প্রেমের হাতেখড়ি পর্ব -৪২ ও শেষ

#প্রেমের_হাতেখড়ি
#পর্ব:৪২
#ফাতেমা_জান্নাত

রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশ। চার দিকে শুনশান নিরবতা। এই সময় টা তে হালকা আওয়াজ টা অনেক বেশি কর্ণপাত হয়।আর সেখানে জান্নাত, প্রণয় এর পরিবার এর কান্না তো তুলনা মূলক ভাবে বেশিই শোনা যাচ্ছে। দুই দিকের দুটো “অপারেশন থিয়েটার” এর দিকে তাকিয়ে আছে দুই পরিবার।ডাক্তার এখনো বের হয়নি।কিছু বলেনি কাউকে।
মিনিট দশেক গড়াতেই ডাক্তার বের হয়ে আসে প্রণয় এর অপারেশন থিয়েটার থেকে।প্রান্তিক ছুটে যায় ডাক্তার এর কাছে।ডাক্তার এর সামনে এসে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ধরা গলায় সুধায়,

—আমার ভাইয়া কেমন আছে আঙ্কেল? আমার ভাইয়া ঠিক আছে তো?

প্রান্তিক এর কথায় ডাক্তার মাথা নিচু করে নেয়।বড় করে দুটো নিশ্বাস ত্যাগ করে প্রান্তিক এর কাধঁ চাপড়ে বলে,

—আই আ’ম সরি প্রান্তিক। প্রণয় এর বুকে গুলি করা হয়েছিলো। যা ওর হার্টে গিয়ে লেগেছে। তাছাড়া প্রণয় এর মাথায় প্রথমত ভারি কিছু দিয়ে বা’রি দেওয়া হয়েছিলো। পরে আবার উপর থেকে ফেলে দেওয়াই মাথার সেই আ’ঘাতে আবার ও আ’ঘাত পেয়েছে।এর ফলে মাথার মগজে ও আ’ঘাত পায় জটিল আকারে।আর সেই জন্যই আমরা চেষ্টা করার পর ও পারিনি অপারেশন সাকসেস করতে।কিছুক্ষণ এর মধ্যে প্রণয় এর জ্ঞান আসবে।হয়তো অল্প কিছুক্ষণ জ্ঞান থাকবে তারপর…

বলেই ডাক্তার সেখান নিশ্বাস ফেলে থেকে চলে যায়।শাহরিয়ার পাবেল আর রোকসানা হু হু করে কেঁদে উঠে।প্রান্তিক সেখানেই ধপ করে বসে যায়।ডাক্তার এর বলা অতি বি’ষাক্ত কথা গুলো তার কানের মধ্যে এসে যেন ঝা ঝা করেছে।রিফাত এসে প্রান্তিক এর কাঁধে হাত রাখতেই প্রান্তিক রিফাত কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে।রিফাত নিস্তব্ধ তা কে সঙ্গী করে নিয়ে নিরবতায় কান্না করে।


কিছুক্ষণ পরেই প্রণয় এর জ্ঞান ফিরে।সে ডাক্তার এর কাছে বহু কষ্টে জানতে চায়,

—“আমার জান্নাত কোথায় “।

ডাক্তার প্রণয় এর কথার উত্তরে শুধু বলে,

—“এখানো অপারেশন চলছে তার”।

প্রণয় অনুরোধ করে।বিনয়ী সুরে বলে,,

—আমি আমার জান্নাত এর সাথে দেখা করতে চাই।প্লিজ নিয়ে চলুন।

ডাক্তার কিছু বলে না প্রণয় এর কথায়।হয়তো বলতে সাহস পাচ্ছে না কিংবা তার হৃদয় বাঁধা দিচ্ছে বলতে।ডাক্তার দুই জন ওয়ার্ড বয় কে বলে “প্রণয় কে স্ট্রেচার করে জান্নাত এর অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে”।

প্রণয় এর নিশ্বাস খুবই সংকীর্ণ ভাবে উঠা নামা করছে।টেনে টেনে নিশ্বাস নিচ্ছে। নিশ্বাস নিতে ও তার কষ্ট হচ্ছে।বুকে ব্য’থা করে নিশ্বাস নিতে গেলে।তবুও শেষ মুহূর্তে তার প্রান প্রিয় প্রিয়তমা স্ত্রী কে দু চক্ষে দেখতে চায় সে।প্রণয় কে স্ট্রেচারে করে বাইরে বের করতেই আরো একবার দুই পরিবার কেঁদে উঠে।কেউ কিছু বলতে চেয়ে ও বলতে পারেনি কান্নার জন্য।প্রণয় সবার দিকে একবার নজর চোখ ভুলিয়ে হেসে দেয়।


