#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_49
#Writer_TanhaTonu
দিনগুলো এভাবেই যেতে লাগল।সকালে ড্রাইভারের সাথে আরশি মেডিকেলে চলে যায়।আসতে আসতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে যায়।সিদ্রাত প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপরই চলে আসে।এসেই আরশির হাতের এক গ্লাস লেবুর শরবত খাওয়া ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।তারপর নিজ দায়িত্বে আরশিকে পড়াবে।আরশিও বেশ প্রফুল্ল মনেই পড়ে কারণ সিদ্রাতের পড়ানোর টাইপ অনেক দারুণ..একটুও এক ঘেয়েমি আসেনা।তারপর ডিনার করে আরও কিছুক্ষণ পড়ে কম্বলের নিচে ঢুকবে দুজন।ভিতরে ঢুকেই শুরু হয়ে যাবে দুজনের দুষ্টুমি-ফাজলামি।কোনোদিন সিদ্রাত আরশিকে সুড়সুড়ি দিয়ে কাঁদিয়ে ফেলে।আবার কোনোদিন আরশি সিদ্রাতকে সুড়সুড়ি দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলে।কারণ সিদ্রাত তো সিদ্রাতই…সে আরশির শরীরে যেখানে সেখানে মুখ ডুবিয়ে দিবে।ব্যাস আরশি তখন বরফের ন্যায় জমে যায়।এভাবে কল্পনারমতোই দিনগুলো কাটছে দুজনের…
__________________________________________
বিকালের শেষ আলোয় পরিবেশটা ঠান্ডা থাকার কথা হলেও ভ্যাপসা গরমে চারপাশটা গিজগিজ করছে।বারবার টিস্যু পেপার দিয়ে মুছেও কপালের ঘাম দূর করা যাচ্ছে না।তারপর আবার ঢাকা শহরের চির পরিচিত সেই জ্যাম যা আধা ঘন্টা যাবৎ তেজগাঁও রোডকে ব্লক করে রেখেছে।আরশি আবারও ঘাম মুছতে মুছতে মোবাইলে বিরক্তি নিয়ে টাইম দেখে নিলো।অলরেডি বিকাল পাঁচটা আট বেজে গিয়েছে।আজানই দিয়ে দিবে একটু পর।রাস্তা পুরো ক্লিয়ার থাকলেও এখন গুলশান যেতে আধা ঘন্টা লাগবে।অথচ জ্যাম ছুটার নামই নেই।খুব সম্ভবত হাফ কিলোমিটার রাস্তা ব্লক হয়ে আছে।আরশি বিরক্তি নিয়ে ড্রাইভারকে বলল…
—”আঙ্কেল আজ কি এই জ্যাম ছাড়বে?রাত দশটার মধ্যেও কি বাসায় যেতে পারব?”
ড্রাইভার সামনে থাকা কারগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল….
—”জ্যাম না থাকলে তো চোখের পলকেই বাসায় পোঁছে যাবো ম্যাডাম।কিন্তু এই জ্যাম কখন ছুটবে তা খোদাই ভালো জানেন”
আরশির ভিতর থেকে ফোস শুব্দ বের হয়ে এলো।প্রতিদিন গুলশান টু ডিএমসি আবার ডিএমসি টু গুলশান আসা-যাওয়ার পথে যে জ্যামের কারণে কি হ্যারেসমেন্ট হতে হয় তা আরশি এই একমাসে হারে হারে টের পাচ্ছে।ডিএমসি যাওয়ার পথে জ্যাম না থাকলেও আসার সময় সর্বনিম্ন হলেও এক ঘন্টার জ্যামে পড়তে হবে যদিও বেশিরভাগ দিনই তিন/চারঘন্টাও পেরিয়ে যায়।তখন আরশির ইচ্ছা করে হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে।মাঝে মাঝে মন চায় সুপার উইমেন হয়ে সবগুলো গাড়িকে উড়িয়ে দিতে।তারপর যখন নিজের অক্ষমতা বুঝতে পারে তখন সত্যিই কেঁদে দেয়।রাগে-দুঃখে আরশি এখনো কারে বসে আওয়াজ ছাড়া কাঁদছে আর সামনে আটকে থাকা সবগুলো কারের ড্রাইভারকে,সড়কমন্ত্রীকে, ডিএমসিকে এমনকি সিদ্রাতকেও মনে মনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে..এটাই তার গত একমাসের রুটিন।হঠাৎ ফোন বেজে উঠে।আরশি চোখটা মুছে ফোনের স্ক্রিনে তাকায় যেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম “সিদ্রু বেপি” আরশির রাগ যেনো আরও বেড়ে গেলো।ও দাঁত কিরমির দিয়ে ফোনটা রিসিভ করে সিদ্রাতকে কিছু বলতে না দিয়েই অকথ্য গাল শুরু করে দিলো….
