প্রাণস্পন্দন পর্ব ৪৪+৪৫

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৪
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ঘাম ছেড়েছে আয়েন্দ্রির তাপিত দেহের। দুই দিনের জ্বরে কাহিল আয়েন্দ্রি। বেহুশের মতো বিছানায় পড়েছিল সে। হেকমতের মৃত্যুটা আবার নতুন করে অশান্ত করে তুলে ছিল আয়েন্দ্রিকে। রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে ছিল তার। রোমানের মৃত্যুর কথা বারবার মনে পড় ছিল। জ্বরের ঘোরে শুধু কেঁদেছে আয়েন্দ্রি।

তার পাতলা শাড়িটা উদরের সাথে লেপ্ট আছে। ঘর্মাক্ত গলার আশেপাশে নহর বইছে। এলোথেলো চুলগুলো অবাধ্য হয়ে চোখে, মুখে লেগে। ওঠে বসে আয়েন্দ্রি। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়েতে প্রতীত হয় পিঠের নিচটাও আর্দ্র। শ্রান্ত চোখে এদিক ওদিক তাকায় আয়েন্দ্রি। ভেজা চুপচুপে শরীরে অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। কিন্তু আয়েন্দ্রির মস্তিষ্কের দুর্বল স্নায়ুতে তরতরিয়ে এক চিন্তার উদয় হলো। নিষ্প্রাণকে ঘরের কোথাও দেখছে না সে। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে থাকে আয়েন্দ্রি। ইতিবিতি করতে থাকে মন। হাত, পা অবলীলায় কেঁপে যাচ্ছে। শূন্য মস্তিষ্কে ওঠে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। বুক ঢিবঢিব করছে তার। গলা শুকিয়ে খরা দেখা দিয়েছে। ভয়ে, আতঙ্কে, সংকোচে বিভ্রান্ত আয়েন্দ্রি। কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে ব্যগ্রতার সাথে। তার শাড়ির আঁচল মুছিয়ে যাচ্ছে করিডোরের ধূলো। আয়েন্দ্রি উদ্ভ্রান্তের মতো চলছে। তার চোখ ভরা জলপুকুর। নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে। তালাব তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত। আয়েন্দ্রিকে এলোথেলো পায়ে নেমে আসতে দেখে কপাল কুঞ্চন করেন তিনি। ভাবুক চোখে চেয়ে ঠাওর করতে চাইছেন কী হচ্ছে!

বিশাল কাঠের দরজা দিয়ে অনুদ্বেগচিত্তে বাড়ির ভেতরে প্রবিষ্ট হয় নিষ্প্রাণ। তাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আয়েন্দ্রি। হতভম্ব হয়ে যায় নিষ্প্রাণ। তার নিমগ্নচিত্তে ছিল অন্য ভাবনা। আয়েন্দ্রির অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ায় চমকে যায় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ধরা গলায় বলল—

“কোথায় গিয়েছিলি তুই? আমাকে একা রেখে কোথায় গিয়েছিলি?”

নিষ্প্রাণ আলতো গলায় বলে উঠে—

“এটা আমাদের বেডরুম নয় ধ্রুবতারা।”

আলগোছে আয়েন্দ্রিকে নিজের কাছ থেকে সরায় নিষ্প্রাণ। স্থির চোখে চেয়ে বলল—

“কখন উঠেছিস?”

আয়েন্দ্রি বিমর্ষ গলায় বলল—

“এখন।”

নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কপাল, গালে আর গলায় হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করে বলল—

“জ্বর নেই এখন। মাই গড! পাগল বানিয়ে ফেলেছিলি এই দুই দিনে আমাকে!”

আয়েন্দ্রি নিরানন্দ চোখে চেয়ে বলল—

“কোথায় ছিলি তুই?”

