#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ২ #রেহানা_পুতুল
পিয়াসা ঝুঁকে গোলাপটি কুড়িয়ে নিতে যাবে, অমনি কারো বলিষ্ঠ পায়ের স্যান্ডেলের নিচে চাপা পড়ে যায় ফুলটি। পিয়াসা মাথা তুলে চেয়ে দেখে আয়মান স্যার।
সে ভূত দেখার মত ঘাবড়ে গেল। আড়ভাঙা স্বরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
স্যার কে মেরেছে ফুল আমি জানিনা।
কলেজে কি সুন্দর মেয়ে তুমি একা? আর দ্বিতীয়টি নেই? আর যদি নাইবা জানো তাহলে ফুলটা তুলতে যাচ্ছিলে কেন? রুক্ষ স্বরে বলল আয়মান ।
স্যার ফুল আমার খুউব ভালোলাগে। তাই ফুলটা নিতে যাচ্ছিলাম। এর বেশি কিছু পিয়াসা বলতে গিয়েও পারলনা।
এখন বড় হচ্ছো তুমি। প্রেম করো আর যাই করো সেটা তোমার ফ্রিডম। তবে অন্তত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরের বাইরে গিয়ে করবে। এসব থার্ডক্লাশ কর্মযজ্ঞ যেন এখানে আর না দেখি।
লুকানো ক্ষোভ আর দুঃখ নিয়ে পিয়াসা লম্বা লম্বা পা ফেলে আয়মানের সামনে থেকে চলে গেল। হেয়ালী করে ভাবল পূর্বের জনমে মনে হয় আমার কপালে এটাই লিখা ছিলো,
হে বালিকা একদা তুমি ধরনীতে পদার্পণ করিবে। কারণে অকারণে এক যুবক শিক্ষক দ্বারা অপমানিত হইবে। যে তোমাকে দেখলেই যুবক রূপধারীতে বয়স্কার বেশ ধরিবে। দূর কি ছাইঁপাশ চিন্তা করছি বলে পিয়াসা নিজের মাথায় নিজেই মৃদু ধাক্কা দিল।
আয়মান কলেজের বারান্দা ধরে এগিয়ে গেল। খুঁজে দেখল কেউ নেউ। তাহলে ফুল ছোঁড়া ছেলেটি কই। মনে হয় আমাকে দেখেই পালিয়েছে। পুনরায় গিয়ে দলিত মথিত হওয়া ফুলটার দিকে চাইল।
‘ আমি ফুল খুব ভালোবাসি স্যার। ‘ পিয়াসার নরম হয়ে বলা বাক্যটি নিজের অজান্তেই মনে হলো আবার।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে গেল পিয়াসা।ক্লাসের অন্য বন্ধুরা আয়মান স্যারের কাছে কোচিং করছে। পিয়াসাও অন্যদের সাথে কোচিং করছে। কারণ ইংরেজির জন্য আয়মান স্যার ভালো। কোচিং ক্লাস হয় কলেজের কমনরুমে।
আজ স্যার এখনো আসেনি কোচিং ক্লাসে। সব বন্ধুরা নানান খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। পিয়াসাদের এই বন্ধুগ্রুপের নাম হলো গ্লুবাহিনী। সুপার গ্লু’ র আঠার মতো তারা একে অপরের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগে থাকে।
এই তোরা একটা কৌতুক শুনবি? বলল হিরন।
পিয়াসা দাঁত কেলিয়ে বলল,
বলতো শুনি। তোর আবার কৌতুক। ঘুরে ফিরে যেই লাউ সেই কদু।
এই পেশা চুপ কর।
হিরু শুন, আজ থেকে, এই মুহুর্ত থেকে তোর সাথে আমার আড়ি। যেদিন তুই পিয়াসা বলে ডাকবি। ঠিক সেদিন তোর সাথে কথা হবে।
জেবা গুনগুনিয়ে বলল পেশা+ব ইকুয়াল হয়, বলে মুখ চেপে মিটমিট করে হাসল।
তুই এত বেশরম মাইয়া ক্যান? পাশ থেকে জুলি বলল।
এই ব্যাপ্যার না। জুলি বাদ দে। জেবার মত এমন একটা খাটাইশ দোস্ত থাকার দরকার আছে। সময় অসময়ে কাজে লাগানো যাবে। এক দমে বলল পিয়াসা।
এই পেশাবু কৌতুকটা শুনে যা আড়ি নেওয়ার আগে।
” স্ত্রী তার স্বামীকে জিজ্ঞেস করছে শিশুসুলভ কন্ঠে,
ওগো আমি মরে গেলে তুমি কি করবে ?
স্বামী ঃ পাগল হয়ে যাব জান।
স্ত্রী ঃ আচ্ছা তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
স্বামী ঃ অবশ্যই বিয়ে করব জান।
স্ত্রীঃ কিইই? তুমি এত বড় বেঈমান?
