#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৪
ওর বয়স তখন আঠারো পেরিয়ে উনিশ। ওকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসি আমার বাড়িতে। আবার শুরু হয় আমাদের দুজনের সংসার। তবে এই নতুন করে শুরু করা সংসার ও ছয় মাসে থমকে যায়। হেরে যাই আমি। তবে এবার শুধু আমি একা হেরে যাই নি। ফাল্গুনীও হেরে যায়। দুজনের ব্যার্থতা মিলে বাক নেয় বিচ্ছেদের পথে। ছয় মাস করে দু’বারে একবছর। একবছরের সংসার গিয়ে দাঁড়ায় কোর্টের দোরগোড়ায়। দুজনের দোষে আজ যোজন যোজন দুরত্ব আমাদের মাঝে।
“আমার কি দোষ ছিলো আর কতোটা ছিলো তার পরিমাণ তা তো চার বছর আগেই নির্ধারণ করা হয়েছিলো, আজ আবার নতুন করে দর কষাকষির কারণ কি? সহানুভূতি লুটতে চান? নাকি নিজের দোষের পাল্লা হালকা করতে চান?”
ফাল্গুনী দাঁড়ানো ঘরের সামনে। ভেজানো দরজা খুলে দিয়ে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে উক্ত কথাগুলো বললো জাগ্রতর দিকে তাকিয়ে থেকে। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকেই। জাগ্রত জবাবহীন হয়ে বসে আছে। তবে ফাল্গুনী অল্পতে থামলো না। ঘরের ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে আরও বললো,
“উদ্দেশ্য আপনার যাইহোক, আপনার সাথে কাটানো শেষ ছ’মাসের স্মৃতিতে সবচেয়ে অস্তিত্বশীল ছিলো আপনার বাবার মৃত্যুর দায় আমার উপর চাপানো, মায়ের কথা রেখে ঝিমলির সাথে আপনার দেখা করতে যাওয়া আর আমাকে প্রতি পদে পদে আপনার অবিশ্বাস করা। আপনার সব দোষ ক্ষমা করতে পারি। না না, করতে পারি বললে ভুল হবে। বলা উচিত সব দোষ ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার এই তিনটি অন্যায় কিছুতেই আমি ক্ষমা করতে পারি নি। এখনও পারি না। এবং তা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আমি ক্ষমা করবো না আপনাকে। কোনদিনও না। এই কথাগুলো বলতাম না, বলার রুচি হয় না আসলে। কিন্তু আপনার শেষ কথা শুনে আমি বুঝে গেছি আপনি এতোক্ষণ নিশ্চয়ই আমাদের অতীতের সুন্দর ও সুখময় দিনের গল্পগুলো শোনাচ্ছিলেন সবাইকে। প্রথম ছয়মাসের সুখী সংসার আর তারপরের উচ্চ মাধ্যমিক অব্দি দু’জন দু প্রান্তে বসে চুটিয়ে প্রেমের গল্প। তাই না? আর তারপর পরের ছ’মাসে এসে আঁটকে গেছেন। সরি সরি। আটকে যান নি আটকে দিয়েছি।”
ফাল্গুনী কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বললো,
“পরের ছ’মাস তোলা থাক না। কি দরকার অমন অতীত হাতড়ে দুর্গন্ধ ছড়ানোর। লাভ তো নেই কোন।”
“লাভ ক্ষতির হিসেব আমি আগেও করি নি, এখনও করি না। ভুল আমাদের দুজনেরই ছিলো। সেই ভুলের শাস্তিও দুজনেই পেয়েছি। তবে আমি আমার ভুলগুলো স্বীকার করে নিয়েছি কিন্তু তুমি তা নিচ্ছ না। আর একটা কথা ফাল্গুনী, আমি কোনদিনও আমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তোমাকে একটা কথাও বলি নি। এটা তোমার মন গড়া কথা। আর সবসময় যে মৌনতা মানেই সম্মতির লক্ষণ হতে হবে এমনটা ভাবা বোকামি আর নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এই বোকামিটাই তুমি আগে করেছো আর এখনও করছো।”
“তাহলে ঝিমলির সাথে কেনো দেখা করতে গেছিলেন আপনি? বলুন কেনো দেখা করতে গেছিলেন? আপনার মা যখন আপনার আবারও বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আপনাকে ঝিমলির সাথে দেখা করাতে পাঠালো তখন কেনো প্রতিবাদ না জানিয়ে সেজেগুজে দেখা করতে গেলেন ঝিমলির সাথে?”