নিষ্প্রাণ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল। বলল—

“নজরুলকে ওর বাড়িতে দিয়ে এসেছি। চাচির অবস্থা ভালো না। আপাতত ওখানেই থাকবে ও।”

নিষ্প্রাণকে দেখে তালাব রান্নাঘরে ঢুকেছিল। আর বের হয়নি সে।

বিগলিত হাসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির ক’গাছি চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল—

“গোসল করে নে। দুই দিন গোসল করিসনি তুই। যা। নিচে আসতে হবে না। আমি খাবার নিয়ে ঘরে আসছি।”

আয়েন্দ্রি দ্বিরূক্তি করল না। নিজের কাছেই কেমন অস্বস্তি লাগছে তার!
,
,
,
ডাইনিং টেবিলে রাখা খাবার থেকে একটা প্লেটে খাবার বেড়ে নিচ্ছে নিষ্প্রাণ। তালাব পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার জন্য উসখুশ করছে তার জিহ্বা। নিষ্প্রাণ হেয়ালি চোখে চেয়ে আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করে। তালাব জড়তা ঝেড়ে সাহস সঞ্জারণ করে মিইয়ে গলায় বলল—

“একখান কথা কই ছোডো সাহেব?”

বলিষ্ঠ গলায় প্রত্যুক্তি করে নিষ্প্রাণ।

“বলুন।”

“জে…কইতাছিলাম বড়ো সাহেবরে ডাক্তার দেখাইলে ভালা হইতো। তার শরীরডা দিনদিন খারাপ হইয়া যাইতাছে। হেকমত ভাইয়ের মরার কথা শুইনা আরো ভয় পাইয়া গেছে।”

চোয়াল শক্ত হয়ে আসে নিষ্প্রাণের। আকুঞ্চিত কপাল। চোখের পাল্লা বিস্তৃত করে তালাবের দিকে চাইতেই তিনি ফাঁকা ঢোক গিললেন। নিষ্প্রাণ পরমুহূর্তেই চেহারায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনে বলল—

“তা নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। বয়স হয়েছে তার। আর কত!”

নিষ্প্রাণ সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পলকহীন চেয়ে আছে তালাব। এক মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল আজ বুঝি নিষ্প্রাণ তার শেষ নিঃশ্বাসটাও কেড়ে নেবে। অজ্ঞাত কারণেই নিষ্প্রাণকে তার ভয় হয়।
,
,
,
আয়েন্দ্রিকে খাইয়ে দিচ্ছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের চোখের দিকে চেয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা ফিনফিনে বায়ুতে নিমগ্ন হচ্ছে কক্ষ। মাথার ওপর ঘুরছে ফ্যান। আয়েন্দ্রির খাওয়ার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই। নিষ্প্রাণ নির্লিপ্ত। আয়েন্দ্রি চোখের কোণ ক্ষীণ করে প্রশ্ন করে —

“তারা কে?”

নিষ্প্রাণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাসে। অধরের কোণ প্রসারিত করে আয়েন্দ্রির মুখে ভাতের লোকমা দিয়ে বলল—

“হেকমত চাচার বোনের মেয়ে ছিল।”

“কোথায় সে?”

নিষ্প্রাণ সাবলীল গলায় বলল—

“নেই।”

নিজের মুখের দিকে নিষ্প্রাণের বাড়ন্ত হাতটা থামিয়ে দেয় আয়েন্দ্রি। চোখ ভর্তি উৎকন্ঠা আর কৌতূহল নিয়ে বলল—

“নেই কেন? কোথায় গেছে সে?”

আয়েন্দ্রির মুখের সামনে থেকে প্লেট নামিয়ে নিজের পায়ের উপর রাখে নিষ্প্রাণ। হাতে থাকা খাবারটুকু নিজের মুখে পুরে চিবিয়ে গিলে নেয়। আয়েন্দ্রির অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বলল—

“তারা নয়। নয়নতারা। নয়নতারার বাবা মারা যায় ও যখন খুব ছোটো। ওর মাকে আবার বিয়ে দেওয়া হয়। নয়নতারার নতুন বাবা ওকে মেনে নেয়নি। তাই চাচা ওকে নিজের সাথে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। তখন চাচা বিবাহিত ছিল না। নয়নতারা এই বাড়িতেই বড়ো হতে লাগল। একদিন ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যায় নয়নতারা।”

অবনত শিয়রে কথাগুলো বলছিল নিষ্প্রাণ। শিয়র উঁচু করে আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় অঝোরে কাঁদছে সে। নিষ্প্রাণ ঝরা গলায় বলল—

