পূর্ণতায় তুমি পর্ব – ৭

গল্পঃ পূর্ণতায় তুমি ( সপ্তম পর্ব )

“ ইয়াং ব্যবসায়ী শুভর হাতে বর্তমান সময়ের আলোচিত মডেল হিমি খুন, হিমির ক্ষতবিক্ষত নগ্ন দেহ উদ্ধার করা হয় শুভর বেডরুম থেকে, শুভকে বর্তমানে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”

খবরটা শুনে অবনীর রক্ত হিম হয়ে এলো, যেই হিমির জন্য অবনীকে দূর করে দিলো শুভ, সেই হিমিকে শুভ খুন করবে এটা অসম্ভব! আর খুন করলেও কেনই বা করবে!

একগাদা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো অবনীর, সেই সাথে প্রচন্ড কৌতুহলে অস্থির হয়ে উঠলো অবনী। এর সত্যতা যাচাই করতে হবেই। ভালোবাসার মানুষটা দূরে ঠেলে দিলেও, তাকে কোনদিন মন থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব না। অবনীর মন অস্থির হয়ে উঠলো এই সময়ে শুভর পাশে দাড়ানোর জন্য।

পরদিনই শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো অবনী! জীবনের প্রথম কেসটা শুভর হয়ে লড়তে চাইছে অবনী, যদি শুভ সত্যি দোষী হয়ে থাকে তাহলে শাস্তি হবে, আর যদি নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে মুক্তি পাবে।

থানায় যোগাযোগ করে সবকিছু সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নিয়ে হাজতে শুভর সাথে দেখা করতে গেল অবনী।

কয়েদীদের পোশাক পরিহিত শুভকে নিয়ে আসা হলো! শুভকে দেখেই অবনীর ভেতরের পৃথিবীতে যন্ত্রণার ঝড় বইতে লাগলো, শুভ অবনীর সাথে অন্যায় করলেও অবনী কখনও চায়নি শুভর এমন পরিনতি! বাঁধ ভেঙে আসতে চাওয়া অবনীর চোখের জল অনেক কষ্টে সামাল দিলো অবনী!

শুভ ভীষণ অবাক হয়ে বললো,– অবনী তুমি!

অবনী স্বাভাবিক ভাবেই বললো,– তুমি শব্দটা ঠিক নিতে পারছি না মিষ্টার শুভ, এখানে আপনি আসামি এবং আমি একজন উকিল! কনভারসেশন ওরকম হওয়া উত্তম!

শুভ বেশ অবাক হয়ে বললো,– অভিনন্দন অবনী, এতটা উন্নতি অপ্রত্যাশিত!

: ধন্যবাদ মিস্টার শুভ, জীবনে অনেক কিছুই অপ্রত্যাশিত! এই যেমন আমার হাসবেন্ড যাকে আমি হৃদয় মন প্রাণ সবকিছু উজাড় করে দিয়ে ভালোবাসতাম, সে আমাকে তাড়িয়ে দিলো, এটা অপ্রত্যাশিত! আবার কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকেনা সেটা প্রমাণ করার জন্য আমি উকিল হলাম, সেটা আপনার কাছে অপ্রত্যাশিত! আবার স্ত্রীকে দূর করে দিয়ে যাকে নিয়ে ঘর বাঁধলেন তাকেই নিজের হাতে খুন করলেন, এটাও আমার কাছে অপ্রত্যাশিত! মানে অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলো সব ঘটে যাচ্ছে কেমন করে যেন! যা-ই হোক, যাকে হৃদয়ের সিংহাসনে রানী করলেন, তাকেই আবার কেন নৃশংসভাবে হত্যা করলেন? ভাবলাম জীবনের প্রথম কেসটা আপনার হয়ে লড়ি, যদি আপনার আপত্তি না থাকে এবং কোনকিছু না লুকিয়ে সত্যি বলেন, তাহলে চেষ্টা করবো!

