” দাড়িওয়ালা ছেলেকে বিয়ে করব আমি? যে ছেলে স্মার্টনেস বোঝে না, মাথায় টুপি,কাধ পর্যন্ত চুল, এ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, যে ছেলে শার্ট -প্যান্ট, টিশার্ট, স্যুট,বুট, না পরে সারাক্ষণ নিজেকে পাঞ্জাবিতেই আবদ্ধ রেখেছে তাকে বিয়ে করব আমি, লাইক সিরিয়াসলি আম্মু! বাবা তার বোনের এরকম একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে কীভাবে ঠিক করতে পারলো? তার বোনের ছেলেকে সে ভয় পেতে পারে, এ বাড়ির সবাই ভয় পেতে পারে আমি ভয় পাই না। আমি ইয়াশকে বিয়ে করতে পারব না মানে পারব না।”
কথাগুলো বলে টেবিলে গ্লাসে রাখা পানি ঢকঢক করে এক দমে খেয়ে নিলো ঈশিতা। পাশের রুম থেকে ঈশিতার সবকথা কান পেতে শুনলেন বেলাল সাহেব, উনার মতে মায়ের অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে মেয়েটা মাথায় চড়ে বসেছে। বেলাল সাহেব পাশের রুম থেকে এসে মেয়ের সামনে দাঁড়ালেন।
ঈশিতা তৎক্ষনাৎ বাবাকে সামনে দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ সে ভেবেছিল তার বাবা হয়তো অফিসেই আছে। ঈশিতা আশ্চর্য হয়ে বলে,-
” বাবা তুমি! ”
” হ্যাঁ আমি, আমি যদি পাশের রুমে না থাকতাম তাহলে তো আমার মেয়ের এত বড় বড় কথা আমি শুনতেই পারতাম না। বাবার পছন্দের উপর মেয়ের ভরসা নেই, বাবার পছন্দকে মেয়ে কোন তোয়াক্কা করে না এটা একটা বাবার কাছে কতটা কষ্টের, এটা তুমি বুঝবে না। যদি তোমার নিজের সন্তান থাকতো তাহলে বুঝতে। আর আমার কথাই শেষ কথা ইয়াশকে তোমার পছন্দ হোক বা না হোক তাকেই তোমার বিয়ে করতে হবে।”
” বাবা আমি ইয়াশ ভাইকে বিয়ে করতে পারবোনা। আমার সাথে উনার যায় না, কোনভাবেই যায় না। আর তাছাড়া দেশে তো ছেলে-মেয়ের অভাব নেই যে মামাতো ফুপাতো ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে দিতে হবে। ”
” তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি ঈশিতা! ”
” আ’ম স্যরি বাবা, কিন্তু আমি ইয়াশ ভাইয়াকে সত্যিই বিয়ে করতে পারব না।”
” আমিও দেখব বিয়ে তুমি কীভাবে আটকাও।”
কথাটা বলেই বেলাল সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মিসেস রমেলা এবং ঈশিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এক পর্যায়ে ঈশিতা রাগ করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঈশিতা এবার সম্মান চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছে। ভার্সিটি খুব একটা দূরে না বিধায় বাড়ি থেকেই যাতায়াত করে। পড়াশোনা যেহেতু প্রায় শেষের দিকে তাই বেলাল সাহেব ঠিক করেছেন বোনের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন কিন্তু ঈশিতা কোনভাবেই ইয়াশকে বিয়ে করতে রাজি না কারণ ইয়াশ রাজনীতির সাথে জড়িত, রাগী স্বভাবের, কেমন একটা সেকেলে ভাব ও আছে তার মধ্যে যা ঈশিতার পছন্দ না। ঈশিতা বেরিয়ে যায় হয়তো বন্ধুদের সাথে দেখা করে বিয়ে ভাঙার কোন প্ল্যান করবে। মিসেস রমেলা মেয়ের এমন ব্যবহার দেখে কপাল চাপড়াচ্ছেন, তার অতিরিক্ত ভালোবাসায় মেয়ের অবস্থা এমন হয়েছে যা এখন ঠিক করার ও নয়। ইয়াশ ছেলে হিসেবে খুব ভালো সেটা তিনিও জানেন তাই ঈশিতাকে যেকোন মূল্যে রাজি করাতেই হবে বলে চিন্তা করেন।
_________
প্রিয়তা ব্যাগ গুছিয়ে হোস্টেল থেকে বের হয়েছে তার একমাত্র ফুপির বাসায় যাবে বলে। সেখানে তার প্রিয় মানুষটির দেখা মিলবে। অনেকদিন দেখা হয় না প্রিয় মানুষটির মায়ামাখা মুখটা। বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল সে এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে হাতে নিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইয়াশ কল দিয়েছে। ফোনস্ক্রিনে ইয়াশ নামটা দেখেই প্রিয়তার মুখে হাসি ফুটে যায়। এক মুহূর্ত দেরি না করে কল রিসিভ করে।
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম, আছিস কোথায় এখন?”
” আমি এই যে আমার হোস্টেল থেকে বের হয়েছি, ফুপি কল দিয়েছিল বাসায় যাওয়ার জন্য।”
” হ্যাঁ মা আমাকে বলেছিল তোকে নিয়ে আসতে কিন্তু আমার একটা ইমার্জেন্সি কল এসেছে এক জায়গায় যেতে হচ্ছে আমি কি তোকে নিয়ে আসতে কাউকে পাঠিয়ে দেব?”
” না কারও আসতে হবে না আমিই একটা রিকশা নিয়ে চলে আসব।”
” পারবি আসতে?”
