প্রাণের_চেয়েও_প্রিয় পর্ব ৬৯

#প্রাণের_চেয়েও_প্রিয়
#Part_69
#Writer_TanhaTonu

আরশি সিদ্রাতের কথার কোনো জবাব দিচ্ছে না।ও কেঁদে-কেটেই শেষ।কাঁদতে কাঁদপ্তে আরশির শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।সিদ্রাত আরশির অবস্থা বুঝতে পেরে আর ঘাটলো না।কোলে তুলে নিলো আরশিকে।যত্নের সাথে বেডের একসাইডে শুইয়ে দিয়ে নিজেও আরশির পাশে শুলো।আরশি সিদ্রাতের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল।সিদ্রাত আরশির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল….

—”আর কেঁদো না লক্ষীটি।শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তোমার জানপাখি…প্লিজ আর কেঁদো না”

সিদ্রাত অনেক কষ্টে আরশির কান্না থামায়।আরশি কান্না বন্ধ করলেও একটু একটু পর পরই কেঁপে উঠছে।সিদ্রাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল….
________________________________

পরের দিন সকালে সিদ্রাতদের বাসার সবাই শাহবাগ চলে আসে সিদ্রাত-আরশির ছোট্ট টোনাটুনির সংসারটায়।মূলত আরশির অপারেশনের কারণেই সবার আশা।আরশির আম্মু-আব্বু আসতে পারেনি।আরশির আব্বু বিজন্যাসের কারণে কানাডা গিয়েছে সাথে আরশির আম্মুও।তবে তারাও ফোনে অনেক কথা বলেছে আরশির সাথে।মেয়েটা যেনো হতাশ হয়ে না যায় সেদিকটায়ও তো খেয়াল রাখা পরিবারের মানুষগুলোরই দায়িত্ব।মুন আর নুসাইফা তো আসার পর থেকে আড্ডা শুরু করেছে শেষ করার নামই নেই।আরশির বিছানাটা এখন মুন,নুসাইফার আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।দুজন বকবক করেই যাচ্ছে।আরশি অসহায় চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল….

—”এতো কথা কিভাবে বলো তোমরা?আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে”

নুসাইফা ব্যগ্রস্বরে বলল….
—”আমার ভালো মানুষটা আসছে!তুই যে কথার ড্রাম ছিলি তা কি আমি জানি না?এখন তো আমার ভালো ভাইটার সংস্পর্শে মানুষ হয়েছিস”

আরশি ভেঙচি কেটে বলল…
—”মানে ইন্ডিরিক্টলি না বলে ডিরিক্টলি বললেই তো পারিস যে তোর নিহান ভাইয়ার সংস্পর্শ চাই..হাহ ঢং!আমিই বরং একটা কাজ করি..আঙ্কেল-আন্টিকে গিয়ে বলি তাদের মেয়ে বাসর করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে”

নুসাইফার মুখটা চুপসে গেলো।মুন হু হা করে হেসে উঠে বলল…
—”আরে আরশি তুমি তাহলে জানোই না কিছু।আর বিশদিন পরই তো নুসু আর নিহানের বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়েছে”

মুনের কথা শুনে আরশির চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেলো।ও নুসাইফার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইচ্ছামতো কিল-ঘুষি দিতে লাগল…

—”আউচ্চ..আরুউউ..ব্যথা লাগে তো।ছাড় বলছি”
—”কুত্তি তুই কোনো কথা বলবি না।এতো বড় একটা নিউজ তুই আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?তোকে তো রোদে শুকিয়ে শুটকি বানাইয়া পঁচা পানিতে ছাড়লেও আমার আত্মা শান্তি পাবে না”

আরশি আবারও নুসাইফাকে মারা শুরু করল।নুসাইফা বিরক্তি নিয়ে বলল…
—”আরে তুই আগে আমায় বলতে তো দে”

আরশি মারা থামিয়ে সরু চোখে নুসাইফার দিকে তাকালো।নুসাইফা মুখ বাঁকিয়ে বলল…
—”গতকাল রাতে এসব ফিক্সড হয়েছে।আর তুই যে এতো বড় বড় কথা বলছিস!ফোনটা একবার চেক করে দেখ আমি কয়টা ফোন দিয়েছি তোকে..অসভ্য মেয়ে!”

আরশি জিহবায় কামড় দিয়ে তাড়াতাড়ি বেড সাইড টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে সাইলেন্ট ফ্রি করল।কল লিস্ট চেক করে দেখল ১৪টা কল নুসাইফার।আরশি কাচুমাচু করে নুসাইফার দিকে তাকালো।নুসাইফা রেগে বলল….
—”আমার মাইরের উষুল তুলব এখন?”

