প্রাণস্পন্দন পর্ব ৪২+৪৩

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

প্রভাতের রৌশনাই জ্বলে উঠেছে ঘণ্টা খানেক আগেই। তমসাচ্ছন্ন অম্বুর বিদীর্ণ করে গলিত সোনার ফলকের ন্যায় উদিত হয়েছে প্রভাকর। পত্রীরা ছুটে চলছে নামহীন গন্তব্যে। তাদের কিচিরমিচিরে শান্ত, নিশ্চল ধরণী কেঁপে কেঁপে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। ধরণীর বুক জুড়ে বহতা সুমিষ্ট প্রভঞ্জনে মেতে ওঠে নবপল্লব।

একটা সুবিশাল পুরোনো লোহার গেইটের সামনে এসে থামে রোদে চকচক করা ব্ল্যাক মার্সেডিজ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘকায় এক পুরুষ। গাড়ি থেকে নেমেই পড়ন্ত শ্বাসে সৃষ্ট করল শব্দ। তীক্ষ্ম নেত্র দিয়ে চেয়ে দেখল অদূরে অবস্থিত অট্টালিকাটি। গাঢ় হাসিতে তার অধর ভরাল। অপর পাশে দরজা খুলে নেমে এলো লাস্যময়ী এক কামিনী। তার পরনের জলপাই রঙা শাড়িটি দমকা বায়ুতে উড়ে গিয়ে তার চোখের দর্পণ আটকাল। নারীদেহটি আলতো হাতে সেই শাড়ির আঁচল নামিয়ে আনে মুখের উপর থেকে। ঠাসা ঠাসা চোখ মেলে অট্টালিকাটি দেখে। সে উৎসুক হয়, হয় আগ্রহী। তার লোচনে যোগ হয় সন্দেহের বাতিক।

লোহার গেইটটির সামনে গিয়ে দাড়ায় নিষ্প্রাণ। হাতের মোবাইলে চোখ বুলিয়ে সংগোপনে বাঁকায় অধর। মোবাইলে কল লিস্টে গিয়ে নির্দিষ্ট নম্বরে কল করে লাইন কেটে দেয় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ছোটো ছোটো পায়ে এগিয়ে এসে নিষ্প্রাণের পাশে দাড়াল। নিষ্প্রাণ সহাস্য অধরে আয়েন্দ্রিকে বুকের একপাশে চেপে ধরে। তার কপালে শুষ্ক অধরের স্পর্শ এঁকে বলল—

“একটু দাড়া। ভেতর থেকে লোক আসবে।”

চোখের ইশারায় প্রত্যুক্তি করে আয়েন্দ্রি। সাবলীল দৃষ্টিতে আগ্রহী হয়ে আছে সে। ক্ষণকাল বাদেই সুবিশাল লোহার গেইটি ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলতে থাকে। পুরোনো গেইটে নতুনের আবরণ। যেন নতুন জীবন তার!

গেইট খুলেই অর্ধ বয়সি এক ব্যক্তি বের হয়ে এলেন। মাথায় স্বল্প চুলে পাক ধরেছে। শীর্ণ হাসিতে রাঙিয়ে নেয় ঠোঁট। ফিকে রঙের হাঁটু অব্দি পাঞ্জাবি। পরনে সাদা আর নীলের মিশেলে লুঙ্গি। গলার উপর চড়ে আছে ছোট্ট গামচা। অমায়িক সম্ভাষণে তিনি বললেন—

“আইছেন ছোডো সাহেব! সেই সক্কাল থেইকা আফনার লাইগা বারান্দায় বইয়া রইছি। আহেন, আহেন।”

নিষ্প্রাণ মোলায়েম গলায় বলল—

“আপনি একা কেন চাচা? ”

পানের রস ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে বের হওয়ার আগেই মুছে নিল তা তালাব। সংকোচিত গলায় বললেন—

“হিকমত ভাইয়ের শরীলডা ভালা নাই। কাইল রাইতে জর আইছে। খ্যাতা মুড়া দিয়া শুইয়া আছে ঘরে।”

তাদের কথা বলা ফাঁকেই নজরুল এসে দাঁড়াল। লম্বা ছেলেটি ছিমছাম গড়নের। এসেই সালাম হাঁকাল।

“সালাম ছোডো সাহেব। আইতে দেরি অইয়া গেল। কই, মাল পত্তর কই? আমি নিয়া যাই।”

