প্রাণহন্ত্রী পর্ব -১০

#প্রাণহন্ত্রী (১০)
দীপ্তিকে কয়েক বার ডাকার পর ও ঘুম থেকে উঠলো না দীপ্তি। প্রচন্ড ঘুমে যেন ওর চোখ জ্বালা করছে। পিট পিট করে তাকিয়ে আবারো ঘুমিয়ে যায়। কুশল এবার বিরক্ত ই হয়। মেয়েটা কি করে যে পুলিশ অফিসারের পরীক্ষা দিয়েছে কে জানে। নিশ্চয়ই ট্রেনাররা দীপ্তির মায়া ময় মুখ দেখে আরাম ছে ছেড়ে দিয়েছে। কুশল হলে নির্ঘাত শূন্য দিতো। দীপ্তির বাহু ধরে ডাকে কুশল।
” আরেকটু ঘুমাই প্লিজ। ”

” একটু একটু করে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার উঠো দীপ্তি। ”

” আরেকটু প্লিজ প্লিজ প্লিজ। ”

কুশল চলে যায়। দীপ্তি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দুই মাস চোখের পাতা এক করতে পারে নি ঠিক মতো। আজ একটু ঘুমাবেই। যেই না চোখটা বুঝেছে ঠিক তখনি অনাকাঙিক্ষত বৃষ্টি এসে ওকে ভিজিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে বর্ষণ! কিছুটা হুরমুরিয়ে উঠে মেয়েটা। বালতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুশল। দীপ্তি বুঝে যায় কি হয়েছে। খুব রাগ হয়। কুশল সব সময় এমন কিছু করবে যা ধারনার বাইরে। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে ওর। দাঁতে দাঁত চেপে কুশল বলে ” মাথায় এখনো দুই বিনুনি করা। প্রথম দিনের মতো বিনুনি টেনে দিবো? ”

চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। পুরনো কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। সেদিন কি ব্যাথা টাই না পেয়েছিলো। দীপ্তির এখনো মনে আছে ব্যথায় মাথা তুলতে পারে নি সেদিন। চেঁচিয়ে উঠে ওহ। বালিশ নিয়ে কুশলের মুখে ছুঁড়ে বলে
” একদম নয়। আপনার বাজে হাতের শক্তিতে আমার পেয়ারা ছা চুলের বারোটা বেজে যাবে। ”

” তাহলে ফ্রেস হয়ে আসো। না হলে খারাপ ই হবে। ”

ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ঠুলু ঠুলু পায়ে এগিয়ে যায় ওয়াসরুমে। আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে মুখে ব্রাশ পুরে দেয়। কনকনে শীতের মাঝে ঠান্ডা পানির ছোঁয়া যেন সুচের আ’ঘা’ত স্বরূপ। একদম ই ভিজে গেছে মেয়েটা। মৃদু কাঁপতে কাঁপতে ব্রাশ করে ওহ। ড্রেস চেঞ্জ করে ঘরে আসতেই চোখে পরে কুশলের দিকে। জগিং এর ড্রেস আপ পরে একদম ই ফিট ফাট। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে দীপ্তি। কুশল এখনো কতো টা সুন্দর!সেই চিত্রের মতোই তেজী ভাব বিদ্যমান। তবে কেন যেন মনে হয় নিজের ভেতরে থাকা সত্ত্বাটা কে লুকিয়ে রেখেছে। কেন এই পরিবর্তন?

