প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৭০+৭১+শেষ

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_70_71(Last)
#Writer_TanhaTonu

#Part_70
মেসবাহ মারিয়ামের কথার জবাব দিতে পারল না।চুপসে গেলো ওর মুখটা।কিছুক্ষণ উশখুশ করে বেরিয়ে গেলো মারিয়ামের চ্যাম্বার থেকে।মারিয়ামের দু’চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল।ও ডান হাতের তালু দিয়ে চোখটা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলল….

—”কাঁটাই যদি না থাকে তাহলে পায়ে বিঁধবে কি?কাঁটাই আমি উপড়ে ফেলব।আমার পথের কাঁটা!চোখের বালি আমার তুমি আরশি!”
____________________________________

ওটির সামনে ছন্নছাড়াভাবে হাঁটছে সিদ্রাত।বুকটা কেমন যেনো খালি খালি লাগছে।একটা ভয়ানক অনুভূতি চেপে আছে বুকটায়।প্রতিটা সেকেন্ডও যেনো এখন হাজার বছরের সমান লাগছে…
আরশির পরিবার আর সিদ্রাতের পরিবারও আছে এখানে।সবার একই অবস্থা।ভয়ে আরশির আম্মু দুই-দুইবার সেন্স হারিয়েছে।একটা মাত্র কলিজার টুকরো মেয়ে তাদের।সুস্থভাবে যেনো ওটির ভিতর থেকে ফিরে আসতে পারে এই প্রার্থনাই জপ করছে সবার মনপাখিটা।সিদ্রাত দেয়ালের সাথে লাগানো একটা সিটে বসে পড়ল।দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল।ছেলেটার চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।সিদ্রাতের আব্বু পাশে বসে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন।সিদ্রাত অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো ওর আব্বুর দিকে।সিদ্রাতের আব্বু বলল….

—”এতো ঘাবড়িও না।এটা একটা ছোট্ট অপারেশন।অহরহ মানুষ করাচ্ছে জরায়ুর অপারেশন।ইনশা আল্লাহ কিছু হবে না আমাদের আরশির…”

সিদ্রাতের কথাগুলো ওর গলায় আটকে আছে।কিছু বলতে গেলেই বুঝি কান্নার সহিত সেগুলো বেরিয়ে আসবে।সিদ্রাত ওর আব্বুকে জড়িয়ে ধরল।ধরা গলায় বলল…
—”আমার আরশির কিছু হবে না আমি বিশ্বাস করি।কিন্তু মনের কি করব আব্বু?সে যে মানতেই চাচ্ছে না।প্রতি মূহুর্তে অবচেতন মন বলছে কিছু হয়ে যাবে না তো?”

আশরাফ আজওয়াদ দীর্ঘ ছাড়লেন।তিনি বুঝতে পারছেন তার ছেলের ভিতর দিয়ে এই মূহুর্তে কি ঝড় যাচ্ছে।কতই না অদ্ভুত এই ভালোবাসা!পাথরের মতো শক্ত মনের মানুষকেও পাবলিক প্লেসে কাঁদিয়ে ক্ষান্ত হয়।পৃথিবীর বেশিরভাগ নিয়ম ভঙ্গের পেছনেও এই ভালোবাসাই দায়ী।ভালোবাসা কি আর নিয়ম,বাঁধা মানে!যুগে যুগে, শতাব্দী থেকে শতাব্দীতে কত অসম্ভবই না সম্ভব করল এই ভালোবাসা!

ওটির দরজা খুলে উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের একজন মহিলা ডক্টর বেরিয়ে এলেন।সিদ্রাত গিয়ে জিজ্ঞাসা করল..
—”প্যাশেন্টের কি অবস্থা ম্যাম?”
—”শি ইজ ওকে নাও।বাট আমার কিছু কথা আছে।প্লিজ চ্যাম্বারে আসুন”

সিদ্রাতের কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল।তবুও ও শুক্রিয়া জানালো যে আরশি ভালো আছে…

আরশিকে ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে।ও এখনো ঘুমোচ্ছে।সিদ্রাত ছাড়া আর কেউ নেই ভিতরে।ডক্টরের চ্যাম্বার থেকে অনেক্ষণ আগেই ও এসেছে।সবাই আরশিকে দেখে আবারও বাইরে চলে গিয়েছে।সিদ্রাত আরশির পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে।মনটা তার বড্ড উদাস আজ।প্রিয়তমা স্ত্রীকে ফিরে পেয়েছে..তার কোনো ক্ষতি হয়নি এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু আছে নাকি!কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও যে সিদ্রাতের মনে একটু একটু বিষণ্ণতা দানা বাঁধছে।বাবা না হতে পারার কষ্টটা সে কাকে বুঝাবে!কাকে দেখাবে তার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে যখন থেকে ডক্টর মারিয়াম বলেছে তার প্রিয়তমা তাকে বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারবে না।কখনো সে ছোট ছোট হাত-পা,চিকন আঙুলগুলো নিয়ে খেলতে পারবে না।কখনো নরম তুলতুলে একটা শরীর বুকে জড়িয়ে ধরে তৃপ্তির সাথে বলতে পারবে না ‘আমার অংশ,আমাদের দুজনার ভালোবাসার ফসল’ সিদ্রাতের বুকটা যেনো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশির কপালে চুমু খেলো।ধীর কন্ঠে বলল….

—”তুমিই আমার সব প্রিয়তমা।তুমি আছো..এটাই যথেষ্ট আমার জন্য।আমার প্রাণের অস্তিত্ব তুমি..আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় তুমি প্রিয়তমা।আমার আর কিছু চাইনা…”

এক সপ্তাহ পর…

—”সিহু সোনা…এতো দুষ্টুমি করো কেন তুমি?আম্মুর কষ্ট হয়না বারবার তোমাকে ক্লিন করে দিতে? আম্মু তো যে সিক তা কি বুঝে না আমার সিহু”

আরশি বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে সিহুর চুল আচড়ে দিতে দিতে বলল কথাটা।সিহু টলমল চোখে তাকালো আরশির দিকে।আরশি সিহুর গালে চুমু দিয়ে হেসে বলল….
—”এই একখান মায়াভরা মুখ দিয়েই আমায় পারেন কাবু করতে।থাক আর মুখ বানানো লাগবে না।আমার পাশে লক্ষী মেয়ের মতো শুয়ে পড়ো এবার…”

সিহু ফোকলা দাঁতে একটু হেসে আরশির গালে চুমু খেলো।তারপর আরশির পাশে শুয়ে ওর উপর আস্তে করে হাত রাখল।সিদ্রাত টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।বেডের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।তারপর আরশির দিকে তাকিয়ে বলল….