জান্নাত এর এখনো অপারেশন ফুল ফিল হয়নি।বাচ্চা এবং মা দুই জনে বাঁচবে কিনা সন্দেহ আছে।জান্নাত প্রচুর ব্লাড লস হয়ে গেছে।ব্লা’ড দেওয়া হয়েছে তার পর ও কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছে না ডাক্তার মরিয়ম। আল্লাহ জানে এই অপারেশন থিয়েটার থেকে কিভাবে বের হতে হয়।জীবত নাকি মৃ’ত।

প্রণয় কে এনে জান্নাত এর পাশে রাখা হয়।প্রণয় জান্নাত এর দিকে তাকায়।জান্নাত চোখ বন্ধ করে আছে।মুখশ্রী তে ব্য’থাতুর ছাপ।চোখ বন্ধ।চোখের কার্ণিস বেয়ে পানি পড়ছে।প্রণয় হাত টা এগিয়ে জান্নাত এর হাত ধরে।জান্নাত চোখ মেলে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে প্রণয় তার দিকে তাকিয়ে আছে।জান্নাত হু হু করে কেঁদে উঠে।কিন্তু তার কাঁদতে ও কষ্ট হচ্ছে। পেটে চিনেচিনে ব্য’থা শুরু হয়।মনে হচ্ছে কিছু কামড়ে ধরে আছে পেটের চামড়া। জান্নাত চি’ৎকার করে উঠে।প্রণয় এর হাতের উপর ভর রেখে শক্ত করে ধরে রাখে।

কিছুক্ষণ পরেই বাচ্চার কান্না শুনা যায়।জান্নাত ঝাপসা চোখের দৃষ্টিতে প্রণয় এর দিকে তাকায়।ডাক্তার এসে বলে তাদের মেয়ে হয়েছে।জান্নাত এর সামনে মেয়ে কে তুলে ধরে।কিন্তু তাকে হাত বাড়িয়ে কোলে নেওয়ার মতো এক বিন্দু শক্তি ও জান্নাত এর মধ্যে অবশিষ্ট নেই।এই তো মনে হচ্ছে তার দেহ থেকে রুহ টা বিধায় নিবে।প্রণয় জান্নাত এর দিকে তাকিয়ে অতি ক্ষীর্ণ কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে বলে,

—“আমার কপাল টা ঠান্ডা হয়ে আছে জান্নাত, আপনার অধর যুগোল এর উষ্ণতা দিবেন না?শেষ বারের মতো”?

জান্নাত তাকায় প্রণয় এর কথা শুনে।প্রণয় চোখে ও জলকণা দেখা যাচ্ছে।জান্নাত চোখে পানি রেখে ক্ষীণ হেসে দেয়।পেট চেপে উঠার চেষ্টা করে জান্নাত ।একটু উঁচু হয়ে প্রণয় এর কপালে অধর ছোঁয়া দেয়।চোখ থেকে দু ফোঁটা নোনাজল প্রণয় এর মুখে পড়ে।আর সেই মুহূর্তে -ই প্রণয় এর বুকের উপর ঢলে পড়ে জান্নাত এর মাথাটা। প্রণয় হকচকিয়ে জান্নাত এর মুখের দিকে তাকায়। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আছে।প্রণয় এর অতি কাছে থাকা সত্ত্বেও জান্নাত এর নিশ্বাস পরছে না প্রণয় সুঠাম দেহের এর উপর।প্রণয় ডাক্তার দের দিকে তাকায়।ডাক্তার মরিয়ম দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বুঝায়, “জান্নাত আর নেই,বিধায় নিয়েছে এই দুনিয়া থেকে”।

