#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
ছেলেটার প্রেমের গভীরত্ব যে অসীমা তা তার জানা। তবুও সে তার প্রেমে পড়েনি কেন ভেবে পায় না রমণী কখনো। আজ কাব্য ভাগ্যের জোরে তার হলেও তখন কাব্য শুধু মাত্র এক ভাসমান মেঘ ছিল। তারপরও সে…
“কাউকে ভালোবাসার কোনো কারণ থাকে না; কারণ থাকে পছন্দ করার, প্রেম করার। ভালোবাসা তো বিনা কারণেই হয়। তাই তো কেউ খুব ভালোবাসলেও তাকে ভালোবাসা যায় না, আবার কারো অবহেলাতেও ভালোবাসা হয়ে যায়।
একচ্যুয়ালি লাভ ইজ দ্যা নেম অফ আ ভেরি ইররেশন্যাল ওয়ার্ল্ড। যে জগতে কোনো যুক্তি, কোনো তথ্য, কোনো চিন্তাশক্তি কাজ করে না।”
বেশ গম্ভীর সুরেই আপন মনেই কথাগুলো বলে রমণী। সে নিজেরে জগতেই আবদ্ধ, আর তার চোখজোড়া আটক সেই কৃষ্ণচূড়ার প্রাঙ্গণেই। এতটাই ডুবে সে পিছনে যে একজন মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারে না।
“আজ বড় বিশাল বিশাল প্রেমের ভাবনায় ডুবে আছো দেখি? কবি হয়ে গেলে না কি?”
আবরারের ডাকে চমকে উঠে পিছনে তাকায় সে। হাস্যরসিক ভাব নিয়েই জবাব দেয়,
“হুম, আপনি ভাবলে তাই-ই। বিকেল হয়েছে চা খাবেন না কি কফি?”
“যেকোনো একটা হলেই হলো, তবে কফি হলে ভালো হয়।”
সামিয়া কফি করে বাবা-মাকে দুই কাপ দিয়ে বেডরুমে ট্রে নিয়ে যায়। বারান্দায় থাকে টুলে কাপটা রেখে বলে,
“এই নিন আপনার কফি।”
বিনা কথাতেই কাপটা হাতে তুলে নেয় আবরার। কফিতে দুই চুমুক দিয়ে সে মুখ খুলে।
“আমার আসলে তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
সামিয়া বিচলিত হয়। ঐ যে তার ভীতু চিন্তা-ভাবনা। তার ভাষ্যমতে তো সমস্যার মুখোমুখি হলেই জটিলতা বাড়ে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে কিছু না বলে বের হয়ে যায় সে।
আবরার অবাক হয়। ভাবছে,
“এমন কী কথা যা জানাতে সবার এত দ্বিধা?”
সামিয়া ফেরত এসে আবরারের হাতের তালুতে বড়সড় একটা চিরকুট গুঁজে কফির ট্রেটা তুলে বের হয়ে যায়। চিরকুটটি গুঁজে দেওয়ার সময় একবারও আবরারের দিকে তাকায়নি। যেন নজর এড়াচ্ছিল সে না কি সত্যিই এড়াচ্ছিল?
সব ভাবনা বাদ দিয়ে চিরকুটটি পড়তে অগ্রসর হয় সে।
“আবরার,
আমি জানি আপনি আমাকে কী জিজ্ঞেস করতে
চাচ্ছেন বা কী নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন। ফাহাদের
সাথে দেখা করেছেন, ফাহাদ আজ আমাকে
সেদিনের সব কথাই বলেছে।
একদিন না একদিন অতীত সামনে আসারই ছিল,
তবে এভাবে যে আসবে সেই ধারণা টুকুও ছিল না। চিন্তা কোরো না, তুমি আর ধোঁয়াশার মাঝে থাকছো না। অবশ্য, ধোঁয়াশার মাঝে রাখার উপায় টুকুও নেই।
অনেক কিছু তোমার জানার আছে, আমার বলার আছে কিন্তু বলো তো কী? বড়োই ভীতু আমি। নিজ মুখে তাই বলতে পারছি না। আমি এখন আমার মামাতো ফুপির বাসায় যাচ্ছি বাবা-মায়ের সাথে।
আমার ফোনের নোটবুকে সম্পূর্ণ অতীতটাই পেয়ে যাবে। সব পড়ে যদি মনে হয় ভালোবাসো, তবে কল কোরো কিংবা চলে এসো। আর যদি মনে হয় থাকা যাচ্ছে না এই একাকিনীর সাথে, তাহলে চলে যাব সব ছেড়ে চেনা শহরে।
ইতি,
তোমার স্ত্রী?
