প্রণয়ের ত্রিভুবন পর্ব ৮

#প্রণয়ের_ত্রিভুবন
#সুপ্তি_আনাম
পর্বঃ ০৮

বর্তমান….

বাসায় বেডের মধ্যে গা এলিয়ে দিয়ে কাজ করছিলো এহমার। খুব জরুরি একটা ডিল নিয়ে কালেয়েন্টদের সাথে আলাপচারিতা করতে মগ্ন। হাই পাওয়ারের চশমার ভেতরে থাকা চক্ষুদ্বয় ল্যাপটপের দিকে নিবদ্ধকৃত। খুব গভীরভাবে ল্যাপটপে মনোনিবেশ করেছে এহমার। কাজটা ঠিকমতো সম্পন্ন না হলে নিঃসন্দেহে বস্ তাকে চাকরিচ্যুত করে দিবেন। বাড়ির সর্বত্রই কোনো মুখরোচক খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে।
বৃষ্টিস্নাত এই দিনটাকে আরোও জমিয়ে দিতে রান্নাঘরে ইলিশ-খিচুড়ি রান্নায় ব্যতিব্যস্ত শুভ্রিলা। নীল রঙের শাড়িটা কোমড়ে বেঁধে নিয়েছে। একে একে কয়েকবার এহমারকে ডাক দিলো সে। কিন্তু কই এহমার আসছে! প্রচন্ড জোড়ে চিৎকার করেও যেনো লাভ হলো না। মনে মনে বড্ড অভিমান হলো এহমারের উপর। ছেলেটা কোনো রেসপন্সও করলোই না! রেগে-মেগে খিচুড়ির এক সাইডে মরিচের গুড়ো মিশিয়ে দিলো। গুড়ো মিশিয়ে দেওয়ার পরপরই মনটায় যেনো পৈশাচিক আনন্দ খেলে গেলো! ফ্রিজ থেকে বরফের কিউবগুলো এনে বেড় করে ফিল্টারের ভেতর দিচ্ছে শুভ্রিলা। এমন সময় পেটের কাছে উন্মুক্ত অংশটায় যেনো কারো শীতল স্পর্শ পেলো। মুহূর্তেই যেনো হিম হয়ে গেলো শুভ্রিলার শরীর৷ বুঝতে বাকি রইলো না মহাশয় এহমার! তবুও মুখ ফুলিয়ে রইলো সে। এহমারের তপ্ত শ্বাসগুলো শুভ্রিলার শরীরে আছড়ে পড়ছে। একরাশ উষ্ণতার ছোঁয়া তাকে গ্রাস করে ফেলছে যেনো। হুট করে শুভ্রিলার কোমড়ে আটকানো এহমারের হাতগুলো এক ঝটকায় টেনে সড়িয়ে দেয় শুভ্রিলা। করুণামৃত কন্ঠে এহমারকে বলে,
–‘এখন কোথা থেকে দরদ দেখাতে আসলে হ্যা? অতক্ষণ তো কুম্ভকর্ণের মতো ঘাপটি মেরে ছিলে!’

শুভ্রিলার কথায় উপচে পড়ছে অভিমানগুলো। ব্যাপারটা অনেক আগেই বুঝতে পারে এহমার। শুভ্রিলাকে কাছে এনে বুকে টেনে নিতে চায় । তবে তাকে ধরার সুযোগ না দিয়েই ডিশগুলো নিয়ে ডায়নিং টেবিলে যেয়ে বসে সে। মনক্ষুণ্ণ ভাবে টেবিলের কাছে এগোয়। টেবিলের দু প্রান্তে প্রতিনিয়তই তারা বসে। তবে, আজ মনে হচ্ছে শুভ্রিলা খানিকাংশে ব্যবধান রেখে বসেছে। এহমার একটা বাঁকা হাসি হেসে তার পাশে যেয়ে বসলো। শুভ্রিলার মনে কোনো রিয়্যাকশান লক্ষ্য করা গেলো না।

–‘আজকের বৃষ্টিধারার দিনে খিচুড়ি-ইলিশ ভাজা আর একটু বউয়ের ভালোবাসা পেলে দিনটা জমে যাবে। কিন্তু আমার বউ আমার উপর রাগ করে আছে….

