#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৫ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
ভনিতা না করেই সারকথাটা বলে ফেলি প্রারম্ভে । সূচনা, বিস্তারিত, উপকারিতা,অপকারিতা, উপসংহার না হয় পরেই বলছি।
আচ্ছা পিয়াসা, আমি যদি তোমার আস্ত জীবনের দায়িত্ব নিতে চাই, তোমার কি কোন আপত্তি আছে ?
পিয়াসা শুকনো মাটিতে উষ্ঠা খাওয়ার মতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল শুনে। চোখ কপালে তুলল। আড়ষ্ট হয়ে এদিক ওদিক চাইলো অচেনা আগুন্তকের মতো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। লুকিয়ে নিজের হাতে চিমটি কাটলো। বুঝে নিল সে স্বপ্ন দেখছেনা। যা শুনেছে সত্যি শুনেছে।
রায়হানের মুখশ্রীতে নিরব চাহনিতে চাইলো৷ মিলানো ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বলল, আপনি ঠিকাছেন তো স্যার?
রায়হান হেসে ফেলল। নিজের কপালের দিকে এগিয়ে আসা চুলগুলোকে পাঁচ আঙ্গুল গলিয়ে পিছনে ঠেলে দিল। রসপূর্ণ কন্ঠে বলল,
তোমার জায়গায় আমি হলেও এমন ভীষম খেতাম। যেদিন বৃষ্টির মধ্যে তোমাকে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দিলাম। তুমি ভিতরে চলে যাওয়ার পর আমার ফোন আসাতে একটু থামতে হয়। তখন তোমার উপর সৎ মায়ের অমানবিক আচরণ দেখতে পাই।
ঠিক ওই মুহুর্তেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে তোমাকে ভালোলেগে যায়। ইচ্ছে ছিলো তোমার সাথে অল্পস্বল্প কথার মাঝে মাঝে তোমার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানব। যে জন্য মোবাইল ও দিলাম তোমাকে। এভাবে সখ্যতা হলে তা বন্ধুত্বে গড়াবে। তারপর প্রেমের প্রপোজাল দিব। কিন্তু তোমার বাবার অকাল মৃত্যুতে সব ওলট-পালট হয়ে গেলো।
তাই ডিসিশন নিতে হলো একবারে তোমাকে বিয়ে করে ফেলার। কিন্তু তোমার ফাইনাল পরিক্ষার পরে তা। তখন তুমিও উপযুক্ত হবে।
কেননা তুমি যার বাসায় এখন থাক, সেখানে কতদিন থাকতে পারবে। আর এই শহরে একজন তরুণী মেয়ে একা টিকে থাকা ভারি মুশকিল। একজন নির্ভরতার মানুষ থাকা চাই। যে ছায়ার মতো তাকে সাথে রাখবে। আগলে রাখবে যতনে। আমি তোমার সেই মানুষটি হতে চাই পিয়াসা। অকপটে কথাগুলো বলে রায়হান একটু থামলো। বোতলের ছিপি খুলে তিন কুলি পানি খেয়ে নিলো পিপাসার্ত হয়ে।
পিয়াসা নরম গলায় বলল, আমিতো আপনাকে স্যার হিসেবেই জানি আর শ্রদ্ধা করি। এই ভিতরে আমার পাশে আপনার সহমর্মিতার হাত বাড়ানোকে আমি নিতান্তই স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখেছি স্যার।
তোমার ভাবনাটাও রাইট পিয়াসা। আর স্যার হলে, বন্ধু হলে, বিয়ে হলে, কি শ্রদ্ধা করা যায়না?
আর শুন সবার থেকে সব সময় শ্রদ্ধা, বিনম্রতা পেতে ভালোওলাগেনা। বিশেষ করে তোমার মতো কারো কাছ থেকে। আশাকরি বুঝতে পেরেছে আমার ইঙ্গিত। তুমি আমাকে একটু এসব কম দেখাবে। বন্ধুর দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করো প্লিজ।
পিয়াসা আহত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
স্যার আমি যদি আপনার প্রপোজাল রিফিউজড করি তাহলে কি আপনি আমার কোন ক্ষতি করবেন?
রায়হান খুক করে হেসে ফেলল,
এই চিনলে মোরে? এটা তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। আমি হার্ট হব। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পডব। তাই বলে ভালোবাসার মানুষটার ক্ষতি করব। ইম্পসিবল। আমরা মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব। আর সেরা জীব মানুষ হয়ে মানুষের ক্ষতি করাতো অমানুষের কাজ। আমাকে কি তোমার অমানুষ মনে হচ্ছে?
