#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ, অপ্রসন্ন মন মস্তিষ্কের দোলাচলে থিতিয়ে থাকা অন্তঃকরণে অবিধেয় চিন্তা চেতনার বিচরণ আয়েন্দ্রিকে নিশ্চুপ করে রেখেছে। উত্তরোত্তর ঘটে যাওয়া উৎকট সব ঘটনায় সে মর্মাহত।
জানালার গ্রিলে হাত রেখে উদাসচিত্তে চেয়ে আছে উত্তরের সে ঘন জঙ্গলে। আমগাছটার মধ্যে বসে থাকা সাদা আর কালোর মিশেলের পাখিটা লেজ নাড়িয়ে শুধু ঘুরে যাচ্ছে। আয়েন্দ্রির করুণ, ক্লান্ত চাহনি। তদ্দণ্ডে তার কটিদেশে উষ্ণ ছোঁয়ায় শিহরিত হওয়া দেহে শ্বাসরুদ্ধ করে ফিরে তাকায় আয়েন্দ্রি। তার অধরে লেপ্টে যায় কিয়ৎপলের ব্যবধানে নিষ্প্রাণের সরু, শুষ্ক ওষ্ঠাধর। আয়েন্দ্রি নির্লিপ্ত। জিজ্ঞাসু নেই তার চোখে। সে পূনরায় উদাসীন হয়ে ফিরে তাকায় জানালার ফাঁক গলিয়ে। কটিদেশে চাপ প্রতীত হলেও ভাবান্তরহীন আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ নৈঃশব্দে তার চিবুক রাখে আয়েন্দ্রির কাঁধে। আলগোছে ছুঁইয়ে দেয় আয়েন্দ্রির স্থির কপোল, শ্রবণেন্দ্রিয়, গলদেশ। অপ্রসন্ন আয়েন্দ্রি। তার চিত্তে কোনোরূপ প্রভাব বিস্তৃত হলো না। আয়েন্দ্রিকে নিজের বক্ষপুটে চেপে ধরে নিষ্প্রাণ। তার বক্ষস্পন্দনের প্রতিটি গুঞ্জন আয়েন্দ্রিকে আহত করছে।
সিক্ত গলায় বলে উঠে নিষ্প্রাণ—
“রেগে আছিস আমার ওপর? সরি রে।”
আয়েন্দ্রি বাকহীন। ইচ্ছে হলো না তার কথা বলতে। নিষ্প্রাণের স্বীকারোক্তির সুর—
“বললাম তো সরি। তোকে আমি সাজতে বলেছি বল? কেন সেজেছিলি ওভাবে? তাও আবার অন্য একজনের মতো! তুই তো আমার ধ্রুবতারা। তোকে কারো মতো সাজতে হবে না। তুই আমার কাছে সবসময় একই। তারাদের সাজতে হয় না। তাদের আলো আপনাআপনি ঝলসে দেয় কারো চোখ, বিদীর্ণ করে হৃদপ্রকোষ্ঠ, আলোকিত করে তমসা। তাদের কৃত্রিম সাজের প্রয়োজন নেই।”
আয়েন্দ্রি মলিন হাসে। ফিরে তাকায় ঝকঝকে নীলাভ্রের বুকে। শুভ্র থোকা থোকা জলদ। ক্ষয়ে নিচ্ছে নীলাভ মায়াকে। সেখানের স্থির চোখ রেখে ম্লান গলায় বলল—
“তুই তাকে ঘৃণা করিস? কেন?”
