প্রাণস্পন্দন পর্ব ৪৬+৪৭

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

লম্বা করিডোরে পাঁচ ফুট পরপর পিলার। নিষ্প্রাণদের এই করিডোর থেকে বাড়ির সামনের দিকটা স্পষ্ট অবলোকন করা যায়। বাড়িটির বাইরের দিক থেকে দেখে এর ভেতরের কাঠামো সম্পর্কে অনুমেয় করা অসম্ভব। নিষ্প্রাণের ঘরের দুইপাশে আরো দুটো ঘর আছে। দোতলায় কর্ণারের দিকে সুবিশাল কক্ষে থাকে রাজন শিকদার। সিঁড়ি দিয়ে ওঠে বামে যেতে হয়। নিষ্প্রাণের কক্ষ তিনতলায়। পূর্ব দিকে করিডোরে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি। তার স্থির চাহনি অকৃত্রিম সৌন্দর্যের আধার বৈচিত্র্যময় মেদিনীর বুকে।

যুবতী বিকেলে শেষ লগ্ন আসতে চলেছে। গাঢ় সমীরে দুলে ওঠে অদূরে দন্ডায়মান সুপারিগাছের চূড়া। দোদুল্যমান সরু পাতা ভেদ করে দেখা যাচ্ছে ধূসর অম্বর। ম্লান হয়ে আসছে তার তীক্ষ্ম রোশনাই। পূর্বাকাশের শেষ প্রান্তে আচমকা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখল আয়েন্দ্রি। কৃষ্ণাভ জলদ ক্ষয়ে নিচ্ছে ধূসর অম্বরকে। সেই আবছায়া গর্জে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে আয়েন্দ্রি। বাড়িটির অভিমুখ বিপরীত দিকে। এদিক থেকে সে পশ্চাতদেশ-ই দেখতে পাচ্ছে। শেওলা পরা, ধূলা-ময়লা আচ্ছাদিত পরিত্যক্ত বাড়িটির প্রতি অমোঘ টান অনুভব করে আয়েন্দ্রি। বাড়িটির ছাদ এখান থেকে স্পষ্টত। আচমকা উদরে পেলব স্পর্শে কেঁপে ওঠে আয়েন্দ্রি। চমকিত চোখে ফিরে তাকাতেই প্রাণপ্রিয় মানুষটির হৃদয় ভেজা হাসিতে লাজুকতায় নতজানু হয় তার অরব আঁখি।

নিষ্প্রাণ সরব গলায় বলল—

“এখানে কী করছিস?”

আয়েন্দ্রি সরু গলায় বলল—

“কিছু না।”

করিডোরের হাফ দেয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি। তার সামনেই মূর্তমাণ পুরুষটির অধর বিস্তৃত হাসিতে অনুরণন শুরু হয় তার দেহে। নিষ্প্রাণ আরেকটু এগিয়ে আসে। ব্যবধান কমিয়ে শূন্যে নিয়ে আসে। শ্বাসে শ্বাসে চলছে কষাকষি! নিষ্পেষিত হচ্ছে একে অন্যের মোহজালে। আয়েন্দ্রির কোমরে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ভীত চোখে তাকিয়ে আছে নিষ্প্রাণের অভীপ্সাপূর্ণ নেত্রগোলকে। তার স্থির,ব্যাকুল, ব্রীড়া চাহনি। নিষ্প্রাণ ঘাড় বাঁকায়। আর্দ্রতায় আচ্ছন্ন করে ফেলে আয়েন্দ্রির গলদেশ। আয়েন্দ্রির শান্ত নারীসত্তায় প্রেম সায়রের উত্তাল মহাতরঙ্গের তান্ডব লীলা শুরু হয়। নিষ্প্রাণ আবেশিত। তার ঘোরে সমাচ্ছন্ন পুরুষালী উত্তাপ ক্রমশ মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। গলা থেকে মুখ উঠিয়ে অক্ষিপল্লব ছুঁয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। দেহের সাথে কম্পিত হতে থাকে আয়েন্দ্রির ওষ্ঠাধর। তা স্বগৌরবে চট করেই লুফে নেয় নিষ্প্রাণ। গাঢ় ছোঁয়া প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। আয়েন্দ্রি তার দৃঢ়তা হারায়। নিষ্প্রাণ মিশিয়ে নেয় তাকে নিজ বাহুডোরে। কলঙ্কিত করে তার ধ্রুবতারার নারীমনকে। নিষ্প্রাণের বাহুবন্ধন শিথিল হতেই ছিটকে সরে পাশ ফিরে আয়েন্দ্রি। শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে অবনত শিয়রে। ফিচেল হাসে নিষ্প্রাণ। পেছন থেকে আয়েন্দ্রিকে জড়িয়ে ধরে চিবুক রাখে তার কাঁধে। খোলা চুলে ঘ্রাণেন্দ্রিয় গুঁজে দীর্ঘশ্বাস টেনে তপ্ত হৃদয়ে বর্ষণ ঘটায় প্রাণহারিনীর সৌরভে। মিইয়ে গলায় বলল—