নিষ্প্রাণ তার ট্রলি ব্যাগটা নিজের হাতেই ধরে আছে। ছোট্ট করে আপত্তি করে বলল, দরকার নেই। তার কাজ সে নিজেই করতে পারবে।
এতক্ষণে নিষ্প্রাণের পাশের মানুষটির দিকে নজর পড়ে নজরুল আর তালাবের। পানের পিকটা পিচ করে ফেলেই প্রসন্ন হাসল তিনি। হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বললেন—

“সালাম নয়া মা। ক্ষেমা কইরা দেন, আফনারে খেয়াল করতে পারি নাই।”

নজরুল আঠারো বছরের সদ্য যুবা। বয়স্ক হেকমতের একমাত্র ছেলে। বাবা অসুস্থ তাই ছেলেকে ডাকা হয়েছে নিষ্প্রাণকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। হেকমত এখানেই থাকে তালাবের সাথে। নজরুল তার নিজ বাড়িতে মায়ের সাথে থাকে। জরুরি দরকারে বাড়ি গিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসে হেকমত।

গেইট থেকে প্রায় তিন মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে নিষ্প্রাণদের বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে হয়। সরু সিমেন্ট, বালুর পথের দুই পাশে লাগানো বড়ো বড়ো ঘাসে ফুটে আছে লাল, সাদা আর গোলাপী রঙের মিনি সাইজের ফুল। আয়েন্দ্রি খুশি দৃষ্টিতে তা দেখছে। বাড়ির একদম সামনে আসতেই অবাক চোখে চেয়ে থাকে আয়েন্দ্রি। সাদা রঙের দালানটির বাইরের দিকে আলপনা অংকিত। কপাল পেছনের দিকে ঝুঁকিয়ে উপরের দিকে তাকায় আয়েন্দ্রি। ছাদের দুই পাশে দুইটা গম্বুজের মতো। যার ভেতরটা ফাঁকা। সেখানে যাওয়ার জন্য হয়তো দালানের ভেতরে কোনো সিঁড়িও আছে। দালানটিকে একদম নতুন মনে হচ্ছে। হওয়ার-ই কথা। কয়েক বছর পর পর -ই বাড়িটি সংস্কার করা হয়। কিন্তু আয়েন্দ্রি বিস্মিত হয়, দালানটি থেকে একটু দূরে অবস্থিত ছোট্ট দালানটি দেখে। সেটি জীর্ণশীর্ণ। পলেস্তার খসে খসে পড়ছে। বৃষ্টি-বাদলে গায়ে পরা শ্যাওলা কালো বর্ণ ধারণ করেছে। একাংশ প্রায় ভেঙে পড়েছে। আরেক পাশ আপাতত ভালো থাকলেও হতপ্রায়। আয়েন্দ্রির হাত ধরে রাখা নিষ্প্রাণের হাতে। তাতে টান পড়তেই নিষ্প্রাণ চোখ রাখে আয়েন্দ্রির আতঙ্কিত মুখে। মুহূর্তেই চোখে হেসে বলল—

“বাড়ির ভেতরে চল। দাদু তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

আয়েন্দ্রি নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকায়। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই আরেক দফা ধাক্কা খায় আয়েন্দ্রি। বিস্তৃত হলঘর। যার অর্ধ সীমানা থেকে বক্রাকৃতির সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির পেছনের দিকে নিচতলায় কয়েকটা কক্ষ। হলরুমের একপাশে বিশাল ডাইনিং টেবিল। প্রায় দশের অধিক মানুষ একসাথে বসে খাবার গ্রহন করা যাবে। অপরপাশের দেয়ালে সমান্তরাল প্রায় পাঁচটা জানালা সাত ফুট পরপর। তাতে সফেদ রঙের পর্দা ঝুলানো। হুরহুর করে প্রভঞ্জনের দমকে ঢুকছে মৃদু, শীতল প্রভঞ্জনের সাথে হলদে নরম রোদ। তাতে প্রতিচ্ছায়া তৈরি হচ্ছে ধূসর রঙা মেঝেতে। আয়েন্দ্রি একটা জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। পুরোদস্তুর শীর্ণ দালানটাকে এখান থেকে অবলোকন করছে আয়েন্দ্রি। তার কাঁধে হাত রাখে নিষ্প্রাণ। হৃষ্ট গলায় বলল—

“উপরে চল।”

আয়েন্দ্রির ঐৎসুক্য চাহনি আর সন্ধিগ্ধ মন বারংবার ওই অব্যবহৃত, অপরিচ্ছন্ন, অসাঢ়, ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দালানটাকে টানছে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দুই জন। আয়েন্দ্রি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে দেখছে সব। এতবড়ো বাড়ি, এত সম্পদ! তবুও নিষ্প্রাণ নিজেকে অনাথ কেন বলেছিল!