আয়েন্দ্রিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। শীতল চোখে কিছুসময় চেয়ে রইল। আয়েন্দ্রি বুঝল না। জানালা দিয়ে আসা ফিনফিনে পবনে আয়েন্দ্রির ক’গাছি চুল উড়ে এলো তার চোখে, মুখে। নিষ্প্রাণ অতলান্ত মায়ায় তা মুখ থেকে সরিয়ে দেয়। কপালে উষ্ণ ফুঁ দিতেই সরে যায় ছোটো কেশ। আয়েন্দ্রি নিভুনিভু চোখে নিষ্প্রাণকে দেখে। ছেলেটা এমনিতে কত স্বাভাবিক। কিন্তু রেগে গেলে! আর ভাবতে চায় না আয়েন্দ্রি। তার গায়ে এভাবে হাত তুলবে নিষ্প্রাণ তা আয়েন্দ্রির কল্পনাতীত।
আয়েন্দ্রির ভাবনার ঘোর কাটে তার গলায় ভেজা স্পর্শে। তার নরম গালে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। শুষ্ক গলায় বলল—
” আমার মা সুইসাইড করেছে ধ্রুবতারা।”
নিষ্প্রাণের এই কথায় কী যেন ছিল। আয়েন্দ্রিকে প্রমত্তা সাগরে ভাসিয়ে নিতে এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। আয়েন্দ্রি ভারাক্রান্ত গলায় বলল—
“তিনি সুইসাইড কেন করেছেন?”
নিষ্প্রাণ ঝরা হাসল। কেঁপে উঠল আয়েন্দ্রির বুক। এমন কথায়ও কেউ হাসে!
হেয়ালি গলায় বলল—
“আমি যদি আবার বিয়ে করি তাহলে তুই কী করবি?”
চমকিত হয় আয়েন্দ্রি। ঝট করেই নিষ্প্রাণের কলার চেপে ধরে বলল—
“মেরে ফেলব তোকে।”
নিষ্প্রাণ গা দুলিয়ে হাসে। মেয়েটা তাহলে তাকে সত্যিই ভালোবাসে! নিস্পৃহ গলায় ফিসফিসিয়ে বলল নিষ্প্রাণ—
“আমার মাও বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল।”
শঙ্কিত হয় আয়েন্দ্রির দৃষ্টি জোড়া। সে স্তম্ভিত, নিভৃত, চকিত।
নিষ্প্রাণ গাঢ় গলায় বলে উঠে—
“দুদিনের মধ্যে আমরা ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। ঝামেলা করিস না। একদম বাড়ির বাইরে যাবি না। আমার কথার যেন নড়চড় না হয়। প্রাণকে নিষ্প্রাণ বানাস না ধ্রুবতারা।”
আয়েন্দ্রিক জড়িয়ে ধরে তার নিবার্ক অধরে দীর্ঘ চুমু খায় নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণের বুকে শিয়র গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। আচমকা গা গুলিয়ে ওঠে তার। মুখ চেপে ধরে ওয়াশরুমে যেতেই ব্যগ্র হয়ে ওঠে নিষ্প্রাণ। উদ্বিগ্ন গলায় চেঁচিয়ে ওঠে—
“ধ্রুবতারা, কী হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস?”
মুখভর্তি বমি করে আয়েন্দ্রি। বুকপাজরে ব্যথা হয়। একটু ধাতস্থ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই নিষ্প্রানের চঞ্চলা মনের অস্থির প্রশ্ন—
“কী হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকব?”