—”ওই হারামি ফোন দিয়েছিস কেন?মজা দেখতে?আমি জ্যামে আটকে কেমন মজায় আছি তা দেখতে?হারামির বাপ হারামি..তোর জীবন আমি তেজপাতা বানামু।আমার জীবনটা শেষ।কুত্তার জ্যাম কি জীবনেও শেষ হবে না।কুত্তার জ্যাম..কুত্তার রাস্তা..তোর পোলাপাইনও কুত্তা… তোর বউও কুত্তা..তুইও কুত্তা..আমি মরে যাবোওওও…এএএএ..ভ্যাএএএএএ”
সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরশির মুখ বন্ধ হলে।আরশি শব্দ করে কেঁদে দিলো।সিদ্রাত আদুরে কন্ঠে বলল….
—”শান্ত হও সোনা।কান্না করো না।আমি তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি।আগে বাসায় আসো..দেখি একটা বিহিত করতে পারি কিনা”
আরশি এবার শান্ত হলো।তবুও নাক টানছে।সিদ্রাত আবারও বলল….
—”আজ কয়টা ক্লাস ছিলো?কোনো এক্সপেরিমেন্ট করেছো?”
আরশি নাক টেনে জবাব দিলো…
—”উহু..”
সিদ্রাত মুচকি হেসে বলল…
—”জানো আমি না দেখেও বুঝতে পারছি আমার পরীটাকে এখন একদম ইনোসেন্ট বাচ্চাদের মতো লাগছে..কিউটের ডিব্বা লাগছে।হেই বাই এনি চান্স..কেঁদে কেটে বাচ্চাদের মতোই আবার নাক-মুখ ভরিয়ে ফেলোনি তো নাকের ওগুলো দিয়ে?”
আরশি এবার ফিক করে হেসে দিলো।তারপর বলল….
—”আপনি খুব খুব খুব পাজি..এতো পাজি হওয়া ঠিক না বলে দিলাম”
সিদ্রাত ঠোঁট কামড়ে হেসে বল…
—”কেন নেক্সট জেনারেশন আরও আপডেট হবে তা নিয়ে চিন্তিত নাকি?অবশ্য আমার জিনই তো বহন করবে..উফফ আ’ম এক্সাইটেড..এই আরশি এই..মিরাক্যালি তিন/চার বছর গায়েব হয়ে যেতো!তারপর একদিন দেখতাম তোমার পেটটা ইয়া ফুলা!ওহহো..হাও ইন্ট্রেস্টিং!”
আরশির গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।ও লজ্জামিশ্রিত মৃদু কন্ঠে বলল…
—”ধ্যাত পাজি..”
—”ম্যাডাম নামুন..এসে পড়েছি”
আরশি ড্রাইভারের কথায় চমকে গেলো।আশেপাশে তাকিয়ে যা বুঝল তা হলো ও এখন বাসার সামনে আছে।আরশি হতবাক হয়ে গেলো।পরক্ষণেই চিল্লিয়ে উঠল…
—”ড্রাইভার আঙ্কেলল???এতো তাড়াতাড়ি বাসায় আসলাম কীভাবে?একটু আগে না জ্যাম ছিলো রাস্তায়!”