—”কি অবস্থা এখন?শরীর কেমন লাগে?”

আরশি মুখ ফুলিয়ে বলল….
—”আর কত শুয়ে-বসে কাটাবো আমি?আপনি আমায় একটু নড়তেও দিন না…”

—”মাত্র এক সপ্তাহ হয়েছে তোমার অপারেশন।এখনো সেলাই-ই খুলা হয়নি আর তুমি এটা-সেটা করতে চাও?ইম্পসিবল… ”

আরশি ভেঙচি কাটল।সিদ্রাত হালকা হাসল।কাবার্ড থেকে একটা টিশার্ট বের করে সেটা পড়ে লেপ্টপ নিয়ে বেডে গিয়ে বসল।আরশি বলল….

—”এখন আবার কি কাজ করবেন?”
—”কাজের অভাব আছে?আজ অফিসে যাইনি।এট ফার্স্ট খোঁজ নেই কি অবস্থা সেখানকার..”

সিদ্রাত এটা বলেই লেপ্টপে মন দিলো।আরশির ভেতর থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস বেরিয়ে এলো।ও আবারও বলল….
—”এতো পরিশ্রম করেন..একটুও ক্লান্ত লাগে না?ইচ্ছা করে না সবকিছু ফেলে মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে যেখানে কোনো কাজের চাপ থাকবে না,থাকবে না কোনো চিন্তা…”

সিদ্রাত কাজ করতে করতেই মৃদু হেসে বলতে লাগল…

—”একটা কথা অলওয়েজ মনে রাখবে..দেয়ার’স নো শর্টকাট ওয়ে অফ সাকসেস।অল্প পরিশ্রম করে তুমি সফল হতে চাও?তাহলে আমি বলব ইট’স টোট্যালি ইম্পসিবল..জাস্ট ইম্পসিবল।আজ আমাদের কোম্পানি দেশ পেরিয়ে বিদেশেও সুনাম অর্জন করেছে।পৃথিবীর ১৪৭টা দেশে আমাদের প্রোডাক্টস সেল হয়…কত বড় পাওয়া এটা তুমি ভাবতে পারবে না।আর রইল মুক্ত পরিবেশ..শান্তির নীড়!আমার শান্তি তো আল্লাহ তোমার মাঝেই দিয়ে দিয়েছে।সারাদিন এতোকিছু সামলে যখন রাতে বাসায় এসে তোমার কোলে মাথা রাখি তখন বিশ্বাস করো…মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই…”

আরশি মুচকি হাসল সিদ্রাতের কথায়।মানুষটা এতো সুন্দর করে অল্প ভাষায় মনের কথাগুলো যখন প্রকাশ করে তখন হৃদয়ে প্রশান্তির স্রোত বয়ে যায়।আরশি মৃদু কন্ঠে বলল…
—”আমায় একটু আপনার বুকে মাথা রাখতে দিবেন?খুব ইচ্ছা করছে…”

সিদ্রাত সরু চোখে আরশির দিকে তাকায়।লেপ্টপটা রেখে আরশির পাশে এসে বসে আরশির মাথাটা নিজের বুকে নেয়।আরশি এক হাত দিয়ে সিদ্রাত জড়িয়ে ধরে পরম শান্তির একটা নিশ্বাস ফেলে।সিদ্রাতও আরশিকে জড়িয়ে ধরে বলে….

—”এই বুকের মালিক তো তুমিই ম্যাডাম।এর জন্য পার্মিশন লাগে?”

আরশি সিদ্রাতের বুকে মুখ গুজে আদুরী কন্ঠে বলে…
—”আমি তো আর নড়তে পারি না।নাহলে আপনার থেকে পার্মিশন নিতে বয়েই গিয়েছে আমার..হুহ”

সিদ্রাত মৃদু শব্দে হাসল।আরশিও হালকা হাসল।পরক্ষণেই কালো মেঘের আবরণে ছেয়ে গেলো আরশির মুখখানি।ও মলিন কন্ঠে বলল….

—”আপনি আমায় এতো ভালো কেন বাসেন?আমি তো আপনাকে কখনোই সুখ দিতে পারব না।বাবা হওয়ার সুখই যে আমি কেড়ে নিয়েছি”

আরশি মুখ তুলে অসহায়ভাবে সিদ্রাতের দিকে তাকালো।আরশির কথা শুনে সিদ্রাতের বুকে কামড় লাগল।ও আতঙ্কিত নয়নে তাকালো আরশির দিকে…
—”এসব,,কে বলেছে,,তোমায়?”

—”আপনি চাইলেও এতো বড় সত্য আমার থেকে লুকাতে পারবেন না।ডক্টর মারিয়াম ফোন দিয়ে আমায় সব বলেছে…”

আরশি আবারও সিদ্রাতের বুকে মুখ গুঁজল আর ডুকরে কেঁদে উঠল।সিদ্রাত আরশিকে নিজের বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে বলল…

—”আল্লাহ যা উত্তম মনে করেন তিনি আমাদের তা-ই দান করবেন।হতাশ হওয়া চলবে না সোনা।আর জানো তো আল্লাহ সবরকারীদেরকে ভালোবাসে”

আরশি সিদ্রাতের কথায় কর্ণপাতই করল না।ও কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল…
—”আপনি আরেকটা বিয়ে করুন সিদ্রাত।আমি আপনাকে আপনার প্রাপ্য সুখ দিতে ব্যর্থ।আমি একজন অপূর্ণ নারী।আপনি নতুন করে আপনার জীবন শুরু ক,,,”

আরশি আর বলতে পারল না কিছু।হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।প্রাণপ্রিয় স্বামীকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া কি এতোই সহজ!কথাগুলো বলার সময় আরশির মনে হচ্ছিলো ভোতা ছুরি দিয়ে কেউ বারবার কলিজায় আঘাত করছে।কি ভীষণ যন্ত্রণা!