একটা কক্ষের সামনে স্থির হয় নিষ্প্রাণ আর আয়েন্দ্রি। তালাব আর নজরুল নিচেই রইল। তারা উপরে আসেনি। আয়ন্দ্রির হাতটা ধরে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করে নিষ্প্রাণ। ঝুলন্ত পর্দার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে যখন ভেতরে ঢুকে আয়েন্দ্রি চকিত হয় সে। একটা হুইল চেয়ারে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ। মাত্রাতিরিক্ত ফর্সা যাকে বলে! তার ভ্রুযুগলও শুভ্রতায় আচ্ছন্ন। মাথার সফেদ কেশে অবতার মনে হচ্ছে তাকে। আকাশ রঙা পাঞ্জাবি পরেছে সে। অদ্ভুতভাবে ঘাড়টা হেলানো বাম কাঁধে।

রাজন শিকদার চশমার কাচ গলিয়ে চাইলেন। আয়েন্দ্রির নিষ্প্রভ, ম্লান, প্রাণহীন মুখটা দেখে চঞ্চলতা দেখা দিলো তার মূর্তিমান চোখে। আয়েন্দ্রি ধীরগতিতে রাজন শিকদারের কাছে এলো। ঝুঁকে বসল সে। রাজন শিকদারের পদযুগল স্পর্শ করে কদমবুছি করল। কিছু না পেয়ে অস্বস্তি নিয়ে তার পায়ের কাছে মেঝেতে বসল। শান্ত গলায় বলল—

“কেমন আছেন দাদু?”

জলপুকুর ছাড়লেন রাজন শিকদার। দরদর করে তার চোখ হতে জল গড়িয়ে পড়ল। আয়েন্দ্রি উদ্বেলিত গলায় বলল—

“দাদু, কাঁদছেন কেন?”

রাজন শিকদারের মুখটা বাঁকানো। স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিনি আর কখনো সোজা হতে পারবেন না। কোমরের নিজ থেকে অসাঢ় তিনি। আকস্মিক অ্যাটাকে তার কথা বলা অনেকটা কষ্টকর! অস্পষ্ট বুলিতে তিনি কিছু আওড়ালেন। কাঁপা কাঁপা হাতটা একটু উঁচু করতেই তা নিজের মাথার উপর রাখল আয়েন্দ্রি। রাজন শিকদারের হাতটা নিজের মাথায় নিয়ে মুখ তুলে তাকাল আয়েন্দ্রি। সরস হাসল সে। বুক ভরে আসলো রাজন শিকদারের। আয়েন্দ্রি নির্বিকার গলায় বলল—

“আপনি শান্ত দাদু।”

সময়ের ফাঁক সরিয়ে আয়েন্দ্রির পাশে এসে দুই হাঁটু মেঝেতে ঠেসে বসে নিষ্প্রাণ। দুঃখী গলায় বলল—

‘দাদু ইজ প্যারালাইজ। এখন এই হুইল চেয়ার-ই তাঁর ভরসা।”

আয়েন্দ্রি চট করেই প্রশ্ন করল—

“এসব কী করে হলো?”

নিষ্প্রাণ নিরুত্তাপ গলায় বলল—

“সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে দাদু।”