“নয়নতারা ঝরে যায় সেদিন। আর কখনো ও ফোটেনি। চাচা আজও নয়নতারাকে ভুলতে পারেনি। ”

আয়েন্দ্রি গলা ধাক্কিয়ে কান্না সুরে করে। যেন মনে হচ্ছে তার আপন কেউ মারা গেছে!
নিষ্প্রাণ শান্ত স্বরে বলল—

“তুই কাঁদছিস কেন? তুই তো আমার ধ্রুবতারা। তোর আলো কখনো আমি ম্লান হতে দেবো না।”

তবুও বাঁধ ভাঙা স্রোত বইছে আয়েন্দ্রির চোখ হতে। নিষ্প্রাণ গূঢ় হাসে। এত বছর আগের মৃত ব্যক্তির জন্য এই মেয়ে এভাবে কাঁদছে! যদি সত্যিই সেদিন ওই ভয়ংকর লীলা দেখত, তাহলে কী হতো এই মেয়েটার! নিষ্প্রাণ তার মুখটা আয়েন্দ্রির কানের কাছে নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল—

“আমাকে না বলে কিন্তু একদম বাড়ির বাইরে যাবি না। তারা কিন্তু এখনো এই বাড়িতে ঘোরাফেরা করে।”

ধুম করেই শ্বাসের সাথে কান্না গিলে নেয় আয়েন্দ্রি। চোখ পিটপিট করে বলল—

“তুই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন?”

“তুই কী ভয় পাস? নাতো। ভয় পেলে কী আর আমার বউ হতে পারতি! ”

আয়েন্দ্রি হতবাক চোখে তাকায়। নিষ্প্রাণ মুচকি হাসে। ক্ষীণ গলায় বলল—

“আমি কিন্তু সত্যি বলছি। বাকিটা তোর ইচ্ছে। তারা কিন্তু সত্যিই আছে!”

আয়েন্দ্রির ঠোঁটের দিকে গাঢ় নজরে তাকায় নিষ্প্রাণ। মনে মনে ভাবে, যখন থেকে আয়েন্দ্রিকে কাছে টেনে নিয়েছে তারা আর আসে না। মেয়েটা বোধহয় রাগ করেছে! করবেই তো। সবকিছুকে মাটি চাপা দিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিল নিষ্প্রাণ। তার জেদ, ক্ষোভ, হিংস্রতা ম্লান হতে শুরু করেছিল। কিন্তু যখন থেকে আয়েন্দ্রিকে দেখেছে তখন থেকে আবারও সেই দিনগুলো ভাসতে লাগল নিষ্প্রাণের চোখে। তারাকে অনুভব করতে শুরু করল নিষ্প্রাণ। কিন্তু আয়েন্দ্রিকে বিয়ের পর মেয়েটা আর আসেনি। কেন?

আয়ন্দ্রির ভয় হতে লাগল। ভূতে বিশ্বাস নেই তার। কিন্তু এই বাড়িটা অদ্ভুতুড়ে। তার উপর প্রথম দিন-ই সে কারো মৃত্যু দেখেছে। আয়েন্দ্রির ছোট্ট মস্তিষ্কে কুটকুট শুরু করে ভয়ের কুহেলিকা। তার চোখে, মুখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেই ভয়ের ভাঁজ। ফিচেল হাসে নিষ্প্রাণ। চোখে খেলে যায় শয়তানি । আয়েন্দ্রির গলার কাছে মুখ নিয়ে বলল—

“ও কিন্তু রাতে এই বাড়িতে হাঁটচলা করে। তালাব চাচার ঘাড়ে একটা দাগ দেখেছিস? ওটা কিন্তু তারা-ই করেছে। ”

ভয়ে হিম হয়ে আসে আয়েন্দ্রির শরীর। তার গলার তুলতুলে জায়গায়টায় গাঢ় কামড় বসায় নিষ্প্রাণ। চকিতে নিষ্প্রাণের এহেন কাজে চিৎকার করে ওঠে আয়েন্দ্রি।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রত্যুষের মিহি হলদে রোদে ঝলমলিয়ে আছে ধরিত্রী। শান্ত বহ্নিসখে উত্তাল পত্রীদের কিচিরমিচির। ধরিত্রী মাতাকে অসিত আচ্ছাদন থেকে মুক্তি দিয়েছে বিবস্নান। তরল আভায় সিক্ত করেছে কচি পত্রপল্লবকে। শিখর উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারিগাছটায় বসে আছে দুটো কাক। কা কা কর্কশ ধ্বনিতে কাঁপিয়ে তুলছে প্রভাতের নৈঃশব্দ।