___
আঁধার রাতে বসার ঘরে অহন মেজাজ খারাপ করে বসে আছে। মেয়েটা এমনিতেই অবাধ্য স্বভাবের, সাথে তার প্রতি রাগ থেকে ভয়ংকর রকম বেয়ারা এবং বেয়াদব হয়েছে। সে যা বলছে সদাই তার উল্টোই করছে।
এইতো খাণিক ক্ষণ আগের কথা। নিশা মুখ ফুলিয়ে টিভিতে ক্রাইম পেট্রোল ডুবে। অহন বেশ খুশমেজাজের সাথেই বাগান থেকে হাতভর্তি বেলি ফুল নিয়ে আসে, প্রেয়সীর চুলের সুঘ্রাণে বেলির সুভাষ আরও ভুবনমোহিনী লাগবে ভেবে।
কিন্তু সে যেই ঘরে এসে নিশার কোমর জড়িয়ে ধরল, নিশা ছিটকে সরে গেল তার থেকে। অহন তবুও বগলদাবা করে ধরে পাশে বসল।
“বিবি, এত রাগে না সোয়ামির উপরে। দেখো, সোয়ামি তোমার জন্য একদম ফ্রেশ ফ্রেশ সুগন্ধা বেলি এনেছি। দেখো, দেখো, কী ঘ্রাণ!”
বলে ফুলে ভরা হাতটি এগিয়ে দিল নিশার দিকে। নিশা হাত ঝাড়া দিয়ে সব ফুল মাটিতে ফেলে দেয়।
“এত ভালো অভিনয় কী করে করো, হ্যাঁ? থামাও এসব ভালো মানুষী, ভালোবাসার অভিনয়। আমি আর নিতে পারছি না এসব। আমাকে এত জ্বালিয়েও শান্তি হয়নি, আরও প্রতিশোধ নিতে চাও?”
“তোমার মাথা ঠিক আছে? কী বলছো এসব অভিনয়-টবিনয়? দেখো এত সুন্দর একটা মুমেন্ট নষ্ট করবা না জান। আমি কিন্তু রেগে যাব তাহলে।”
বলেই আবার কাছে টেনে নেয় নিজের প্রেমিকা বনাম স্ত্রীকে।
ঘাড়ে উষ্ণ স্পর্শ পেতেই নিশা আবেশে চোখ বুজে ফেলে, পরক্ষণেই কী একটা মনে করেই আবার রেগে যায়। এক ধাক্কায় মেঝেতে পড়ে যায় অহন, কারণ সে এতটা সামলে দাঁড়িয়ে ছিল না।
“তুমি আমাকে টাচ করবা না। আমাকে ছোঁয়ার কোনো অধিকার নাই তোমার। যাকে ভালোবাসো তাকে যেয়ে ছোঁও।”
এবার রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে অহনের। এক ঝটকায় কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় ফেলে দু হাত নিজের হাত জোড়ার মাঝে বন্দী করে নেয়। পা চালিয়েও, জোরাজুরি করেও লাভ হয় না। পুরুষের দানবীয় শক্তির নিকট কী আর জিতে এই কোমল দেহের নারী!
হার মেনে শান্ত হয় নারী, তবে চোখে চোখ আর রাখে না। কিন্তু তাতে কী? যুবকের রাগ তখনো চূড়ায়। হিসহিসিয়ে বলল,
“ঐদিকে দেখিস? আরেক জামাই বসে আছে ঐদিকে? আমার দিকে তাকা!”