সিদ্রাত রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো আরশির দিকে।গম্ভীর কন্ঠে বলল…
—”মেনে নিতে পারবে যখন তোমার সামনে অন্য কোনো মেয়েকে আমি ভালোবাসব?কপালে ভালোবাসার ছোঁয়া দিবো?মেনে নিতে পারবে যখন দেখবে ভোরে অন্য একটা মেয়ে তোমার স্বামীর রুম থেকে ভেজা চুলে বের হচ্ছে?মেনে নিতে পারবে তো যখন দেখবে অন্য কোনো নারীর সন্তান তোমার স্বামীকে বাবা বলে ডাকছে?পারবে মেনে নিতে?কি হলো বলো?”

আরশির কান্নার আওয়াজ আরও বেড়ে গেলো সিদ্রাতের কথা শুনে।কখনোই যে এই যন্ত্রণা মেনে নেওয়া সম্ভব না..অসম্ভব…
—”আমি আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না..মরে যাবো আমি,,একদম শেষ হয়ে যাবো।কি,,ন্তু,, আমার জন্য,, আপনার জীবন,,নষ্ট,,”

—”শশশ…আর কোনো কথা না।যদি আর একদিন এসব উল্টা-পাল্টা কথা বলো..গড সোয়্যার… আমি উল্টা-পাল্টা কিছু একটা করে ফেলব..”

আরশি সিদ্রাতের এমন হুমকি শুনে সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলো।করুণ দৃষ্টিতে সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে রইল।সিদ্রাত মুখ ফিরিয়ে নিলো।আরশি ফুঁপাতে ফুঁপাতে সিদ্রাতের বুকে মুখ গুঁজল।সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।আরশির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল….

—”আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।উল্টা-পাল্টা কিছু ভাববে না।একদম না।তাছাড়া আমাদের কাছে তো সিহু আছেই…”

আরশি কোনো জবাব দিলো না।নিশব্দে কাঁদতে লাগল….

আরও এক সপ্তাহ পর আরশির সেলাই খুলে আনল।দিনগুলো কোনোরকম দুজনের কেটে যেতে লাগল।কেটে যেতে লাগল জীবনের আরও কয়েকটা বছর।প্রথম প্রথম বাচ্চার জন্য আরশির খুব মন খারাপ লাগত,,প্রায়ই কাঁদত।সিদ্রাতের ভালোবাসায় এখন সেসব শুধুই স্মৃতি।সিদ্রাত এতো বেশি কেয়ার করে আরশির,,এতো ভালোবাসে যে দুঃখের দিনগুলো মনে করার সময়ই যেনো পায়না ও….

সিহুও এখন বড় হয়ে গিয়েছে।চার বছরে পড়েছে সে।এই আড়াই বছরে অনেকের জীবনই পরিবর্তন হয়েছে।সিদ্রাতের বাবা-মা শাহবাগে চলে এসেছে।পাঁচ জনের সুন্দর একটা পরিবার তৈরি হয়েছে তাদের।নুসাইফা আর নিহানেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে।নুসাইফা দ্বিতীয় বারের মতো কনসিভ করেছে।প্রথম বাচ্চাটা দুই মাসের মাথায় মিসক্যারেজ হওয়ার পর সে কি কান্না মেয়েটার।মুন আর আরহামেরও জমজ মেয়ে হয়েছে।দুটো বাচ্চাই পরীর মতো…সবাই সবার পরিবার নিয়ে খুব সুখী আছে।এতো সুখের মাঝে,এতো দায়-দায়িত্বের মাঝে কখনো কখনো সিদ্রাতের মনটাই ভেঙে যায় যখন ও দেখে ছোট্ট বাচ্চাকে বাবা কোলে নিয়ে আদর করছে।যতই হোক মানুষেরই মন তো…
আজও সিদ্রাত নিজের কেবিনে থাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তাটার ডান সাইডে থাকা এক বাবা ও সন্তানের দিকে।কি যত্নে বাবা তার সন্তানকে ফুচকা খাইয়ে দিলো আবার মুখ মুছে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলো।সিদ্রাতের চোখের কোণে জল ভরে এসেছে।হঠাৎ বেজে উঠা ফোন কলে ওর হুশ আসল।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে একটা বাজখাই কন্ঠস্বর ভেসে আসল…

—”হ্যালো পাপা…কোতায় তুমি?আচ আমলা ছুত আম্মুদেল বালি যাবো না?”

সিদ্রাত হালকা হাসল।মুচকি হেসে বলল…
—”ছোট আম্মুদের বাসায় তো আমরা রাতে যাবো সোনা..এখন তো তোমার পাপা অফিসে”

সিহু তবুও নাছোড়বান্দা। সে এসব শুনতে রাজি না।কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল…

—”কিন্তু পাপা..মাম্মাতো ওছুত্থ।মাম্মামের পেট বেথা কলে।কাঁতছে মাম্মাম..”

সিদ্রাত কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে বলল…
—”কি হয়েছে তোমার মাম্মামের?মাম্মামকে ফোনটা দেও তো মা..”
—”মাম্মা কতা বপবে না..অনেক বেতা কলে..”
—”আচ্ছা আমি এখনি আসছি।তুমি দীদাকে ডেকে আনো। বলো মাম্মামের খেয়াল রাখতে।আমি আসছি”

সিদ্রাত ফোনটা কেটে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল কেবিন থেকে।সিহু ফোনটা কেটে পেছনে ঘুরতেই হকচকিয়ে গেলো।কাচুমাচু করতে লাগল।আরশি সরু চোখে তাকিয়ে বলল…
—”মাম্মাম অসুস্থ?মাম্মামের পেটে ব্যথা?ব্যথায় মাম্মাম কথা বলতে পারছে না…তাইনা?”