স্বামী ঃ পাগলে কখন কি করে ঠিকাছে জান ? ”
শান্ত স্বভাবের পিয়াসাও অন্য বন্ধুদের সাথে হেসে কুটিকুটি হলো।
আরেকটা কৌতুক শুন বলে হিরন আবার বলল,
” পার্কের একটি বেঞ্চেতে বসে আছে প্রেমিক প্রেমিকা। তারা একে অন্যের প্রতি প্রেমের পরিমাপ বোঝাচ্ছে। এক পর্যায়ে প্রেমিকটি উঠে দাঁড়িয়ে গেল। চোখে মুখে রাজ্যের অস্থিরতা। একটু খোলা জায়গায় গিয়ে বুক টানটান করে দাঁড়ালো। দুহাত মেলে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল,
প্রিয়া আমরা স্বাধীনভাবে প্রেম করব। কেউ কোন বাধা হয়ে আসতে পারবেনা। কারণ এই পৃথিবী শুধু তোমার আমার। আমাদের দুজনার।
পার্কের মাঝ বরাবর মেঠো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে এক প্রবীণ লোক। তিনি শুনতে পেয়ে এগিয়ে এলেন প্রেমিক ছেলেটির সামনে।
বললেন, তাহলে কি তোমরা দুজন ছাড়া এ পৃথিবীতে বাস করা আমরা সবাই ভাড়াটিয়া? ”
হোঃ হোঃ হোঃ করে সববন্ধুরা উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। জেবা বলল,চরম হইছে এটা।
বিনা টিকেটে পিউর বিনোদন দিলাম তোদের । আমার দিকে একটু নজর রাখিস তোরা।
হ রাখিস ফেল্টু বয় হিরোর দিকে। চোখের পাতা টেনে বলল জুলি।
স্মার্ট ছেলেমেয়েরা কি আড্ডাবাজি চলছে? বলেই আয়মান স্যার চলে এলো। সবগুলো বোবা হয়ে গেল পলকেই। কোচিং চলাকালীন রায়হান স্যার ও ক্লাসে ঢুকলো।
আয়মানের সাথে তার কথা বলার ধরন দেখে ছাত্র হিরন জিজ্ঞেস করল,
স্যার আপনারা দুজন মনে হয় ফ্রেন্ড?
আয়মান সহাস্যে হেসে বলল,
ওহ হো! তোমরা জাননা? রায়হান ও আমি বহুদিনের পুরোনো বন্ধু। আমরা দূরের এলাকার হলেও স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথেই শেষ করেছি। বাট আমার লাইফে ওর অবদান বেশী।
রায়হান বন্ধু আয়মানের পিঠ চাপড়ে, ও ভালো ছেলেতো তাই সামান্য কিছুকেই অসামান্য করে বলতে পারে।
মাশাল্লাহ স্যার। আপনাদের বন্ধুত্বের বন্ধন যেন চির অম্লান, চির অক্ষয় থাকে। আশীর্বাদ ঢংয়ে বলল নাহিদ।
তোমার কথার ফুল চন্দন ফুটুক। হেসে বলল রায়হান।
জেবা ও তুলি কানে কানে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলছে।
আয়মান বলল,কি বলছ তোমরা?
সাহসী মেয়ে তুলি বলেই ফেলল,
স্যার বলছি যেকোন মানুষের বন্ধুত্ব যতই মধুর হোক আর গভীর হোক, কিন্তু নিজের বউ বা বরের ভাগ কেউই দিবেনা।
রায়হান বলল,খুব দামী কথা বললে তুলি। এটা অসম্ভব।
হয়েছে টপিক চেঞ্জ করো এবার তোমরা। নির্দেশ দিল আয়মান।
সবগুলো নোট খাতায় মনোনিবেশ করলো। রায়হান পিয়াসার দিকে চেয়ে আছে সকরুণ চোখে। সেদিনের পর হতেই পিয়াসার জন্য তার হৃদয়ে একটা সফট কর্ণার কাজ করছে। পিয়াসাকে নিয়ে তার মনে শত প্রশ্ন, শত জিজ্ঞাসা। এ যেন এক দুর্নিবার কৌতুহল। কিন্তু কিভাবে জিজ্ঞেস করবে, কি ধরে প্রসঙ্গ তুলবে তার কোন অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছেনা।
পিয়াসা মনে হয় পড়াশোনায় আগের চেয়ে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছ? চুপচাপ দেখা যাচ্ছে যে? জিজ্ঞেস করলো রায়হান।
পিয়াসা এক পলক চোখ তুলে চাইলো রায়হানের দিকে। কিন্তু মুখে কিছুই বললনা। রায়হান ও আর কিছুই জিজ্ঞেস করলনা। সবার উদ্দেশ্যে বলল, পরিক্ষার সময় দেখতে দেখতেই ঘনিয়ে আসবে। তোমরা কারো কোন সমস্যা হলে আয়মান স্যারকে ফোন দিবে।
আয়মান হিরনের খাতায় তার পাবলিক নাম্বার লিখে দিয়ে, সবাই নাম্বার নিয়ে রাখ। এনিটাইম ফোন দিতে পারবে।
পিয়াসা ছাড়া সবাই নাম্বার লিখে নিল।
পিয়াসা নাম্বার নিলেনা যে? জিজ্ঞেস করলো রায়হান।
স্বল্পভাষী আয়মান দেখেও চুপ রইলো। কারণ সে জানে তার মতো করে এই মেয়েটাও তাকে পছন্দ করেনা। আর না করাটাই স্বাভাবিক। তাই হয়তো নাম্বার নেয়নি।
পিয়াসা চুপ হয়ে আছে। রায়হান যা বোঝার বুঝে নিল। তাই দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করলনা আর। কোচিং শেষ হয়ে গেলে সবাই একসাথে বের হয়ে গেল। পিয়াসা রায়হানের পিছন পিছন গিয়ে স্যার বলে ডাক দিল।
রায়হান পুলকিত হল মনে মনে। দাঁড়িয়ে গেল।
স্যার আপনার রুমালটা সেদিন যে দিয়েছিলেন। এই নেন।
ওহ। আমি ভুলেও গিয়েছি। এই সামান্য কিছু ফেরত দিতে হয়? রেখে দাও তুমি।
নাহ স্যার। সামান্য হোক কি হয়েছে। জিনিসতো। আমি ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে দিয়েছি।
আচ্ছা দাও। রুমাল দিলে নাকি ঝগড়া হয় আমার দাদীর মুখে শুনেছি। তবে না ধুইলেই বেশী ভালো হতো।
বুঝলাম না স্যার। না ধুইলে বেশি ভালো হতো কেন?