প্রণয় কেঁদে দেয়।জান্নাত এর কপালে আর মুখে আদরে ভরিয়ে তুলে।সর্বশেষ এ নাকের সেই তিল টাতে ও একটা আদর করে দেয়।জান্নাত কে সেই ভাবেই বুকের উপর রাখে।সরায় না।ডাক্তার মরিয়ম কে ইশারায় বলে, “তার মেয়ে কে দিতে”।ডাক্তার মরিয়ম ছোট্ট ফুটফুটে একটা বাচ্চা এনে প্রণয় এর পাশে হাতের উপর দেয়।প্রণয় তাকায় তার রাজকন্যার দিকে।একপাশে মৃ’ত স্ত্রী অন্য পাশে তার সদ্য জন্মগ্রহণ করা রাজকন্যা।
প্রণয় মেয়ের মাথায় আদর দিয়ে দেয়।নিশ্বাস টা আটকে আসছে তার।তবু মেয়ে কে কাছে টেনে মেয়ের কানের কাছে আজান দেয়।হেসে দেয় মেয়ের দিকে তাকিয়ে। নিশ্বাস এর গতিবেগ বেড়ে যায় প্রণয় এর।বুকের বাম পাশ টায় যেন কিছু কামড়ে ধরে আছে।হৃৎপিণ্ড টাকে যেন টেনে বের করে নিতে চাচ্ছে।চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।ঝাপসা দৃষ্টি তেই একবার মেয়ের দিকে তাকায়।পর মুহূর্তে জান্নাত এর দিকে তাকিয়ে বলে,

—‘‘আপনাকে দেখে যেমন আমার মনে প্রেমের হাতেখড়ি হয়েছিলো।ঠিক তেমনি আপনাকে দেখেই যেন আমার দেহের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ হয় জান্নাত ’’।

বলেই বার কয়েক প্রণয় নিশ্বাস টেনে টেনে নিয়ে নিথর হয়ে যায়।দেহ থেকে রুহ টা বিধায় নিয়েছে।ডাক্তার মরিয়ম এসে প্রণয় কে চেক করে দেখে প্রণয় ও জান্নাত এর সাথে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। পাশে তাদের রাজকন্যা ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে।মেয়ে টা জানো না তার জন্মের দিন-ই সে এতিম হয়ে গেলো।

ডাক্তার মরিয়ম প্রণয় এর মেয়ে কে কোলে নিয়ে বের হয় ‘ওটি’ থেকে।দুই পরিবার এর সবাই ছুটে আসে।ডাক্তার মরিয়ম আর সিনিয়র ডাক্তার এর দিকে কান্নারত মুখশ্রী নিয়ে তাকিয়ে বলে,

—জান্নাত আর প্রণয় কোথায়?

দুই জনে ডাক্তারি চুপ থাকে।প্রান্তিক আর জুরাইন, রিফাত ডাক্তার দের থেকে উত্তর এর জন্য অপেক্ষা না করে ছুটে যায় ‘ওটি’ এর ভিতরে। দুই টা সিটে দুটো নিথর দেহ পড়ে আছে।জুরাইন ‘আপু’ বলে চি’ৎকার করে উঠেই জান্নাত এর সিটের কাছে গিয়ে চি’ৎকার করে কান্না করতে থাকে।প্রান্তিক প্রণয় কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে যাচ্ছে। জুরাইন কান্না করতে করতে বলে,

—এই আপু!আপুরে!উঠনা।আপু আমি তোর সব কথা শুনবো রে।আর তোকে মা’রবো না।তোকে রাগাবো না।আপু তুই উঠ।আমি আর পাখির সাথে কথা বলবো না।আপু আমি কার সাথে রে মজা করবো? কার সাথে বাড়িতে গিয়ে ছুটাছুটি করবো? কার এসে উদ্ভট কথার উত্তর জানতে চাইবো?আপুরে উঠ নারে তুই।

—ভাইয়া, এই ভাইয়া। শুনতে পাচ্ছো না আমার কথা?আরে এই ভাইয়া শুনতে পাচ্ছো না আমার কথা?উঠছো না কেন?ভাইয়া এভাবে কেন চলে গেলে আমাদের ছেড়ে?আল্লাহ কেন তোমাদের দুই জনকে আমাদের থেকে নিয়ে গেলো?তোমাদের মেয়ে টা যে এতিম হয়ে গেলো। ও কাকে বাবা বলে ডাকবে ভাইয়া? ভাইয়া আমি কার কাছে গিয়ে আমার সব কথা শেয়ার করবো?কে আমার শেয়ার বক্স হবে?কে আমার মন খারাপ এর সময় আমার সঙ্গী হবে।ভাইয়া…