: অবনী সত্যি হলো এটাই, আমি হিমিকে খুন করিনি। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে! সবার কাছে জবাবদিহিতা করতে করতে আমি ক্লান্ত, তাই এর বেশি কিছু বলার ইচ্ছে আমার নেই!

: জীবন বাঁচানোর জন্য মিথ্যা বললেও দোষ নেই, আর আপনি নির্দোষ হয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমানের জন্য অন্তত সত্য-টাই নাহয় বলবেন, জবাবদিহিতা করবেন শুভ, এটা স্বাভাবিক।

কথাবার্তা শেষে শুভকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। অবনী বেরিয়ে এসে সোজা শুভর বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো।

মাঝপথে হঠাৎ অবনীর মজনুর কথা মনে হলো, মজনু যে হিমির ড্রাইভার ছিল।

মজনুকে খুঁজে বের করলো অবনী, মজনুর চেহারায়ও ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। পুলিশ মজনুকে শহরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছে আপাতত।

অবনী অভয় দিয়ে মজনুকে বললো,– মজনু যারা এটা করেছে তারা মাস্টারপ্ল্যান করেই করেছে, সত্যিটা সামনে আনতে না পারলে তুমিও ফেঁসে যেতে পারো! খুনের রাতে ঠিক কি কি হয়েছিল আমায় সব খুলে বলো! পুরো দিনটায় কি কি করেছিল হিমি, কোথায় কোথায় গিয়েছিল!

মজনু একটু ভেবে বললো,– ম্যাডাম, সেদিন পুরোটা দিন হিমি ম্যাডাম বাসায় ছিল, শুভ স্যারের বাসায়, সন্ধ্যায় শহরের নামকরা বার ব্লু-বারে গিয়েছিল, সেখানে আরও একজন জনপ্রিয় মডেল নুসাইবা-নিশি ম্যাডাম ছিলো। হিমি ম্যাডাম এবং নিশি ম্যাডামের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে একটা ঝামেলা চলছিল। ব্লু-বারের মালিক মিসেস পূর্নতা-কবির এড কোম্পানির মালিক হওয়ায় দুজনকেই ডেকেছিল দুজনের মধ্যের রাগারাগির অবসান ঘটিয়ে মিল করিয়ে দেবে বলে। কিন্তু হিমি ম্যাডাম এবং নুসাইবা-নিশি ম্যাডাম দুজনের কেউ আপোষে আসতে চাইছিল না!

অবনী অবাক হয়ে বললো,– কিন্তু দুজনের ভেতর গন্ডগোল ছিল ঠিক কি নিয়ে?

: ম্যাডাম ইতালিয়ান একটা কসমেটিকস ব্র্যান্ড বাংলাদেশে প্রচারণার জন্য একটা এড নির্মাণ করার দায়িত্ব দেয় মিসেস পূর্নতা কবিরের এড কোম্পানিতে, যেহেতু ইতালিয়ান নামকরা ব্র্যান্ড, কোটি টাকার ডিল। মিসেস পূর্নতা কবির মডেল হিসেবে প্রথমে নুসাইবা-নিশি ম্যাডামকে সিলেক্ট করলেও, শুভ স্যারের সহায়তা নিয়ে হিমি ম্যাডাম নিশিকে সরিয়ে নিজে মডেল হিসেবে কন্ট্রাক্ট সাইন করে। এসব নিয়ে ঝামেলা চলছিল!

: আচ্ছা তারপর কি হয়েছিল ব্লু-বারে?

: হিমি ম্যাডাম আমাকে ডেকে বলেছিল তার ফিরতে অনেক রাত হবে, তাই আমি ওখান থেকে চলে আসছিলাম।

: কোথায় গিয়েছিলে! হিমির বাসায় নাকি শুভর বাসায়?

: আপনি চলে যাবার পর থেকে হিমি ম্যাডাম শুভ স্যারের বাসায়ই থাকতো সবসময়, তাই শুভ স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম।

: শুভ তখন কোথায় ছিল?

: বাসায় ছিল ম্যাডাম।

: তখন আনুমানিক রাত কয়টা হবে?

: দশটা।

: শুভ কি করছিল বাসায় তখন?