রায়হান ছল করার আশ্রয় নিলো। তুমি কষ্ট করে না ধুইলেও হতো। এটা মিন করেছি।
তাই বলেন বলে পিয়াসা মিষ্টি হেসে দিল। রায়হান কৌশলে তার মোবাইল নাম্বার লিখে দিল পিয়াসাকে। বলল, যেকোন প্রয়োজনে ফোন নয় শুধু মিসকলড দিলেই হবে।
চকিতে বিষম খেল পিয়াসা। বুকের ভিতর খচখচানি শুরু হলো। একজন শিক্ষক এত উপচানো আন্তরিকতা কেন আমার মতো একজন নিরীহ ছাত্রীকে দেখাচ্ছে। কারণ কি?
কোন সমস্যা পিয়াসা?
কাঁচুমাচু করতে করতে জানাল,স্যার আমার মোবাইল নেই। এজন্যই আয়মান স্যারের ও নাম্বার নেইনি।
রায়হান আফসোস করে বলল, ওহ আচ্ছা। আচ্ছা পিয়াসা তোমার এইম ইন লাইফ কি বা ক্যারিয়ার নিয়ে কোন স্বপ্ন আছে কি?
পিয়াসা মাথা নিচু করে ধীর গলায় জানালো,
স্যার এসব বলতে গেলে লম্বা সময় লাগবে। আমি আজ যাই। বাসায় তাড়া আছে। অন্য একদিন আপনাকে বলল।
রায়হান দেখল সেদিন দেরী হতেই বেদম মার খেলো সৎ মায়ের হাতে।
চট করে নিজের পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে নিল। সিম সহ পিয়াসার দিকে এগিয়ে ধরলো। বলল,আমার দুটো মোবাইল। এটা তুমি রাখ।
মুহুর্তেই মুখ মলিন করে ফেলল পিয়াসা। তার আত্মসম্মানে বাঁধলো খুব
। এটাকে রায়হান স্যারের দয়া মনে হলো তার কাছে। বলল, না স্যার প্লিজ। আপনি কেন আমাকে ফোন দিবেন?
আরেহ মেয়ে। দিচ্ছি কই। তুমি ফ্রি টাইমে ঠিক সেই কথাগুলো আমার সাথে শেয়ার করবে। যা এখন বলতে তুমি। এরপর আমাকে সেট দিয়ে দিবে। কারণ কলেজে আসলে অতিরিক্ত সময় তোমার বা আমার কারোই হচ্ছেনা।
এবার পিয়াসা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোবাইলটা নিল। রায়হান চলে গেল। পিয়াসা ভাবনার একূল ওকূল করেও কোন সদুত্তর পেলনা। রায়হান স্যার এতটা ভালো। এতটা আন্তরিক। নাকি সেদিন আমার দূর্দশাগ্রস্ত জীবন সম্পর্কে স্যার কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে? করতে পারাটাই যুক্তিযুক্ত। আর তারজন্যই কি এই অসীম সহানুভূতি?
এদিকে কলেজের বারান্দার একপাশে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা দেখে গেল আয়মান। আজ কিছু না বললেও কাল ঠিকই পিয়াসাকে নাজেহাল করতে ভুল করবেনা সে। বন্ধু রায়হানকে কিছুই বলবেনা সে। কারণ সে জানে পিয়াসাই আস্ত একটা খারাপ মেয়ে।
পিয়াসা মোবাইলের সুইচড অফ করে ব্যাগের ভিতরে রাখল। চলে গেল বাসায় । তাদের বাসায় গেট দিয়ে ঢুকতেই সে যা দেখল,তাতে আৎকে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
চলবে…২