নিষ্প্রাণের ব্যাকুলতায় আচম্বিতে তাকায় আয়েন্দ্রি। ক্লান্ত স্বরে বলল—
“না, আমি ঠিক আছি। একটু অস্থির লাগছিল। তেমন কিছু না। রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওকে। তুই রেস্ট নে। কিছু লাগলে তালাব চাচাকে বলিস। আমি একটু বাইরে গেলাম। কাজ আছে।”
আয়েন্দ্রি নীরব সম্মতি দেয়।
নিষ্প্রাণ যেতেই সচল হয় আয়েন্দ্রির মন, মস্তিষ্ক। বিছানার কোণায় পড়ে থাকা মোবাইলটা নিয়ে কল করে কাউকে। রিসিভ হতেই ভয়ার্ত গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—
“প্রাণ মাত্রই বাইরে গেছে। আমার ভয় করছে। আপনি প্রাণকে ভুল ভাবছেন।”
মিশকাত গুমোট শ্বাস ফেলে বলল—
“দেখো আয়েন্দ্রি, প্রথমে তুমি যে ভয়টা পাচ্ছ তা পাওয়া বন্ধ করো। জাস্ট রিল্যাক্স।”
আয়েন্দ্রি শ্বাস গিলে নেয়। নমনীয় গলায় বলল—
“আপনার কেন মনে হয় প্রাণ তার পরিবারকে খুন করছে? ও মাত্র দশ বছরের ছিল। ওইটুকু বাচ্চা…। আপনি ভুল ভাবছেন মিশকাত।”
“হয়তো। কিন্তু সবটা মিথ্যে হতে পারে না। তুমি বলেছ নিষ্প্রাণ তার রাগের বশে এমনটা করেছে। রাগের বশে খুন! তাও এভাবে! আয়েন্দ্রি তুমি এখনো ওকে চিনতে পারনি। ”
আয়েন্দ্রি ফুঁপাতে থাকে। সে কিছুতেই মানতে চায় না নিষ্প্রাণ তার পরিবারকে খুন করেছে। মিশকাত দৃঢ় গলায় বলল—
“আমি খবর নিয়েছি। সেদিন রাজন শিকদার বা নিষ্প্রাণ কেউ ই মসজিদে ছিল না। তারা বাড়িতেই ছিলেন। হঠাৎ আগুন লাগাতে সবাই ছুটে যান সেখানে। রাজন শিকদার কেস করতে চাননি। কেস করেছেন তার-ই কর্মচারী হেকমত। তুমি-ই বলো কেন করেননি রাজন শিকদার কেস? তার তো নিজে আসা উচিত ছিল!
ঘটনার ধামা চাপা পড়তেই নিষ্প্রাণকে রাতারাতি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বারো বছর পর ফিরে আসে সে। আচ্ছা বলোতো, তোমার কী একটুও মনে হয়নি নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক নয়? আমি তোমার ফ্রেন্ড তৃণার সাথে কথা বলেছি। নিষ্প্রাণের আচরণ সম্পর্কে শুনে আমি রীতিমতো হতবাক! আয়েন্দ্রি…নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক নয়।”
বুক কাঁপিয়ে জল বর্ষন হচ্ছে আয়েন্দ্রির চোখের কোটর থেকে। সাজানো গুছানো কথাগুলো দলা পাকিয়ে গেল গলায়। মিশকাতের কর্ণকুহর হলো সেই অবিশ্রান্ত ধারার ঝুমঝমু শব্দ। গলা পরিষ্কার করে বলে উঠে সে—
“শান্ত হও আয়েন্দ্রি। সারক আমাকে সব বলেছে। নিষ্প্রাণ রাগের বশে কিছু করেনি। ওর সবকিছুই সাজানো। নিজেকে সামলাও আয়েন্দ্রি। তুমি ছাড়া কেউ ওকে ভাঙতে পারবে না। ও কোনো প্রমান রাখেনি। ওদের বাড়িতে নয়নতারা নামের একটা মেয়েও ছিল। আগুন লাগার একসপ্তাহ আগে মেয়েটি মারা যায়। কিন্তু তারও আগে থেকে মেয়েটাকে ওই বাড়িতে দেখা যায়নি। মেয়েটা রোজ পাশের একটা মাদ্রাসায় যেতো। আমি অনেক কষ্টে সে সময়ের মাদ্রাসার শিক্ষককে খুঁজে বের করেছি। কী হয়েছিল মেয়েটার সাথে? সে নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পরেই আগুন লাগে। নয়নতারার মৃত্যু কী কারণে ঘটেছে তা কেউ জানে না। ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার মানে নেই। কারণ বাড়ির কাজের লোকদের অন্দরমহলে যাওয়ার এতটা সুযোগ তখন ছিল না। নিষ্প্রাণের কারণে ছাদের দরজা বেশিরভাগ সময় লাগানো থাকত। আয়েন্দ্রি, ওই বাড়িতে কী হয়েছে তা একমাত্র নিষ্প্রাণ আর ওর দাদু জানে। আর এর সত্যতা তোমাকেই বের করে আনতে হবে।”
আয়েন্দ্রি ঝুমঝুম বৃষ্টিস্নাত গলায় বলল—
“আমি কী করব? কাকে বিশ্বাস করব আমি? প্রাণ যতটা শান্ত ততটা ভয়ংকর। ও যদি কিছু করে বসে!”