আরশি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল…
—”আমি অসুস্থ বাচ্চা।তুই শিশু নির্যাতন করতে পারিস না”

নুসাইফা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলল…
—”তুই বাচ্চা?”

মুন হাসতে হাসতে বলল…
—”আমাদের শিশু আরশি দুদিন পর আরেকটা শিশু পয়দা করবে।তারপর আরও তিন/চারটা করবে..তাতে কী!আমাদের শিশু আরশি শিশুই থাকবে”

নুসাইফা উচ্চস্বরে হেসে উঠল সাথে মুনও।আরশি মুখ বাঁকা করে তাকালো।তখনই সিদ্রাত রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল…

—”হেই লেডিস!তোমাদের গসিপিং কি শেষ হয়েছে নাকি আজ সারাদিনই চলবে…”

আরশি সিদ্রাতকে দেখে মুচকি হাসল।সিদ্রাতও ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।নুসাইফা চোখ সরু করে বলল…

—”হোয়াটস আপ ব্রো?লেডিসদের মাঝে কি মনে করে এলে?উফফ দরজায় লিখা উভিৎ ছিলো ‘মেন আর নট এলাউড’ হাহ…”

—”মাইর চিনিস!আমার রুমে থেকে আমাকেই পার্মিশন দেখাচ্ছিস!এখনই বের হো..নাহলে কপালে দুঃখ আছে”

মুন ভেঙচি কেটে বলল…
—”বউয়ে সাথে রোমান্স করবে সেটা বললেই হয়।আমাদের কাবাবে হাড্ডি হওয়ার রোগ নেই”

মুন ভেঙচি কেটে উঠে দাঁড়ালো।নুসাইফাও হেসে বেড থেকে উঠে দাঁড়ালো।দুজনই সিদ্রাতকে ভেঙচি কেটে চলে গেলো।সিদ্রাত হেসে দরজা লক করে দিলো।আরশি মৃদু হেসে বলল….

—”আপনি পারেনও বটে।ছোট বোনদেরকেও ছাড় দেন না”

সিদ্রাত আরশি কোলে মাথা রেখে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ল।সিল্কি চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল…
—”কজ এখন আমি তোমায় আদর করব।সো কোনো ছাড়াছাড়ি নেই”

আরশি নিশব্দে হাসল।সিদ্রাত আরশির একটা হাত নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নিলো।আলতো করে হাতে চুমু খেয়ে বলল…

—”সবসময় এভাবেই হাসবে ওকে?এই হাসতেই আমার পরীটাকে মানায়।এই হাসিটা তো তোমার জন্যই তৈরি প্রিয়তমা”

সিদ্রাতের এমন আবেগী,গভীর অনুভূতি মিশ্রিত কথাগুলো যেনো আরশির হৃদয়ের গহীনে গিয়ে ধাক্কা দিলো।ওর চোখ দুটো জলে টলমল করে উঠল।এতো সুখ সহ্য হবে তো ভাগ্যে!যদি ছেড়ে চলে যেতে হয় তাহলে কীভাবে এই মায়ার বাঁধন ছিন্ন করবে?কীভাবে এই গভীর ভালোবাসা রেখে অন্ধকারের জগতে পা দিবে মেয়েটা!এসব ভেবেই টুপ করে একফোটা জল আরশির চোখ গলিয়ে সিদ্রাতের কপালে আঘাত হানল।সিদ্রাত সাথে সাথে কেঁপে উঠল।তাড়াতাড়ি উঠে সোজা হয়ে বসে আরশিকে বুকে টেনে নিলো।আরশি একটুও কাঁদতে চাচ্ছে না।কিন্তু কষ্টটা চেপে রাখাও যে কঠিন থেকে কঠিনতম!সিদ্রাত আরশির চোখজোড়ায় চুমু খেলো।ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়ায় শুষে নিলো অশ্রুকণাগুলো।আরশি ছলছল চোখে তাকিয়ে রইল সিদ্রাতের দিকে।সিদ্রাত দুহাত দিয়ে আরও একবার আরশির চোখজোড়া মুছে দিয়ে বলল….