: ঘুমাচ্ছিলো ম্যাডাম।

শুভ ঘুমাচ্ছিল শুনে ভীষণ অবাক হলো অবনী, রাত দুটো তিনটার আগে তো শুভ কোনদিন ঘুমায় না, ঐদিন কেন দশটার দিকেই ঘুম!

অবনী বললো,– ঐদিন শুভ কোথায় কোথায় গিয়েছিল বলতে পারো মজনু?

: না ম্যাডাম, তা তো জানিনা!

: শুভর গাড়িটা কোথায়।

: বাসায় পার্কিংএ আছে।

: চলো আমার সাথে মজনু!

: কোথায় ম্যাডাম?

: শুভর বাসায়।

মজনুকে নিয়ে অবনী শুভর বাসায় এসে পার্কিং-এ ঢুকে শুভর গাড়ি আনলক করে মজনুকে বললো,– গাড়ির মাইলেজ মিটারে দ্যাখো শুভর গাড়ি নতুন কেনা থেকে এ পর্যন্ত কত কিলোমিটার চলেছে।

মজনু দেখে বললো,– ম্যাডাম আট হাজার পাঁচশ পাঁচচল্লিশ কিলোমিটার।

অবনী বাসার সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করে দেখলো খুনের আগেরদিন সকাল নটায় গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল শুভ, বাসা থেকে অফিসে যেতে বিশ কিলোমিটার, এবং আসতে বিশ কিলোমিটার, টোটাল চল্লিশ কিলোমিটার!

মজনু অবাক হয়ে বললো,– কিছু পাইছেন ম্যাডাম!

অবনী বললো,– জলদি শুভর অফিসে চলো, ওখানকার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে হবে।

অফিসের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে নটা বিশ মিনিটে শুভ অফিসে এসে পৌছায়, তার মানে বাসা নটার সময় বেরিয়ে শুভ ঠিক সময়ে অফিসে এসে পৌঁছেছিল।

এরপর দেখা যায় সারাদিন স্টাফদের নিয়ে মিটিং সহ নানান অফিসিয়াল কাজে ব্যাস্ত ছিল শুভ, রাত আটটায় অফিস থেকে বের হয় শুভ! কিন্তু বাসার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছিল শুভ বাসায় ফেরে রাত নটায়।

অফিস থেকে বাসায় ফিরতে বিশ মিনিটের রাস্তা, বাকি চল্লিশ মিনিট শুভ কোথায় ছিল?

অবনী মজনুকে বললো,– মজনু জলদি আবার শুভর বাসায় চলো, শুভর গাড়িতে তো জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু আছে, বের করতে হবে ঐদিন শুভর গাড়ি কত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছিল, ঐদিনের ডেটা নিশ্চয় স্টোর করা আছে।

শুভর বাসায় এসে পার্কিং-এ ঢুকে অবনী চেক করে দেখলো ঐদিন শুভর গাড়ি টোটাল পাঁচচল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে, তার মানে অফিস থেকে ফেরার পথে ঐ বাড়তি চল্লিশ মিনিট কোথাও কাটিয়েছিল, যেখানে আসতে যেতে ঐ বাড়তি পাঁচ কিলোমিটার!

হঠাৎ অবনীর মনে পড়লো শুভ প্রায়ই অফিস থেকে ফেরার পথে নবনীতা কফিশপে কফি খাবার জন্য যেত।

অবনীর ধারণা এবার মিলে যাচ্ছে, ঐ রাতে শুভর জলদি ঘুমিয়ে পড়ার রহস্য নিশ্চয়ই ঐ কফিশপের সাথে জড়িত!

শুভ এবং হিমি যে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

হঠাৎ গুলির শব্দে লাফিয়ে উঠলো অবনী, তাকিয়ে দেখলো একটা বুলেট মজনুর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে গেল, মজনু মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

কালো মুখোশ পরিহিত খুনি এবার পিস্তলটা অবনীর দিকে তাক করলো…

চলবে…

আবীর হোসেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here