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে আয়েন্দ্রি। এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে কী করা উচিত মিশকাতের সে বুঝতে পারছে না। সারক সুস্থ হয়ে আয়েন্দ্রির বাবা -মায়ের সাথে দেখা করে সবটা জানে। সারকের চতুর মস্তিষ্ক বলছে তার এই কিডন্যাপিং এ নিষ্প্রাণেরই হাত। সে এমন কাউকে খুঁজছে যে টক্কর দিতে পারবে নিষ্প্রাণকে। তখন খোঁজ পায় মিশকাতের। সদ্য ট্রেনিং শেষ হয়েছে তার। মিশকাতের ঠিকানা দেয় আয়েন্দ্রির ভাই আরাজ। মিশকাতের সাথে সবটা আলোচনা করেই একটা স্বচ্ছ প্ল্যান ফাঁদে তারা। আয়েন্দ্রির নাম্বার আরাজের কাছ থেকেই নিয়েছে মিশকাত। শাড়ি পড়ার প্ল্যানটাও মিশকাতের দেওয়া। আর তার বিপরীতে নিষ্প্রাণের ভয়ংকর ব্যবহার আয়েন্দ্রিকে ভাবতে বাধ্য করেছে নিষ্প্রাণ আসলেই স্বাভাবিক নয়।
মিশকাত গাঢ় গলায় বলল—
“তোমাকে রাজন শিকদারের কাছেই যেতে হবে। তিনিই পারবেন তোমাকে সাহায্য করতে।”
“দাদু তো ঠিক করে কথা বলতে পারে না।”
“জানি। আমি যা বলছি তা মনোযোগ দিয়ে শোনো।”
মিশকাত এক অবিশ্বাস্য বুদ্ধি দিয়ে দেয় আয়েন্দ্রিকে। কী করে সে রাজন শিকদারের কাছ থেকে নিষ্প্রানের সত্যতা বের করতে পারবে।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃঃ৪৯
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
রাজন শিকদার অরব। তার পাশেই বসে আছে আয়েন্দ্রি। ঘনঘন অক্ষিপল্লব নাড়িয়ে কিছু দেখছে। হাসমুল দাঁড়িয়ে আছে একটু পেছনেই। ক্ষীণ গলায় অনেকটা আদেশের সুরেই বলে উঠে আয়েন্দ্রি—
“হাসমুল, আপনি একটু তালাব চাচার কাছে গিয়ে বলুন তো আমি আজ হাসের মাংস খাবো। বলবেন, ঝাল ঝাল করে যেন রান্না করে।”
হাসমুল মনে হয় বিরক্ত হলো। সে সটান হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। আয়েন্দ্রি ভ্রু নাচিয়ে মিহি গলায় ধমকে উঠে বলল—
“কী হলো যান! দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চাচাকে গিয়ে বলে আসুন।”
হাসমুল নাকের ডগা ফুলিয়ে বলল—
“জে যাইতেছি।”
হাসমুল কক্ষের বাইরে পা রাখতেই ব্যাকুল হয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। তড়িঘড়ি করে মোবাইল বের করে রাজন শিকদারের হাতের সামনে ধরে। রাজন শিকদার তার আঙুলে এখনো একটু জোর পান। আয়েন্দ্রি চট করে তাকে কীবোর্ড এনে দেয়। যাতে করে তিনি শুধু আঙুলের ছোঁয়ায় লিখতে পারেন। আয়েন্দ্রি তটস্থ গলায় বলল—
“দাদু প্লিজ, আজ চুপ করে থাকবেন না। আপনি তো সব জানেন তাই না। প্রাণের কী হয়েছে? ওর কী ছোটোবেলায় কোনো অসুখ হয়েছিল? প্লিজ দাদু, কী হয়েছিল বলুন না?”