ছিঃ ছিঃ। একদম না স্যার। আপনাকে আমিও খুব পছন্দ করি। খুব ভালো জানি। কিন্তু তা আপনার মতো করে নয়।
যেহেতু পছন্দ করো। ভালো ও লাগে। তাহলে বলনা আমার সাথে জীবন সমুদ্র পাড়ি দিতে আগ্রহী?
রায়হান ব্যাকুল হয়ে আছে পিয়াসার মুখে হ্যাঁ সূচক ছোট্ট একটা শব্দ শোনার জন্য। তার হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।
ক্ষমা করবেন স্যার। আমি প্রায় গরীব ঘরের সন্তান বলতে গেলে। এসব বর্ণিলতা আমাকে মানায়না। আমি পারবনা।
রায়হান কল্পনাও করেনি পিয়াসার জবাবটা এমন হবে। হজম হচ্ছেনা পিয়াসার কথা। অনুযোগমিশ্রিত কন্ঠে বলল,
কি ছেলেমানুষী করছ পিয়াসা? পারবনা মানে কি? আমি কি প্রেম করতে বলছি আমার সাথে? তা না হয় আমরা বিয়ের পরেই করব। আমিতো বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি তোমাকে। তোমার বাবা থাকলে হয়তো উনার কাছেই যেতাম তোমাকে চাইতে। তোমার পাত্র পছন্দ না হওয়ার কারণ?
কোন কারণ নেই স্যার।
তাহলে ফিরিয়ে দিচ্ছ কেন আমাকে? হাতে থাকা ফুলটা পিয়াসার হাতের দিকে বাড়িয়ে দিল রায়হান।
সর্যি স্যার আমি এ ফুল নিতে পারবনা।
রায়হান ফুলটাকে মুঠোয় পুরে কচলে ফেলে দিল মাটিতে ছুঁড়ে। পিয়াসার একহাত টেনে নিজের বুকের সাথে মিশে ধরল। টের পাচ্ছ কিছু? একবার যদি তোমার মাথাটা আমার বুকে রাখতে, শুনতে পেতে এ হৃদয় ভাঙ্গার গর্জন। তুমি সময় নাও প্রয়োজনে। আমি অপেক্ষা করব। তবুও ফিরিয়ে দিওনা। আমার সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে জনমভর তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করব৷ তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি পিয়াসা।
পিয়াসা জোর করে নিজের হাতকে মুক্ত করে নিল রায়হানের হাতের ভিতর থেকে। বেজায় মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝতেছেনা রায়হানকে কি বলবে বা কি বলা উচিত। কিভাবে এখন কলেজে সামনের দিনগুলোতে চোখ মেলাবে।
একটু মজবুত হয়ে মাথা নিচু করে বলল, স্যার আপনার মাঝে আমাকে নিয়ে এত অনুরাগ এর আগে প্রকাশ করেননি। হুট করে আজ একেবারে বিয়ের কথা বলে ফেললেন। কেমন যেন লাগছে। আমি উঠি। খুব ক্ষুধা পেয়েছে।
ওহ শিট! এক্সট্রেমলি সরি। আমার আগেই উচিত ছিল তোমাকে লাঞ্চ করানোর। একচুয়েলি আবেগে বিবেক হারিয়ে ফেলেছি বলে হেসে উঠে দাঁড়িয়ে গেল ।
পিয়াসাকে নিয়ে উদ্যানের ভিতর থেকে বের হয়ে গেল। পিয়াসা বাসায় গিয়ে খাব বলল। কিন্তু রায়হান নাছোড়বান্দা। একটা নিকটস্থ রেস্টুরেন্টে ঢুকল পিয়াসাকে নিয়ে। পছন্দের মেন্যু দিয়ে পিয়াসা পেটপুরে ভাত খেলো। পিয়াসা তৃপ্তির ঢেকুর তুলল বহুদিন পর তার প্রিয় কইমাছ ভাজা খেত পারল বলে। বাসায় ভাজলে একটা পুরো মাছ কখনোই প্লেটে জুটতোনা। হয় অর্ধেক নয় শুধু মাথার অংশ ভাগে পেত।
পিয়াসাকে বাইকে চড়িয়ে বাসার গেটে নামিয়ে দিল রায়হান । নিবেদিত চোখে চেয়ে বলল, আমাকে ভুল বুঝে ভুলে যেওনা।