ফাল্গুনী সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে চিৎকার করে উঠলো। জাগ্রতর কথাগুলো জালের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে ফাল্গুনীকে। গায়ে জ্বালা করছে এমন যেনো মরিচ গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে কেউ। ফাল্গুনীর চিৎকার করে কথা বলায় বিলাসি দেবী ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া করে উঠলেন। ধমকে বললেন,
“ফাল্গুনী আস্তে কথা বলো। এটা তোমার নিজের ঘর নয়। আর না তুমি একা আছো এখানে।”
ফাল্গুনী গলার স্বর সম্পূর্ণ খাদে নামিয়ে ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আমি পারছি না আর। আর নিতে পারছি না। মা গত চার বছর ধরে আমার গলায় কাটার মতো আটকে আছেন উনি। না পারছি ওগরাতে আর না পারছি গিলতে। উনি শুধু বলে যাচ্ছেন দোষ আমাদের দুজনেরই ছিলো, আমিও দোষী ছিলাম, উনি ওনার দোষ মাথা পেতে নিয়েছেন, স্বীকার গেছেন নিজের সমস্ত অন্যায়, আমি আমার দোষ স্বীকার করছি না, মেনে নিচ্ছি না নিজের ত্রুটিগুলো, উনি সুযোগ চাইছেন আরেকটা আরও কত কি। এসব কথাগুলো অনর্থক কারণ আমি তো ওনার মতো কিছু করিনি। উনি উনার মায়ের কথায় ঝিমলির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো বিয়ের জন্য। আমার বিশ্বাসে আঘাত লেগেছে তাতে। উনার মা যখন বারবার তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী করে গেছে তখন প্রতিবাদ করা তো দূর চুপ করে গেছেন তিনি। তাতে আমার কষ্ট হয়েছে ভীষণ। আমার বলা প্রতিটা কথা উনি অবিশ্বাস করে বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি মিথ্যেবাদী। তাতে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। এমন আরও অনেক কিছু করতেন উনি যা আমাকে কষ্ট দিতো খুব। আমার মন চাইতো উনি আমার হয়ে দুটো কথা বলুক। আমি মুখিয়ে থাকতাম কখন উনি উনার মাকে বলবেন আমাকে ছাড়া উনি অন্যকাওকে বিয়ে করতে চান না। ঝিমলির মতো রুপে গুণে স্বয়ংসম্পূর্ণা মেয়ে তার চাই না। তার শুধু আমাকেই চাই। কিন্তু তিনি তা বলতেন না। মায়ের মিথ্যে অসুস্থতার বাহানায় ভুলে পুতুল নাচ নাচতেন আর সাথে আমাকেও নাচাতেন।”
“তখন সময়টাই এমন ছিলো ফাল্গুনী। পরিস্থিতি এমন ছিলো না যে আমি চিৎকার করে সবাইকে বলে বেড়াবো আমি আমার বউকে ভালোবাসি আর তাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। পরিস্থিতি আমাকে চুপ করিয়ে রেখেছিলো। কুলুপ এঁটে দিয়েছিলো আমার মুখে। তুমি আমায় স্বার্থপর ভাবো তো? হ্যাঁ আমি স্বার্থপরই বটে। তাই এতোক্ষণ অব্দি শুধু নিজের ত্রুটিগুলোই তুলে ধরলাম, ব্যক্ত করে গেলাম নিজেকে শুধুমাত্র তোমাকে ফিরে পাবার স্বার্থে। ভুল তো তোমার-ও ছিল ফাল্গুনী। এবার তাহলে স্বার্থহীন হয়ে তোমার ত্রুটিগুলোও তুলে ধরি? আমার নজরে তোমার ত্রুটিগুলো কি ছিল তা ব্যক্ত করি।”
জাগ্রত কথাগুলো বলে থেমে গেলো। ফাল্গুনী নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো জাগ্রতের কথা শোনার অপেক্ষায়। এমনকি ঘরে উপস্থিত বাকি মানুষগুলোও চুপ করেই আছে। সবাই চায় আজ শুধু ওরা দুজনেই কথা বলুক। বিলাসি দেবীও চান দুজনের সব কথা আজ এখানেই শেষ হয়ে যাক। দুজনের মনে যতো কলুষিত স্মৃতির খোলস জমে আছে মিলিয়ে যাক সব। দুজনের এক হওয়ার সিদ্ধান্ত নাহয় দুজনেই নেবে কিন্তু মনের গোমর তো কমুক, তাহলে মনের ভারও কিছুটা কমবে দুজনের। নিসান ও তাই চায়। তাই তো আঁখির ভাই শুভর নাম্বারে কিছুক্ষণ আগে নিসান মেসেজ করে বলছিলো ফাল্গুনীকে কোন এক বাহানায় এ ঘরে পাঠিয়ে দিতে। তাই তো হটাৎ করেই ফাল্গুনী চলে এসেছে এ ঘরে।