“ঘরে চল।”

আয়েন্দ্রি লাজুকতায় জড়ানো মায়ায় বলল—

“উঁহু।”

“তাহলে কী করবি?”

“জানি না।”

“কী জানিস তুই? আমায় পাগল করতে?”

“যাহ!”

ঝরা হাসে নিষ্প্রাণ। লজ্জায় গুটিয়ে যাওয়া আয়েন্দ্রির স্বাভাবিক ব্যবহারের নিমিত্তে তাকে ছেড়ে দেয়ালের উপর ওঠে বসে । আতঙ্কিত গলায় চোখ নাচিয়ে বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“এই, পড়ে যাবি!

নিষ্প্রাণের হাতটা খাবলে ধরে আয়েন্দ্রি। যেন ছেড়ে দিলেই সর্বনাশ ! গহন হাসে নিষ্প্রাণ। সুপ্ত গলায় বলল, প্রাণ কখনো তার স্পন্দনকে ছেড়ে যাবে না। আয়েন্দ্রির হাতের বাঁধন শক্ত হতেই তা ছাড়িয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। সরব গলায় বলল—

“পড়ব না। রিল্যাক্স।”

আয়েন্দ্রির মন মানলো না। পূনরায় নিষ্প্রাণের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল। আয়েন্দ্রির শাড়ির আঁচল নেমে গেছে। তা খানিকটা কুঁচকে কাঁধে উঠিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। তৎক্ষণাৎ নিষ্প্রাণের অবাধ্য চোখ আটকে আয়েন্দ্রির নাভিকমলে। ফর্সা মেদহীন উদরে এক সুডোল গহ্বর। অধরে কোণে চোরা হাসে সে। আয়েন্দ্রি ঝলমলে গলায় প্রশ্ন করে—

“ওই বাড়িটাতে কেউ থাকে না?”

নিষ্প্রাণ পাশের দালানে তাকায়। তেতো হয়ে ওঠে তার স্বচ্ছ মনটা। তবে তা বুকের অভ্যন্তরে-ই সীমাবদ্ধ। পরিত্যক্ত দালানটির দিকে চেয়ে অবলীলায় বলতে থাকে—

“না। ওটা থাকার জন্য বানায়নি দাদু। দাদুর হৈ-হুল্লোড় পছন্দ না। তিনি সবসময় চুপচাপ আর ঝামেলাহীন থাকতে পছন্দ করতেন। তাই বাড়ির যত অনুষ্ঠান হতো সবকিছুর আয়োজন করা হতো ওই বাড়িতে।”

আয়েন্দ্রি চট করেই বলল—

“তোর বাবা, মা কোথায় প্রাণ? সীমান্ত বলেছিল তুই ছোটোবেলা থেকেই একা! মিথ্যে বলেছিলি তাই না?”