চোখে জ্বলে উঠল উজ্জ্বলতা রাজন শিকদারের। ত্রসনে আচ্ছন্ন সে। নিষ্প্রাণের দিকে চোখের মনি ঘুরিয়ে বিধ্বস্ত নজরে চাইলেন তিনি। অনুভূতিশূন্য নিষ্প্রাণের ধারাল চাহনিতে কেঁপে উঠল রাজন শিকদার। তার পেছনে হুইল চেয়ারের হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাজন শিকদারের প্রিয় ভৃত্য হাসমুল।
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৪৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নিষ্প্রাণের সাথে তার কক্ষে প্রবেশ করে আয়েন্দ্রি। তার কম্পিত নজর! বিস্তীর্ণ কক্ষের একপাশে সুসজ্জিত বিছানা। তার পাশে ছোট্ট টেবিল। উত্তরে জানালা। তার পাশেই একটা আলমিরা যা বইতে ঠাসা। অন্যপাশে আরও আসবাবপত্র। দেয়াল জুড়ে পেইন্টিং। হলদে রঙের দেয়ালে শুভ্র সিলিং। নিষ্প্রাণ কক্ষে ঢুকেই জানালাগুলোর থাই টেনে দেয়। অহনের নুর তরতর করে ঢুকে পড়ে কক্ষে। আলোকিত হয় কক্ষ। অবাক ভঙিমায় তা সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষনে দেখে চলছে আয়েন্দ্রি। তার অক্ষিজোড়া প্রশস্ত। জানালার পর্দাকে মাঝ বরাবর বিভাজন করে সরিয়ে দেয় নিষ্প্রাণ। অপলক দৃষ্টিতে কক্ষের পেইন্টিংগুলো দেখছে আয়েন্দ্রি। আলমিরা, ওয়্যারড্রোব, বিছানা সব-ই অত্যাধুনিক!

ধূলো জমেছে বিছানায়। নিষ্প্রাণ বিছানার পুরোনো চাদরটা টেনে উঠিয়ে ফেলে। তার ক্লোজেট থেকে নতুন চাদর নামিয়ে তা বিছিয়ে দেয়। কক্ষের মেঝের অবস্থাও করুণ! ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সাহায্যে তা আপাতত পরিষ্কার করে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে জানালা ঘেঁষে। দূরের জঙ্গলে আটকে গেছে তার চোখ। বেড়ে ওঠা আগাছা, পরগাছা আর বৃক্ষের ডালে। পাতা ঝরে স্তুপ হয়ে আছে। কালশে, স্যাঁতসেঁতে। দুই একটা হলদে পাখি দেখছে আয়েন্দ্রি। গাছের ডালে উড়াউড়িতে ব্যস্ত। কেমন হিমশীতল বায়ু বইছে! কী অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ! আয়েন্দ্রি চোখ বুঝে নেয়। চকিতে তার কানের কাছে উষ্ণ তাপ অনুভূত হতেই চোখ মেলে আয়েন্দ্রি। কিঞ্চিৎ ফিরতেই দেখল টসটসে চোখে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণ।

আয়েন্দ্রি অবশীভূত গলায় প্রশ্ন ছুড়ে—

“এসব তোদের?”

নিষ্প্রাণ মায়াময় হেসে বলল—

“না। আমাদের।”

সংকীর্ণ হাসে আয়েন্দ্রি। দুপুর রোদের তীব্রতা বাড়ছে। প্রভাকর তার দীপ্তি ছড়াচ্ছে মেদিনীর বুকে। নিষ্প্রাণ অনুরক্তির সুরে বলল—

“ফ্রেশ হয়ে নে। জার্নি করেছিস, ভালো লাগবে।”

“হুম।”

ব্যাগ থেকে মিষ্টি কালারের একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে আয়েন্দ্রি। বিছানায় সটান হয়ে পড়ে থাকে নিষ্প্রাণ। ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহটা বিশ্রাম চাইছে।
,
,
,
বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে নিষ্প্রান। তার বুকের সাথে লেপ্টে আছে আয়েন্দ্রি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে অলসতা কাটানোর অভিপ্রায়ে শুয়েছিল আয়েন্দ্রি। কিন্তু কিছুতেই ঘুম ধরা দিলো না তার চোখে। হয়তো নতুন জায়গা তাই!

আয়েন্দ্রির চুলে আঙুল ঢুকিয়ে খেলছে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি নির্লিপ্ত। খচখচ করছে তার চিত্ত। অনেক প্রশ্নের ডালা সাজিয়েছে সে। তার উত্তর পাওয়া জরুরি।
সংকুচিত গলায় প্রশ্নের দ্বার খোলে আয়েন্দ্রি।

“তুই সবাইকে মিথ্যে কেন বলেছিলি? এত কিছু থাকার পরও নিজেকে অনাথ, অবহেলিতরূপে কেন সবার সামনে তুলে ধরেছিলি।”

আয়েন্দ্রির দিকে বাঁকিয়ে ছিল নিষ্প্রাণ। এবার সোজা হয়ে কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল—

“দাদু বাড়ন করেছিল। বলেছিল অনার্স শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে একজন সাধারণ মানুষের মতোই থাকতে হবে। কথা দিয়েছি তাকে আমি।”

আয়েন্দ্রির অন্ত:করণ বিষাদের কালিমায় মেখে যায়। এমনটা না হলেও পারত! যদি নিষ্প্রাণ আগেই সবটা জানিয়ে দিতো তাহলে এসব আর হতো না।
আয়েন্দ্রি মুখ দিয়ে অবচেতন মনেই নিঃসৃত হলো—

“এমনটা হওয়া কী জরুরি ছিল?”