জাগ্রত ফাল্গুনীর চোখে রাখা চোখ ফিরিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো মৃত্তিকায়। অতীতের স্মৃতি অন্বেষণ করে টুকরো টুকরো কিছু মুহুর্ত কুড়িয়ে প্রাচুর্য গড়ে নিলো মন মস্তিষ্কে। তারপর বেসামাল আলুখালু হয়ে বলতে লাগলো,
“প্রথম ছ’মাস তুমি মায়ের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে, মাকে খুশি করার চেষ্টা করতে, মায়ের কটুবাক্যেও হাসি মুখে জবাব দিতে। আমি দেখেছি, অনুভব করেছি তোমার মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। কিন্তু তুমি ফিরে আসার পরের ছ’মাসে এমন ছিলে না। নিজে থেকে মায়ের সাথে কথা কম বলতে, মা একটা কথা বললে তুমি পাঁচটা উত্তর দিতে, সংসারের সব কাজগুলোও যেনো মাকে দেখাতেই একা হাতে করতে, বাবার সাথে যেভাবে মন খুলে কথা বলতে মায়ের সাথে সেভাবে কথা বলা তো দূর সবসময় আরও মাকে পাশ কাটিয়ে চলতে। বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের অসুস্থতাকেও নাটক বলে গেছো; তাও আবার মায়ের সামনেই। আর ঝিমলি কে বিয়ের কথা বললে না? আমি কি তোমায় বলেছিলাম আমি মায়ের জন্য ঝিমলিকে বিয়ে করবো? আমি তোমায় বুঝিয়ে বলি নি মায়ের সমস্যা? বাবার মৃত্যুতে মা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলো। তুমি নিজে চোখে দেখেছো সেটা। মায়ের অসুস্থতার জন্য আমাকে মায়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়ে চলতে হয়েছে। মায়ের চিকিৎসা চলছিলো তখন আর মা ওষুধ খেতে চাচ্ছিলো না। মাকে ওষুধ খাওয়ানোর শর্তে আমাকে ঝিমলির সাথে দেখা করতে যেতে হয়েছে। তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমি সেটা। এমনকি এ-ও বলেছি আমি বেঁচে থাকতে আমার জীবনে একজন নারীই থাকবে, সেটা হলে তুমি। আমার জীবনে তুমি ছাড়া অন্য কোন নারীর আগমন কখনো হবে না। কিন্তু তুমি শুধু একটাই কথা বলতে মা অসুস্থ নয় মা অসুস্থতার নাটক করছে। অথচ আমি যখন প্রমাণ করতে বলেছি তুমি কিন্তু প্রমাণ করতে পারো নি। উল্টে হিতে বিপরীত হয়েছে পুরোটা বিষয়। মা আরও বেশি হাইপার হয়ে গেছিলো তোমার প্রমাণ এর চক্করে। তুমি আমাকেও মানতে না। গ্রাহ্য করতে না আমার কথা। আচ্ছা আমার কথা শুনে মন থেকে না হলেও অন্তত নাটক করে তো মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে পারতে। করো নি। আমি বারবার তোমায় অনুরোধ করেছি মা যতোদিন না মোটামুটি সুস্থ হচ্ছে ততদিন একটু চুপ থাকতে। যেটা যেমন চলছিলো তেমন চলতে দিতে কিন্তু তুমি তা হতে দাও নি। মা ঝিমলির সাথে আমার বিয়ের কথা বলে পাগলামি করলেও আমাদের ডিভোর্সের কথা কিন্তু মা একবারও কখনো বলে নি। তুমি আমার সাথে তর্কাতর্কি করে একদিন ডিভোর্সের কথা তুলেছিলে তাও আবার মায়ের সামনে। সেদিন থেকেই মা ডিভোর্সের জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। গলায় দড়ি অবধি দিতে গেছে। মাকে