প্রান্তিক চি’ৎকার করে উঠে।’ওটি’ থেকে চি’ৎকার করে কান্না শুনে বাইরের সবাই চলে আসে ভিতরে। কান্নার আহাজারি শুরু হয়ে যায় আরো এক বার।অতি প্রিয় মানুষ দুই জন যে তাদের মাঝে থেকে চির বিদায় নিয়েছে।সবার কষ্ট গুলো ক্ষীণ সময়ের জন্য হলেও ছোট্ট শিশু টির কষ্ট টা সারাটা জীবন এর জন্য।সে যে মা বাবা হারিয়ে পুরো এতিম হয়ে গেলো। জন্মগ্রহণ করা দিন টি যে তার খুশির দিনের তালিকায় নাম লেখেনি।

চলবে ইনশাল্লাহ✨🖤#প্রেমের_হাতেখড়ি
#পর্বঃ_৪৩(অন্তিম পাতা)
#ফাতেমা_জান্নাত

রিফাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে চলছে।তার পাশের তরুণী তার কাঁধে হাত দিয়ে শান্ত হতে বলে।তার পাশে দাঁড়ানো রিপ্তি নামের তরুণী টি অন্য কেউ নয়।তারই স্ত্রী। তাদের বিয়ে তিন বছর হয়েছে দুই মাস আগেই।গত তিন বছরে রিফাত কখনো রিপ্তি এর কাছে প্রণয় জান্নাত এর ভালোবাসার প্রেমের হাতেখড়ি এর গল্পটা শুনাইনি। আজ কে রিপ্তি অনেক অনুরোধ করার পর রিফাত প্রথম থেকে সব কিছু রিপ্তি কে বলে।আজকের এই দিন টি তে জান্নাত প্রণয় তাদের মাঝে বিদায় নিয়েছে।তাদের মেয়ে এসে ছিলো দুনিয়া তে।জান্নাত প্রণয় মা’রা গেছে আজ আট বছর হয়ে গেছে।আট বছর আগে তারা মা’রা যাওয়ার দুই দিন পরেই প্রণয় দের দলের আজাদ সাহেব কে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।কারণ সূত্র হিসেবে ধরা পড়েছে লামিয়া সুলতানা কে মে’রে ফেলার সময় আজাদ সাহেব -ই লামিয়া সুলতানা কে পিছন থেকে হাত আর মাথা টেনে ধরেছিলো। এবং কি প্রণয় এর নির্বাচন এর অনেক কথা আজাদ সাহেব রাফসান মির্জার কাছে লিক করতো।পার্টি অফিস এর অনেক গোপনীয় কথা আজাদ সাহেব রাফসান মির্জা কে বলতো।শুধু মাত্র টাকার লোভ করেই তিনি রাফসান মির্জার সাথে হাত মিলিয়ে ছিলো। আর এই সব কিছু জানা গেছে রাফসান মির্জা কে পর পর দশ দিন রিমান্ড দেওয়ার পর তিনি আজাদ সাহেব এর নাম বলেছে।আদালত আজাদ সাহেব এর যাবত জীবন কারাদণ্ড ধার্য করেছে।আর রাফসান মির্জার এক বছর হাজত বাস এবং মৃ’ত্যু দণ্ড দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরেই জান্নাত প্রণয় এর কবর এর কাছে এসে দাঁড়ায় প্রান্তিক, জুরাইন,রিফাত সজীব,সুজন।পাচঁ জনে এসে জান্নাত এর প্রণয় এর কবর জিয়ারত করে।তাদের থেকে অনেকটা দূরে ইশি,লাবণ্য, রিপ্তি,আর আট বছর এর প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে আছে।জান্নাত প্রণয় এর মেয়ে প্রাপ্তি। মেয়ে টা কে এই আট বছরে লালন পালন করেছে প্রান্তিক, ইশি, জুরাইন। ‘প্রাপ্তি ‘ বলতে পা’গল তারা।মেয়ে টা যে তাদের- ই ভাই বোনের শেষ সম্বল। চোখে হারায় মেয়ে টা কে তারা।

কবর জিয়ারত করেই প্রান্তিক এসে প্রাপ্তি কে নিজের কোলে তুলে নেয়।দুই গালে আদর করে দেয়।প্রাপ্তির চোখে ছল ছল করছে।কিন্তু ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে।প্রাপ্তি প্রান্তিক এর গালে ও একটা আদর দিয়ে বলে,

—চাচ্চু আম্মু -বাবার সাথে কথা বলা শেষ?

