প্রণয়ের রং,পর্ব:৭+৮

0
206

প্রণয়ের রং
পর্ব – ০৭

” আমাদের জীবনে কখনও কখনও এমন কোনো মানুষ আসে যারা আসায় আমাদের জীবন বদলে যায়.. তারা আমাদের বদলে দেয়। নয়তো তাদের জীবন বদলে যায় আমাদের কারণে… ”

ভরা পূর্ণিমার রাতে ছাদের এক কোণে পা ঝুলিয়ে বসে কথাগুলো নিজে নিজেই আওড়াচ্ছিলো শুভ্র। সত্যিই তার জীবন আজ অন্যরকম লাগছে। কে জানতো কখনও তার জীবনেও ভালোবাসার স্নিগ্ধ বাতাস এসে ওর মন ছুঁয়ে যাবে। ওকে রাঙিয়ে যাবে প্রণয়ের রঙে….

___” ভালোবেসে ফেলেছি তোমায় নিমপাতা.. অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছি। চুপি চুপি এসে আমার মনের কুঠিরে আসন পেতে বসে গেছো আমি টেরও পাইনি। ”
আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে চলেছে শুভ্র।

………………….

ভাঙা-গড়ার খেলায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সময়। সময় নিজের সাথে নতুন সম্পর্কের বন্ধন বয়ে আনে। তেমনি আবার অনেকসময় পুরনো সম্পর্কে পঁচন ধরায়।

নিমিতা ও শুভ্রের মাঝে দিনে দিনে দূরত্ব কমে আসছিলো। ছোট্ট ছোট্ট বিশেষ মুহুর্তগুলি তাদের অনুভূতিগুলোকে গাঢ় করে তুলছিল…

ওদের দুজনের কাছে আসা নিতু ও মেধার কাছে আনন্দের হলেও আবিরের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। ওর মনের মানুষ অন্যকারোর দিকে ধাবিত হচ্ছে এটা সে মানতে চায় না।

___” তুই আমার নিমিতা। অন্যকারো কাছে তোকে যেতে দিবো না আমি। আমার মনের কথা খুব জলদি জানাবো তোকে। ”

___” এই বাদড়.. কি ভাবছিস এত মন দিয়ে? ”
নিতুর প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে এলো আবির।

___” কিছু না। নিমিতা কই? ”

___” শুভ্র ভাইয়া ডেকে পাঠিয়েছে ওকে। উনার কাছে গেছে। ”

___” ওর সাথে নিমিতার এত কি কথা বলবি আমায়? ”

___” এত রেগে যাচ্ছিস কেন? কোনো দরকারেই ডেকেছে হয়তো। ”

___” শোন.. এসব আমায় বোঝাতে আসবি না। দরকার.. হাহ্..”

বলেই নিমিতাকে খুঁজতে চলে গেল আবির। কিন্তু ওর এমন ব্যবহার নিতুর মনে কু গাইছে। আজ সে আবিরের চোখে অন্যকিছু দেখছে..

___” নিয়তি কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে আমায়? যাকে আমি মনের আসনে বসিয়েছি সেই মানুষটা কি আমারই বেস্ট ফ্রেন্ডকে… ”
নাহ্.. আর ভাবতে পারছে না নিতু।

আবির কিছুদূর যেতেই দেখলো নিমিতা আসছে এদিকটায়। আবিরকে দেখে ওর সামনে আসতেই সে কাঠ কাঠ গলায় প্রশ্ন করলো__

___” কই ছিলি? ”

___” শুভ্র ভাইয়া ডেকেছিল। ”

___” কেন? ”

___” এমনিতেই পড়াশোনার খবর, ক্লাস কেমন চলছে এসব শুনতে। ”

___ ” ওর এসব নিয়ে চিন্তা কেন? তোর সবকিছুই ওকে বলতে হবে? ”

___” এভাবে কেন বলছিস? সিনিয়র হয় তাই হয়তো.. ”

___” সিনিয়র বলেই? আদিখ্যেতা দেখাতে আসবি না আমায়। ”

কথাটা বলেই চলে গেল আবির। নিমিতা ওর এমন ব্যবহারের আগা-গোড়া কিছুই বুঝলো না। নিতুকে ফোন করে ওর কাছে চলে গেল সে।

কাল নিমিতাদের ডিপার্টমেন্টে ছোট্ট একটা পার্টি আছে। সব মেয়েরা ঠিক করেছে তারা শাড়ি পরবে। নিমিতা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