শান্ত করাতে আমি মায়ের সামনে শুধু একবার বলেছিলাম আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো। ব্যাস হয়ে গেলো। আমার কোন কথাই তুমি আর মানলে না। আমার কোন আকুতি তোমাকে এতটুকু গলাতে পারে নি। তোমার একটাই কথা ছিলো মা অসুস্থ নয় মা নাটক করছে। হয় মায়ের সামনে আমাকে বলতে হবে আমি তোমাকে ডিভোর্স দেবো না নয়তো সত্যি সত্যি তোমাকে ডিভোর্স দিতে হবে। আমি সময় চেয়েছিলাম তোমার কাছে। আমার সময় চাওয়া তোমার কাছে অবিশ্বাস মনে হয়েছিলো। সবসময় শুধু বলে গেছো আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তোমাকে অবিশ্বাস করি। তৎক্ষনাৎ মায়ের সামনে ডিভোর্সের কথা বলতে মানা করার পর তুমি আর কোন কিছু মানলে না। সেদিন আমার চোখে চোখ রেখে ডিভোর্স চাইলে। আর আমিও রাগের বসে বলে দিলাম ডিভোর্সের কথা। তারপর সেই যে চলে গেলে আর ফিরলে না। তোমার বাবাও ফোন দিয়ে বললেন ডিভোর্সের কথা। আমাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্তও দেননি। এরপর তোমার আমার দেখা হলো একেবারে সাগর দা’র চেম্বারে। তোমার বাবা আমাদের দুজনের ডিভোর্সের কথা আলোচনা করলে সাগর’দা এডভাইস করলো জুডিশিয়াল সেপারেশন এর জন্য আবেদন করতে। তাতে এক বছরের জন্য আইনের মাধ্যমে আলাদা থাকার সুযোগ পাবো দুজন। এক বছর পরে যদি দুজনের মতের মিল না হয়, দুজনে একসাথে না থাকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হয় তবে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করা যাবে। সাগর দা’র কথায় আমি আশার আলো পেয়েছিলাম খানিকটা। ভেবেছিলাম এক বছরে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। এদিকে মা সুস্থ হয়ে যাবে আর ওদিকে তোমার রাগও কমে যাবে। যেভাবেই হোক মানিয়ে নেবো তোমাকে। নিজেকে বুঝ দিতাম এই বলে যে দোষ আমারও আছে তাই চারিদিকে এতো বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু সব উলটপালট হয়ে গেলো। চোখের পলকে সব হারিয়ে বসলাম। একদিকে তুমি হারিয়ে গেলে, আর আরেক দিকে মাকেও হারিয়ে ফেললাম। সবদিক সামলে নিতে গিয়ে কাউকেই ধরে রাখতে পারলাম না।”
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৫
“ভেবেছিলাম এক বছরে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। এদিকে মা সুস্থ হয়ে যাবে আর ওদিকে তোমার রাগও কমে যাবে। যেভাবেই হোক মানিয়ে নেবো তোমাকে। নিজেকে বুঝ দিতাম এই বলে যে দোষ আমারও আছে তাই চারিদিকে এতো বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু সব উলটপালট হয়ে গেলো। চোখের পলকে সব হারিয়ে বসলাম। একদিকে তুমি হারিয়ে গেলে, আর আরেক দিকে মাকেও হারিয়ে ফেললাম। সবদিক সামলে নিতে গিয়ে কাউকেই ধরে রাখতে পারলাম না।”
কথা বলতে বলতে ক্ষীন হয়ে এলো জাগ্রতর কন্ঠস্বর, অস্পষ্ট হয়ে এলো দৃষ্টি। নিসান আঁখি আর বিলাসি দেবীর মন ও চেহারার অভিব্যক্তি নরম হলেও ফাল্গুনীর মুখাবয়ব দেখে বোঝা যাচ্ছে না ভেতরের চলমান মনোভাব কি তার। তবে সুরৎ পর্যবেক্ষণ করে ভাবুকতার খোঁজ অবশ্যই পাওয়া গেলো। ফাল্গুনী কিছু ভাবছে। ভেবেচিন্তে জাগ্রতকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার মা কি এখনও অসুস্থ? মানে আগের চেয়ে অনেক বেশি? নাকি…….”