ড্রাইভার হেসে বলল…
—” না ম্যাডাম..আপনি প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে স্যারের সাথে কথা বলছেন।আরও আধা ঘন্টা আগেই জ্যাম ছেড়েছে…”
আরশি বেশ ক্ষানিকটা পুলকিত হলো।তারপর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল সিদ্রাত এখনো লাইনে।আরশি মুচকি হেসে ফোনটা কেটে বাসার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।নিজের রুমে গিয়ে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে সিদ্রাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।
সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির দুহাতের উপর নিজের দু’হাত রাখল।আরশি ক্লান্তস্বরে ফিসফিস করে বলল…
—”জানেন আমার না খুব কষ্ট হয় প্রতিদিন আসার সময় ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকতে।আপনি তো জানেন আমি এমনিতেই জার্নি করতে পারিনা…”
আরশি এটুকু বলে শরীরের ভরটা সিদ্রাতের পিঠের উপর ছেড়ে দিলো।সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির দিকে ঘুরে আরশিকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো।ক্লান্তিতে আরশির চোখদুটো বুঝে এলো।নিশ্বাসগুলো ভারী হয়ে গেলো আর শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে এলো।সিদ্রাত আরশিকে পাজোকোলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো।তারপর একটু উঁচু করে হোয়াইট এপ্রোনটা খুলে দিলো।চুলগুলোও খুলে দিলো।ক্লান্তিটা একদম স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে মেয়েটার চোখে-মুখে।সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশির কপালে ডিপলি কিস করল।তারপর নিজেই মেয়েটাকে উঁচু করে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো।সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় শাওয়ারের চিন্তা বাদ দিয়ে পুরো শরীরটা মুছিয়ে দিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে দিলো।তবে মাথায় দুমগ পানি ঢালল কারণ তালুটা প্রচন্ড গরম ছিলো।তারপর চুলগুলো মুছে দিয়ে আবারও বেডে এনে শুইয়ে দিলো।ঘুমন্ত মুখটা কতইনা স্নিগ্ধ লাগছে!সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির ঠোঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে লাইটটা অফ করে দিয়ে চলে গেলো…
——————–
আরশির ঘুম ভাঙতেই দেখল ওর শরীরে একটা কম্ফোর্টার জড়ানো।হসপিটাল থেকে আসার সময় শরীরটা নিস্তেজ লাগলেও এখন অনেকটাই স্নিগ্ধ লাগছে।আরশি উঠে বসতেই দেখল ওর শরীরে একটা পাতলা ফতুয়া আর প্লাজো জড়ানো।চুলগুলোও ভেজা।কাজগুলো সব সিদ্রাতের বুঝতেই লজ্জায় আরশির গাল দুটো গরম হয়ে গেলো।তারপর মেয়েটা উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে চুলগুলো আচরে নিলো।তখনই সিদ্রাত আর ওর আব্বু-আম্মু প্রবেশ করল।আরশি তা দেখে মাথায় উড়না টেনে নিলো সেই সাথে অবাকও হলো সবাইকে একসাথে দেখে।আরশি গিয়ে সিদ্রাতের আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি গলায় বলল…
—”আম্মু আজ কিন্তু আমি তোমার হাতে ভাত খাবো হুম?আজ আমি অনেক উইক”
সিদ্রাতের আম্মুর চোখ দুটো কেন যেনো ভরে আাসল।সিদ্রাতের আব্বু থমথমে গলায় বলল…
—”আরশি তোমার ব্যাপারে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আশা করি তুমি আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে”.
সিদ্রাতের আব্বুর এমন থমথমে কন্ঠ শুনে আরশি কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হলো।মনের ভিতর কেমন যেনো করতে লাগল।আড়চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে দেখল সিদ্রাতের ফেইসটা ফ্যাকাসে।আরশি একটা ঢোক গিলল….
চলবে…
প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_50
#Writer_TanhaTonu
সিদ্রাতের আব্বু থমথমে গলায় বলল…
—”আরশি তোমার ব্যাপারে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আশা করি তুমি আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করবে”.
সিদ্রাতের আব্বুর এমন থমথমে কন্ঠ শুনে আরশি কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হলো।মনের ভিতর কেমন যেনো করতে লাগল।আড়চোখে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে দেখল সিদ্রাতের ফেইসটা ফ্যাকাসে।আরশি একটা ঢোক গিলল….