চোখের কোণে হাসল নিষ্প্রাণ। বিজ্ঞের মতো বলল—

“হয়তো। মানুষের ভাগ্যে তাই হয় যা তার ভাগ্য সংবিধানে উল্লিখিত। মহান আল্লাহ পাক সব মানুষের ভাগ্য বিধান তার জন্মের পূর্বেই লিখে রাখেন। তা পরিবর্তন করার দুঃসাহস কারো নেই। মানুষ পারে শুধু সেই মোতাবেক নিজেকে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করতে।”

বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে নিষ্পেষিত মনে বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“তুই সুস্থ তো প্রাণ?”

নিষ্প্রাণ ভরাট দৃষ্টিতে আয়েন্দ্রির দিকে তাকাল। আয়েন্দ্রির সজলনেত্রের মায়ায় স্তব্ধ হয়ে এলো নিষ্প্রাণের ধাবমান রক্তকণিকা। নৈঃশব্দে ভারী শ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি আদুরে বিড়াল ছানার মতো নিজেকে সমার্পিত করে নিষ্প্রাণের বক্ষ:স্থলে। দুই হাতে বুকের দিকটা খামচে ধরে বলল—

“তুই আর এমন করিস না প্লিজ! নিজের রাগকে কন্ট্রোল কর।”

নিষ্প্রাণ প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। গাঢ় চুম্বনে ভিজিয়ে তুলল আয়েন্দ্রির গলদেশ। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—

“করব না। হ্যাভ অ্যা রিলেক্স, সি ইউ নট ফর মাইন্ড।”

ফিক করে হেসে ফেলে আয়েন্দ্রি। চকচকে চোখে চাইতেই দেখল নিষ্প্রাণ অদ্ভুতভাবে তার দিকেই চেয়ে আছে। লাজুক হাসে আয়েন্দ্রি। নিষ্প্রাণের হৃদকুঠিরে বসন্তের হাওয়া লাগে। মেয়েটা আজ অনেকদিন পর অকৃত্রিম হাসল!
আলতো করে আয়েন্দ্রিকে বুকে জড়িয়ে নেয় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি নীরবে সাড়া দেয় তাতে। বুকপিঞ্জিরায় ছোট্ট পাখির মতো গুঁজে থাকে। নিষ্প্রাণের উষ্ণতায় তপ্ত হচ্ছে আয়েন্দ্রি। তার মাথায় আদুরে হাত বুলায় নিষ্প্রাণ।বলল—

“চোখ বন্ধ কর। ঘুম আসবে।”

“হুম।”

আয়েন্দ্রি চোখ মুদন করতেই বদ্ধদ্বারে ভয়াল থাবা বসাতে লাগল কেউ। চমকে ওঠে বসে আয়েন্দ্রি। আতঙ্কিত গলায় বলল—

“কে?”

নিষ্প্রাণ আশ্বাস দিয়ে বলল—

“আমি দেখছি। ডোন্ট ওয়ারি।”

নিষ্প্রাণ নিরুদ্বেগ পায়ে হেঁটে দরজা খুলতেই ভয়াতুর গলায় চোখের স্মিত ধারা ঝরিয়ে নজরুল বলল—

“ছোডো সাহেব, আব্বা জানি কেমন করতাছে! আপনারে ডাকতাছে। তারাতারি চলেন।”

নিষ্প্রাণ কপাল কুঞ্চন করে বলল—

“কী হয়েছে চাচার?”

“জানি না। আব্বা কেমন করতাছে। আফনে তারাতারি চলেন ছোডো সাহেব।”

নিষ্প্রাণ দ্রুত পা চালায়। নিচতলায় সিঁড়ির পেছনের দিকের একটা ছোট্ট কক্ষে থাকে হেকমত। কক্ষের সামনে আসতেই থমকে যায় নিষ্প্রাণ। আদেশের সুরে বলল—

“তুমি এখানেই দাঁড়াও নজরুল।”

“কিন্তু আব্বা!”