নিষ্প্রাণ ফিরে তাকাল আয়েন্দ্রির দিকে। আয়েন্দ্রির উৎসুক দৃষ্টির বিপরীতে নিষ্প্রাণের সরল উত্তর—

“আগুনে পুরে মারা যান তারা।”

আয়েন্দ্রি আবিষ্ট নজরে তাকায়। আগুনের কথা শুনতেই তড়াক করে ওঠে তার মস্তিষ্ক। নজরে আসে নমনীয়তা। ঘটে যাওয়া অব্যর্থ ঘটনার অপ্রকট দৃশ্য সহসা ভাসতে শুরু করল আয়েন্দ্রির চক্ষুদর্পণে। শ্রান্তিহীন এক ভয়াতুর উৎপীড়ন হতে থাকল তার মস্তিষ্কে। সকাতরে প্রশ্ন করে বসে আয়েন্দ্রি।

“মানে? কী বলছিস তুই? কী হয়েছিল তাদের সাথে?”

নিষ্প্রাণ অনুপল চুপ থেকে পূর্ণ নজরে তাকাল। অনুভূতিশূন্য গলায় বলল—

“দাদুর তিন ছেলে ছিল। আমার বাবা বড়ো ছিলেন। আমার আগেই জন্ম নেয় তার দুটো কন্যা সন্তান। মেঝ কাকার কোনো ছেলে মেয়ে ছিল না। ছোটো চাচ্চুকে দাদু এস. এস.সি পাশ করার পর জার্মান পাঠিয়ে দেয়। ছোটো চাচ্চু অনেক মেধাবী ছিলেন। তাই দাদু অনেক আশা নিয়ে তাকে পড়তে পাঠায়। পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই এক প্রবাসী মেয়েকে বিয়ে করেন তিনি। ফিরে আসেন বাংলাদেশ।
আমার বড়ো বোন তখন বিবাহিত ছিল। ছোটো বোনের সেদিন ছিল জন্মদিন। অনেক বড়ো আয়োজন করা হয়েছিল। তবে শুধুই আপনজনদের নিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শর্টসার্কিট হয়। আগুন লেগে যায় সেখানে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের সেদিন জীবন্ত সমাধি হয় ওই আগুনে। তারপর থেকে ওখানে তালা ঝুলিয়ে দেয় দাদু।”

আয়েন্দ্রির চোখ দিয়ে টপটপ করে অবিশ্রান্ত জল ঝরতে লাগল। হাওয়া ধরা অস্বচ্ছ গলায় বলল—

“তুই কোথায় ছিলি? দাদু কোথায় ছিল?”

নিষ্প্রাণ অবারিত গলায় বলল—

“আমাদের গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব মারা গিয়েছিলেন । তার জন্য মসজিদে দোআ মাহফিলের আয়োজন করেছিল। আমি আর দাদু সেখানেই ছিলাম।”

পরমুহূর্তেই নিষ্প্রাণের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আয়েন্দ্রি। হু হু করে কেঁদে বুক ভাসায়। যদি সেদিন নিষ্প্রাণ সেখানে থাকত, তাহলে তাকেও ওই সর্বনাশা আগুন গ্রাস করে নিতো। তাহলে আয়েন্দ্রি কখনো তার প্রাণের দেখা পেতো না। নিষ্প্রাণ দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে। অতীত সে ভুলতে চায়। ওই আগুনের লেলিহান শিখা হয়ে তো নিজের পরিবারের সবাইকে ভষ্ম করেছে নিষ্প্রাণ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। একটা ছয় মাসের ভ্রুণকেও সে ছাড়েনি। কেন ছাড়বে? ওই আজন্ম ভ্রুনের জন্যই তার তারাকে প্রাণ দিতে হয়েছে! খুবলে খেয়েছে ওরা তাকে! নিষ্প্রাণ নিজের চোখে সে রাসলীলা দেখেছে। ছোট্ট নিষ্প্রাণ সেদিন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য অবলোকন করেছিল।

নিষ্প্রাণের শিরদাঁড়া শক্ত হতে থাকে । ফুলতে থাকে বুক। কঠোর হয় চোয়াল। তেজী হয়ে ওঠে বাহু। সরোষে আয়েন্দ্রিকে চেপে ধরে নিজের সাথে। আয়েন্দ্রি ব্যথা অনুভব করে বুকে। গোঙানি দিয়ে ওঠে সে। অস্পষ্ট গলায় বলে উঠে—

“প্রাণ!”