রাজন শিকদার তার চিরায়ত কাজে ব্যস্ত। নির্লিপ্ত, নির্বাকভাবে বসে আছেন। বাম পায়ের নিচের অংশ কনকন করছে। ব্যথায় কাতর হলেও তা প্রকাশ করার অবকাশ নেই। গুমড়ে যাচ্ছেন নিজের অন্ত:করণে। আয়েন্দ্রির ত্রস্ত দৃষ্টি। কোমল গলায় শুধায়—

“বেশি ব্যথা হচ্ছে দাদু?”

রাজন শিকদার কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। থমথমে মুখে বসে রইলেন। তার চোখের কাতরতা মিলিয়ে গেল। হাসমুল দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনেই। আতঙ্কিত সে। দুরুদুরু বুকে বলল—

“আফনে ঘরে যান নয়া বউ। বরো সাহেবরে আমি দেখতাছি।”

আয়েন্দ্রি মৃদু রাগ দেখিয়ে বলল—

“কেন? আমি থাকলে কী সমস্যা?”

আমতা আমতা শুরু করে হাসমুল। মিনমিনে গলায় বলল—

“জে…না…মানে…।”

বিরক্ত হয় আয়েন্দ্রি। ছেলেটাকে অদ্ভুত লাগে তার। সারাক্ষণ চুপকে থাকে রাজন শিকদারের সাথে। তার খাওয়া, গোসল, ঔষধ সব কিছুতেই হাসমুলের একচ্ছত্র অধিকার। আয়েন্দ্রি ভ্রু-বিলাস করে কড়া গলায় বলল—

“আপনি যান, কুসুম গরম করে সরিষার তেল নিয়ে আসুন। আমি দাদুর পায়ে মালিশ করে দেবো।”

হাসমুল ভয়াতুর চোখে চেয়ে অবিশ্বাস্য গলায় বলল—

“কী কইতাছেন নয়া বউ! আফনের করন লাগতো না। আমি মালিশ কইরা দিমু নে। আফনে যান।”

আয়েন্দ্রি ওঠে দাড়ায়। চক্ষু গরম করে বলল—

“আপনাকে আমি যা বলেছি তাই করুন। যান। তেল নিয়ে আসুন।”

থতমত খেয়ে যায় হাসমুল। আয়েন্দ্রির চোখের আগুন বিদীর্ণ করে তার বুক। ভয়ে থরথরিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশ্য ছুটে। আয়েন্দ্রি শান্ত ভঙ্গিতে রাজন শিকদারের পায়ের কাছে বসে। রাজন শিকদারের হাত কাঁপছে। হাতটা ওঠানোর আপ্রান চেষ্টা অব্যাহত। আয়েন্দ্রি মিষ্টি করে হাসল। সন্তর্পনে রাজন শিকদারের হাতের নিচে নিজের শিয়র অবনত করল। রাজন শিকদার নিজের ঠোঁট চেপে ধরলেন। কান্না পাচ্ছে তার। ধীরে ধীরে তার হাতও নড়াচড়ার শক্তি হারাচ্ছে। হয়তো একদিন সবকিছুই বিলীন হয়ে যাবে। আয়েন্দ্রি উজ্জ্বল চোখে তাকায়। শরতের কাশফুলের অনুরূপ দুই চোখের শুভ্রতায় আপ্লুত হয় রাজন শিকদার। মেয়েটাকে প্রাণ ভরে দোআ করতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু তার শরীর সঙ্গ দিলো না।

আয়েন্দ্রি আলতো হাতে রাজন শিকদারের পায়ে মালিশ করতে থাকে। অবিরত গলায় বলল—

“দাদু, একটা কথা বলব?”