“সেপারেশনের পর থেকে মা আমার বিয়ে নিয়ে প্রচুর পরিমানে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। প্রথম কয়েকদিন কোনভাবে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে চললেও একদিন ধরে বেঁধে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। ফাল্গুনীর খোঁজ না পেয়ে এমনিতেই মাথা ঠিক ছিলো না তাই আমিও রাগের বসে উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হই আর মাকে মুখের উপর কথা শুনিয়ে দিই। আমার এমন খেই হারানো বিচ্ছিন্ন জীবনের জন্য দায়ী করি মা কে। কথা শোনাই অনেক। তারপর মায়ের অসুস্থতা বেড়ে যায়। হাইপার হয়ে যায় আর অসুস্থ হয়ে পড়ে। মাকে ডাক্তারের কাছে নিলে ডাক্তাররা ভর্তি করানোর উপদেশ দিয়ে বলেন মায়ের মানসিক অবস্থা একটুও ভালো নয় তাই ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে নেওয়াই মঙ্গলজনক হবে। এমন অবস্থায় বাড়িতে থাকাটা মায়ের জন্য ঝুকিপূর্ণ হবে এবং অন্যদের জন্যও। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী ভর্তি করাই মাকে হসপিটালে। তার তিনদিন পর হটাৎ খবর পাই মা ব্রে’ই’ন স্ট্রো’ক করে মা’রা গেছে। মা আর বেঁ’চে নেই। ব্যাস, কয়েকদিনের ব্যাবধানে হারিয়ে ফেলি সব। যেই মায়ের জন্য তোমাকে হারালাম সেই মাকেও ধরে রাখতে পারলাম না। হারিয়ে ফেললাম মা কে। নিঃ’স্ব কা’ঙ্গা’ল হয়ে গেলাম একলা আমি।”
জাগ্রতর মায়ের মৃ’ত্যুর কথা শুনে সবাই চমকে উঠলো। বিলাসি দেবীর বুকে এক ভারী পাথরের ঠাঁই হলো। ভারী আবহাওয়া বইলো মন মস্তিষ্ক সবটা জুড়ে। এতোদিন তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য তিনজন মানুষকে নিজমনে দায়ী ভেবে গেছেন। আর তাতে প্রথম অবস্থানে ছিলো জাগ্রতর মা।
ফাল্গুনী ফিরে এলে ওর মুখ থেকে জাগ্রতের মায়ের ব্যাবহার, আচার-আচরণ, কথাবার্তা সম্পর্কে শোনার পর এমনিতেই ঘৃণা জন্মে গেছিলো জাগ্রতর মায়ের উপর। তার মেয়ের গায়ের রঙ চাঁপা শ্যামবর্ণের আর সাংসারিক কাজকর্ম সুনিপুণভাবে জানতো না বলে জাগ্রতর মায়ের কাছে এতো অপছন্দের হওয়াটা তার মোটেও ভালো লাগতো না। আবার নাতি-নাতনীও জলদি চাইতেন তিনি। কোনো মানুষকে কেনো তার গায়ের রঙ আর সাংসারিক কাজকর্মের যোগ্যতা দিয়ে শতভাগ বিবেচনা করা হবে? কাজের অজ্ঞতা কি আর কারও সর্বদা থাকে? আর বাহ্যিক সৌন্দর্যই কি জীবনের সব? তাছাড়া ফাল্গুনী তো আর কুৎসিত নয়। চেহারা কি সুন্দর হাতে আঁকা আলপনার মতো নিখুঁত। আর তারা তো আর তাদের মেয়েকে জোর করে তাদের ছেলের সাথে বিয়ে দেন নি। ছেলের বাড়ির লোকের মতামত আর ছেলের বাবার অসুস্থতার জন্যই বিয়েটা হয়েছিলো। তবুও জাগ্রতর মায়ের অমন বিষাক্ত আচার-আচরণ তাকে খুব যন্ত্রণা দিতো। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিতো ফাল্গুনীর বাবার কষ্ট। রোজ গুমরে গুমরে কষ্ট পেয়েছেন মেয়ের জীবনের কাটাছেঁড়া হাল দেখে। নিজেকে দায়ী করে গেছেন সবসময়। কিন্তু আজ জাগ্রতর কথা শুনে তার মনে হচ্ছে জাগ্রতর মা আগে থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলো। তাই তার ব্যাক্তিত্ব ছিলো অমন কাঁটার মতো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দোষী ভাবতেন জাগ্রত আর ফাল্গুনীকে। তার ধারণায় দুজনেই সমান দোষী ছিলো। নিজেদের সম্পর্কের ব্যার্থ পরিণতির কারণ হিসেবে দুজনেই সমপরিমাণ দায়ী ছিলো বলে তিনি মনে করতেন আর বিশ্বাস করতেন স্বামী স্ত্রী নিজেরা ঠিক থাকলে কোন তৃতীয় ব্যক্তির সাধ্যি নেই সেই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে ভাঙন ধরানোর। আর মাঝখান থেকে প্রাণ হারিয়েছে তার স্বামী। স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছেন তিনি। এসব ভাবনা-চিন্তা নিয়ে ফাল্গুনীকে এতোদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি। আর মনে মনে ঘৃণা করে গেছেন জাগ্রত ও তার মাকে। আজকে সব উলটপালট হয়ে গেলো। আজকে সবটাই পরিস্থিতির স্বীকার বলে মনে হচ্ছে। যেনো প্রকৃতির খেলা ছিলো সব।
এদিকে ফাল্গুনীও জাগ্রতর মায়ের মৃত্যুর কথা হজম করতে পারলো না। তাও আবার মানসিক ভাবে এতোটাই অসুস্থ ছিলেন যে ব্রেইন স্ট্রোক করেই মারা গেলেন তিনি। যদি সত্যিই তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন তাহলে জাগ্রতর সামনে এক রকম আর আড়ালে ফাল্গুনীর সামনে আরেক রকম ব্যাবহার করতেন কেনো? অসুস্থতায় কেউ এমনটা কি করে করতে পারে? তাও আবার পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেন জাগ্রতর জীবন থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া আর নতুন করে জাগ্রতকে বিয়ের পিড়িতে বসানো নিয়ে। এসবও কি তবে মানসিক অসুস্থতার জন্যই করতেন তিনি? তাহলে কি ভুলটা তারই ছিলো? তার কি তাহলে জাগ্রতর কথা বিশ্বাস করে তার মায়ের অসুস্থতার কথা বিশ্বাস করা উচিত ছিলো? নিজের ভুল আর জেদের বসেই কি তবে সব হারালো? এমন হাজারও প্রশ্ন আর আর আক্ষেপ বাসা বাঁধলো ফাল্গুনীর মনের কোনে। বিশ্বাস হয়েও হতে চাচ্ছে না। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে আবার বিশ্বাসও করতে ইচ্ছে করছে। সবটাই ঘোলাটে কাঁদা জল হয়ে রইলো।
নিসান জাগ্রতর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সবাইকে নিজের ভাবনায় চুপ থাকতে দেখে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো ছোট করে কেশে নিয়ে। সবাই জাগরূক দৃষ্টিতে মনোযোগি হলে নিসান ফাল্গুনীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“সবটাই তো শুনলে ফাল্গুনী। তোমাদের সম্পর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই পরিস্থিতির বাঁকে বাঁক নিয়ে নিজ গতিতে বয়ে চলেছে। তোমরা কেউ শতভাগ নির্দোষ না হলেও শতভাগ দোষীও নও। না তুমি না জাগ্রত দা আর না তার মা। সবাই পরিস্থিতির স্বীকার ছিলে। এবার অতীত হাতড়ানো বন্ধ করে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাও দু’জন। কে কতোটা দোষী আর কে কতোটা নির্দোষ এ হিসেব আর কতো চলবে? এবার মান অভিমান ভুলে নতুন করে শুরু করো সবটা। তখনকার পরিস্থিতি ছিলো বিচ্ছেদ আর বিচ্ছিন্নতার। এখনকার পরিস্থিতি আর সময়টা পুনর্মিলন এর। সময় ও চায় তোমাদের পুনর্মিলন হোক। নয়তো চার বছর পর এভাবে একই বাসে পাশাপাশি সিটে দুজনের দেখা হওয়াটা অভাবনীয় আর বিরল নয় কি?’