” আমি জানি আমি সুন্দর। তবে এভাবে দেখার মতো এতো টা ও সুন্দর নই। ”

কুশলের হঠাৎ এমন ধাঁচের কথায় গা শিউরে উঠে। কিছুটা লজ্জা ও পায়। তবে দীপ্তি তো দীপ্তি ই। কিছু তেই হার মানবে না। তাই ভেঙ্চি কেঁটে বলে” বুড়ো হয়ে গেলে মানুষের মাথায় বুদ্ধি থাকে না সেটার ই বড়সড় প্রমান দিলেন। ”

” আমি বুড়ো হয়ে গেছি? ”

” আলবাত হয়েছেন। ত্রিশ এর কোঠা তে বয়স যাওয়া মানেই তো মাঝ বয়সী। ”

মুখ ভার করে ফেলে কুশল। হঠাৎ ই মাথায় টান অনুভব করে দীপ্তি। পর পর কয়েক টা থা*প্পড় মে*রে কুশলকে দূরে সরায়। তেড়ে এসে বলে ” আরেক বার বিনুনি টানলে একদম মে*রে দিবো। ”

” বুড়ির শক্তি কতো জানা আছে আমার। ”

চারপাশে চোখ বুলায় দীপ্তি। ভ্রু নাচিয়ে বলে ” এখানে বুড়ি কোথায়? ”

” কেন তুমি। ”

” আমি! ”

” অবশ্যই তুমি। মেয়েরা কুঁড়ি তেই বুড়ি আর তুমি তো এখন তেইশ বছরের কুটনি বুড়ি।”

” ঐ কুটনি বুড়ি মানে। আমার সাথে মশকরা হচ্ছে। আপনি বুড়ো , যেনো তেনো নয় শয়*তান বুড়ো। ”

ঘড়ির কাঁটা বেজে উঠে। ছয়টা বেজে গেছে। কুশল অনুভব করে যাওয়া প্রয়োজন। দীপ্তির মাথায় চাটি দিয়ে চলে যায়। হা হয়ে থাকে দীপ্তি। দরজার কাছে গিয়ে পেছন ফিরে কুশল বলে ” জগিং এর ড্রেস আপ পরে চলে আসো। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ”

” ছাড়বো না আমি। গুনে গুনে শোধ নিবো। আমার সাথে ফাজলামি করার ফল কিন্তু খুব খারাপ। ”
.

” আর কতোক্ষন এই ফালতু দৌড় প্রতিযোগিতা করবো আমরা। ”

” এটা ফালতু দৌড় নয়। যুদ্ধের সময় এই দৌড় কাজে লাগে। নিজেকে বাঁচাতে কিংবা প্রতিপক্ষকে আ**ঘাত করতে। ”

” আমি আর পারছি না। ”

দীপ্তির সাথে সাথে কুশল ও থেমে যায়। হাঁটু তে দু হাত রেখে লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। ট্রেনিং এর সময় ও এমন অত্যাচার করা হয় নি। কুশল কে পাষান বলেই মনে হয়। দীপ্তির দিকে গুক্লোজ বারিয়ে দেয়। ঘাসের উপর বসে বলে ” মাত্র নয় বছর বয়সে আমি তলোয়ার ব্যবহার করতে শিখি। ভারী তলোয়ারের সাহায্যে আ*ঘাত করার মতো শক্তি তখনি অর্জন করি। এর কারন একটাই, আমার বাবা। তিনি তাঁর পূর্ব পুরুষের মর্যাদা ধরে রাখতেই আমাকে এই তলোয়ার শিক্ষা দান করেন। এই আধুনিক যুগে এটার প্রয়োজন নেই। তবে জমিদারি বলতে ও একটা কথা আছে। সেই বংশ ধর হওয়ার কারনে আমাকে ও এই শিক্ষা গ্রহন করতে হয় তাও নয় বছর বয়সেই। ”

” ওয়াও। আপনার হারে জোড় আছে বেশ। ”

মৃদু হাসে কুশল। বলে ” এখন উঠো। ”

” আবার কি? ”

” তলোয়ার ব্যবহার শিখবে। ”

” প্রয়োজন কি? রিভলভার ব্যবহার জানি তো। ”

” এক্সট্রা অর্ডিনারি হওয়ার জন্য শিখতে হবে। ”

” আশ্চর্য! এই জমিদার বংশের নিয়ম কানুনের তো শেষ নেই। ”

” আমার বংশের এক মাত্র সদস্য আমি। বাকি সবাই মৃ**ত। ”