রাজন শিকদার স্পষ্ট আওয়াজ করতে না পারলেও মুখের গোঙানিতে অনেক কিছুই সামনের ব্যক্তিকে বোঝাতে সক্ষম হন। আয়েন্দ্রি নতজানু মুখটা উঁচু করে রাজন শিকদারের চোখের দিকে তাকাল। তিনি তার পাঁপড়ি ঝাকালেন। প্রশ্রয় পেয়ে প্রশ্ন করল আয়েন্দ্রি।

“প্রাণকে আপনি কেন বাড়ন করেছিলেন যেন সে কাউকে তার সত্যিকারের পরিচয় না বলে?”

হাসফাস শুরু হয় রাজন শিকদারের। গলায় শুষ্কতা অনুভব করেন তিনি। বিপদের আভাস ছুটে আসছে তীরের বেগে। ব্যবচ্ছেদ ঘটাবে সব সত্যের। রাজন শিকদার অদ্ভুত আচরণ শুরু করেন। খিঁচুনি দিয়ে ওঠে তার শরীর। ভয়ংকর, ভয়াল শ্বাস ফেলতে শুরু করেন, যেন কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। হাসমুল কক্ষে প্রবেশ করেই রাজন শিকদারের এমন অবস্থা দেখে ব্যগ্র হয়ে ছুটে আসে। তার বুকের মাঝে হাত ঘষতে ঘষতে বলল—

“আফনে যান নয়া বউ। যান তারাতারি। তাঁরে আমি দেখতাছি।”

আয়েন্দ্রি ছলছল চোখে ত্রাসিত গলায় বলল—

“কী হয়েছে দাদুর? এমন করছেন কেন?”

“তাঁর খিচুনি ওঠছে। আপনি যান। ভয় পাইয়েন না। জলদি যান।”

আয়ন্দ্রির যেতে ইচ্ছে হলো না। বুড়ো লোকটার জন্য মায়া হলো তার। কেমন তরপাচ্ছে! রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে আয়েন্দ্রি। করিডোরে ব্যাকুল হয়ে ছুটছে সে। আচমকা তার নাক গিয়ে ঠেকে কোনো শক্ত পাটাতনে। আয়েন্দ্রি সপ্রতিভ হয়। সচকিত চোখে তাকাতেই দেখে নিষ্প্রাণের বক্ষস্থলে ঠাই হয়েছে তার। নিষ্প্রাণ প্রাণবন্ত হাসে। আয়েন্দ্রির কপালে অধর বিলাস করে বলল—

“কী হয়েছে? এভাবে ছুটছিস কেন?”

আয়েন্দ্রি উদ্বেলিত গলায় বলল—

“প্রাণ! দাদু কেমন করছে!”

চোখ পিটপিট করে নিষ্প্রাণ। গাঢ় স্বরে বলল—

“আমাকে ছেড়ে ওই বুড়োকে পছন্দ হয়েছে তোর?”

আয়েন্দ্রির টলটলে চোখের কাতর চাহনি শিথিল হয়। সিক্ত আঁখিপাল্লা নড়ে ওঠে। নিষ্প্রাণ আশ্বাসের সুরে বলল—

“ঘরে যা। আমি দেখছি। এন্ড ডোন্ট ওয়ারি।”

“হুম।”
,
,
,
রাজন শিকদারকে বিছানায় শুইয়ে দেয় হাসমুল। ব্যস্ত হয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে হাতে নিতেই নিষ্প্রাণের ভরাট কন্ঠে থমকে যায় সে।

“হাসমুল!”

হাসমুল ফিরে তাকায়। নিষ্প্রাণ এগিয়ে এসে তার হাত থেকে শিশিটা নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল—

“তুমি বাইরে যাও। ”

“জে।”

রাজন শিকদার দম বন্ধ করে চেয়ে আছেন। নিষ্প্রাণ একটা সিরিঞ্জে শিশি থেকে তরল নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাসে। রাজন শিকদার বিচলিত চোখে চাইলেন।
তার দুই পাশে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। ঝুঁকে যায় তার মুখের ওপর। ক্লান্তিহীন গলায় বলল—

“কেন করছেন এসব? ওই মেয়েটাকে কেন জড়াতে চান এসবে? জড়াবেন না ওকে এসবের মধ্যে।”

রাজন শিকদারের নিশ্চল দেহটার দিকে পূর্ণ নজর বিছিয়ে পূনরায় বলল সে—

“এই মেয়েটাকে-ই বিয়ে করতে নিষেধ করেছিলেন আপনি। দেখুন, আজ সে কত চিন্তিত আপনার জন্য। আমি কিন্তু আপনাকে আঘাত করতে চাইনি। তবে ধ্রুবতারাকেও হারাতে চাইনি। তবে আপনার কপাল বলতে হয়! এই বয়সেও সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে দিব্যি বেঁচে আছেন! আমি কেন আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছি জানেন?”