সিহু টলমল চোখে আরশির দিকে তাকালো।পরক্ষণেই লাফিয়ে আরশির কোলে উঠে গেলো।গলা জড়িয়ে ধরে বলল…
—”ছলি মাম্মাম..আল মিত্যা বপব না..পাপা আতে না..তাই বয়েছি….”

আরশি সিহুর গালে চুমু দিয়ে বলল…
—”পাকা মেয়ে আমার।এখন পাপা এসে যদি দেখে তুমি মিথ্যা বলেছ তখন রাগ করবে না পাপা?”

সিহু লম্বা একটা হাসি দিয়ে বলল….
—”না কলবে না..বলব সিহু ম্যাতিক দিয়ে বালো কলে পেলেছে মাম্মাকে…”

আরশি হেসে উঠল সিহুর কথায়।সিহুও ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল…
সিদ্রাত প্রায় দশ মিনিটের মধ্যেই বাসায় ফিরে এলো।তড়িঘড়ি করে রুমে আসতেই ওর চোখ সরু হয়ে গেলো….

#Part_71
সিদ্রাত প্রায় দশ মিনিটের মধ্যেই বাসায় ফিরে এলো।তড়িঘড়ি করে রুমে আসতেই ওর চোখ সরু হয়ে গেলো।কারণ সিহু লক্ষী মেয়ের মতো ওর ইংলিশ বইয়ে এ ফর এপেল,বি ফর বল পড়ছে আর আরশি সিহুর পাশে বসে ওর নিজের পড়া পড়ছে।এখানে যে কেউ অসুস্থ তা কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না।সিদ্রাত ভ্রু কুচকে বেডে গিয়ে সিহুর পাশে বসে।সিহুকে পাপাকে দেখে ঝাপিয়ে কোলে উঠে পাপার…
—”ইয়েএএ!!পাপায়ায়া!!”

আরশি সিহুর কথায় তাকিয়ে দেখে সিদ্রাত এসে গিয়েছে।ও মুচকি হেসে বলে…
—”এসে পড়েছেন?”
—”সিহুর মাম্মাম নাকি অসুস্থ।তাই তো এসে পড়তে হলো”

আরশি হালকা হেসে বলল….
—”সিহু ম্যাজিক দিয়ে ওর মাম্মামকে সিক করে ফেলেছিলো।আবার ম্যাজিক দিয় সুস্থও করে ফেলেছে”

আরশির কথার অর্থ বুঝতে সিদ্রাতের বেগ পেতে হয়না।ও মুচকি হেসে সিহুর গালে গাল ঘষে বলল…

—”আম্মু..তুমি জানো না মিথ্যা কথা পঁচা মেয়েরা বলে।তুমি কি আমাদের পঁচা সিহু?”

সিহু ঠোঁট উল্টিয়ে ডানে বামে মাথা নাড়ায়।সিদ্রাত সিহুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে….

—”আর মিথ্যা বলবে তাহলে?”

—”না..ছলি পাপা..”
—”আমার মা-টা!ইট’স ওকে আম্মুটা”

আরশি হালকা হাসল বাবা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে।সিদ্রাত আরশিকে ইশারায় কাছে আসতে বলল।আরশি সিদ্রাতের কাছে গিয়ে বসলে সিদ্রাত সিহুর সাথে আরশিকেও জড়িয়ে ধরে।আরশি মুচকি হেসে সিহুর অগোচরে আলতো করে সিদ্রাতের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়।সিদ্রাত চোখ মেরে ফিসফিস করে বলে….

—”বাকিটা রাতে শোধে-আসলে নিবো”

আরশি নিশব্দে হাসল।মৃদু কন্ঠে বলল…

—”সন্ধ্যা তো প্রায় হয়ে আসছে।রেডি হবেন না?সন্ধ্যার পরপরই তো আরমুন আর তাহামের বার্থডে কেক কাটবে।মুন আপু এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে..এখনো কেন যেয়ে পৌঁছাইনি তাই..”

—”উফফ মুনটাও হয়েছে এক..আচ্ছা রেডি হও।আধা ঘন্টার মধ্যেই বের হবো”

—”আচ্ছা…”

সিদ্রাত-আরশি সিহুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আধা ঘন্টার মধ্যেই।উদ্দেশ্য মুনের শ্বশুর বাড়ি…
ওখানে পৌঁছাতে আরও আধা ঘন্টা লাগে।বাসায় পৌঁছুতেই মুন আরশিকে জড়িয়ে ধরে।আরশি হালকা হেসে বলে…
—”ভালো আছো মুন আপু?”
—”হুম আলহামদুলিল্লাহ ভালো।তুমি ভালো আছো?”
—”হুম..আলহামদুলিল্লাহ। আরমুন আর তাহাম কোথায়?”

—”আরহামের কাছে।আসো উপরে আসো”

মুন আরশিকে ছেড়ে সিহুকে কোলে নেয়।তারপর উপরে নিজেদের বেড রুমে নিয়ে আসে সবাইকে।আরশি আরহামের কাছ থেকে আরমুনকে কোলে নিয়ে চুমু দিয়ে বলে….
—”সোনামনি আমার..এক বছর শেষ করলে এই পৃথিবীতে আসার ”

ছোট্ট আরমুন ফ্যালফ্যালভাবে আরশির দিকে তাকিয়ে রইল।আরশি হালকা হাসল।সিদ্রাত আরহামকে বলল….
—”শালা আমার ভাগ্নি পুরো তোর মতোই হয়েছে”

আরহাম সিদ্রাতের পেটে কিল দিয়ে বলল…
—”শালা আমি তোর বোনকে বিয়ে করেছি।তুই আমার কোন বোনকে বিয়ে করে আমায় শালা বানালি?”