শীতল ক্রোধে রুহ শিহরিত হয় নিশার। এই একটা মাস যে এই চেনা পুরুষটির অচেনা রূঢ় রূপই দেখেছে সে। ভয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে। নীরব এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে বন্ধ চোখ হতেই।
অহন নিশার চিবুক চেপে ধরে নিজের সামনে রাখে। অতঃপর পরপর তিনবার ভয়ংকর কামড় বসায় ফুলকো ডান কপোলের একই জায়গায়।
“আহ! ছাড়ো প্লিজ অহন। অনেক লাগছে আমার।”
কোঁকিয়ে উঠে বলতে শুরু করে নিশা। সেসবে কোনো ধ্যান দেয় না অহন। নিজের রাগ মিটলেই শান্ত হয় সে। তবুও তার বাহুবন্ধনের বন্দিনী হয়েই আছে যুবতী, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
“খবরদার, একদম কাঁদবা না! আস্কারা পেতে পেতে একদম মাথায় উঠে গেছো। এখন যাও, কাটায় কাটায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে। একদম হাটবে না, বসবে না, শুবে না। ”
শাসানো শেষে নিশাকে বেডের সামনে দাঁড় করিয়ে বের হয় সে। এখনো সোফায় বসে রেগে বসে আছে যুবক।
এদিকে নিশা সেখানে দাঁড়িয়েই নীরবে কাঁদছে। আজ কী না শুনল সে ঝুমকোর থাকে। কত বড় বাস্তবতা জানল অহনের। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এসব।
___
রাতুল নিজের শোরুমে এসির নিচে বসেও দরদর ঘামছে। তার ভাবনা জুড়ে আছে তার স্ত্রী অনন্যা এবং তাদের উভয়ের বৈবাহিক জীবন। এই ভাবনার মাঝেই কখন যে সন্ধ্যা হয়ে এল টেরই পায়নি সে। কর্মচারী শফিক বলে উঠে,
“ভাই, বাড়ি যাবেন না?”
ভাবনার ঘোর ভাঙে তার। তাও গম্ভীর মুখখানা তার।
“হুম, এখনই বের হচ্ছি। সকালে হিসাব নিব, সব ঠিক-ঠাক করে রেখো।”
“ঠিক আছে, ভাই।”
হুট করেই রাতুলের কী হলো কে জানে। সে আজ ক্লান্ত শরীরে সোজা বাড়ি ফিরার জন্য অগ্রসর না হয়ে গেল ফুলের দোকানে। রজনীগন্ধা ফুলের দুটো স্টিক নিল, কিন্তু শুকতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
“উফঃ! বউয়ের জন্য ফাস্ট টাইম বাড়িতে ফুল নিয়ে যাচ্ছি! তাও কী বস্তা পঁচা বাশি! কালকেই ফুল গাছ এনে লাগাব বাড়িতে, তাহলে একদম ফ্রেশ ফ্রেশ ফুল পাব।”
কথাগুলো বিড়বিড়াতে বিড়বিড়াতে বাড়ির উদ্দেশ্যে প্রস্থান করে সে।
অনন্যা রান্নাঘরে কাজ করছিল। ঠিক তখনই ঘামে সিক্ত শীতল ছোঁয়া পায় ঘাড়ে। কেউ আলতো হাতে সরিয়ে দিচ্ছে তার ঘাড় বেয়ে পড়ে থাকা চুলগুলো।
বিচলিত হয়ে পিছনে ঘুরে দেখে রাতুল। স্বস্তির বড় এক শ্বাস শেষ ফেলে কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
“আজব! আমাকে ভয় দেখিয়ে মারার প্ল্যানিং করে আসছো না কি!”
“ইশ্! দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ আমার। তাকে মারব আমি! ছিঃ! ছিঃ! এমন অলক্ষ্মণে কথা বলে না বউ।”
স্বামীর রসিকতায় ভেঙচি কাটে অনন্যা। শাশুড়ি ডায়াবেটিকের ভুক্তভোগী, তিনবেলায়ই রুটি আহার করেন। আর সেই রুটি হতে হবে একদম পাতলা এবং নরম। বর্তমানে সেটাই তৈরি করছে সে।
“যাও, যাও, ফ্রেশ হয়ে নেও। বেশি লেট হলে আবার ঠাণ্ডা লেগে যাবে। রাত ঘুমাচ্ছে, ওকে কিন্তু উঠিয়ো না। ”
রাতুল চলে যায় বেডরুমে। কোনো এক দ্বিধায় ফুলগুলো দিতে পারেনি সে। গোসল করে সোজা চলে যায় কিচেনে। অনন্যাকে আদেশ দেয়,