বাঁকা হাসে নিষ্প্রাণ। ভয়ংকর পৈচাশিক হাসি। রাজন শিকদারের কানের কাছে মুখটা নিয়ে চাপা স্বরে বলল—

“মরার আগে আমার সন্তানকে অন্তত দেখে যাবেন। আমার ধ্রুবতারা আমার সন্তানের মা হবে। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, ওই আগুনে আপনার অনাগত নাতিকেও আমি জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য দোষটা ওর-ই ছিল। ওর জন্যই আমার তারাকে মরতে হয়েছে।”

রাজন শিকদার ক্লান্ত চোখে চেয়ে রইলেন। নিষ্প্রাণকে মনুষ্যত্বহীন এক দানব মনে হলো তার কাছে। নিষ্প্রাণ সিরিঞ্জটা পুশ করে দেয় রাজন শিকদারের হাতে। সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে তেজহীন গলায় বলল—

“ধ্রুবতারাকে এসবে জড়াবেন না। আর মাত্র তিনটা ডোজ। তারপর আপনার এই আওয়াজ চিরতরে শান্ত হয়ে যাবে। সে কয়েকদিন নিজেকে কন্ট্রোল করুন। অযথা ঝামেলা করবেন না। অযাচিত ঝামেলায় নিজের আর ধ্রুবতারা দুজনের প্রাণ সংকটে নিয়ে আসবেন আপনি।”

রাজন শিকদার নিমগ্নচিত্ত চেয়ে রইলেন। নিষ্প্রাণ গম্ভীর গলায় বলল—

“মেয়েটাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। দয়া করে আমার হাতে আর খুন করাবেন না। প্লিজ দাদু! ইউ লাভ মি, তাই না?
#প্রাণস্পন্দন
#বোনাস_পর্ব
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ঘরময় পায়চারী করছে আয়েন্দ্রি। মোবাইলটা সমানতালে গুঁতিয়ে যাচ্ছে। যতবার আলফাজ সাহেবকে কল করছে বারংবার কেটে যাচ্ছে। রাগ হচ্ছে প্রচন্ড। এখানে নেটওয়ার্ক কেন পাওয়া যায় না?

আয়েন্দ্রিকে কথার বলার জন্য নিষ্প্রাণের মোবাইল ব্যবহার করতে হয়। ভীষণ বিরক্ত সে। আজও নিজের নাম্বার দিয়ে অনেকবার ট্রাই করেও কল কানেক্ট করতে পারল না আলফাজ সাহেবের নাম্বারে। মেজাজ একশতে একশত!
,
,
,
নিষ্প্রাণের সামনে তৃপ্তিকর হাসিতে আচ্ছন্ন মিশকাত। এই এলাকার নতুন এস আই। কৌতূহলী হয়ে ছুটে এসেছেন রাজন শিকদারের সাথে দেখা করতে। নিষ্প্রাণকে তা জানাতেই তার সরল উত্তর।

“দাদু অসুস্থ। আপাতত তিনি আপনার সাথে কথা বলতে পারবেন না। আপনার যা প্রশ্ন করার আমাকে করুন।”

অধর বিস্তৃত করল মিশকাত। জানার আগ্রহ নিয়ে বলল—

“আসলে কিছুদিন হলো আমি জয়েন করেছি। পুরোনো আনসলভড কেস ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আমি একটা জিডির কপি পেয়েছি। কয়েকবছর আগে সম্ভবত আপনাদের পাশের বিল্ডিং এ আগুন লাগে। রাজন শিকদারের পুরো পরিবার সেই আগুনে মারা যায়। আপনি তো তার নাতি? আপনারা সেদিন কোথায় ছিলেন?”

লম্বা শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। নির্ভয়চিত্তে বলল—

” মসজিদে। দোআ মাহফিলে।”

“কতজন মারা যায় বলুন তো? আর আগুনটা লেগেছিল কী করে?”