___” নিতু রে.. তোর মনে আছে অরিয়েন্টেশনের কথা? শাড়ি পরাতে কি কান্ডটা হলো। ”

___” হ্যাঁ। তাই বলে আর শাড়ি পরবি না? ”

___” ওই খচ্চর লোক আমার শাড়িকে তেনা বলছে। আর পরতে না করছে। ”

___ ” কিচ্ছু হবে না। ভালোভাবে সেফটিপিন লাগায় দিবো তোরে এবার। ”

___” না রে.. ভয় হচ্ছে খুব। ”

___” আচ্ছা শুভ্র ভাইয়ার পছন্দের রং জানিস? ”

___” হুম। শুনেছিলাম একবার। সাদা। ”

___” তাহলে কাল সাদার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে নিবি নিজেকে। ভাইয়া চোখই ফেরাতে পারবে না। ”

___” বাহ্ রে.. উনার পছন্দ মতো কেন সাজতে যাবো?”

___” এহহ্.. শোন মেয়ে.. নাটক কম করো। কিছু বুঝিনা মনে হয় তাই না? ”

___” না রে। যা ভাবছিস তা মোটেও না। ”

___” হ..হ.. পুরো ক্যাম্পাস এই কথা জেনে যাবে আর তুই না না করেই যাবি.. ”

মগ ভর্তি চা নিয়ে বেলকনিতে বসেছে নিমিতা। গালে হাত দিয়ে চিন্তার পুকুরে খাবি খাচ্ছে। নিতুর কথা শুনবে সে? সত্যিই সাদা শাড়ি পরবে? ফের ওই খচ্চর তান্ডব শুরু করলে? এসব ভাবতে ভাবতেই বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিলো…

চলবে…
নিমিতা আনাম

প্রণয়ের রং
পর্ব – ০৮

পরদিন ভোর ৬:৩০ এ নিতু ও মেধা আসে নিমিতার বাসায়। এসেই ধুপধাপ ধাক্কা দিতে লাগলো নিমিতার রুমের দরজায়। লাফিয়ে উঠে বসলো সে। হুড়মুড় করে ছুট লাগাল দরজা খুলতে না জানি কি হয়েছে। দরজা খুলেই ওদের দেখে নিমিতার মেজাজ বিগড়ে গেল।

___ ” এই ভোর বেলা কি ডাকাতি করতে গেছিলি দুজন?পুলিশ লাগছে পিছনে? ”
চোখ মুখ খিচে জিজ্ঞেসা করলো নিমিতা।

___” দুর.. সর তো। এই ছেমড়ি এমনিতেই ভোর ৫ টা থেকে দৌড়ের উপ্রে রাখছে আমারে। এখন আবার তুই প্রশ্নের ডালা নিয়া খাড়াইছোস। উফফ.. বিছানা ডাকতেছে আমারে। ”
বলেই দুহাত ছড়িয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরলো মেধা।

___” কেন? কই গেছিলি তোরা?”

___” ফুল মার্কেট। দেখ কী কী কিনেছি। ”

হাতে থাকা শপিং ব্যাগ থেকে সব বের করলো নিতু। চুড়ি, ফুল আর এক গাদা সেফটিপিন।

ওদের কান্ড দেখে নিমিতা অবাক না হয়ে পারলো না।

___” এগুলি কেন আনছিস? কি করবি তোরা?”

নিতু এবার সব দাঁত বের করে হেসে বললো __

___” কেন..সাজবো। ভুলে গেছিস আজ কি?”

___” সব মনে আছে। আমি শাড়ি পরবো না। তোরা পর। ”

___” আরেহ্… টেনশন নিস না। এই দেখ ৪ ডজন সেফটিপিন আনছি। ৩ ডজন তোরেই পরায়ে দিবো। বাকি ১ ডজন আমার আর নিতুর জন্যে।”
বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে বসতে বললো মেধা।

নিতু গিয়ে আলমিরা থেকে নিমিতার শাড়ি বের করে আনলো। তারপর দুজনে মিলে জোর করেই নিমিতাকে শাড়ি পরালো। ওরাও তৈরি হয়ে নিলো। নিমিতা শাড়ি তো পরেছে, তবে মনে ভয় আছেই।

মেধা সত্যি সত্যিই পুরো ৩ ডজন সেফটিপিন পরিয়ে দিয়েছে নিমিতাকে।

___” তুই যে কোথায় কোথায় সেফটিপিন পরিয়ে দিছিস আল্লাহ্ মালুম। খুলতে গিয়ে শাড়ি ছিড়লে তোর চুল ছিড়বো আমি। ”
চোখ দুটো সরু করে মেধার দিকে তাকিয়ে বললো নিমিতা।