আয়েন্দ্রির আহত গলায় সেকেন্ডে নিজের গহন রাগের মৃত্যু ঘটায় নিষ্প্রাণ। ক্রোড়ে তুলে নেয় আয়েন্দ্রিকে। আয়েন্দ্রি বিপন্ন গলায় বলল—

“এই করছিস কী! ছাড়, পড়ে যাব আমি।”

“পড়বি না।”

নিষ্প্রাণের গলা জড়িয়ে ধরে আয়েন্দ্রি। পাছে পড়ে না যায়! করিডোরের পশ্চিমদিকের শেষ প্রান্তে একটা সরু সিঁড়ি। এই সিঁড়ি সোজা ছাদের গম্বুজে গিয়ে থামে। চওড়া নয় তা। দুইজন মানুষ পাশাপাশি উঠতে সমস্যা হবে। সেক্ষেত্রে কাউকে কোলে নিয়ে ওঠা আরও দুরূহ ব্যাপার। সে কাজটি-ই করল নিষ্প্রাণ। সোজা না হয়ে, আড়াআড়ি ওঠে সিঁড়ি বেয়ে। আয়েন্দ্রি বোকা বোকা চোখে চেয়ে আছে। সিঁড়ির উপরের দিকে উঠতেই আঁধার ছেয়ে যেতে থাকে। আয়েন্দ্রি সেই আবছা আলো আঁধারে নিষ্প্রাণের সপ্রতিভ দুই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। গলা থেকে এক হাত সরিয়ে চুলে গলিয়ে দেয়।

ডিম্বাকৃতির গম্বুজটার ভেতরটা ফাঁকা। অনায়াসে গুটিকয়েক মানুষ দাঁড়াতে পারবে। গম্বুজের চারপাশে দেয়াল থাকলেও তা সম্পূর্ণ নয়। ডোরাকাটার মতো। সরু করে কিয়ৎখানি জায়গায় আচ্ছাদন তো কিয়ৎখানি ফাঁকা। এমনটা করেই পুরো গম্বুজ তৈরি। আয়েন্দ্রিকে কোল থেকে নামায় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি উচ্ছ্বাসিত হয়ে নিচের দিকে চাইতেই তার কলিজা কেঁপে ওঠে। নিষ্প্রাণের বুকে ঠাঁই নেয় সে। নিষ্প্রাণ আদুরে হাসে। মোলায়েম গলায় বলল—

“ভয় পাস না। আমি আছি। তাকিয়ে দেখ।”

আয়েন্দ্রি ভয়, জড়তার রেশ কাটিয়ে দুরুদুরু মনে সমান্তরালে তাকায়। এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সারি সারি নারকেল গাছ, বছর পুরোনো বটগাছ, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, নদীর ধারা। আয়েন্দ্রি অবাক নয়নে তা দেখে। ভয়ংকর সুন্দর!
পশ্চিমাদেশে জেগে উঠেছে দাবানল। লুপ্ত হয়ে গেছে ধূসর মায়া। সেখানে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করেছে রক্তিম বিবস্নান। অগ্নি বলয়ে রঞ্জিত করেছে নিলাভ্রকে। উড়ে গেল একঝাঁক কালো পাখি। ছোটো ছোটো পাখনা মেলে নীড়ে ফেরা টান। সরু, লম্বা, তীক্ষ্ম শিখরের সুপারিগাছগুলো যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। এখন-ই ভেদ করে যেন সবকিছু দলিয়ে নেবে। লাল আভায় খানিক জায়গা করে নিয়েছে তপ্ত সফেদ মেঘ। চলছে একে অন্যের সাথে বোঝাপড়া। সমীরণে চলছে দোলাচল। তার তেজ বাড়তেই নড়ে ওঠে নারকেল গাছের সরু ফলার মতো পত্র। বটগাছে শুরু হলো ঝংকার। ভেতরে ভেতরে পরস্পরে চলছে গভীর আলিঙ্গন। বাইরের কারো সেখানে অধিকার নেই।