নিষ্প্রাণ মোলায়েম হাসল। সপ্রতিভ গলায় বলল—

“প্রায় নয়, দশ জনের মতো হবে। শর্টসার্কিট হয়েছিল।”

“আপনি এত দৃঢ়তার সাথে কী করে বলছেন? আপনি তো তখন খুব ছোটো!”

নিষ্প্রাণ সচেতন চোখে চেয়ে ঝরা হাসল। তেজহীন গলায় বলল—

“এখন তো আর ছোটো নই। বুঝতেও শিখেছি আর মনে রাখতেও শিখেছি।”

নিষ্প্রাণের কথার ধার মিশকাত বুঝল না। বিমূঢ় গলায় বলল—

“আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

নিষ্প্রাণ সোজা হয়ে বসল। আবেশিত গলায় বলল—

“হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ পড়েছেন? আমি ছোটবেলায় ছবিটা দেখেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি। সেদিন রাতে রাবেয়ার সাথে কী হয়েছিল তার একটু ধারণাও আমি করতে পারিনি। মন্টু কেন মাস্টার কাকাকে মারল তাও বুঝতে পারিনি। তবে এখন বুঝতে পারছি। কেন বলুন তো?
কারণ আমি এখন আর দশ বছরের নিষ্প্রাণ মুনতাসির নই। আশা করি আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?”

বিমূঢ় চাহনি মিশকাতের। হতভম্ব সে। নিষ্প্রাণ কী বুঝাইতে চাইল? সে কী তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছে?

সিঁড়ি বেয়ে গুটগুট করে নেমে আসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণ ছাড়াও যে অন্য কেউ সেখানে আছে তা ঠাওর করতে পারল না সে। নিমগ্ন দৃষ্টি তার অসহ্যকর মোবাইলে। আদুরে গলায় বলে উঠে—

“দেখ না প্রাণ, সে কখন থেকে ট্রাই করেই যাচ্ছি, কল ঢুকছেই না।”

নিষ্প্রাণ ওঠে দাঁড়ায়। আয়েন্দ্রির হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে মৃদু গলায় বলল—

“এখানে গ্রামীনের টাওয়ার নেই। তাই নেটওয়ার্কের বারোটা। আমার মোবাইল নে।”

“না। তুই আমাকে নতুন সিম কিনে দে। বারবার তোর মোবাইল নিতে পারব না।”

“আচ্ছা, দেবো।”

“আয়েন্দ্রি!”

অপরিচিত পুরুষ কন্ঠে চেতন ফিরে আয়েন্দ্রির। অক্ষিপুট কিঞ্চিৎ অশিথিল করে চেয়ে পুরুষটিকে চেনার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। পূর্ণ নজর ক্ষেপন করে স্থির রইল।
মিশকাত প্রফুল্ল হেসে বলল—

“চিনতে পারনি? আমি। মিশকাত। ঝুমু ভাবির দেবর। তোমার কাজিন।”

চমকে মনে পড়ল আয়েন্দ্রির। তার ফুফাতো বোন ঝুমুর একমাত্র দেবর মিশকাত। আয়েন্দ্রি উৎফুল্ল গলায় বলল—

” ও মনে পড়েছে। আপনি! এখানে?”

মিশকাত অধর ছড়িয়ে হাসল। হৃষ্ট গলায় বলল—

“চিনতে পেরেছ তাহলে! এই এলাকার নতুন এস আই। গত সপ্তাসে জয়েন করেছি। কিন্তু তুমি এখানে?”

” শি ইজ মাই ওয়াইফ।”

নিষ্প্রাণের প্রশ্বস্ত গলায় তার দিকে মনোযোগ দিলো মিশকাত। কিছুটা অবাক হলো সে। বিস্ময়ভরা গলায় বলল—

“আপনি আয়েন্দ্রির হাজবেন্ড? কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি আয়েন্দ্রির বিয়ে কোনো প্রফেসরের সাথে ঠিক হয়েছিল।”

গা দুলিয়ে হেসে ওঠে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির অপ্রতিভ চাহনি। দাম্ভিকতার সাথে বলল নিষ্প্রাণ—

“জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে…তিন বিধাতা নিয়ে। যা ওপরওয়ালা লিখেছে তাই হবে। বুঝলেন মি. এএএএস আই।”

চমৎকার করে হাসল মিশকাত। নিষ্প্রাণের সাথে একমত পোষণ করে বলল—

“দিস ইজ রাইট। আচ্ছা, আসি আজ তাহলে। হাজার হোক, নতুন একটা সম্পর্ক তো তৈরি হয়েছে। আই উইশ, আমাদের আবার দেখা হবে!”