সিদ্রাত মাথা চুলকে হেসে দিলো।সিদ্রাতের হাসি দেখে মুন আর আরশিও হেসে দিলো….
আটটার পর সব গেস্টরা চলে আসলে আরমুন আর তাহামের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে কেক কাটা হলো।আরশি খেয়াল করল বেশিরভাগ গেস্টদেরি কোলে ছোট্ট এক বছর বা তার চেয়েও কম বয়সের বাচ্চা।সবাই খুব যতনে বাচ্চাদেরকে সামলাচ্ছে।আরশির মুখটা মলিন হয়ে গেলো।ও মলিন চোখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।তখনই একজন মহিলা বলে উঠল….
—”এই মেয়ে তুমি আমার নাতীটার দিকে নজর দিচ্ছো কেন?শুনেছি নিজে নাকি বাজা?এখন আমার মেয়েটার বাচ্চার উপরও নজর দিচ্ছো?উফফ..কি যে অবস্থা!এই মিতালি বাচ্চাকে নিয়ে দূরে যা।বদনজর লাগবে”

আরশির চোখ জলে ভরে উঠল।উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে গেলো এমন আকষ্মিক ঘটনায়।আরহাম রেগে মহিলাটাকে কিছু বলতে যেতে নিতেই মুন বাঁধা দেয়।আরশি চোখের জল মুছে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যেতে নিলে সামনে সিদ্রাত বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।ওর চোখগুলো রাগে লাল হয়ে গিয়েছে।হাতের আঙুলগুলো শক্ত করে মুঠি করে রেখেছে।আরশি সিদ্রাতের দিকে করুণ চোখে তাকায়।অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে আবারও উপরে উঠে যায়….

সিদ্রাত আরহামের সামনে এগিয়ে যায়।শান্ত কন্ঠে বলে…
—”আমি আরশিকে নিয়ে চলে যাচ্ছি।তুই এদিকটা সামলা”

আরহাম মাথা নিচু করে বলে…
—”সরি ভাই..আমার বাসায় এসে এভাবে তোদের অপমানিত হতে হলো”

সিদ্রাত আরহামের কাঁধে হাত রেখে বলে…
—”ইট’স ওকে।তোর কোনো দোষ নেই।দোষ আমাদের সোসাইটির,,আমাদের সোসাইটির মানুষের আউটলুকে দোষ”

সিদ্রাত কথাটা বলে উপরে চলে গেলো।আরশিকে শান্ত করে রেডি হয়ে সিহুকে নিয়ে আরহামদের বাসা থেকে বেরিয়ে এলো।আরহাম আর মুন ইচ্ছামতো ঝাড়ল ওই মহিলাকে…

বাসায় আসার পরও আরশির মন ভালো হলো না।ও চুপ করে বেডের এক কোণায় শুয়ে রইল।সিদ্রাতও কিছু বলল না।ওর নিজের কাছেও কিছুই ভালো লাগছে না।দুজনের মাঝখানে সিহু ঘুমাচ্ছে।আরশি সিদ্রাতের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে শুয়ে নিশব্দে কাঁদছে।সিদ্রাত জানা সত্তেও আরশিকে থামালো না।কতই বা বুঝাবে এই ব্যাপারটা নিয়ে!ব্যাপারটাই এমন যে ভাবলেই কষ্টগুলো শিরা-উপশিরায়ও ছড়িয়ে পড়ে…

পরেরদিন সিদ্রাত অফিসে চলে যাওয়ার পরই সিহুর তীব্র পেটে ব্যথা শুরু হয়।মেয়েটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।সিহুর কান্না দেখে আরশিও কেঁদে দিয়েছে।সিদ্রাতের আম্মু ডক্টরকে ফোন দিয়ে সিহুর শরীরে দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতে লাগল।আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলল…

—”আম্মু সিহুটার হুট করে কি হলো বলো তো?মেয়েটা আমার খুব কষ্ট পাচ্ছে।ইশ কিভাবে কাঁদছে আমার সোনামানিকটা!ও আম্মু সিহু ভালো হয়ে যাবে তো?”

আয়িশা আজওয়াদ চিন্তিত কন্ঠে বলল…
—”শান্ত হো তুই..কিছু হবে না ইনশা আল্লাহ।গতকাল কেইক টেইক খেয়েছে..বদহজম হয়ে গিয়েছে হয়ত।সিদ্রাত আর তোর আব্বুও মিটিংয়ে।কাউকেই ফোন দিয়ে পাচ্ছি না।ডক্টর আসুক..ইনশা আল্লাহ খারাপ কিছু হবে না…”

আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলল….
—”ইনশা আল্লাহ…”

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডক্টর চলে আসল।চেকাপ করে বলল…
—”ফুড পয়জনিং হয়ে গিয়েছে।হসপিটাল থেকে ওয়াশ করে আনল সবচেয়ে ভালো হবে।আর ছোট্ট বাচ্চা তো..তাই খাবারের দিকটায় একটু বেশি সতর্ক থাকবেন..”

সিদ্রাতের আম্মু বলল..
—”ওকে ডক্টর।ওয়াশ তো তাহলে আজই করাতে হবে তাইনা?”
—”হ্যাঁ হ্যাঁ..অবশ্যই”

ডক্টর চলে গেলে আরশি আর ওর শাশুড়ী মিলে সিহুকে হসপিটালে নিয়ে গেলো।ডক্টর পয়জন ওয়াশ করে কিছু ওষুধের প্রেসক্রিপশন লিখে দিলো আর বলল…
—”চকোলেট,চিপস এসব থেকে দূরে রাখবেন..বাসার হাইজিনিক খাবারটাই সবসময় দিবেন ওকে..”
—”জ্বি ধন্যবাদ ম্যাম”

ডক্টর মৃদু হেসে বলল…
—”মাই প্লেজার।

ডক্টরের কেবিন থেকে বেরুতেই আরশি আর ওর শাশুরীর আরহামের আম্মুর সাথে দেখা হয়ে গেলো।সিদ্রাতের আম্মু বলল….
—”ডক্টর আবিদা..আপনার দেখা মিলল তাহলে?”