কুশলের কথায় মন খারাপ হয়। হঠাৎ করেই রুমানার কথা মনে পরে। রন্ধে রন্ধে যেন শীতলতা নেমে আছে। ঘাস ধরে কেঁদে উঠে। কুশল বলে ” নিজেকে সামলাও। এভাবে দুর্বলতা প্রকাশ করে শত্রুকে শক্তিশালী করে দিও না। ”

” আম্মা কে বাঁচাতে পারলাম না আমরা। ”

” অনেক বছর কেঁটে গেছে দীপ্তি। মামুনি কোনো পাপ করে নি। ইজ্জত বাঁচাতে বেছে নিয়েছে আ**ত্মহ*ত্যা। ”

কুশলের হঠাৎ এমন কাঠখড় হওয়াতে অবাক ই হয় দীপ্তি। মানুষটা কোন ধাতু তে তৈরি? এমন অনুভূতিহীন কেন! নাকি বাইরেটা কোনো বিশেষ আদলে ঢাকা।

চির পরিচিত গ্রামে এসে থমকে যায় কুশলের উদ্বিগ্ন হৃদয়। বাতাসের গতি বেড়ে যায় কয়েক গুন। জমিদার বাড়ির আলোতে চকচকে দু খানা পাখি মেতে উঠে প্রেম সুখে। কি সুন্দর কলরবে মুখরিত পরিবেশ। নিজের ছোট বেলার সমস্ত স্মৃতি যেন চোখে ভাসে। দু আঁখি পল্লব বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। এখন যাওয়া প্রয়োজন। দীপ্তিকে একা রেখেই চলে এসেছে ওহ। জমিদার বাড়ির গতি পথ বড় কঠিন হয়ে আছে। নিজের প্রানের ভয়ে থমকে আছেন আনন্দ পাঠান। ঠিক থমকে নয় , তবে ভ**য়ে আছে। মানুষের ঘাম জড়ানো টাকা লুটে নিলে ভয় তো হবেই। মাথায় হেলমেট লাগিয়ে বাইক নিয়ে চলে আসে শহরে।

ঘরে এসে দীপ্তির রুমে উঁকি দেয় ছেলেটা। এই সুন্দর মুখাশ্রী বার বার বিমোহিত করে ওকে। কোথাও একটা প্রেমের আভাস মিলে। সারা জনম তাকিয়ে থাকার বাসনা জাগে। তবে নিজের অনুভূতি কে ব্যক্ত করা যাবে না। এখন শুধু একটাই লক্ষ্য প্রতিশোধ। নিজের জীবন বিপন্ন হয়ে আছে। দীপ্তিকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবে মেয়েটার গাঁয়ে কোনো আঁচ আসতে দিবে না। এমনি পাহাড় গড়েছে ছেলেটা।

নড়ে চড়ে উঠে দীপ্তি। তৎক্ষনাৎ সরে যায় কুশল। দীপ্তির ঘুম গাঢ় হলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আবারো নির্ঘুম রাত্রি কাটাবে ওহ। রঙ তুলি নিয়ে বসে। চিত্রে ফুঁটিয়ে তুলে মায়াময়ী দীপ্তির ঘুমন্ত মুখ। আহা এ যেন জীবন্ত মানবী।
.

কড়া রোদ্দুরে হেঁটে চলেছে। শীত কাল যেতে না যেতেই এমন গরমের তিক্ততায় যেন প্রাণ যায় যায়।কখন জ্বিহা বেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারে নি দীপ্তি। কিছুটা কার্টুনের মতোই হেঁটে চলেছে মেয়েটা। ফিক করে হেসে উঠে কুশল। যেই হাসি দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে দীপ্তি। নাকের পাটা ফুলিয়ে কাছে আসে। কুশলের হাসি যেন বন্ধ হবার নয়। পাশের স্তূপ করা বালু থেকে এক মুঠো বালি নিয়ে কুশলের গাঁয়ে ছুঁড়ে দেয়। ছেলেটার মুখ তখন দেখার মতো। তাতেই যেন গগন কাঁপানো হাসিতে মেতে উঠে দীপ্তি। কিছুটা রাগ হলে ও প্রকাশ করে না কুশল। এই মিষ্টি হাসির শব্দ শুনতে বেশ ভালোই লাগছে। দীপ্তির দুই বিনুনি ধরে হাঁটা লাগায়। মাথায় হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বলে ” ছাড়ুন , ব্যাথা পাচ্ছি। ”