রাজন শিকদার কাঁপতে লাগলেন। মুখ দিয়ে গোঙানি বের হচ্ছে। হাতটা উঁচু করতে গিয়ে যেন পারলেন না। ব্যর্থ হলেন তিনি। আয়েন্দ্রি ভয়াতুর চোখে চেয়ে বলল—
“প্লিজ দাদু। তাড়াতাড়ি করুন। হাসমুল বা প্রাণ যে কেউ এসে যাবে। ”
রাজন শিকদার উতলা হয়ে উঠলেন। অতি কষ্টে কিছু একটা বললেন। কিন্তু তা বুঝতে সক্ষম হলো না আয়েন্দ্রি। তিনি আঙুলের সাহায্যে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছেন। লিখলেনও। কিন্তু ততক্ষণে হাসমুল এসে পড়েছে। আয়েন্দ্রি মোবাইল লুকিয়ে ফেলে।
,
,
,
ঊষারে উদিত প্রভাকরের হলদে মিহি রোদের ঝলমলে আবরণে অবগাহনে মত্ত বসুন্ধরা। বহ্নিসখে মৃদু শীতলতা। এক ঝাঁক পাখির কুহুতান। মোলায়েম পরিবেশে মন মাতানো সৌরভ।
বেঘোরে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন নিষ্প্রাণ। বিছানার একপাশে বেসামাল সে। বিছানার সাথে বুক লেপ্টে আছে। আয়েন্দ্রি কিছুক্ষণ শ্বাসরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। মস্তিষ্কের নিউরণগুলো বেগতিক হারে ছুটছে। শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ঘন, তীব্র, প্রবল নিঃশ্বাসের ভয়াল আগ্রাসন। আর দেরি করা যাবে না। বেডসাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা খালি দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আয়েন্দ্রি। পানিতে প্রায় তিনটা ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছে সে। এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না তার। সারারাত ঘুম হয়নি তার। রাজন শিকদার মোবাইলে দুটো শব্দ লিখেছেন,” নিষ্প্রাণ অসুস্থ”।
সিঁড়ি বেয়ে যখন নিচে এলো আয়েন্দ্রি, তখন কাউকে সে দেখল না। ভোর হয়েছে সবে। আলোর স্ফুটিক ছড়াতে শুরু করেছে। ঘুমে নিমগ্ন বদ্ধ পুরী। আয়েন্দ্রি নির্বিঘ্নচিত্তে বিশাল দরজারটার পাল্লাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। ভয়ে তার বুকের কলিজা লাফিয়ে যাচ্ছে।
গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করে আয়েন্দ্রি। শীতল সমীরণেও ঘেমে যাচ্ছে সে। কপাল আর নাকের ডগায় জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শ্বাস চলছে বেগতিক হারে। গলায় দেখা দিয়েছে উষরতা। আয়েন্দ্রির জিব লেগে আসে। শরীরে নিম্নাংশে কাঁপন শুরু হয়েছে। হাতের মুঠে থাকা চাবির ছড়ার দিকে তাকিয়ে বৃহৎ ঢোক গিলল। রাতে যখন নিষ্প্রাণ নিচে খেতে আসে তখনই রাজন শিকদারের ঘর থেকে চাবি খুঁজে নিয়ে আসে আয়েন্দ্রি।
দালানটির সামনে আসতেই বুক ধকধক করতে শুরু করে আয়েন্দ্রির। ময়লা পরা দরজায় আলতো হাত ছোঁয়াতে সমস্ত দেহপিঞ্জর কেঁপে ওঠে তার। মাকড়সার জাল, গুড়ি গুড়ি পোকার অবাধ বিচরণ লোহার দরজাটাতে। আয়েন্দ্রি ভয়কাতুরে চোখে চেয়ে রইল। সহসা কাঁপতে শুরু করল তার হাত। সে কি ফিরে যাবে?