মোহনীয় সেই অস্তাভা বিবস্নানের সান্ধ্যাকালীণ ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের তীব্র কুহেলিকা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আয়েন্দ্রিকে। শীতল, অদৃশ্য, সূঁচালো সমীর তার দেহপিঞ্জরে নীরবে গেঁথে যাচ্ছে। আয়েন্দ্রি ঘোরগ্রস্ত। তার ঘোর কাটে নিষ্প্রাণের লাজহীন স্পর্শে। আয়েন্দ্রির খোলা চুল সরিয়ে উষ্ণ, তৃষ্ণার্ত চুমু খেলো তার কাঁধে। মিহি গলায় বলল—

“সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। চল।”

আয়েন্দ্রি পূর্ণ প্রকটিত আঁখুটে গলায় বলল—

“আরেকটু থাকি, প্লিজ!”

” আচ্ছা।”

গম্বুজের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে নিষ্প্রাণ। তার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে আয়েন্দ্রি। আয়েন্দ্রির সচেতন, নির্নিমিখ দৃষ্টি সূদুরের সেই বিবস্নানের অগ্নি বলয়ে। খানিক পরেই সে প্রলীণ হয়ে যাবে নিকষ আঁধারে। নভোলোক ফুড়ে বেরিয়ে আসবে শশাঙ্ক।

আয়েন্দ্রির আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। অতি যত্নের সাথে অধরের কাছে এনে সিক্ত চুমু খায় হাতের তালুতে। আয়েন্দ্রি মোহিত হয়। সম্মোহনীত তার মস্তিষ্ক। নিষ্প্রাণের হাত এনে ছুঁইয়ে ধরে তার অনাবৃত উদরে। বেপরোয়া, অবিশ্রান্ত লাজহীন স্পর্শে জমাট বেঁধে যায় আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ তার মুখটা আয়েন্দ্রির কানের কাছে নিয়ে বলল—

“ঝড়া শিউলীর অঙ্গ তোমার,পদ্মকোমল ঠোঁট,
শুভ্র মেঘের ভাঁজে ভাঁজে রচিত প্রেমের জোট,
অগাধ মুগ্ধতা সৌরভে তোমার,মুক্তো ঝরা হাসি,
পলে পলে যেথায় হারাই প্রিয়,তোমায় ভালোবাসি।”

আয়েন্দ্রি মুগ্ধ হয়ে শোনে তা। সলজ্জ চোখে জল উথলে আসে। পেছন ফিরে নিজের পূর্ণ ভর ঢেলে দেয় নিষ্প্রাণের বুকের পাটাতনে। নিরবধি, অক্লান্ত প্রেমে মশগুল আত্মহারা দুই আঁখিপল্লব অশিথিল করে চেয়ে থাকে নিষ্প্রাণের মুখের দিকে।

আঁধার নেমেছে বসুন্ধরায়। ছেয়েছে নীলাভ্র অসিতে। প্রভঞ্জনে উঠেছে ঝড়। খট করেই গম্বুজের সিলিং এর চৌখালো জায়গায় নির্লিপ্ত হলদে বাল্বটা জ্বলে ওঠে। সেই হরিদ্রাভ আলোতে আয়েন্দ্রি তার প্রেমময় পুরুষকে দেখে। নিষ্প্রাণ আকন্ঠ ডুবে ভাবতে থাকে, এই মেয়েটাকে সে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে! অনুভূতিশূন্য তার প্রাণহীন জীবনে প্রাণসঞ্জিবনী হয়ে এসেছে এই মেয়ে! তার প্রাণস্পন্দন হয়ে এসেছে। আলতো হাতে আয়েন্দ্রিকে জড়িয়ে ধরে নিষ্প্রাণ। স্বগতোক্তি করে বলল—