” হ্যাঁ দশমিনিটেরই তো রাস্তা, আমি পারব আসতে আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”
” ঠিক আছে তাহলে সাবধানে আয়, আমার এখনই বের হতে হবে রাখছি তাহলে।”
” ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ। ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
প্রিয়তা আর কিছু না বলে কল কেটে দেয়। নিজেই একা একা কথা বলতে থাকে, “এই লোকের ব্যস্ততা কখনও যাবে না, সারাদিন রাত এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ত আছে তো আছেই। একটা কীভাবে এত ব্যস্ত থাকতে পারে সেটা প্রিয়তা কিছুতেই বুঝতে পারে না। একটু এখান থেকে বাসা অব্দি সাথে করে নিয়ে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো! ”
আবার নিজেই নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয় কারণ ইয়াশের তো আসার কথা ছিলই না।
প্রিয়তা একটা রিকশা ডেকে উঠে ফুপির বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। প্রিয়তা এবার সম্মান প্রথমবর্ষে। গতকালই প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হলো, তার ফুপির বাসাও ভার্সিটি থেকে অল্পকিছুদূরের দূরত্ব। প্রথমে তার ফুপি নিজেই বলেছিল তার বাসায় থেকেই পড়াশোনা করতে কিন্তু ইয়াশ নিজেই নিষেধ করেছে, বলেছে অবনী আর প্রিয়তা একসাথে থাকলে কারো পড়া হবে না ঠিকমতো। মাঝেমাঝে যেন ঘুরতে আসে, দুজন একসাথে সময় কাটাবে।
ইয়াশ হয়তো প্রিয়তাকে মামাতো বোন হিসেবেই দেখে কিন্তু প্রিয়তা মোটেও ইয়াশকে ফুফাতো ভাইয়ের নজরে দেখে না। ক্লাস নাইনেই প্রায় প্রতিটা মেয়ে প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়ে। প্রিয়তাও এর ভিন্ন হয় নি, সেও প্রথমবারের মতো ইয়াশের প্রেমে পড়েছিল। বয়স হিসেব করতে গেলে গোটা দশ বছরের বড় ইয়াশ প্রিয়তার থেকে। সে কতবার ভেবেছে ইয়াশকে তার মনের অনুভূতিগুলো একে একে সব বলে দেবে কিন্তু তার সামনে গেলে সাহসে কুলিয়ে ওঠে না। আনমনে রিকশায় বসে থাকে প্রিয়তা, রাজ্যের ভাবনা এসে ভর করে তার মাথায় কবে বলে উঠতে পারবে সে তার অনুভূতিগুলো!
________
ইয়াশ আলমারি থেকে লন্ড্রি করা সাদা রঙের পাঞ্জাবি পাজামা পরে, আতরে নিজেকে মুড়িয়েই ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয় রুম থেকে। ইয়াশের মা মিসেস বেলা রান্না ঘরে কিছু একটা করছিলেন ছেলের ভর দুপুরে বের হওয়া দেখে দৌঁড়ে দরজায় এসে দাঁড়ান।
ওরনা দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলেন-
” এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস বাবা?”
” মা একটা জরুরি কল এসেছে, আমার এক্ষুণি যেতে হবে।”
” আমি যে এতকিছু রান্না করলাম, তার কি হবে?”
” আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসব মা, চিন্তা করো না।”
” কি জরুরি দরকার শুনি? প্রিয়কে যে নিয়ে আসতে বললাম তার কি হলো?”
” ওকে কল দিয়েছিলাম, রওয়ানা দিয়েছে। চলে আসবে হয়তো এখনই। ”
” মেয়েটা এতদিন পর আসছে, তোকে বললাম নিয়ে আসতে আর তুই কি না একাই আসতে বললি!”
” না মা, আমি বলেছিলাম কাউকে পাঠাবো কি না কিন্তু ও বলল একাই আসতে পারবে। এখন আর কথা বলতে পারব না আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে মা, এখন আসছি আল্লাহ হাফেজ। আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
ছেলে চলে গেলে তবুও সেই দরজার দিকেই তাকিয়ে থাকেন। ছেলেটা সারাদিন এত তাড়াহুড়োতে থাকে! আবার রান্নাঘরে গিয়ে রান্নায় মন দেন তিনি, মেয়েটা এসে খেতে চাইবে তাই রান্নাটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।
_________
সিড়ি দিয়ে নামার সময় বোরখা,নিকাবে কাউকে দেখে একপাশে দাঁড়িয়ে যায় ইয়াশ। মেয়েটিও ইয়াশকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়।
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”( প্রিয়তা)
” ওয়ালাইকুমুস সালাম, কে প্রিয়?”
” হ্যাঁ আমি। ”
” বাহ ভালো পরিবর্তন হয়েছে দেখছি, মাশআল্লাহ। আচ্ছা যা ভেতরে যা মা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আমি যাই আমার কাজ আছে।”
” নিচে দেখলাম গাড়ি নিয়ে কয়েকজন অপেক্ষা করছে।”
” হ্যাঁ আমার জন্যই।”
” আচ্ছা, কখন আসবেন?”
” খুব তাড়াতাড়ি আসব ইন শা আল্লাহ, এখন যাই আমি আল্লাহ হাফেজ । ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
ইয়াশ পাশ কাটিয়ে বের হয়ে চলে যায়, প্রিয়তা চেয়ে থাকে আর বলে ইশ কি সুন্দর লাগছে আমার শেহজাদাকে! আমি আজকেই ফুপিকে বলব তোমার ছেলের বউ বানিয়ে নাও আমায়।”
চলবে…..
#প্রিয়তার_প্রণয়সন্ধ্যা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#সূচনা_পর্ব