পিয়াসা নিরব থেকে গেটের ভিতরে চলে গেল। রায়হানের খুব একটা মন খারাপ হলনা। তার বিশ্বাস এখন পিয়াসা পিতৃশোকে আচ্ছন্ন রয়েছে। শোক কাটিয়ে উঠুক। সময় গড়িয়ে যাক। এ ভিতরে চলতে চলতে ভালো না বেসে যাবে কই।
এদিকে আয়মান কথা প্রসংগে মা বোনকে পিয়াসার দুরাবস্থার কথা জানালো।
তার মা বলল,
তুই মেয়েটাকে কালকেই আমাদের বাসায় নিয়ে আয়।
মা ও আমাদের বাসায় আসবেইনা। আমাকে ভয় পায়। একদিন বেত দিয়ে মেরেছি তাই। আরেকদিন অনেক ঝেড়েছি। অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা ভাব পারলে।
ঢাকা শহরে মানুষ নিজে থাকতে জায়গা পায়না আবার এমন একটা বিবাহযোগ্যা মেয়ে রাখবে? তোর ও যা কথা বেক্কলের মতো। আমাদের বাসায় জায়গা আছে। ও আলিশার সাথে ঘুমাবে।
পাশ থেকে আয়মানের ছোটবোন আলিশা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। বলল আম্মু আমি একটা বন্ধু পাব। আপু পাব। আর বোর হবনা এই একলা বাসায়। ভাইয়া না আনতে পারলে তুমি আমি মিলে আপুটাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসব।
আয়মান বলল,আচ্ছা আগে আমি ওকে বলে রাজি করাতে পারি কিনা দেখি। ওর আবার টনটনে মর্যাদাবোধ।
পিয়াসাকে নিয়ে আয়মান সারাদিন অনেক ভাবল। বললে যদি হিতে বিপরীত কিছু ঘটে, তারচেয়ে ও ওর মতো থাকাই ঢের। তবুও পরের দিন রাতে পিয়াসাকে ফোন দিল।
পিয়াসা মোবাইল স্কিনে চেয়ে দেখল আয়মান স্যার লিখা। অবাক হয়ে চোখের পাতা ভাঁজ করলো পিয়াসা। পড়ার কোন প্রয়োজনে সম্ভবত ফোন দিয়েছে স্যার। এই ভেবে রিসিভ করলো।
হ্যালো আসসালামু আলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ তুমি?
আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন?
হুম ভালো আছি। তোমার সাথে একটু কথা ছিল। এখন বলব নাকি কাল দেখা করবে পরে? তোমার সুবিধা যেভাবে হয়?
স্যার পড়ার বিষয়ে হলেতো এখনই বলতে পারেনা।
না অন্য বিষয়ে।
তাহলে কাল আমি সময় সুযোগ করে দেখা করব স্যার। এখন কথা বলতে আমার সমস্যা। শুয়ে গিয়েছি।
ওকে। ঘুম ভালো হোক। আয়মান ফোন রাখল। পিয়াসার ফোনের কন্ঠ এত মিষ্টি। ওহ মাই গড! ভেবেই রোমাঞ্চিত হলো আয়মান।
পিয়াসার মাথা চরকির মত ঘুরছে। কি হচ্ছে তার সাথে এসব। কোন অশুভ হাতছানি নয়তো?
পরেরদিন পিয়াসা ক্লাস ও কোচিং শেষে অফিসে যায়। আয়মান অফিসে কাজের বাহানায় থেকে যায়। সবাই চলে গিয়েছে দু একজন অধস্তন কর্মচারী বাদে।
পিয়াসার দিকে মুখ তুলে চাইলো একবার৷ চেয়ারে বস।
না স্যার সমস্যা নেই বলেন।
পিয়াসা তোমার কি কোথাও থাকার ব্যবস্থা হয়েছে?
না স্যার হয়নি। তার আর দরকার ও নেই। ফাইনাল পরিক্ষা পর্যন্ত পাশের আন্টিদের বাসায় থাকব। তারপর গ্রামে চলে যাব। গ্রামের ভার্সিটিতে এডমিট হব। টিউশনি করাব। তাতেই চলে যাবে কোনরকম। ঢাকায় কোনভাবেই থাকা সম্ভব নয়।
আয়মান শান্তসুরে বলল,আমি যদি
তোমার থাকার ব্যবস্থা করি থাকবে?
কোথায় স্যার?
আমাদের বাসায়। জানি কি ভাবছ তুমি এখন?
চলবেঃ ৫