—”কিছু হবে না ইনশা আল্লাহ।আল্লাহর উপর ভরসা রাখো”

আরশি সিদ্রাতের বুকে মুখ গুজল।ধরা গলায় বলল…
—”আমার কিছু হয়ে গেলেও আপনি আপনার জীবনে অন্য কাউকে জায়গা দিবেন না।মনেও না।আমি ওপারে আপনার অপেক্ষায় থাকব।অপেক্ষায় থাকব জান্নাতের এক কোণায় নতুন করে ছোট্ট একটা সংসার গড়ার জন্য।আমায় নিরাশ করবেন না…”

আরশি এটুকু বলেই থেমে গেলো।কথাগুলো আটকে আসছে।আর কিছু বলতে গেলেই যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।সিদ্রাত আরশির পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল….

—”আমার রব আমার প্রতি এতোটা কঠোর হবেন না।তিনি জানেন আমি তোমাকে নিয়ে খারাপ কিছু কল্পনাও করতে পারিনা।কল্পনায়ও আনতে পারিনা তোমাকে ছাড়া থাকার কথা।নিশ্চয়ই আরোশে আজিমের মালিক আমার প্রতি কোমল রূপ প্রদর্শন করবেন…”

সিদ্রাত গভীর শ্বাস ফেলল।ওর কন্ঠস্বরও যে আটকে আসছে….

আরশি মুখটা উঁচু করে আলতো করে নিজের উষ্ণ ঠোঁট সিদ্রাতের ঠোঁটে ছোঁয়ালো।সিদ্রাতও প্রেয়সীর উষ্ণতা নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের ভাজে পুরে নিলো।মেতে উঠল ভালোবাসার এক দুঃখ মিশ্রিত সুখকর মূহুর্তে…

ঘনিষ্ঠ মূহুর্তে আরশি অস্পষ্টস্বরে বলল…

—”এই সুখ নিয়েই আমি আজীবন বাঁচতে চাই।আপনার প্রেমে মাতোয়ারা হতে চাই।আপনাতে মিশে থাকতে চাই”

সিদ্রাত আরশির গলায় কিস করতে করতে নেশামাখা কন্ঠে বলল…
—”আমার অস্তিত্বে মিশে আছো তুমি।আমাদের আত্মা যে একে-অপরের মাঝে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছে।কখনোই ছিন্ন হবে না এই বন্ধন ইনশা আল্লাহ।আমি তোমাতেই মিশে রবে আজীবন আর তুমি আমাতে প্রিয়তমা”

আরশির অস্পষ্ট জবাব…
—”আমার প্রিয়তম…”

পুরো ঘর পুনরায় ছেঁয়ে গেলো নীরবতায়।বিরজমান রইল একজোড়া প্রেমিক যুগলের উষ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাস…
___________

দুদিন পর…
—”মারিয়াম..প্লিজ ডোন্ট সে লাইক দিজ টাইপ অফ স্টুপিডিটি।ওকে আমি সুস্থ চাই আন্ডার্স্টেন্ড?কিছু যেনো না হয় ওর..”

মারিয়াম গভীর শ্বাস ফেলে বলল…
—”অনেক ভালোবাসো ওকে…তাইনা?আমায় এতোটা ভালো না হোক..তার একভাগও কি ভালোবাসা যায়না মেসবাহ?”

মেসবাহর উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মূহুর্তেই শান্ত হয়ে গেলো মারিয়ামের কথায়।ও শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মারিয়ামের দিকে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল….

—”পারসোনাল কথা পারসোনালিই হবে।এটা হসপিটাল।তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো।আরশির যেনো কিছু না হয়।ধরে নাও আরশির সুস্থতা তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট”

মারিয়াম তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে এপ্রোনটা হাতে নিলো।পড়তে পড়তে বলতে লাগল…

—”দ্যাটস মিন..আমি তোমার ওয়াইফ হওয়া সত্ত্বেও তুমি আমায় বাইরের একটা মেয়ের জন্য ভালোবাসবে!এটাই তো মিন করতে চাচ্ছো তাইনা যে আরশির অপারেশনটা আমি সাকসেসফুলি করতে পারলে তুমি আমায় স্ত্রীর অধিকার দিবে!”

মেসবাহ মারিয়ামের কথার জবাব দিতে পারল না।চুপসে গেলো ওর মুখটা।কিছুক্ষণ উশখুশ করে বেরিয়ে গেলো মারিয়ামের চ্যাম্বার থেকে।মারিয়ামের দু’চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল।ও ডান হাতের তালু দিয়ে চোখটা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলল….

—”কাঁটাই যদি না থাকে তাহলে পায়ে বিঁধবে কি?কাঁটাই আমি উপড়ে ফেলব।আমার পথের কাঁটা!চোখের বালি আমার তুমি আরশি!”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here