বাসন্তী পাড় সাদা শাড়ি পরেছে নিমিতা। আঁচল বাসন্তী – সাদা মিশেলে। দুহাত ভর্তি সাদা-বাসন্তী মিলিয়ে চুড়ি পরা। চুলগুলি খোপা করে কাঠগোলাপের মালা পরেছে। চোখে টানা করে কাজল পরা আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পরেছে।

সাদা রং যেকোনো কিছুর সৌন্দর্য্য দ্বি-গুণ বেড়ে দেয়। তাইতো সাদার ছোঁয়ায় আজ নিমিতার সৌন্দর্য্য আরও বেড়ে গিয়েছে। অপরূপ মায়াবী লাগছে ওকে।

তিন বান্ধবী একসাথেই ভার্সিটিতে এসেছে। আবির আগেই এসেছে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল গেটে। নিমিতাকে দেখে আরেকদফা প্রেমে পরলো ওর।

ভার্সিটির সবার চোখ যেন নিমিতাকেই দেখছে। সবার মাঝে ওকেই বেশি সুন্দর আর মায়াবী লাগছে।

শুভ্র আড়াল থেকে দেখছিলো নিমিতাকে। আর সবটাই খেয়াল করছিলো সে।

নিমিতারা হাঁটতে হাঁটতে মাঠের একপাশটায় আসতেই পেছন থেকে শুভ্র ডাকলো ওকে।

___” নিমপাতা। ”

নিমিতা পেছন ফিরে দেখলো শুভ্র দাড়িয়ে। বাসন্তী রঙের পান্জাবি ওর পরনে। দুজনকে কেউ একসাথে দেখলে “প্রেম- জুটি মনে করবে।

নিমিতার কাছে শুভ্রকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। মনে মনে হাফ ছাড়লো সে। ভাবছে শুভ্র তার প্রশংসা করতে এসেছে।

___” শাড়ি, চুড়ি,ফুল,কাজল সব পরে এসেছো দেখছি আজ!!”
হাসি মুখে বললো শুভ্র।

নিমিতা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর।

শুভ্রের চেহারা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। কপালের রগ ভেসে উঠেছে।

___” রং – ঢং যে এত ভালো পারিস জানতাম না। ”

হঠাৎ এমন কথায় নিমিতা চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে। নিতু ও মেধাও হঠাৎ এই ভাব বদলের কিছুই বুঝতে পারছে না। নিমিতা অবাক হওয়ার সীমা হারিয়েছে। সে প্রশ্ন করলো__

___” মানে? ”

___” খুব সরল সাজা হচ্ছে.. না? শাড়ি কেন পরেছিস? ”

নিমিতা চুপ করে আছে। সে খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছে এখন কি হবে।

___” নিষেধ করেছিলাম তোকে শাড়ি পরতে…করিনি? তবুও কেন? ছেলেদের শরীর দেখানোর শখ মিটেনি এখনো? ” হিসহিসিয়ে বললো সে।

নিমিতার চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পরছে। মুখের ভাষা যেন সব মিলিয়ে গেছে ওর। শুভ্রের চিৎকারে আশেপাশে সবাই জড়ো হয়ে গেছে।

___” এখন কেন চুপ করে আছিস? উত্তর দে। ” আবারও চিৎকার দিলো সে।

নিমিতা ভয়ে কেঁপে উঠলো। আবিরও চলে এসেছে। এতক্ষণে। কাঁপা কাঁপা গলায় নিমিতা বলতে লাগলো __

___” আমি পরতে চাইনি।”

___” পরতে চাসনি মানে? এখন মিথ্যেও বলবি আমায়? ”

বলেই ওর কাছে এসে একটান দিয়ে খোপার ফুল ছিড়ে ফেললো।

নিমিতা হতবম্ব হয়ে গেল। সে মোটেও ভাবেনি যে এমন কিছু করবে শুভ্র। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাচ্ছে ওর। এই মানুষটার জন্যে সেজেছিল সে!!

আর এক মুহুর্তও দেরি না করে দৌড়ে চলে গেল নিমিতা। আর এক সেকেন্ড ও এই লোকটাকে দেখার ইচ্ছে নেই ওর।

শুভ্র চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই নিতু ডাকলো ওকে।

___” ভাইয়া.. ও শাড়ি পরতে চায়নি আমরাই জোর করেছি। আর হ্যাঁ আপনার পছন্দের রং সাদা। তাই ও আপনার জন্যেই সাদা শাড়ি পরেছে। ”

শুভ্রের কানে শুধু একটা কথাই ভেসে আসছে ” ও আপনার জন্যেই সাদা শাড়ি পরেছে..”

চলবে…
নিমিতা আনাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here