“পুনর্মিলন তো অনেক পড়ের কথা, আমি আপাতত একটু একান্ত সময় চাই।”
ফাল্গুনীর কথার জবাবে নিসান কিছু বলবে তার আগেই জাগ্রত বলে উঠলো,
“তোমার সময় লাগলে নাও। আরও কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন করো। আমাকে ক্ষমা করতে না পারলে শাস্তি দাও। কিন্তু ডিভোর্সের জন্য আপিল করার কথা ভুলেও মনে এনো না ফাল্গুনী। আমার কাছে ফিরে আসাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত হোক। তোমার একান্ত বাধ্যগত ও ব্যাক্তিগত শেষ ঠিকানা শুধু আমি হতে চাই।”
বিলাসি দেবী বিব্রতবোধ করলেন এ ঘরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে। আঁখিকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন তৎক্ষনাৎ। নিসান ও বাইরে চলে এলো হুরমুরিয়ে। সবার চলে যাওয়া খেয়াল হতেই ফাল্গুনীর বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের মাঝবরাবর কামর দিয়ে ধরলো তড়িৎগতিতে। পা চালিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা খেয়াল হতেই পা দুটোকে স্তম্ভিত-জড়-অসাড় বলে মনে হলো ক্ষনিকের জন্য। জাগ্রত সামনে এসে দাঁড়ালো মুহুর্তের মধ্যেই। ফাল্গুনীর তৎক্ষনাৎ ইচ্ছে হলো নিজের বুকের উপর হাত রাখতে। এতো ভয়, সঙ্কোচ আর জড়তাকে সঙ্গী করে পাল্লা দিয়ে চলা হৃৎস্পন্দনের ওপর হাত রেখে থামিয়ে দিতে পুরো স্পন্দন প্রক্রিয়াকে। তবে এতো এতো ভাবনা শুধু মনের গহীনেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফাল্গুনীর। মুখে এসবের ছিটেফোঁটা চিহ্ন অব্দি নেই। খুব সহজ ও স্বাভাবিক মুখাবয়ব নিয়ে জাগ্রতের সম্মুখভাগ দখল করে দাঁড়িয়ে আছে সে।
জাগ্রত কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দেখলো ফাল্গুনীকে। তারপর পুরুষালি গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“পানির অপর নাম জীবন, ঠিক তেমনই ভোরের অপর নাম হয়তো প্রত্যাশা, আর অন্ধকার রাতের অপর নাম হয়তোবা অপেক্ষা। প্রতি রাত মানুষ প্রতিক্ষা করে এমন একটি ভোরের দেখা পেতে, যে ভোর তাদের জীবনে শুধু সূর্যের আলো নয় নতুন প্রত্যাশার আলোও নিয়ে আসবে। প্রতিটি সকাল প্রতিটি মানুষের জন্য কিছু না কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা। আর রাত হলো সেই প্রত্যাশা প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষা প্রহর। সেই অপেক্ষার প্রহর শেষে কেউ চোখ খুলে ভোরের আলোয় নিজের প্রত্যাশার বিসর্জন দেখতে পায়। আবার কেউ ভোরের আলোর সাথে প্রত্যাশার আলোকেও গায়ে মেখে উষ্ণ অনুভবে তৃপ্ত হয়। আজ থেকে আগামী প্রতিটা রাত আমি সেই অপেক্ষা নামক প্রহর গুনবো এমন এক ভোরের আশায়, যে ভোর আমাকে তুমি নামক প্রত্যাশার উষ্ণ আলোয় ভিজিয়ে দেবে। আর সিক্ত করবে তোমার উপস্থিতি।”
“অপেক্ষার শেষ প্রহরে যদি প্রত্যাশার আলো হয়ে আমি না আসি তাহলে?”