__________________________________
সিদ্রাতের আব্বু সোফায় গিয়ে বসল।তারপর ইশারায় আরশি আর সিদ্রাতকেও বসতে বলল।সিদ্রাত বেডে বসল আর আরশি সোফায় বসল সিদ্রাতের আব্বুর পাশে।সিদ্রাতের আব্বু বলল…
—”চোখ-মুখ একদম শুকিয়ে গিয়েছে তোমার।খাওয়া-দাওয়া কি করো না?”
আরশি জিহবা দিয়ে ঠোঁটজোরা ভিজিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলে…
—”আব্বু খাই তো ঠিকমতো”
—”তাহলে শরীরের এই অবস্থা কেন?লোকে দেখলে তো বলবে আমরা বোধয় তোমার উপর টরচার করি”
আরশি চমকে সিদ্রাতের আব্বুর দিকে তাকালো আর বলতে লাগল..
—”ছি ছি আব্বু এসব কি বলছো?তোমাদের মতো পরিবার পাওয়া প্রতিটি মেয়ের স্বপ্ন।আর আমি ভাগ্যবান বলেই তো তোমাদেরকে পেয়েছি।একদম উল্টা-পাল্টা বলবা না।তোমরা আমার নিজের বাবা-মার থেকে কোনো অংশে কম নও”
সিদ্রাতের আব্বু মুচকি হাসে।তারপর বলে…
—”তাহলে এই বাবাটার কথা অমান্য করবে না তো?”
আরশির কলিজায় যেনো কামড় লাগল।তারপরও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল আর ডানে-বামে মাথা নাড়ালো।সিদ্রাতের আব্বু আবারও বলতে লাগল…
—”প্রতিদিন গুলশান থেকে শাহবাগ যাওয়া-আসা তোমার উপর রীতিমতো জুলুম হয়ে যাচ্ছে তা আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।এটা ঠিক যে আরও দূর থেকেও মানুষ সেখানে গিয়ে পড়ছে।বাট তুমি যেহেতু একদমই জার্নি করতে পারো না তাই ব্যাপারটা সিরিয়াস।তাও জ্যাম না থাকলে তেমন প্রবলেম ছিলো।কিন্তু আসার সময় যে জ্যামটা টলারেট করতে হয় সেটা সত্যিই ইনটলারেবল।আজই তো তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে।ডক্টর তো প্রেশার মেপে দেখে ৪৫/৬০..এভাবে চলতে থাকলে খুব বড় কিছু হয়ে যাবে…”
আরশি অবাক হয়ে বলে…
—”আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম?আবার ডক্টরও এসেছিলো?”
সিদ্রাতের আব্বু মুচকি হাসল।তারপর বলল…
—”হুম মামনী তুমি সেন্সলেস হয়েছিলে।তুমি বাসায় আসার প্রায় চল্লিশ মিনিট পরই সিদ্রাত গিয়ে ডক্টর আনে।আচ্ছা যাই হোক..আমি ডিসিশন নিয়েছি যে তুমি পড়াশুনাটা শাহবাগ থেকেই কমপ্লিট করো..আমি কি বলতে চাচ্ছি বুঝেছে তো..আগামীকালই শাহবাগ শিফট হবে”
আরশির মাথায় যেনো বাজ পড়ল।ও চিৎকার করে উঠল…
—”কিইহহ?আব্বু এসব কি বলছ তুমি?এটা একদমই পসিবল না।তোমাদের সবাইকে ছেড়ে তিনটা বছর কাটিয়েছি।আমি আর কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইনা।আমি এখান থেকেই প্রতিদিন মেডিকেলে যাবো।কিছু হবে না আমার।তবুও প্লিজ আমায় দূরে সরিয়ে দিওনা তোমাদের থেকে”
আরশি কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে দিলো।ওদিকে সিদ্রাতের আম্মুও উড়না দিয়ে চোখ মুছছে আর সিদ্রাতের ফেইস একদম ফ্যাকাশে।সিদ্রাতের আব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলল…
—”আহা মামনী!বাচ্চামো করলে হবে না তো।আর কে বলেছে আমরা তোমায় দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছি?প্রতি বৃ্হস্পতিবার বিকালে বাসায় চলে আসবে।শুক্রবারে আমাদের সাথে থেকে একবারে শনিবার এখান থেকে মেডিকেলে যাবে।দেখলে তো আমাদের সাথে তিনদিন থাকা হচ্ছে।আর তোমার সাথে তো সিদ্রাতও যাবে।এতোদিন তুমি আর নুসাইফা যে বাড়িটায় থাকতে সেটা সিদ্রাতের নিজের টাকায় করা বাড়ি।তোমরা দুজন ও বাড়িতেই থাকবে।ওখানেই শিফট হবে দুজন আর আগামীকালই”
আরশি এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে বলল…
—”আমি কোথাও যাবো না..কোথাও না।তোমরা দুজনও চলো তাহলেই যাবো আর নাহলে যাবো না।আমি থাকতে পারব না তোমাদেরকে ছাড়া”
আরশি কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো।সিদ্রাতের আব্বু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তারপর শক্ত গলায় বলল….