কোনো প্রতুত্তর করলো না শুভ্রিলা। আনমন চিত্তেই প্লেটটায় খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে সে। এহমার অপরাধী কন্ঠে আবারও বলতে শুরু করে।
–‘ তুমি আমার উপর রাগ করে আছো শুভ্রু, তেমার কাছে যাই নি বলে? বাট, ট্রাস্ট মি এটা অনেক ইম্পর্টেন্ট একটা ডিল ছিলো। যেটা আজকের মধ্যে না করলে বস্ চাকরীতে আর রাখবে না৷ তাই যাওয়া হয়নি৷ আমি সর‍্যি এর জন্য!’
ফট করে চেয়ার থেকে উঠে যেয়ে এহমারের পাশে বসে শুভ্রিলা। বসার সময় ফট করে এহমারের গালে একটা চুমু দেয়। এতেই যেনো মহাখুশি হয়ে যায় এহমার। গুরুগম্ভীরভাবে মুখ করে শুভ্রিলা বলে,

—‘এরপর থেকে আমার এক ডাকে হাজির না হলে, এক চুলও ছাড় দিবো না কিন্তু! ‘

–‘ঠিক আছে শুভ্রু। তুমি একবার ডাকলেই তোমার আলাদিন হাজির হয়ে যাবে! ‘

–‘কথাবার্তায় তো একশোয় একশো তুমি। বিয়ের আগে বোকা-সোকা ছিলে। আমার পাল্লায় পড়ে চালাক হয়েছো। আই ডিজার্ভ মাচ মাচ ডিগনিটি ফর দ্যাট! এখন খেয়ে দেয়ে আমাকে রক্ষে করো মিস. এহমার ‘

শুভ্রিলা তার খাওয়া বাদ দিয়ে এহমারের দিকে তাকায়। গপগপিয়ে খেতে ব্যস্ত সে। হুট করে শুভ্রিলার মনে পড়ে যায় এহমারের অংশে মরিচ পাউডার এ্যাড করেছিলো রাগের মাথায়। আর পড়ে মনেও ছিলো না। মনে মনেে অস্থিরতা শুরু হয় তার। এই না জানি কখন এহমার ঝাল ঝাল বলপ চেঁচিয়ে উঠবে। ভয়ে ভয়ে জলের গ্লাসটা এগিয়ে তার দিকে রাখে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে এহমার বললে,

–‘এই তো, একেই না বলে রান্না! আমি তোমাকে পেয়ে ধন্য শুভ্রু!’

মনে মনে অনেক বড়ো বাঁচা বেঁচে যায় শুভ্রিলা। তবে, এহমার এতো ঝাল সহ্য করতে পারে তা জানা ছিলো নাহ। মনে মনে ভীষণ রাগও লাগে, তাহলে তখন শুভ্রিলা রেগে থাকলেও এহমারের ঝাল খেয়ে কোনো সাইড ইফেক্ট হতো না। রাগ লাগে তার। এহমারের টি-শার্টের কলার চেপে ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে,

–‘তোমার ঝাল লাগলো না কেনো হ্যা? ‘
শুভ্রিলার এমন উদ্ভট ধরনের কথায় এহমার হতবিহ্বল প্রায়! ব্যাঙ্গ করে একটা হাসি দিয়ে বলে,

–‘ওহ, তাহলে এই স্পেশাল ঝালটা আমার জন্য ছিলো? বুঝতে পারলাম রেগে করেছো। বাট দ্য ম্যাটার অব রিগ্রেট ইজ আমি এটা খুব মজা করে খেয়েছি। ‘ আবারও হাসতে শুরু করে এহমার। তার হাসিটার দিকে চেয়ে থাকে শুভ্রিলা। এহমার ক্ষ্যান্ত হয়ে ফিচেল কন্ঠে বলে,

–‘আমি তোমারই শুভ্রু, আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে। গরমাগরম খিচুড়ির মজাটা মিস্ করিও না। তুমিও স্টার্ট করো।’