প্রান্তিক হেসে দিয়ে প্রাপ্তি কে আরেকটু জড়িয়ে ধরে বলে,

—হ্যাঁ আম্মু বলেছি তো কথা।তোমার আম্মু আর বাবা বলেছে তোমাকে কান্না না করতে।তুমি কান্না করলে ওরা কষ্ট পায়।

প্রান্তিক এর কথা শুনে প্রাপ্তি দুই হাত দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে হেসে দিয়ে বলে,

—আমি কান্না করছি না তো চাচ্চু। এই দেখো প্রাপ্তি হ্যাপি।

বলেই হেসে দেয়।প্রান্তিক এর কোল থেকে জুরাইন প্রাপ্তি কে নিজের কোলে নিয়ে বলে,

—আজকে আমরা ঘুরতে যাবো কেমন আম্মু?

—কখন যাবো মামা?

—এখনি।চলো।

বলেই জুরাইন প্রাপ্তি কে ঘুরতে চলে যায় নিজের বাইক নিয়ে।সময় এর পালা বদলে সেই এগারো বছরের জুরাইন ও এখন বড় হয়েছে।এগারো বছর সময়ে যখন জান্নাত আর প্রণয় মা’রা গিয়ে ছিলো। তখন থেকে-ই বয়স এর তুলনায় জুরাইন অধিক বেশি ম্যাচুরিটি এনে ছিলো নিজের মাঝে। মানুষ বলে না,”বয়স এর সাথে সাথে মানুষ ম্যাচুউর হয়”।আমি বলি কথা টা সম্পূর্ণ ভুল।কারণ বয়স বেদে নয় বরং স্থান, কাল আর সময় এর পরিবর্তন বেদে মানুষ ম্যাচুউর হয়।এগারো বছর বয়সে ক্লাস ফাইভে থাকা জুরাইন নামক চঞ্চল বালক টি এখন উনিশ বছর বয়সের অনার্সে পড়া একটা বুঝদার ছেলে।যে কিনা তার মৃ’ত বোনের মেয়ে কে সেই আট বছর আগ থেকে-ই সবার সাথে সাথে আগলে রেখেছে,খেলেছে,ঘুরতে নিয়ে গিয়েছে।পরিবারের সবার খেয়াল রাখতে শিখেছে। জান্নাত মা’রা যাওয়ার পর থেকেই জুনায়েদ আজমী অধিক বেশি ই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বড্ড আদরের ছিলো জান্নাত তার।মেয়ে দের যেমন বাপের প্রতি টান থাকে।বাবা দের ও মেয়ে দের প্রতি ছেলে দের তুলনায় একটু বেশিই টান থাকে তাই তো আজ আট বছরে ও তিনি মেয়ে হারানোর শোক থেকে বের হতে পারেনি।প্রাপ্তি কে দেখলেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।প্রাপ্তি জান্নাত এর মতোই সেই নাকের তিলটা নিয়ে এসেছে।এই তিল টার দিকে তাকালেই যেন জান্নাত এর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে।আর প্রাপ্তির চোখ গুলো প্রণয় এর মতো।হাসি টা ও প্রণয় এর পেয়েছে।


প্রান্তিক এর পার্টি অফিস থেকে ফোন আসায় ইশি কে নিয়ে চলে আসে রিফাত,সজীব আর সুজন কে বলে।ইশি পাচঁ মাসের প্রেগন্যান্ট। এটাই তাদের প্রথম বাচ্চা। এত বছর প্রাপ্তি এর দিকে তাকিয়ে দুই জনের কেউ বাচ্চা নেওয়ার কথা মাথায় আনে নি।প্রাপ্তি কেই নিজে দের বাচ্চার মতো মানুষ করেছে।কিন্তু পারিপার্শ্বিক মানুষ এর নোনতা কথা দিন দিন যেন মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে।তাই না পেরে এবার সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চা নেওয়ার। সাথে এ ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাপ্তি কে নিজে দের মেয়ের মতোই আগের মতো করে ভালো বাসবে। কখনো প্রাপ্তি কে বাবা মা এর অভাব বুঝতে দিবে না।
প্রণয় মা’রা যাওয়ার পরে প্রান্তিক এমপি পদবী তে আসে।প্রণয় যে ভাবে মানুষ এর খেয়াল রাখতো প্রান্তিক ও তেমনি খেয়াল রাখে।কার কোথায় কি প্রয়োজন। মানুষ যেন প্রান্তিক এর মাঝে প্রণয় কে খুঁজে পায়।