—”আমি এসব কিছুই শুনতে চাইনা।আমি এবাড়ির কর্তা..আমার ডিসিশনই শেষ ডিসিশন।আগামীকাল মেডেকেলে যাবার প্রয়োজন নেই।দুজন আগামীকাল ও বাড়িতে উঠবে আর সবকিছু নিজেদের মতো সাজিয়ে নিবে।এর যেনো নড়বড় না হয়”
সিদ্রাতের আব্বু কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ালেন।তারপর আর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।আরশি দৌড়ে গিয়ে ওর শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।সিদ্রাতের আম্মু আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আর চেষ্টা করল শান্ত করতে।আরশি কিছুটা শান্ত হলে তিনিও চলে গেলেন।আরশি বেডে উঠে একদম কোণায় গিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল।সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড থেকে উঠে রুমটা লক করে নিলো।লাইট অফ করে আরশির পাশে গিয়ে শুয়ে ওকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরল।সিদ্রাতের স্পর্শ পেয়ে আরশি যেনো আরও গলে গেলো।জোরে জোরে শব্দ করে কাঁদতে লাগল।সিদ্রাত আরশিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল।আরশিও সিদ্রাতকে জড়িয়ে ধরে সিদ্রাতের বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে।সিদ্রাতও আরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।কষ্ট যে তারও হচ্ছে।প্রিয় বাবা-মাকে ছেড়ে এতগুলো দিন থাকতে হবে ভেবেই সিদ্রাতের কলিজায় মোচড় মারে।তবুও নিজেকে সামলে নেয়।শক্ত করে তুলে নিজেকে…এটাই হয়ত পুরুষদের জীবন যেখানে কষ্টগুলো কখনো কারও সাথে শেয়ার করা হয়ে উঠে না।কষ্ট বুকে নিয়েই দুজনের রাতটা কেটে যায়….
পরের দিন সবাইকে ছেড়ে আসার সময় আরশির যে কি কান্না!হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা দুই মাকে জড়িয়ে ধরে যেনো বিয়ের কনে বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।সিদ্রাত অনেক কষ্টে আরশিকে থামায়।তারপর নিজে গিয়ে ওর বাবা-মাকে টাইটলি হাগ করে।সিদ্রাতের আম্মু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর আব্বু বলে…
—”দুজনের টোনাটুনি সংসারটা সামলে রেখো।নিজেদের বোঝাপড়াটা যেনো হাই লেভেলের হয়।একটু ঝড়ো বাতাসেই যেনো তা নড়বড়ে হয়ে না যায়।আরশি ছোট..ওর পুরো দায়িত্ব তোমার।আশা করি কখনো কোনো অভিযোগ আমার কানে আসবে না তোমাদের দুজনের বিরুদ্ধে।কখনো মনোমালিন্য হলে নিজেদের মধ্যেই আবার তা মিটিয়ে নিবে”
সিদ্রাত আর আরশি মাথা নিচু করে সম্মতি জানায়।সবার থেকে বিদায় নিয়ে দুজন রওনা দেয় শাহবাগের উদ্দেশ্যে।দেড় ঘন্টার মধ্যেই এসে পৌঁছেও যায়।সিদ্রাত আরশিকে বলে…
_”উপরের ডানদিকের একবারে কর্ণারের রুমটা আমাদের।গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও”
—”আপনি ফ্রেশ হবেন না?”