“আমাক ছেড়ে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাবিস না ধ্রুবতারা। তোর প্রাণ তার অন্তিম স্পন্দন তোর মাঝেই সমাহিত করবে।”
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাজন শিকদারে কক্ষের বিশাল ছবিটার দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আয়েন্দ্রি। প্রতিটি মানুষের প্রতিচ্ছবিকে সে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যেন সবাই তার চক্ষুদর্পনেই দাঁড়িয়ে আছে। রাজন শিকদার হুইল চেয়ারে বসে আছেন। খুটখুট করছে হাসমুলের মুখ। আয়েন্দ্রির এই ঘরে আসাটা তার মোটেও পছন্দ না। রাজন শিকদারকে যে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয় তার হেতু কোনো একসময় তিনি নিজের বাক শক্তি হারাবেন। নিষ্প্রাণ চায় না তার অতীত কখনো সবার সামনে আসুক। রাজন শিকদার প্রায়ই উত্তেজনাবশত হাত, পা ছোড়াছুড়ি শুরু করেন। যদিও তা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তার অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিতে আতঙ্কিত হাসমুল সেই ইঞ্জেকশন পুশ করা মাত্রই তিনি শান্ত হয়ে যান। নিষ্প্রাণ বলেছে তার খিঁচুনির জন্য দেওয়া হয় এই মেডিসিন যা সম্পূর্ণ মিথ্যে।

ছবিতে সবাইকে দেখা গেলেও নিষ্প্রাণকে ছবিটার কোথাও নজরে এলো না আয়েন্দ্রির। উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে হাসমুলকে—

“এই ছবিতে প্রাণ নেই কেন?”

হাসমুল নাকের ডগায় বিরক্তি ঝুলিয়ে হেয়ালি গলায় বলল—

“ছোডো সাহেব তহন আছিলে না। ”

আয়েন্দ্রি চুপ করে যায়। সে বুঝতে সক্ষম হয় হয়তো ছবিটা নিষ্প্রাণের জন্মের অনেক আগেই তোলা হয়েছে। নিষ্প্রাণের মাকে বেশ লাগল আয়েন্দ্রির। কী সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে! গা ভর্তি গহনা! মনে হতেই পারে বেশ উচ্চ বংশীয়।
,
,
,
আলমিরা থেকে সিঁদুর লাল রঙের একটা সিল্কের শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আয়েন্দ্রি। শাড়ির পাড়ের সাথে ম্যাচ করে সোনালী রঙের ব্লাউজ খুঁজতে খুঁজতে হাপিয়ে উঠেছে সে। অবশেষে পেয়েও গেল তা।

আজ সাজলো আয়েন্দ্রি। গাঢ় লাল রঙা শাড়িতে। গা ভর্তি গহনা জড়িয়েছে। সিঁথি কেটে ঘাড়ের সাথে লাগোয়া খোঁপায় গুঁজেছে কৃত্রিম গাজরা। ঠোঁট রাঙিয়েছে লাল রঙে। কোমরে কোমরবন্ধ। কুচিহীন শাড়ির আঁচলে ভাঁজ তুলেছে পাঁচের অধিক। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখছিল আয়েন্দ্রি।

নিষ্প্রাণ কোনো একটা কাজে নজরুলদের বাড়ি গেছে। সেখান থেকে মাত্রই ফিরেছে সে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত,বিপণ্ণ শরীর নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। তার উপস্থিতি টের পেতেই আয়নার কাছ থেকে সরে আসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের শ্রান্ত দেহটার কাছে এসেই ঝরা হাসে। সাথে হেসে ওঠে আয়েন্দ্রির চোখ। ঝুমঝুমিয়ে বলল—

“দেখ, কেমন লাগছে আমাকে?”