সজীব এর বিয়ে হয়ে ছিলো পাচঁ বছর আগেই।কিন্তু আফসোস সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার স্ত্রী চির বিদায় নিয়েছে।তাই এখন নিজের ছেলে ইমতিয়াজ কে নিয়ে থাকে।কিন্তু প্রতি বছর এই দিনটা আসলে সব কাজ রেখে প্রণয় এর কবর এর কাছে আসবেই।রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে সে।রাজনীতি তে জড়িয়ে থাকলে তার প্রণয় ভাই এর কথা বেশি মনে পড়ে।তাই রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছে।শহরের ছোট্ট একটা বাসায় ছেলে কে নিয়ে থাকে।সাথে একটা অফিসে ছোট খাটো কাজ করতো।কিন্তু প্রান্তিক অনুরোধ করে প্রণয় এর অফিসে -ই কাজ করতে বলেছে।তাই প্রান্তিক এর কথা না ফেলে প্রণয় এর অফিসেই কাজ করছে।


সুজন আর লাবণ্য এর কোনো সন্তান নেই।লাবণ্য আর কখনো ‘মা” হতে পারবে না বলে জানিয়েছে ডাক্তার। আর তার কারণ লাবণ্য কে গণ ধর্ষ’ণ করা হয়ে ছিলো।সেই সূত্রে লাবণ্যের মধ্যে কম্পলিকেশন দেখা দিয়েছে। সুজন এই নিয়ে লাবণ্য কে কিছু বলেনি কখনো। তার তো কোনো দোষ ছিলো না তাহলে বলবে কেন?তাছাড়া সে তো তার প্রণয় ভাই কে কথা দিয়ে ছিলো ভবিষ্যৎ এ ও কখনো লাবণ্য কে পুরনো কথা শুনিয়ে কষ্ট দিবে না।তাই মানুষ টা বেচেঁ নেয় তাতে কি হয়েছে? এর পরেও তার কথা পালন করে যাচ্ছে।এতিম খানা থেকে একটা ছোট্ট মেয়ে শিশু দত্তক নিয়েছিলো।যার বয়স এখন সাত বছর।বাচ্চা টি সুজন আর লাবণ্য কে ই মা বাবা বলে ডাকে।তাদের মেয়ের নাম রেখেছে সিনথিয়া।এই তো বেশ চলছে আলহামদুলিল্লাহ। আর কি লাগে?

🌸🌸

রাতের আকাশে যেন নিকষ কালো চাদর বিছিয়ে রেখেছে। আর সেই কালো আকাশ টা তে বাঁকা চাঁদের বুড়ি তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।তাকে পাহারা দিচ্ছে হাজার হাজার তারা।প্রাপ্তি তার মা বার রুমের বেলকনি তে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ টা উপভোগ করছে।মা বাবার কথা তার প্রতিটা মুহূর্তে মনে পড়ে।কিন্তু তার মামা আর চাচ্চু বলে সে কান্না করলে তার মা বাবা কষ্ট পাবে।তাই তো কান্না করে না সে।কান্না দের দমিয়ে রাখে।

ঘরে ফিরে এসে সকালে তাড়াহুড়া তে বালিশ এর নিচে রেখে যাওয়া প্রেমের হাতেখড়ি নামের ডাইরি টা বের করে নেয়।ডাইরি টা তে শেষের অনেক গুলো পাতা খালি।অনেক গুলো কথা অসম্পূর্ণ। ডাইরি টা তার মায়ের -ই লেখা।মা ও চলে গিয়ে ছিলো ডাইরি ও অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো।

প্রাপ্তি ডাইরি টা খুলবে আবার এমন সময় ইশি নিচ থেকে প্রাপ্তি কে ডাকতে ডাকতে উপরে আসছিলো। প্রাপ্তি তা দেখেই তাড়াতাড়ি ডাইরি টা ড্রেসিং টেবিল এর ডয়ারে রেখে দেয়।