“তুমি রুটি বেলো, আমি তাওয়ায় ছেঁকে দিচ্ছি।”
রমণী তো ধাক্কার পর ধাক্কা খাচ্ছে। যে লোক জীবনেও কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকেনি, সে আজ দু-দুবার রান্নাঘরে এলো। আবার যে লোক সারাদিন মুখটা গোমড়া, গম্ভীর, রাগীয়ে রাখে, সে আজ এত হাস্যোজ্জ্বল মুখে। ব্যাপারটা ঠিক ধরেও ধরতে পারছে না।
সব রুটি ছেঁকতে ছেঁকতে রাতুলের গোটা মুখ ভিজে গেছে ঘামে। মনে মনে ভাবে,
“বউয়ের কাজটা সহজ না। এসির নিচে বসেও আমার প্যারা লাগে, মেয়েটা এখানে এই গরমে সবসময় খাটে। আর আমি কোনোদিন এসে একদফা জিজ্ঞেসও করি না।”
খাওয়া শেষে অনন্যা সোজা ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। বের হতেই নানা দ্বিধা পেড়িয়ে তার সম্মুখে ফুলগুলো ধরেই ফেলে রাতুল। অনন্যা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকায়।
“ভালোবাসি বউ! অনেক ভালোবাসি! তোমাকে ছাড়া, আমার রাতকে ছাড়া সব বৃথা। সব বৃথা। ওয়াদা আমার তোমার যোগ্য স্বামী হয়ে দেখাব।”
অনন্যার কী হয় কে জানে? যে মেয়েটা জীবনে কারো সামনে কাঁদেনি, সে আজ হুহু করে কেঁদে ফেলে জড়িয়ে ধরে তার জীবনসঙ্গীকে। নারী মন বুঝা বড্ড অসাধ্যকর সাধ্য।
“আমাকেও মাফ করে দাও। আমি শুধু নিজের দাম্ভিকতা নিয়েই ছিলাম। তোমাকে বুঝানোর চেষ্টা টুকুও করিনি। বরং, কত বাজে, জঘন্য পথে পা দিতে যাচ্ছিলাম। আরেক মেয়ের জীবন নষ্ট করতে…”
আবারও শব্দ করে কেঁদে উঠে সে। রাতুল মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
“ইশ্! এভাবে কেউ কাঁদে? থামো নাহলে তোমার ছেলে উঠে ভ্যা ভ্যা করবে।”
কান্নার মাঝেই হেসে উঠে যুবতী। আরও নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে স্বামীকে।
চলবে…
#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
‘আজ একসপ্তাহ আমার ঘুম সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। আগে তো রাতে কম হলেও দুতিন ঘণ্টা ঘুমাতাম, এখন ঘুমই আসে না। সারাটা রাত্রি রোমান্টিক সব গান শুনে কাটাই, মনের মাঝে যেন সর্বক্ষণ কয়েক শতক জোনাকির আলোড়ন হচ্ছে। ঐ ছেলেটার মাঝে এমন কী জাদু আছে যে তাকে দেখার পর আমার এমতাবস্থা?
তবে কি আমি প্রেমে পড়েছি? সত্যি প্রেমে পড়েছি সেই যুবকের? কিন্তু কেমন প্রেম এটা? আমি তো তাকে চিনি না, জানি না। সবে মাত্র একটা সাক্ষাৎ। তাকে কোথায় পাব আমি? আর সে কি ভালোবাসবে আমাকে? আমাকে তো আমার মা-ই পছন্দ করে না, আত্মীয়-স্বজন সবাই বলে আমি দেখতে ভালো না। তবে আমি তাকে কী করে পাব? আল্লাহ, তুমি তো সব পারো। তাহলে পায়িয়ে দাও না তাকে, প্লিজ।
♪____________________________♪
ফেসবুকে স্ক্রল করছিলাম, হুট করেই তার পেজ পেয়ে গেলাম। পেজের ছবিগুলো, আর স্ট্যাটাসগুলো পড়ে আরেকদফা প্রেমে পড়লাম মানুষটির। তার নাম কাব্য। উহু, সে আমার প্রেমকাব্য। এত মোহনীয় কেন সে? উফঃ! দেখলেই জাস্ট ভালোবাসতে মন চায়। থ্যাংক ইউ সো মাচ আল্লাহ, তুমি তাকে পায়িয়ে দিলে।
আমি একটু আগেই তাকে ইনবক্স করেছি। সে কি রিপ্লাই দিবে আমার ছোট্ট ‘হাই’ এর? আচ্ছা, আমাদের মধ্যে কি কিছু সম্ভব? তার পেজে দেখলাম কত মেয়েই তার অন্ধভক্ত। কত সুন্দরী তাকে চায়! সেখানে আমি বড়োই বেমানান জানি। তারপরও মন মানে না।