নিষ্প্রাণ ভয়াল নিঃশ্বাস ফেলল। চোখ, মুখ বিকৃত করে তাকাতেই আঁতকে ওঠে আয়েন্দ্রি। ভয়চকিত গলায় বলল—

“কী হয়েছে?”

নিষ্প্রাণের শ্বাসে যেন ধরা কাঁপিয়ে দেবে। রণমূর্তি ধারণ করে এক ভয়াল চড় বসিয়ে দেয় আয়েন্দ্রির গালে। ছিটকে পড়ে আয়েন্দ্রি সমান্তরাল মেঝেতে। ভয়, ব্যথা নিয়ে চোখের পল্লব উঁচুনিচু করে নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই যেন পৃথিবী ঘুরে গেল আয়েন্দ্রির। নিষ্প্রাণ স্রোতের বেগে এসে আয়েন্দ্রির খোঁপাটা মুঠোবন্দি করে রোষিত গলায় বলল—

“তোকে এভাবে সাজতে কে বলেছে? কেন সেজেছিস তুই? এই, এই ! কেন সেজেছিস এভাবে?”

ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছে আয়েন্দ্রির। টলটল করে তার চোখের কলসি উপচে পড়ল নোনা জল। চুলের ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। নিষ্প্রাণ ক্ষুব্ধ হয়ে আরও এক টান লাগাল আয়েন্দ্রির খোঁপায়। ডুকরে উঠল আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের রাগ বাড়ল দ্বিগুন হারে। সজোরে বসাল আরেক চড়। আয়েন্দ্রি হতভম্ব হয়ে গেল। তার শরীরের সব শক্তি নিষ্প্রাণের চোখের আগুনে গলে গেল। নিষ্প্রাণ চেঁচিয়ে উঠে—

“কেন সেজেছিস এভাবে? কেন মহিলার মতো সেজেছিস? ওই, কী সমস্যা তোর? খোল, খোল এসব। আর কোনোদিন যদি এভাবে সাজতে দেখেছি জানে মেরে ফেলব তোকে আমি।”

আয়েন্দ্রিকে সোজা করিয়ে দাড় করায় নিষ্প্রাণ। বেপরোয়া হাতে তার গায়ের সমস্ত গহনা, শাড়ি খুলে ফেলল। রাগে বিহ্বল নিষ্প্রাণের নখ গেঁথে যায় আয়েন্দ্রির নরম শরীরে। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই তার। দমিয়ে রাখা রাগের বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে আয়েন্দ্রির চোয়াল চেপে ধরে নিষ্প্রাণ।

“আর কোনোদিন যদি ওই মহিলার মত সেজে আমার সামনে আসিছ, সত্যি তোকে মেরে ফেলব আমি। মনে রাখিস।”

গজগজ করে কক্ষ থেকে বের হয় নিষ্প্রাণ। নিচে বসে পড়ে আয়েন্দ্রি। গলা, উদর, বাহুর বিভিন্ন জায়গা লাল আঁচড় ফুলে উঠেছে। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লহু।

নিষ্প্রাণের পদার্পণ ঘটে রাজন শিকদারের কক্ষে। দেয়ালে থাকা ছবিটার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি তার। নিষ্প্রাণের রাগান্বিত আনন দেখে ভড়কে যায় হাসমুল। ফাঁকা ঢোক গিলে অধর ছড়াতেই নিষ্প্রাণ ফুঁসলে উঠে বলল—

“কোথায় ছিলি তুই?”

