ভালোবাসার কথা। নিসান আবার ফিরে এলো ঘরের সামনে আর জাগ্রত কে ডেকে উঠলো। জাগ্রত হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ডাক শুনতেই। নিসান হাসি মুখ করে বললো,
“কিছু বলার ছিলো ফাল্গুনী দি কে?”
জাগ্রত মাথা নেড়ে না করে চলে গেলো যেখানে খাবার রাখা আছে সেখানে। নিসান ও চলে এলো সেখানে। সেখানে আসতেই দেখা হলো নতুন এক মুখের সাথে। একজন মহিলা জাগ্রতর সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে থমকানো মুখভঙ্গিতে। জাগ্রতর মুখভঙ্গি দেখতে পেলো না নিসান। তাই খানিক এগিয়ে গেলো জাগ্রতর দিকে। নিসান এগিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা নিসানকে জিজ্ঞেস করলো আঁখির কথা। ভদ্রমহিলার গলার স্বর কাঁপা শোনালো নিসান এর কাছে তাই তার পরিচয় চাওয়া হলো না। আঁখির রুম দেখিয়ে দিলো আঙ্গুলের ইশারায়। ভদ্রমহিলা চলে গেলো তৎক্ষনাৎ। জাগ্রতও নিসান কে এড়িয়ে পা বাড়ালো আবার ওই ঘরের দিকে।
আঁখি আর ফাল্গুনী খাওয়া শেষ করে সবে উঠে বসেছে। এর মধ্যেই ঘরে কারো পায়ের আওয়াজ শুনে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো দরজার কপাট জোড়ার দিকে। চোখে পড়লো সাদা ধবধবে শাড়ি পরিহিতা এক অর্ধবয়স্ক নারী দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর হয়ে। ফাল্গুনী চমকালো। থমকে গেলো নয়ন জোড়া। ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে ডেকে উঠলো মা বলে।
বিলাসি দেবী আরও এক দফা চমকালেন। চোখ জোড়া জ্বালা করে উঠলো ভীষণ। এসেছিলেন আঁখির খবর শুনে কিন্তু ক্রমশ অবাঞ্ছনীয় কিছু মানুষের সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে জাগ্রত তারপর ফাল্গুনী। ফাল্গুনী কেনো এসেছে? তার জন্যই কি এলো মেয়েটা? কিন্তু দুজনে একসাথে এক জায়গায় কি করে?
~চলবে