ইশি এসে প্রাপ্তি কে নিয়ে যায় খাবার খাওয়ার জন্য।প্রাপ্তি একবার চোখ ভুলিয়ে পুরো রুমটা তে তাকায়।এই রুমটা তে তার মা বাবার হাজারো স্মৃতি লেগে আছে।তার কানে এসে যেন তার মা বাবার হাসি মজা করার প্রতিটা কথা এসে বা’রি খাচ্ছে।যেন পাশাপাশি দুটা বেলকনি থেকে তার মা বাবা কথা বলছে।বেলকনি তে বসে প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখছে তার মা বাবা।পাশের বেলকনি থেকে তার মা তার বাবা কে মি. ভালোবাসা বলে সম্বোধন করছে।এমন হাজার ও ভাবনা প্রাপ্তি এর মনে এসে বাসা বাধছে।এই আট বছরে তার মায়ের ডাইরি টা সম্পর্কে কিছুই জানতো না সে।গতকাল – ই মা বাবার রুমে ঘুমাতে এসেছিলো। বুঝ হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর তার মা বাবা মা’রা যাওয়ার আগের দিন রাত আর যেদিন মা’রা যায় সেই রাত এই দুই দিন রাতে মা বাবার রুমে ঘুমায় সে।তার মা বাবার সাথে কল্পনা তে কথা বলে এই দুটো রাতে।সেই সূত্রে ঘুমাতে এসেই কি মনে করে ড্রেসিং টেবিল এর ডয়ার খুলেছিলো।আর সেখানেই ডাইরি টা পায় আর সকালে ভোরে ভোরে পড়া শুরু করে।এবং জানতে পারে তার মা বাবা দুষ্টু মিষ্টি প্রেমের হাতেখড়ির গল্পটা।

ইশি প্রাপ্তি কে নিয়ে যায় নিচে।ডাইরি টা পড়ে থাকে ডয়ারে।থেকে যায় কিছু অসমাপ্ত লেখা।পাশে পাশে বেলকনির এক রাজনীতি বিদ আর এক সাধারণ খানিক চঞ্চল মেয়ের আত্মগোপনে রাখা ভালোবাসা থেকে বিয়ের গল্প।রাজনীতি বিদ দের সুখের সংসার করার স্বপ্ন দেখতে নেই।বিশেষ করে যারা অন্যায় এর পথে রুখে দাঁড়িয়ে মানুষ এর সেবার জন্য রাজনীতি করতে চায়।তাদের তো পুরোই নিষেধ। যার জল জ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে থেকে যায় প্রণয় আর জান্নাত। কিন্তু প্রান্তিক কি আর তা মানে?সে ও চলছে পুরো উদ্যমে রাজনীতি এর পথে।

প্রাপ্তি ঘরে এসেই একটা অ্যালবাম নিয়ে তার মা বাবার ছবিটা দেখতে থাকে।ছবি টার মধ্যেই মা বাবার মুখে আদর দিয়ে বলে,

—আল্লাহ ওখানে তোমাদের ভালো রাখুক আম্মু -আব্বু দোয়া করি। তোমাদের প্রাপ্তি অনেক হ্যাপি আছে।তোমরা মন খারাপ করো না,কষ্ট পেয়ো না কেমন? প্রাপ্তি অনেক হ্যাপি থাকে।চাচ্চু, মামা,ছোট মা আমার অনেক খেয়াল রাখে।আমাকে আদর করে।আমাকে হ্যাপি রাখে।তোমাদের পার্শিয়া জেনিথ ও সব সময় আমাকে হ্যাপি রাখে আব্বু আম্মু।
প্রাপ্তি অনেক হ্যাপি আব্বু -আম্মু।

বলেই প্রাপ্তি অ্যালবাম টা জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।চাইলে ও যে সে কান্না আটকা তে পারেনি আজ।আজ মা – বাবার কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে তার।তার বাবা মা যে আল্লাহর কাছে চলে গেছে আর ফিরে আসার নয়।মা বাবার অভাব কেউ তাকে বুঝতে না দিলেও রাতের অন্ধকারে ঠিকই মা বাবার অভাব এসে তাকে ঝেকে ধরে।

✨সমাপ্ত 🖤

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here