আরহামের আম্মু মুচকি হেসে বলল…
—”আয়িশা তুই ঠিক হবি না।বুঝিসই তো সারাদিন মেডিকেল তারপর সংসার..খুব বিজি থাকি…”

—”আরশি দেখ..বিয়াইন আমায় তুই করে বলছে।মান-সম্মান শেষ”

আরশি আরহামের আম্মুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।আরহামের আম্মু হেসে বলল…
—”আরশি.. তোমার শাশুড়ী একটা অকৃতজ্ঞ।এতো বছরের বন্ধুত্ব ভুলে সে এখন বেয়ান নিয়ে বসে আছে…”

আরশি মুচকি হেসে বলল…
—”হয়েছে এবার তোমরা থামো।এই বুড়ো বয়সে এসে বাচ্চাদের মতো শুরু করেছো।তোমাদের থেকে তো আমার সিহুই ভালো”

আরহামের আম্মু আর সিদ্রাতের আম্মু হেসে দিলো।আরহামের আম্মু হঠাৎ বলল….

—”হোয়াটেভার,,,আরশি…তুমি কি ইদানিং প্রেগনেন্সির কোনো টেস্ট করিয়েছো বা তোমার পিরিয়ড কি রেগুলার হচ্ছে?”

আরশি আরহামের আম্মুর কথায় চমকে উঠল।সাথে সাথে কিছুটা বিব্রতও হলো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল…
—”পিরিয়ড দুই চক্র মিস হয়েছে..কিন্তু আমি তো এসব খেয়াল করিনি।তাছাড়া…ডক্টর মারিয়াম আরও আড়াই বছর আগেই বলেছে আমি মা হতে পারব না…”

আরহামের আম্মু ভ্রু কুচকে বলল…
—”মারিয়াম!মানে আয়রুনা মারিয়াম!ওকে তো রাস্টিকেট করা হয়েছে জালিয়াতির কারণে..আর ওকে তো মেসবাহ নিজেই রাস্টিকেট করিয়েছে..”

আরশি অনেকটা চমকে উঠল।সিদ্রাতের আম্মুও কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে বলল…
—”কি বলছিস এসব?আমরা তো এসব কিছুই জানি না।মেসবাহ নিজে কেন ওর ওয়াইফকে রাস্টিকেট করাবে?”

আরহামের আম্মুর আরশির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল…
—”আচ্ছা সেসব কথা পরে হবে।আমার কেবিনে আসো তুমি আরশি।আমি আল্ট্রাস্নোগ্রাফি লিখে দিচ্ছি।আই থিংক রিপোর্ট পজিটিভ আসবে…!”

আরহামের আম্মুর কথা শুনে আরশির বুকটা কেঁপে উঠল।ওর যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না এরকম কিছু সম্ভব।সিদ্রাতের আম্মু সিহুকে নিজের কোলে নিয়ে আরশিকে ইশারায় যেতে বলল।কেবিনে আসলে আরশিকে কিছু টেস্ট আর আল্ট্রাস্নোগ্রাম লিখে দিলো।আরশি সেগুলো সব করিয়ে নিলো।এক ঘন্টা পরই আল্ট্রাস্নোর রিপোর্টটা আরশি পেয়ে গেলো যদিও টেস্টের রিপোর্ট আরও পরে পাবে।রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে আরশির শরীরে কম্পন শুরু হয়ে গেলো।ওর নিশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।এও কি সম্ভব!এটা তো পুরোই মিরাক্যাল..কিভাবে সম্ভব এটা?
রিপোর্টে যে স্পষ্টভাবে পজিটিভ লিখা।আরশি ধীর পায়ে ডক্টর আবিদার কেবিনে এগিয়ে গেলো।রিপোর্ট দেখে মিসেস আবিদা মুচকি হেসে বললেন…
—”আলহামদুলিল্লাহ… সিদ্রাত খুব বেশি খুশি হবে..টেস্টের রিপোর্টতো সন্ধ্যার আগে পাবে না।সেগুলো আগামীকাল সিদ্রাতকে বলবে কালেক্ট করে আমায় দেখাতে।তুমি এখন টোট্যালি রেস্টে থাকবে…”

আরশি নিজেকে সামলাতে পারল না।খুশিতে কেঁদে উঠল।মিসেস আবিদা নিজের চেয়ার থেকে উঠে এসে আরশির কাঁধে হাত রাখলেন।আরশি দাঁড়িয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল।কান্নার চোটে ও কথাও বলতে পারছে না।আরহামের আম্মু আরশির পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে দিতে বলল….

—”এই মেয়ে..এতো কাঁদতে হয়?শরীর খারাপ করবে না?তোমার শাশুড়ী তো বাইরে অপেক্ষায় আছে সুখবর শোনার জন্য।তাকে তো জানাতে হবে”

আরশি মাথা তুলে কাঁদতে কাঁদতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।চোখ মুছে বাইরে যায়।সিদ্রাতের আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বলে…

—”আম্মু,,,আল্লাহ আমার উপর মুখ,,তুলে চেয়েছেন,,,আমি মা হবো,,মা হবো আমি,,,”

সিদ্রাতের আম্মুও খুশিতে আধখানা হয়ে গেলো।উনি আরশিকে জড়িয়ে ধরে পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন…

—”আলহামদুলিল্লাহ.. আল্লাহ তোর সংসারে,তোর জীবনে রহমতে রহমত করে তুলুক..আমিন”

সিদ্রাতের আম্মু আরশিকে ছেড়ে দাঁড়ালো।তারপর বলল…
—”আচ্ছা মা তুই সিহুকে নিয়ে কারে গিয়ে বস।আমি তোর আবিদা আন্টির সাথে কথা বলে আসি”

আরশি চোখ মুছে সম্মতি জানালো।সিহুকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল।খুশিতে ওর অবস্থা খারাপ।অপ্রত্যাশিত এই সুখবর যেনো পুরো জীবনটাকে এক মূহুর্তে বদলে দিলো।আসলেই কথাটা ঠিক..”সবর করো।আল্লাহ এতো বেশি দিবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে”

সিদ্রাতের আম্মু আবিদার কেবিনে গেলো।আবিদা মুচকি হেসে বলল…
—”আমি জানতাম তুই আসবি”

সিদ্রাতের আম্মু সামনের চেয়ারটায় বসে বলল…
—”এবার আমায় সব বল তো মেসবাহর ব্যাপারে..”