—”হুম হবো।তার আগে খাবারের ব্যবস্থাও তো করতে হবে।দুপুরে কি খাবে?”
আরশি সিদ্রাতের কথার জবাবে বলে…
—”চলুন আমার সাথে উপরে।রান্না আমি করব..এখন আগে ফ্রেশ হবেন”
—”কিন্তুউ,,”
আরশি চোখ পাকিয়ে তাকাল।সিদ্রাত নিশ্বাস ফেলে বলল…
—”আচ্ছা চলো উপরে..আগে ফ্রেশ হই”
আরশি মৃদু হাসল।সিদ্রাত রুমের সামনে এসে দরজা খুলতেই আরশি অবাক হলো।আর পাঁচটা রুম থেকে একবারেই ভিন্ন রুমটা।খুবই বড়..বলা যায় বিশাল ময়দান।দরজা বরাবর বিপরীত পাশে থাই লাগানো বিশাল বারান্দা।রুমের বামদিকে দেয়ালের সাথে লাগোয়া বড় একটা অফ হোয়াইট কালার বেড, বেডের পাশে আধুনিক ডিজাইনের হোয়াইট আর ব্ল্যাকের কম্বিনেশনের ড্রেসিং টেবিল।বামসাইডের দেয়ালে বড় একটা সোফা আর পাশে ছোট্ট একটা ওয়াল ক্যাবিনেট,রুমের আরেকপাশে ফ্লোর থেকে রুফ পর্যন্ত লাগোয়া বিশাল একটা আলমারি,আলমারির পাশে খালি জায়গায়টায় একটা বড় ফুলদানিতে বিভিন্ন কালারের আর্টিফিশিয়াল ফুল…এছাড়া দেয়ালগুলোও বিভিন্ন ফ্লাওয়ারের ডিজাইনে ডিজাইন করা।আরশি হা হয়ে সব দেখল।তারপর বলল…
—”এতো সুন্দর রুমটা!এজন্যই এই রুমটা লক করা থাকত তাইনা?নুসু কখনো আমায় এ রুমে ঢুকতে দিতো না”
সিদ্রাত হালকা হেসে বলে…
—”আমার রুমে প্রবেশ নিষেধ ছিলো।কিন্তু এখন তো এ রুম সহ রুমের মালিকেরও মালকিন তুমি”
আরশি মুচকি হাসল।তারপর দুজন রুমে প্রবেশ করল।আগে আরশি গিয়ে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে।সিদ্রাত আরশির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো।আরশি চুলগুলো ভালো করে মুছেই কাজে নেমে গেলো….
আগে ট্রলি ব্যাগ থেকে সব জামা-কাপড় বের করে ভাজে ভাজে কাবার্ডে রাখল।তারপর গেলো কিচেনে…অল্পের ভিতরে শুধু ভাত বসালো আর ইলিশ মাছ ভাজি করল।কারণ অলরেডি দুপুর হয়ে গিয়েছে।একটা ছাব্বিশ বাজে।বেশি কিছু করতে গেলে লেইট হয়ে যাবে।এমনিই সিদ্রাত সকালে তেমন কিছু খায়নি।হঠাৎ আরশির মাথায় আসল সালাদের কথা।ভাত হতে হতে সালাদ করলে মন্দ হয় না।যেই ভাবনা সেই কাজ…
আরশি তাড়াতাড়ি ব্লেন্ডার বের করে তাতে ধনে পাতা,পুদিনা পাতা,টক দই একসাথে ব্লেন্ড করে নিলো।তারপর একটা বাটিতে এক কাপ শসা কুচি,হাফ কাপ টমেট কুচি নিয়ে তাতে ওয়ান ফোর্থ চা চামচ বিট লবণ,হাফ চা চামচ ভাজা জিরার গুড়ো,লবণ,হাফ চা চামচ চিনি,ওয়ান ফোর্থ চা চামচ গোল মরিচের গুঁড়ো, পিঁয়াজ কুচি আর ব্লেন্ড করে রাখা মিশ্রণ নিয়ে সব একসাথে মিশিয়ে তৈরি করে নিলো সালাদ “রায়তা”।এর মধ্যেই ভাতও হয়ে গেলো।সবকিছু গুঁছিয়ে টেবিলে সাজিয়ে আরশি আবারও রুমে আসল।দেখল সিদ্রাত রুমে নেই।ওয়াশরুমের দরজাও খোলা।আরশি ভ্রু কুচকে বারান্দার দিকে যেতে নিলেই কেউ পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরল।আরশি ভয়ে লাফ দিয়ে উঠল।পরে সিদ্রাত বুঝতে পেরে হাতের কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলল…
—”এসব কি হুম?এভাবে কেউ কাউকে ভয় দেখায়?আমি কতটা ভয় পেয়েছি জানেন?”