“আআমিইই…।”

নিষ্প্রাণ দেওয়ালে টাঙানো ছবিটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। ক্রোশে বশীভূত নিষ্প্রাণ পায়ের নিচে দলিয়ে ফেলে ফ্রেমটাকে। কিচকিচ করে তার কাঁচ ভেঙে বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। রাজন শিকদারের কাছে গিয়ে ঝুঁকে গিয়ে দমদমে গলায় বলল—

“ভালো হচ্ছে না দাদু। একদম ভালো হচ্ছে না।”

রাজন শিকদার কম্পিত চোখে চাইলেন। চেয়েই রইলেন।
,
,
,
সেভাবেই মেঝেতে বসে আছে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ কঠিন শান্ত। কক্ষে এসে আয়েন্দ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসায়। ওয়েন্টমেন্ট নিয়ে আয়েন্দ্রির পাশে বসে। নিখুঁত হাতে আয়েন্দ্রির ক্ষতস্থানগুলোতে সাদা আঠালো জিনিষটির প্রলেপ দিতে থাকে। আয়েন্দ্রি কেঁপে ওঠে। ক্ষত জায়গাগুলো চিনচিন করে উঠছে। আয়েন্দ্রির সিক্ত পল্লব বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আর্দ্র গলায় বলল—

“এমন কেন করলি তুই?”

নিষ্প্রাণ ঠোঁটের কোণে মলম লাগাতেই কঁকিয়ে ওঠে আয়েন্দ্রি।

“তোকে এভাবে সাজতে কে বলেছে?”

“উনি তোর মা নিষ্প্রাণ।”

টুপ করে আয়েন্দ্রির ক্ষত জায়গায় চুমু বসায় নিষ্প্রাণ। নিরুদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে বলল—

“সে আমার মা নয়।”

আয়ন্দ্রি বিস্মিত হয়। কৌতূহলী গলায় বলল—

“কী বলছিস তুই?”

“হুম। আমি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। আমার মা সুইসাইড করেছে। ওই যে, করিডোর দেখছিস? এখান থেকে লাফ দিয়ে। আমিও ওখানেই ছিলাম। ওই দেয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে আমার মাকে এখান লাফ দিতে দেখেছি।”

আয়েন্দ্রি নির্বাক চোখে চেয়ে থাকে। কী বলছে এই ছেলে! নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কাছ মুখ নিয়ে বলল—

“আমি তোকে এই বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছি। আমার অতীত ঘাটতে না করেছি। তুই আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ। এর মাঝে অতীতের কালো ছায়াকে ডাকিস না ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রির নিজেকে অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছে। কিছু ভাবার মতো জোর সে তার মস্তিককে দিতে পারছে না। কর্ণরন্ধ্রে ঝড় তোলা নিষ্প্রাণের প্রতিটি শব্ধ অবাস্তব সত্য মনে হলো তার। নিস্পৃহ, নিষ্প্রভ, নিরীহ চাহনি।

নিষ্প্রাণ আলগোছে তার মাথাটা রাখে আয়েন্দ্রির কোলে। লম্বালম্বি শুয়ে নাজুক চোখে চেয়ে বলল—

” কোনো এক রূপকথার জগতে..
তুমি তো এসেছ আমারই হতে…

আয়েন্দ্রির ভেজা আঁখিপুট দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। তা পড়ছে নিষ্প্রাণের শুষ্ক, খসখসে, প্রাণহীন ঠোঁটে। ঝাপসা চোখে আয়েন্দ্রি কক্ষের বাইরে তাকায়। তার মনে হলো কেউ একজন তাকে দেখে হাসছে। খুব হাসছে। পাগলের মতো হাসছে। মুক্ত বিহঙ্গের মতো হাসছে। ফুটে ওটা সদ্য গোলাপের মতো তার হাসি। যেন এ যাবতকালের জন্য বদ্ধ কুঠরি থেকে সে ছাড়া পেয়েছে!

একটু দূরেই একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সে চেয়ে আছে অনিমেষ। সেই কেউজন আচমকা করিডোরের হাফ দেয়ালের উপর উঠে বসে। পরে..খানিক পরেই একটা ঝপাং আওয়াজ। সেই কেউ একজনকে আর দেখল না আয়েন্দ্রি। বাচ্চা ছেলেটি দৌড়ে দেয়ালের কাছে গেল। নতজানু হয়ে চেয়ে রইল।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here