“জানিনা। ভেবে দেখা হয়নি। এমন উদ্ভট চিন্তা আমার মাথায় আসে না।”
“আমি পরিস্থিতি ভেদে চিন্তা ভাবনা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।”
“তোমাকে এখনো নিজের করে পাওয়াই হলো না। পাওয়ার আগেই হারিয়ে বসলাম দু-দুবার। এবারও কিছুটা তেমনই পরিস্থিতি। এবার দিয়ে হবে তিনবার। চিন্তা করো, তিনবার হারাতে বসেও ফিরে পাওয়ার আশা রাখি যেখানে এক আকাশ সমান, সেখানে না পাওয়ার এক চুল সম্ভাবনা চিন্তা করে অস্বাচ্ছন্দ্য কেনো বোধ করবো? আমি এবার ভীষণ ভাবে আশাবাদী। ভীষণ ভাবে।”
নিস্তব্ধ পুরো রুম। রুমের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইলো একটি অসম্পূর্ণ সম্পর্কের তিক্ত স্মৃতির খোলস অন্বেষণ। খোলাসা হলো কত-শত অভিযোগ এর ঝাঁক ঝাঁক অভিযোগনামা। রুমটা এখন খালি হলেও রুমে রয়ে গেলো কিছু দীর্ঘ শ্বাস এর তীব্র গন্ধ। ফাল্গুনী বেরিয়ে গেছে রুম থেকে। জাগ্রতর আশাবাদী হওয়ার অনুরাগী কন্ঠ মাথা ধরিয়ে দিয়েছে তার। কেমন যেনো দপদপ করে উঠেছে মস্তিষ্ক জুড়ে। তাই আর দাঁড়ায় নি জাগ্রতর সামনে। ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেছে বাইরে। জাগ্রত আর কি করবে। দীর্ঘ এক শ্বাস রুমের ভেতরে রেখে, চলে গেছে বাইরে। বাড়িটা প্রতিবেশিরদের। তেমন কোন গভীর সম্পর্ক নেই তাদের সাথে। আর কি কখনো আসা হবে এখানে? যদি আসা হয়, তবে সেদিন শুধু স্মৃতি হয়ে রবে আজকের দিনটা।
জাগ্রত বাইরে এসে দেখে হাতে গোনা একজন মানুষ আছে বাড়ির মানুষ ছাড়া। সবাই চলে গেছে নিজ নিজ গন্তব্যে। শুধু চেয়ারম্যান যাকে সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন সে বসে আছে শুভর সাথে। পাশে আবার নিসান ও যোগ দিয়েছে খোশগল্পে। নিসান জাগ্রতকে আসতে দেখে বললো,
“জাগ্রত দা এসেছো? চলো তো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তুমি আমি যে খাইনি তা কেউ জানতো না। তাই বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো সবটাই গরীব দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। চলো বাইরে থেকে খেয়ে আসি দুজন।”
‘ভালো হয়েছে। দুজন তো একবেলা একটু ভালো খেতে পেলো। তা ভুলেই হোক আর স্বইচ্ছায়।’
“হ্যাঁ, বসে বসে কেমন পূর্ণ করে ফেললাম দুজন, বলো! কার ভাগ্যের অন্ন উপরওয়ালা কোথায় রেখেছেন তা বলা মুশকিল। চলো যাই। আমাকে আবার আজকেই ফিরে যেতে হবে বরিশাল। তাই দেরি করতে চাচ্ছি না। আঁখিকে নিয়ে রিস্ক নিতে চাই না। বেশি রাত হয়ে গেলে এতো দূরের পথে জার্নি করা তো মুশকিল।”
__________________
নিসান আর আঁখি বেরিয়ে পরেছে। এলাঙ্গা থেকে এক গাড়িতে নবীনগরে যাওয়া যাবে আবার সেখান থেকে বাস ধরে সোজা বরিশাল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে যেই না দুজনে বেরুবে তখনই আগমন হলো নতুন একজনের। আগন্তুকের মুখ দর্শন করে আঁখি খানিক গুটিয়ে গেলো। নিসান এর বাহু জাপটে ধরে চেয়ে রইলো মাটির দিকে।
~চলবে