“আমি যা বলছি তাই করো।”

বিনা শব্দ করে দুঃখী দুঃখী মুখে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল নজরুল। ভেতরে ঢুকে নিষ্প্রাণ। তেল চিটচিটে কক্ষ। অগোছালো, পুরোনা আসবাবপত্র। মলিনতায় সমাচ্ছন্ন কক্ষের এক পাশে একটা চৌকির উপর শুয়ে আছেন হেকমত। নিষ্প্রাণ তার পাশে গিয়ে বসল। হেকমতের চোখের মনি চকচক করে উঠল। হাত, পায়ে প্রাণ ফিরে এলো। অতি কষ্টে ওঠে বসার চেষ্টা করছেন। নিষ্প্রাণ হাত বাড়াল। পিঠের পেছনে তিনটি বালিশকে স্তুপাকার করে ঠেস দিয়ে বসালেন হেকমতকে। বড়ো বড়ো শ্বাস টানছেন তিনি। মর্মাহত গলায় বলল নিষ্প্রাণ—

“ক্ষমা করবেন চাচা। আসতে পারিনি আপনাকে দেখতে।”

হেকমত লম্বা শ্বাস টেনে বললেন—

“না, না ছোডো সাহেব। ক্ষেমা চাইয়েন না আফনে। আমি কিছু মনে করি নাই।”

“আপনার গায়ে তো প্রচুর জ্বর চাচা। চলুন আপনাকে হসপিটালে নিয়ে যাই।”

হেকমতের শরীর যেন আগুনের লাভা! প্রাণসঞ্জিবণী ফুরিয়ে আসার দরুণ শ্বাস টেনে যাচ্ছেন। আবেগভরা গলায় বললেন—

“না গো ছোডো সাহেব। আমার সময় ফুরাইয়া আইছি। আমি আর বাঁচুম না। মরার আগে, এট্টু নয়া মারে দেখবার চাই। আফনি তারে এট্টু ডাহেন।”

“দেখবেন চাচা। তার আগে আপনার সুস্থতা প্রয়োজন। চলুন।”

নিষ্প্রাণ ব্যস্ত হয়ে হেকমতকে উঠাতে গেলে তিনি বাঁধা প্রদান করেলেন। কাতর গলায় বললেন—

“না। আমার সময় নাই ছোডো সাহেব। তারে ডাকেন। আমি এট্টু তারে মন ভইরা দেখুম। কতদিন আমার নয়নতারারে দেখি না।”

নিষ্প্রাণ কঠিন গলায় ডেকে উঠে—

“নজরুল! নজরুল!”

নজরুল দৌড়ে আসে। বাবার মৃতপ্রায় অবস্থা দেখে ডুকরে ওঠে। বর্ষণ ধারা ঝরিয়ে বলল—

“আব্বা! আব্বা! কী অইছে আপনের? এমন করতাছেন ক্যান?”

গায়ে জড়ানো মোটা কাঁথাটা সরিয়ে রাখলেন হেকমত। উন্মুক্ত গলায় বললেন—

“কিছু হইনাই রে বাপ। তুই এট্টু নয়া মারে ডাইকা নিয়া আই। আমি তারে দেখমু।”

“যাও নজরুল। ধ্রুবতারাকে ডেকে নিয়ে আসো। বলবে, আমি ডেকেছি।”

“জে। আমি যাইতাছি।”

নজরুল যেন তার শেষ ট্রেন ধরতে যাবে। টগবগিয়ে দৌড় লাগাল সে। হেকমতের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে নিষ্প্রাণ। পুরু গলায় হেকমতের আবদার—

“আমার পোলাডারে দেইখেন ছোডো সাহেব। ওরে একটু মানুষ বানাইয়েন। ”

“চাচা, আপনি একটু শান্ত হউন। নজরুলের সব দায়িত্ব আমার।”

চকিতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন হেকমত। অসহায় গলায় বললেন—

“আমার নয়নতারারে ওরা বাঁচতে দিলো না। নজরুল রে দেইখেন ছোডো সাহেব।”

নিষ্প্রাণ বদ্ধ শ্বাস ফেলল। হেকমত জানে না যার কাছে তিনি অনুনয় করছেন তার হাতেই মৃত্যু ঘটেছে নয়নতারার!