মিসেস আবিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
—”তোর ভাসুরের ছেলে।আমার থেকে বেশি তোর জানার কথা ছিলো।যাই হোক…মেসবাহ তোর বাড়ির বউকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসত।সম্ভবত আরশি যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন থেকে।ফেইসবুকে ছবি দেখে প্রেমে পড়েছিলো।কিন্তু প্রকাশ করতে না পারায় ছোট ভাইয়ের বউ হয়ে গেলো।কিন্তু ভালোবাসা কমেনি।পরবর্তীতে পরিবারের চাপে মারিয়ামের সাথে বিয়ে হলেও স্ত্রীর অধিকার মারিয়ামকে দেয়নি।সেই থেকে মারিয়ামের আরশির প্রতি একটা ক্রোধ কাজ করত।আর মে বি সেই প্রতিশোধটা ও নিয়েছে অপারেশন থিয়েটরে।আরশিকে মিথ্যা রিপোর্ট দেখিয়েছে ও..খুব সম্ভবত আরশি আর সিদ্রাতের মাঝে সম্পর্কে ফাঁটল ধরানোর জন্য…”

সিদ্রাত আম্মু অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন।এতো কিছু হয়ে গিয়েছে অথচ উনারা কিছু জানেনই না।উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন…

~~~~~
সন্ধ্যা ছয়টা আট বাজে।আরশি একটা লাল পাড়ের গোল্ডেন কাতান শাড়ি পড়ে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস ভাবে সেজেছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ও নিজেকে দেখছে আর লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।সিদ্রাত যখন শুনবে সে বাবা হতে যাচ্ছে কতটাই না খুশি হবে!আরশি লাজুক হেসে আয়নার মধ্য দিয়েই নিজের কাজল কালো চোখজোড়ার দিকে তাকালো। সাথে সাথে লজ্জায় দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।অতঃপর দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো…

বেশ কিছুক্ষণ পর সিদ্রাত ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরল।রুমে ঢুকে দেখল ব্লু শেডের লাইটটা জ্বলছে শুধু..আরশি বা সিহু কেউই নেই রুমে..সিদ্রাত ঘামে ভেজা সাদা শার্টটা খুলতে লাগল।তখনই ওর চোখ গেলো সেন্টার টেবিলে ছোট্ট একটা প্রদীপ জ্বলছে আর পাশে একটা কিসের যেনো খাম..
সিদ্রাতের ভ্রুজোড়া কুচকে এলো।ও শার্টটা খুলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।লম্বা একটা হট শাওয়ার নিয়ে টু কোয়ার্টার একটা ব্ল্যাক প্যান্ট আর ব্লু টিশার্ট পড়ে বেরিয়ে এলো।টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে সোফায় বসে খামটা হাতে নিলো।বুঝল এটা কোনো হসপিটালের রিপোর্ট।সিদ্রাত রিপোর্টটা খুলে চোখ বুলাতেই ওর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেলো।ভালো করে আরও দুবার রিপোর্টটা পড়ল ও..নিজের চোখকে কেন যেনো মিথ্যা মনে হচ্ছে।বিশ্বাস হচ্ছে না কোনোকিছু।খুশিতে ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।পুরো শরীর যেনো দুবার কেঁপে উঠল।রিপোর্টটা আগের জায়গায় রেখে দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে বলল…

—”আমি,,বাবা হবো,,ছোট্ট একটা প্রাণ,অামার অংশ আমার প্রিয়তমার গর্ভে,,আলহামদুলিল্লাহ.. আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ..”

কিছু একটা ভেবে সিদ্রাত ছুট লাগালো ছাদের উদ্দেশ্যে।ওর প্রেয়সী যে,এখন এই একটা জায়গায়ই থাকতে পারে।ছাদের দরজার সামনে এসে সিদ্রাত দাঁড়িয়ে পড়ল।শাড়ি পরিহিতা আরশির ব্যাকসাইড দেখা যাচ্ছে।ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা,,শাড়ির আচল ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।সিদ্রাত ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল আরশির কাছে।আরশির হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে।পেছনে না তাকিয়েও ও বুঝতে পারছে ওর অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।সিদ্রাত যত আগাচ্ছে আরশির হৃদস্পন্দন ততই বাড়ছে।একটা সময় সিদ্রাত একদম আরশির শরীরের সাথে ছুঁই ছুঁই ভাবে দাঁড়ালো।অন্যরকম এক অনুভূতির টানে আরশি চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলল।সিদ্রাত আরশিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ ডুবালো।আরশি সিদ্রাতের হাতের উপর নিজের হাত রাখল।সিদ্রাত যত গভীরভাবে আরশির ঘাড়ে নিজের ঠোঁটের পরশ বুলাচ্ছে আরশির শ্বাস তত বাড়ছে।সিদ্রাত ওর একটা হাত আলতো করে শাড়ির ফাঁক দিয়ে পেটের উপর রাখল।আরশি কেঁপে উঠল।সিদ্রাত লো ভয়েসে বলল….

—”জানপাখি এটা কি সত্যি?আমি সত্যিই বাবা হবো?এসব স্বপ্ন নয়তো?আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না”

আরশি ঠোঁট কামড়ে মুচকি হেসে বলল…
—”আমাদের মাঝে সত্যিই নতুন অস্তিত্ব আসতে চলেছে।আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন সিদ্রাত..আপনি বাবা হবেন..”