একসাথে সময়টাকে উপভোগ করতে থাকে এহমার আর শুভ্রিলা।

——————————❀
ডেস্কের ওপরে বসে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকোতে শুকতে এহমারের সাথে আড্ডা দিতে মগ্ন ছিলো শুভ্রিলা। আজকের সিক্ত পরিবেশের দিনটা বেশ ভালোই কাটছে তার।

–‘তোমার চুলের ঘ্রাণটা উফফফ আমাকে মাতাল করে দেয়। তুমি কি জানো প্রতিরাতে তোমার চুলের গন্ধ নেওয়ার জন্য তোমার কাছে যেয়ে শুই?’

এহমারের মুড ভালো আছে। অবশ্য শুভ্রিলার সাথে থাকলে মন মেজাজ খারাপ হওয়ার সাধ্যি থাকে না!এহমারের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো শুভ্রিলা। হঠাৎ যখন সে শুনতে পেলো এহমার প্রতিরাতে তার কাছে এসে শোয়, মনের অজান্তেই কেমন একটা খটকা লাগলো তাকে। বুকটা যেনো ধুককক্ করে উঠলো। তবে, শুভ্রিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

–‘এহমার, ইদানীং খুব রোমান্টিক হয়ে গেছো মনে হচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার যখন এতই আমার কৃত্রিম চুলের ঘ্রাণ ভালো লাগে তাহলে প্রতিরাতে একটা শ্যাম্পু নিয়ে ঘুমোতে পারো, আই নেভার কেয়ার৷ বাট, আমার কাছে আসার মানে কি? ‘

শুভ্রিলার এহেন কথায় এহমার বিরক্তিকর আওয়াজ ‘চ’ উচ্চারণ করে। নিরলস ভাবে বলে,

–‘কি একটু রোমান্টিক হবো তা না, সব কিছুতেই তোমার আপত্তি!’
এহমারের কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে শুভ্রিলা। আচানক শুভ্রিলার ফোনে কারো কল্ আসতেই দৌড়িয়ে সেদিকে যায় শুভ্রিলা। ফোনটা তার বেডের পাশে থাকা কাবার্ডের উপর রাখা ছিলো। এহমার বেডে বসেই কাজ করছিলো। শুভ্রিলার ফোন বেজে উঠলপ সেদিকে তাকিয়ে দেখে এক আননোন নম্বর থেকে কল আসছে। শুভ্রিলা কেমন হড়বড়িয়ে রুমে ঢুকে নম্বরটার দিকে পরখ করে সাথে সাথেই ধরে ব্যালকোনিতে চলে গেলো। এহমারের মনে কেমন খটকা লাগলো। শুভ্রিলার ধরার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিলো ওটা শুভ্রিলার যেনো পূর্বপরিচিত কোনো নম্বর। হতভম্ব বনে সেদিকে চেয়ে থাকে এহমার। একটু বাদেই সহাস্যমুখে ব্যালকোনি থেকে আসে শুভ্রিলা। এহমার কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। এহমারকে এরকম রোবটের মতো থাকতে দেখে শুভ্রিলা জিজ্ঞেস করে,

–‘কি হলো? ফেইস এমন হুতোম প্যাঁচার মতো করে রেখেছেন কেনো? এনিথিং রং? ‘

–‘ কার সাথে কথা বললে এতোক্ষণ ? ‘ চোয়াল শক্ত করে এহমার বলে।

–‘ওই ওই আমার একটা ফ্রেন্ড। ‘ কোনোভাবে কথাগুলে বলে তপ্ত শ্বাস ফেলে শুভ্রিলা । কথাগুলে বলার সময় গলায় যেনো দলা পাকিয়ে যাচ্ছিলো। একরকম প্রতুত্তর করে সেখান থেকে কেটে পড়ে শুভ্রিলা। আরো এক দফা খটকা লাগে এহমার। শুভ্রিলা মনে হয় তার থেকে কিছু একটা লুকোচ্ছে, বুঝে ফেলে এহমার।

.
.
চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here