বিক্ষিপ্তচিত্তে বসে আছে আয়েন্দ্রি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। কেমন অদ্ভুত, অস্পষ্ট অনুভূতিতে গ্রাস করছে তাকে। গা ছমছম করছে। নজরুলের ভয়াল গলায় আঁতকে ওঠে আয়েন্দ্রি।

নয়া বউ!নয়া বউ!”

দরজা খোলা-ই ছিল। পর্দার আবরণ সরিয়ে বাইরে আসে আয়েন্দ্রি। ভয়কাতুরে গলায় বলল—

” কী হয়েছে? প্রাণ কোথায়?”

ঘামে ভেজা মুখটা মুছে নিল নজরুল। জমানো থুথু গিলে নিল। জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল শুষ্ক ঠোঁট। বলল—

“ছোডো সাহেব ডাকতাছে। চলেন আমার লগে।”

আয়েন্দ্রির গা কাঁটা দিয়ে উঠল। নজরুলকে এভাবে দেখে খারাপ কিছুর আভাস পেল সে।
,
,
,

আয়েন্দ্রি এগিয়ে আসতেই তার দিকে কী অতলান্ত, অপরিমেয়, অবিচ্ছেদ্য মায়ায় চেয়ে রইলেন হেকমত। না! এ তার নয়নতারা নয়। তার নয়নতারা তো শুভ্র পরী। যার পরতে পরতে শুভ্রতার মোহজাল! যার আশেপাশের বিস্তীর্ণ ভূমি সুবাসিত। শুভ্রতার আচ্ছাদনে নিদ্রিত এক অপ্সরা কামিনী ছিল তার নয়নতারা!

আয়েন্দ্রি তেমনটা নয়। সাধারণ গোছের চেহারা তার। ম্লান দুই চোখ। তীক্ষ্ম নাসিকা। আবক্ষ চুল। যেখানে নয়নতারার ছিল রেশমকালো দীঘল কেশ। হেকমত তাজ্জব হলেন। এই মেয়েকে কেন বিয়ে করল নিষ্প্রাণ! ও তো তার নয়নতারা নয়।

আয়েন্দ্রি ভয়ে ভয়ে নিষ্প্রাণের পাশে এসে বসল। আলগোছে ধরে রাখল তার বাহু। হেকমতের চোখ জোড়া শান্ত, স্থির, রক্তিম। মুখ খোলেন তিনি। বললেন—

“কেমন আছেন নয়া মা?”

আয়েন্দ্রি ভোলা ভোলা চোখে চাইল নিষ্প্রাণের দিকে। নিষ্প্রাণ চোখের ইশারায় তাকে আশ্বাস দিলো। ভয় নেই!
আয়েন্দ্রি সরল দৃষ্টিতে হেকমতের দিকে চেয়ে বলল—

“আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

হেকমত খেয়াল করলেন আয়েন্দ্রির ঠোঁট। যা সত্যিই তার নয়নতারা অনুরূপ। খুশিতে আবেশিত হলেন তিনি। চিত্ত দুলে উঠল তার। নিষ্প্রাণের দিকে তাকিয়ে দিলখোলা হেসে বললেন—

“যুগ যুগ ধইরা আফনের তারা আফনার লগেই থাউক ছোডো সাহেব। তারে আমার তারার মতো ঝইরা যাইতে দিয়েন না। আগলাইয়া রাইখেন তারে। আগলাইয়া রাইখেন।”

স্ফীত প্লাবনে মেতে উঠল হেকমতের দুই চোখ। সম্পর্কহীন এই মানুষটার জন্য আয়েন্দ্রির মন কেমন করে উঠল। সিক্ত হলো তার আঁখি পল্লব। হেকমত অবিশ্রান্ত শ্বাস নিতে লাগল। ব্যগ্র হয়ে উঠল সকলে।তালাব নৈঃশব্দে পানি ছাড়লেন চোখ থেকে। কতদিন ধরে একসাথে তাদের উঠাবসা। নজরুল বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।

“আব্বা! আব্বা!”

মোলায়েম হাসলেন হেকমত। একটা সুদীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে শান্ত হয়ে গেল তার তপ্ত দেহ। ধীরে ধীরে ভারী হতে লাগল। উদ্ভ্রান্তের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগল নজরুল।

আয়ন্দ্রি নিজের রোদনেভরা মুখটা নিষ্প্রাণের বাহুতে চেপে ধরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিষ্প্রাণ। কারো মৃত্যুতে এখন তার কষ্ট হয় না। অনুভূতিশূন্য এক প্রাণহীন মানব সে।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here