দাঁড়িয়ে রইল আয়েন্দ্রি। নিজেকে ধাতস্থ করে সিদ্ধান্তে অটল হলো। যে করেই হোক সে ভেতরে যাবেই। চাবির ছড়াটার সবগুলো চাবি একের পর এক ট্রাই করে যাচ্ছে আয়েন্দ্রি। ভয়ে গা গুলিয়ে ওঠল তার। সে কি চাবি আনেনি তাহলে?
ভয়ে হিম হয়ে এলো তার উষ্ণ গাত্রবরণ। জমে এলো জল চোখের কোণে। আচমকা চাবি পড়ে যায় নিচে। চাবির ঝংকারে কেঁপে ওঠে আয়েন্দ্রি। অধর ছড়িয়ে শ্বাস ফেলে। ধূলোয় মাখামাখি চাবির ছড়াটা নিয়ে আবারও একের পর ট্রাই করতে থাকে। ফট করেই খুলে যায় কালো রঙের বৃহদাকার তালাটি। আয়েন্দ্রি সুপ্ত শ্বাস ফেলে। খুশিতে চকচক করে ওঠে তার আঁখিদ্বয়। ঘনঘন কয়েকটা শ্বাস ফেলে দুই হাতে দরজায় ধাক্কা মারতেই ক্যাটক্যাট আওয়াজে তা খুলে যায়। ভেতরে থেকে হুরহুর করে বদ্ধ বায়ু বেরিয়ে আসে। আয়েন্দ্রির দম আটকে আসে। শুষ্ক, কটকটে, উষ্ণ বায়ু। ভয়ে জড়ানো কম্পিত পায়ে এগোতে থাকে সে। দালানটির ভেতরে তমসাচ্ছন্ন। দরজা, জানালা বন্ধ হওয়াতে ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা আলোয় আবছা লাগছে সব। আয়েন্দ্রির শরীর ভারী হয়ে আসে। যেন এখনই সে বরফ হয়ে যাবে! বিস্তৃত মেঝেতে ধূলোর স্তুপ। আয়েন্দ্রির শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। হাসফাস করে সে। তার হৃদস্পন্দন দমদম করছে। যেন ব্যবচ্ছেদ ঘটাবে তার দেহের। বুকের অভ্যন্তরে কম্পিত বস্তুটি যেন ছিটকে বেরিয়ে আসবে!
আয়েন্দ্রি একটা লম্বা শ্বাস নেয়। ধাতস্থ হয়ে পুরো দালানে চোখ বুলায়। ছোট্ট একটা সিঁড়ি। আয়েন্দ্রি পা বাড়ায়। ধীম ধীম করে এগিয়ে যাচ্ছে সে। বক্র আকৃতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে আয়েন্দ্রি। সিঁড়ির রেলিং এ হাত লাগাতেই শিরশির করে ওঠে তার শরীর। দেয়ালে দেয়ালে যেন ফিসফিসানি চলছে। নীরব ঘাত -প্রতিঘাত। আয়েন্দ্রি শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না। ঝুলন্ত মাকড়সার জালে আচ্ছন্ন সব। গুমোট অনুভূতি। কালশে আঁচড়। যেন সর্বশান্ত এক মূর্তপ্রতীক।
আয়েন্দ্রি প্রভঞ্জনে কম্পন শুনতে পায়। চকিতে বিদঘুটে এক শব্দ। লাফিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি। একটা টিকটিকি লাফিয়ে পড়েছে তার গায়ের উপর। ভয়ে চেঁচিয়ে সিঁড়ির উপর বসে পড়ে সে। সাহস সঞ্চয় করে ওঠে দাঁড়ায়। বুক ভরে শ্বাস নিল সে। আয়েন্দ্রির গলা শুকিয়ে এসেছে। একটু একটু করে পা বাড়াতে থাকে। দোতলা করিডোরে এসে থামে সে। সরু করিডোরের একপাশে কক্ষ অন্যপাশে দেয়াল। আয়েন্দ্রি গুটগুট করে এগিয়ে যায়। বিছানো, জড়ানো সরু, পাতলা জালের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে দরজায় হাত দেয়। একটু জোরে ধাক্কা দিতেই খটখট আওয়াজে খুলে যায় দরজা। ভেতরে থেকে তপ্ত বায়ু বেরিয়ে আসে। আয়েন্দ্রি দ্রুত সেখান সেখান থেকে সরে আসে। কেশে ওঠে সে। শূন্য, স্থবির, নীরব পরিবেশে আয়েন্দ্রির কাশির শব্দ মাতম শুরু করে। ঘাবড়ে যায় আয়েন্দ্রি। ঘনঘন শ্বাস ফেলে রয়ে সয়ে কক্ষের ভেতরে ঢুকে। তিন ধারের জানালা বন্ধ হওয়ায় আবছা অন্ধকার। দেয়ালের পলেস্তার খসে পড়ছে। গা ছমছম করে আয়েন্দ্রির। ধুলোর আস্তরণে চাপা দীর্ঘশ্বাস। আয়েন্দ্রি চারদিকে ভালো করে দেখে। কিছু নেই সেখানে। সন্তর্পনে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। একটু সামনে এগিয়ে আরও একটা কক্ষ। আয়েন্দ্রি সেই কক্ষে প্রবেশ করে। আশ্চর্য হলেও সত্য দালানটির বাইরের দরজা বৃহৎ তালা থাকলেও ভেতরে কোথাও কোনো তালা নেই। যেন যে কেউ ইচ্ছে করলেই ভেতরে যেতে পারবে!
আয়েন্দ্রি সেই কক্ষে ঢোকে। কিন্তু সন্দেহ করার মতো বা তার প্রয়োজনীয় কোনো কিছুই ছিল না সেখানে। আয়েন্দ্রি হতাশ হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। আলোর স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে শুরু করলেও দালানের ভেতরে তার অস্তিত্ব খুবই ক্ষীণ। আয়েন্দ্রি চলতে শুরু করে। এমন আরও কয়েকটা কক্ষ। সব একই। কিন্তু একদম শেষের কক্ষের সামনে এসে থমকে গেল আয়েন্দ্রি। তাতে একটা তালা ঝোলানো। আয়েন্দ্রি বিস্মিত চোখে তাকায়। খুতখুত করছে তার অন্তঃকরণ। আয়েন্দ্রি ফাঁকা ঢোক গিলল। চাবি! এখন চাবি কোথায় পাবে সে?
হাতে থাকা চাবির ছড়া নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে তালা খোলার চেষ্টা করতে থাকে। নির্দিষ্ট চাবি তালাতে পড়তেই খট করে খুলে যেতেই আয়েন্দ্রির চোখে মুখে খেলে যায় তীব্র উচ্ছাস। দুই হাতে সজোরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আয়েন্দ্রি। কিন্তু হতাশ সে! সেই একই অবস্থা। আয়েন্দ্রির মস্তিষ্কের নিউরণে চাপ সৃষ্টি হয়। এই কক্ষে তালা কেন ছিল? আয়েন্দ্রির জানালার কাছে এগিয়ে যায়। কাঠের জানালার পাল্লা খুলে দিতেই প্রভাকরের দীপ্ত রশ্মি ভুরভুর করে ভেতরে প্রবিষ্ট হয়। আয়েন্দ্রি বাকি দুটো জানালাও খুলে দেয়। এক কালো গহ্বর যেন প্রাণসঞ্জিবনী ফিরে পেল। আলোয় আলোকিতে কক্ষের দেয়ালে তাকাতেই চকিত হয় আয়েন্দ্রি। পিঁপড়ার একটা ভারী দল দেয়াল বেয়ে চলছে। তেলাপোকা খেলছে লুকোচুরি। টিকটিকি যেন জামাই ষষ্ঠিতে এসেছে!
আচানক বুক ধড়ফড় করে ওঠে আয়েন্দ্রির। প্রকট হতে থাকে সেই ভয়ংকর সিটির সুর। আয়েন্দ্রি দরজার দিকে তাকাতেই ধড়াস করে লাফিয়ে ওঠে তার কলিজা। নিষ্প্রাণ!