সিদ্রাত আরশিকে নিজের দিকে ঘুরালো।আরশি একপলক সিদ্রাতের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল।সিদ্রাত ঠোঁট কামড়ে হালকা হেসে আরশির কপালে চুমু খেলো।আরশিকে পরম যত্নে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো।অতিরিক্ত খুশিতে আটকে আসা কন্ঠে বলতে লাগল….

—”আমি যে কতটা খুশি তোমায় বোঝাতে পারব না সোনাপাখি..আমার ভিতর এতো শান্তি লাগছে আর এতো ভালো লাগা কাজ করছে যা বর্ণনা করা অসম্ভব।নিজেকে অনেক বেশি পূর্ণ মনে হচ্ছে।এতো বড় সারপ্রাইজ আমি আজ পাবো তা আধা ঘন্টা আগেও জানতাম না…আমি আজ অনেক খুশি জানপাখি..অনেক বেশি খুশি”

আরশির ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠল প্রিয় মানুষটার এতোটা আনন্দ আর খুশি দেখে।প্রিয়তমর খুশি,হাসি বুঝি এভাবেই হৃদয়ে সুখের ঢেউ তুলে!আরশি মুখ তুলে সিদ্রাতের চোখে চোখ রাখল।সিদ্রাতের দৃষ্টিও অন্যরকম।দুজনের চোখেই যেনো অসীম ভালোবাসা।আরশি একটু উঁচু হয়ে সিদ্রাতের কপালে চুমু খেলো।সিদ্রাত মুচকি হাসল।তারপর আবারও সিদ্রাতের বুকে মুখ গুজে নাক ঘষতে ঘষতে বলল…
—”আমিও অনেক খুশি মিস্টার..অনেক বেশি খুশি আমিও..আমার মাঝে আপনার অংশ বেড়ে উঠছে..এ যে আমার পরম পাওয়া প্রিয়তম।আমি যে সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী…”

সিদ্রাত আরশির কানের লতিতে ঠোঁট ছুইয়ে ধীর কন্ঠে বলল…
—”তুমি আমাকে এতো বড় একটা গিফট দিয়েছো..আমি যে ঋণী হয়ে গেলাম জান..সারাজীবন ভালোবেসেও এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।তবুও ভালোবেসে যাবো।অনেক বেশি ভালোবেসে যাবো প্রেয়সী আমার।অনন্তকাল প্রবাহিত হবে তোমার আমার ভালোবাসার ঢেউ।ভালোবাসি প্রিয়তমা..তুমি যে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় সোনা..”

আরশির মনে খুশির ঢেউ বয়ে গেলো।মুখজুড়ে ফুটে উঠল খুশির স্পষ্ট রেখা।ঠোঁটে হাসি প্রসারিত করে লাজুক কন্ঠে বলল…

—”তুমিও যে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় প্রিয়তম..”

কথাটা বলে আরশি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো..
সিদ্রাতের বুকে অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে গেলো আরশির মুখে “তুমি” শুনে।গত ছয় বছরে এই ফার্স্ট মেয়েটা তাকে তুমি করে বলল।সিদ্রাত ঠোঁট কামড়ে হাসল।তারপর দুষ্টু হেসে আরশির খোলা কোমরে ঠান্ডা হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে বলল…

—”কি বললে মাত্র জানপাখি?আরেকবার বলো না সোনা..”

আরশি লজ্জামাখা কন্ঠে বলল…
—”উহু..লজ্জা লাগে.”
—”প্লিজ জানপাখি..তোমার কন্ঠে “তুমি” ডাকটা যে আমার কাছে অমৃতর চেয়েও অধিক অমৃত.. প্লিজ আরেকবার বলো প্রিয়তমা…”

আরশি লাজুক কন্ঠে বলল….
—”তুমি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় প্রিয়তম…”

সিদ্রাত ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল…
—”হে রমনী!এ কি করলে তুমি?আমার বুকে যে চিনচিন ব্যথা করছে।কি জাদু করে আমার এই বুকটা দখল করলে তুমি?কি জাদু তোমার ওই চাহনীতে যা আমায় বারেবারে ঘায়েল করে!উফফ তোমার প্রেমের জাদুতে আমি যে মূমুর্ষ হে রমণী!”

সিদ্রাতের এমন প্রেমময় কথায় আরশি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।সিদ্রাতকে ধাক্কা দিয়ে লাজুক কন্ঠে “ধ্যাত” বলেই দৌড়ে পালাতে নিলো।কিন্তু তার আগেই সিদ্রাত শাড়ির আচল টেনে ধরল।আরশি পালাতে গিয়েও পারল না।সিদ্রাত আরশির শাড়ির আচল হাতে প্যঁচিয়ে এগুতে এগুতে মৃদু হেসে বলল…

—”তোমার চোখ চেয়েছি বলে, এমন ডুবল আমার চোখ,,
অমন অথৈ জ্বলে রোজ, আমার ডুব সাঁতারটা
হোক,,
শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমি তোমার হব
ঠিক,,
তুমি ভীষণ অকূল পাথার, আমি একরোখা
নাবিক,,
শোনো, জ্বল ছল ছল কাজল চোখের কন্যা
সর্বনাশী,,
আমি তোমায় ভালোবাসি…” (লেখক-অজ্ঞাত)

আরশি পেছনে ঘুরে সিদ্রাতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিসফিস করে বলল….

—”তোমার আবেগমাখা খামখেয়ালী
আঁটছে আমার পিছু,
আমার আসা যাওয়ার পথের বাঁকা
পাইনি অন্যকিছু,

তুমি হাতটি শুধু ধরো,আমি হবো না আর কারও
তোমার স্বপ্নগুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়… ”

সিদ্রাতের দু’ঠোঁটের কোণার হাসি প্রসারিত হলো।ও গভীরভাবে আরশির কপালে চুমু খেলো।আরশি আরও একবার লাজুক হাসল প্রিয়তমর স্পর্শে….

~~~~💕💕💕💕সমাপ্ত💕💕💕💕~~~~

এতোদিন গল্প দিতে অনেক অনিয়ম করেছি আমি।সেজন্য অবশ্যই আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আগামীকাল থেকে “আমার অপ্রকাশিত গল্পে অস্পৃশ্য তুমি” শুরু করব।ইনশা আল্লাহ আর অনিয়ম হবে না।সবার পাশে থাকা কামনা করে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি। অাল্লাহ হাফিয🥰🥰

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here