“অফকোর্স, হোয়াই নট?”

নিষ্প্রাণের সাথে হ্যান্ডশেক কথে বিদায় নেয় মিশকাত।
,
,
,
বিছানায় সটান হয়ে শুয় আছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি নিজেকে পরিপাটি করছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। মাথাটা একটু উঁচু করে আয়েন্দ্রিকে দেখে নিয়ে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ে নিষ্প্রাণ—

“ছেলটার সাথে কতবার দেখা হয়েছে তোর?”

আয়েন্দ্রি ফট করে পেছন ফিরে বলল—

“কেন?”

“এমনি।”

আয়েন্দ্রি শাড়ির পাড়টা টানটান করে আঁচল কাঁধে ওঠায়। খেয়ালিপনায় বলল—

“একবার। আপুর বিয়ের সময়। এরপরে আর কখনো দেখা হয়নি।”

“কত বছর হয়েছে বিয়ের?”

“প্রায় পাঁচ বছর।”

“পাঁচ বছর পর তোকে দেখেই চিনে ফেলল?”

আয়েন্দ্রি ডাসা ডাসা চোখে চেয়ে বলল—

“কারণ ও তোর মতো গবেট মস্তিষ্কের না। এস আই বুঝলি। পুলিশ।”

আয়েন্দ্রি ততক্ষণে বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কোমল হাতে এক টান মারতেই আয়েন্দ্রির কোমলাঙ্গ দেহ নিষ্প্রাণের বুকে উপর এসে পড়ে। তাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় নিষ্প্রাণ।

“আমি গবেট?”

“হুম।”

আয়েন্দ্রির কপালে চুমু আকে নিষ্প্রাণ। মায়াময় গলায় বলল—

“এই গবেট তোকে ভালোবাসে।”

আয়েন্দ্রি চিলতে রোদের মতো হাসে। নিষ্প্রাণের নাকের সাথে নাক ঘষে বলল—

“আমিও।”

হৃদয় ভেজা হাসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে। মায়াবী, কুহেলিকা চাহনি। ফট করেই হেসে ফেলে আয়েন্দ্রি। হাসি হাসি ঠোঁটে বলল—

“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

“তোকে দেখি।”

“ওরে আমার পিচ্চি বর! ছাড় !”

“তবুও তোর থেকে দুই বছরের বড়ো আমি।”

“জি… উদ্ধার করেছেন আমাকে।”

চোরা হাসল নিষ্প্রাণ। হাতের বেড় শক্ত করতেই আয়েন্দ্রি মিশে গেল নিষ্প্রাণের বুকের পাটাতনে। নৈঃশব্দে গহন শ্বাসক্রিয়ায় চলছে একে অন্যকে বিদীর্ণ করা তীক্ষ্ম প্রেমময় বাণ। কেমন অদ্ভুত, আবেশিত, সিক্ত চোখে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ। কন্ঠনালীতে সহস্র দিবস ধরে জমে থাকা অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে অনুরক্তির সুরে বলল—

“আমি তোকে ভালোবাসি। সত্যিই ভালোবাসি ধ্রুবতারা। আমার যুগ ধরে চলা হাজারও মিথ্যের মায়াকাহনে একমাত্র সত্য তুই। আমার মোহাচ্ছন্ন উদ্দেশ্যহীন জীবনের একমাত্র গন্তব্য তুই। তুই আমার ধ্রুবতারা। শুধু আমার।”

আয়েন্দ্রি ঘোর লাগা চোখ নত হয় কিয়ৎপলেই। নেমে আসে উজ্জ্বল আলোয় প্রেম বিলাসের মাহেন্দ্রক্ষণ।

চলবে,,,
চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here