নিষ্প্রাণের গোলাকার ওষ্ঠাধরে সেই পরিচিত সুর। আয়েন্দ্রি ভয়ে সিটিয়ে যায়। নিষ্প্রাণ চোখে হাসে। সিটি বন্ধ করে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। চকচকে চোখে আয়েন্দ্রির দিকে তাকাতেই ভয়কাতুরে গলায় বলে উঠে সে—-
“প্রাআআণ তুই?”
নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক গলায় বলল—
“হ্যাঁ। আমি। কেন?”
আয়েন্দ্রির আত্মা শুকিয়ে আসে। থরথরিয়ে কাঁপছে সে। গলার স্বর বসে আসে। কম্পনরত গলায় বলল—
“তুততততই এখানে!”
নিষ্প্রাণ ধীর পায়ে আয়েন্দ্রির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়েন্দ্রির উদ্ভাসিত চাহনিতে ভয়ের উত্তাল স্রোত। তা নামছে অরবে। নিষ্প্রাণ ঘাড় বাকিয়ে একবার গাঢ় নজরে দেখল আয়েন্দ্রিকে। ফট করে হেসে ঠাস করে এক চড় বসায় আয়েন্দ্রির গালে। ধুম করে মেঝেতে লেপ্টে পড়ে আয়েন্দ্রি। জমা ধুলো উড়ে গিয়ে আয়েন্দ্রির স্বরনালীতে প্রবেশ করে। খুসখুসে কাশি হয় তার। আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের দিকে চাইতেই দেখল ভয়ংকর কোনো সত্ত্বাকে। আয়েন্দ্রির চুলের গোছা তখন নিষ্প্রাণের মুঠোয়। খামছে ধরে আয়েন্দ্রির মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল—
“কেন এসেছিস এখানে? তোকে কতবার বলেছি বাড়ির বাইরে বের হতে না। তবুও বের হলি? কী জানতে চাস তুই?”
আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কোণ কেটে লহু গড়িয়ে পড়ছে। বিমর্ষ, বিধ্বস্ত, ভঙ্গুর চাহনি। অনুনয়ের সুরে বলল—
“প্রাণ আমার কথা শোন।”
দাঁতের সাথে দাঁতে কেটে ধরে অদ্ভুতভাবে হাসে নিষ্প্রাণ। ধারাল গলায় বলল—
“কী বলবি তুই? পানির সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়েছিলি? মিশকাতের সাথে এত কথা তোর! আমার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করিস ওকে তাই না?”
আয়েন্দ্রির বিস্ময় আকাশ ছুঁল। পূর্ণ নজরে নিষ্প্রাণের দিকে চেয়ে বলল—
“আমার লাগছে প্রাণ। প্লিজ ছাড়।”
ক্ষুব্ধ নিষ্প্রাণ মুখ বিকৃতি করে বলল—
“তোর সাহস কী করে হলো এখানে আসার? হ্যাঁ। মিশকাত যা বলেছে তা সব সত্য। আমি, আমিই আমার পুরো পরিবারকে আগুন জ্বালিয়েছি। জীবন্ত। এই ঘরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। নিজের চোখে দেখেছি সেই আত্ম চিৎকার। শুনেছিও।”
আয়েন্দ্রির মনে হলো কেউ তার হৃদপিন্ডটা টেনে হিঁচড়ে বের করে নিচ্ছে। রক্তের স্রোত বইছে তার সারা শরীরে। নিষ্প্রাণ সেই মুঠোভর্তি হাতে আয়েন্দ্রি মাথাটা মেঝেতে বিকট আওয়াজে ঠেসে ধরে। চিৎকার করে ওঠে আয়েন্দ্রি। তার কপাল চিরে রক্তের প্রস্রবণ ঝরছে। আয়েন্দ্রির শরীর জমে আসে। চোখ ঝাপসা হতে থাকে তার। নিষ্প্রাণের ভয়াল আগ্রাসনের আরও অনেক কিছুই যে দেখা বাকি।
চলবে,,,
চলবে,,,