সিদ্রাত মুচকি হেসে আরশির ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো।আরশির শরীর কেঁপে উঠল।সিদ্রাত মাতাল করা কন্ঠে বলল…
—এই পিচ্ছিটা যে এতো ভয় পায় তা তো জানতাম না।কবে থেকে এতো ভয় পাও?”
আরশি মুখ দিয়ে কিছুই বলতে পারছে না।একদম স্ট্যাচু হয়ে গিয়েছে।সিদ্রাতের উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় আরশির ঘাড় ছেড়ে পিঠে নেমে এলো।আরশি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল….
—”কি,,কর,,ছেন?”
—”হুশশ,,চুপ!আদর করছি”
নেশাধরা কন্ঠেই সিদ্রাত জবাব দিলো।আরশি চোখ-মুখে খিচে বন্ধ রাখল।তখনই সিদ্রাতের ফোন বেজে উঠল।সিদ্রাত হুশে ফিরে আসল ফোনের আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে ফোনের দিকে তাকালো।আরশিও ঠোঁট টিপে হেসে ফোনের দিকে তাকালো যেখানে একটা মেয়ের নাম জ্বলজ্বল করছে… “ইশা”
চলবে….
গল্পটা কালকেই লিখেছিলাম।পোস্ট করার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলাম না।তার আগেই দাদীর মৃত্যুর খবর চলে এলো।আজও পোস্ট করার মতো অবস্থায় ছিলাম না।একটু আগে জুলিয়া আপু একটা কমেন্ট দেখালো।কিছুটা রাগ আর কিছুটা কষ্ট থেকেই পোস্ট করলাম
এতদিন মোনাজাতে দোয়া করেছি “আল্লাহ আমার নানা আর দাদাকে তুমি জান্নাত দান করো।তাদের কবরের আজাব মাফ করে দিও।তাদের কবরের সামনে জান্নাতের একটা দরজা খুলে দিও।”কিন্তু এখন থেকে আরও একটা নাম যোগ হলো এই দোয়া’তে
” দাদী”..এখন থেকে দোয়াটা হবে “আল্লাহ আমার নানা,দাদা আর দাদীকে জান্নাত দান করো।তাদের কবরের আজাব মাফ করে দিও।তাদের কবরের সামনে জান্নাতের একটা দরজা খুলে দিও।”
আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করি যেনো কখনো কাউকে ক্যান্সার রোগটা না দেয়।চোখের নিমিষে মোটা-তাজা একজন মানুষকে কঙ্কালে পরিণত করে দেয় এই রোগটা আর সাথে তো আছেই যন্ত্রণাময় ব্যথা।কান্না চলে আসে মনে পড়লে যে বুড়ো দাদীটা আমার কিভাবে চিৎকার করত ব্যথায়।এমএসএল-এর মতো ওষুধেও কোনো কাজ করত না।আল্লাহ যেনো কাউকে ভুগিয়ে মৃত্যু না দেয়;অন্তত বুড়ো মানুষগুলোকে কে না।
আমার দাদী একটা কথা বলত —”সময় থাকতে পথ ধরিও,,না করিও দেরি,,,কখন জানি বেজে যায় মওতের ঘড়ি”
আসলেই এখনি পথ ধরার সময়।কবর আমাদেরকে দিনে সত্তরবার স্মরণ করে।
বেশি না..সাতবারও যদি আমরা কবরকে স্মরণ করি তাহলে পাপ আমাদেরকে অনেকটাই ছেড়ে দিবে।য়