” সুদর্শন পুরুষের দেওয়া ব্যাথা ও সুখ ময় হয় । ”

” নিজেকে সুদর্শন বলতে লজ্জা করে না? ”

” মিথ্যে হলে লজ্জা করতো। আমি নিশ্চয়ই সুদর্শন পুরুষ। তুমি নিজেই বলেছিলে। ”

” চোখের ব্যামো ছিলো আমার। ছাড়ুন এবার। ”

” এই দুই বেনুনির হেতু পাই না আমি। আশ্চর্য! ”

শ্বাস ফেলে কুশল। শার্ট ঝেরে হাঁটা লাগায়। দীপ্তির রেজাল্ট দিবে আজ। কিছুটা ভয় কাজ করছে। যদি ও পাস না করার চান্স নেই বললেই চলে। তবে রেজাল্ট এর টেনশন তো টেনশন ই হয়। মায়ের ইচ্ছে পূরনের জন্য পুরো পৃথিবী এলোমেলো করে দিবে দীপ্তি। রুমানার স্নেহ ময়ী হাতের স্পর্শ যেন এখনো গাঁয়ে লেগে আছে। চোখ ভিজে যায়। সৎ মা এতো আপন হয় কি করে?

” কান্না বন্ধ করো দীপ্তি। বারং বার নিজের দুর্বলতা কেন টেনে ধরো। নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাসী হও। মামুনি কি বলেছিলো মনে আছে? ”

দু দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো দীপ্তি। বলে
” সৎ অফিসার হতে। আর নিজের কাজের প্রতি বিশ্বাসী হতে ও সর্বদা অটল থাকতে। ”

” তাহলে এমন কেন করছো? ”

কথা বলে না দীপ্তি। কিছুটা অন্যমনস্ক হয় কুশল। দীপ্তিকে কাজের প্রতি অটল রাখতে হবে। কাজের প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি করতে হবে।

অফিস থেকে খবর আসে দীপ্তি সিলেক্ট হয়ে গেছে। চোখ দুটো কানায় কানায় পরিপূর্ন হয়। মুখে হাত গুঁজে কেঁদে উঠে। কুশল বারন করে না আর। এটা খুশির কান্না। এই আবেগের সাথে জড়িয়ে আছে কিছু স্বপ্ন, কিছু ভালোবাসা।

লেটার নিয়ে ছুটে আসে দীপ্তি । বুকে হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে কুশল। আচমকাই কুশলের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে মেয়েটা। ক্রন্দনরত অবস্থাতেই চিৎকার করে বলে
” আমি পেরেছি। আমি পেরেছি আম্মার স্বপ্ন সফল করতে। ”

চোখ ভিজে যায় কুশলের। বা হাতের তালু তে চোখ মুছে বলে ” শপথ গ্রহন করতে হবে এবার। যাও ”

মাথা ঝাঁকায় দীপ্তি। শপথ গ্রহনের জন্য দাঁড় করানো হয়। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বিপরীত পথে হাঁটা লাগায় কুশল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ” তোমার মেয়ে শপথ গ্রহনের সাথে সাথে আমার নিকট হতে দূরে চলে গেল মামুনি। ওর কাজ আর আমার কাজ ভিন্ন। আমি যে প্রাণহ*ন্ত। আমাকে যে খু*ন করতেই হবে। আর তোমার মেয়ে হবে আমার বিপরীতে। ওর হাত থেকেই হাতকড়া পরবো আমি। তবে কিছুতে ওর পেশাকে অসম্মান হতে দিবো না। তোমার স্বপ্ন কে ও অসম্মান করবো না। আমার জন্য দোয়া করো। ”

চলবে….
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here