♪____________________________♪
আমি তো ভেবেছিলাম সে রিপ্লাই-ই দিবে না। কিন্তু দুদিন পর হলেও সে দিয়েছে। আজ তার সাথে প্রায় বিশ মিনিটের মতো চ্যাটিং করেছি। যদিও তেমন বিশেষ কিছু নয়, টুকটাক হাই-হ্যালো টাইপ কথাবার্তা। তবুও এতটা শান্তিবোধ হচ্ছে, যা জীবনে কোনোদিন হয়নি।
সত্যিই যেই শান্তি ভালোবাসার মানুষের নিকট পাওয়া যায়। তা কারো নিকটই পাওয়া যায় না। তার উপর তার গোছানো-সাজানো কথাবার্তাই যেন রীতিমতো এক মায়াজাল। যাতে আটক হই আমি বারংবার।
♪____________________________♪
এখন তার সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। বেশ অনেকটাই ফ্রেন্ডলি হয়ে গেছে আমাদের সম্পর্ক। তার সম্পর্কে প্রায় অনেকাংশই এখন আমার জানা। মজার বিষয় তার বাড়ি না কি আমার দাদুর গ্রামেই। কী মজার বিষয় না! আমার দাদুবাড়িই এখন আমার শ্বশুরবাড়ি হবে।
আচ্ছা, সে যে আমার এতটা ক্লোজ হচ্ছে, আমাকে দেখে দূরে চলে যাবে না তো আবার? আমি যে খুব ভালোবাসি তাকে। খুব! খুব! তাকে ছাড়া জীবন বৃথা আমার। কিন্তু সে কি আমাকে ভালোবাসে না কি শুধু বন্ধু ভেবেই…?
♪____________________________♪
আজকাল সে খুব একটা অনলাইনে আসে না। তবে প্রতিনিয়ত আমার স্বপ্নে আসে, এমন কী যখন আমি জেগে থাকি তখনো সে আসে। আমাকে আমার মতোন ভালোবাসে। আমি সারারাত ঘুমাই না কল্পনায় আসা তার সাথে কথা বলে কাটাই। কিন্তু আমি ছুঁতে গেলেই সে গায়েব হয়ে যায়। আমি হয়তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি তার জন্য।
কাব্য এখন শুধুই আমার ভালোবাসা নয়, আমার অবসেশন, আমার প্রিয় অসুখ সে। তবে এই অসুখ অত্যন্ত ভালো, সুখময়। তার অনুপস্থিতিতেও আমায় তার সান্নিধ্য দেয়।
♪____________________________♪
তাকে প্রেম নিবেদন করেই ফেললাম খাণিক ক্ষণ আগেই। রাতের দেড়টার দিকে প্রেম নিবেদন মনে হয় আমি ছাড়া আর পাগল করে না। আচ্ছা, সকালে যখন সে দেখবে তার রিয়েকশন কেমন হবে? সে আমাকে ভালোবাসবে তো? আমি জানি না কিচ্ছু জানি না।
যাকগে প্রিয় নোটবুক, আজ বিদায় জানাই। একটু পরেই কাব্য আসবে তাকে সময় দেওয়া লাগবে বুঝলে। গুডবাই।
♪____________________________♪
বাবা কী করে যেন বুঝে গেছে আমি রাতে একাকি কথা বলি। হয়তো রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সে শুনেছে। আজ শিশু বিশেষজ্ঞ মিজু আঙ্কেলকে বাড়িতে ডাকিয়েছিলেন আমাকে দেখতে। অন্য ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি, ভেবেছেন জানাজানি হলে মানসম্মান যাবে। মিজু আঙ্কেল বলেছেন তেমন কিছু হয়নি আমার, একদম ঘুম হয় না দেখেই না কি এমনটা হচ্ছে।
মিজু আঙ্কেলের ঔষধগুলো খাব না কি ভাবছি? খেলে হয়তো কাব্য আর আসবে না। কিন্তু কী করব খেতে হবেই। মা এমনিতেই অনেক মেরেছে, মারতে মারতে হাত-পা ফুলিয়ে ফেলেছে। মায়ের কথা শুনে না অনেক খারাপ লাগে।
মা বলেছে, আমার মতোন সন্তান থাকার চাইতে না থাকাই ভালো। বলেছে, এমন পাগল মেয়ে তার কোনো কুকর্মের ফল! আসলেই হয়তো আমার মৃত্যুই শ্রেয়। আচ্ছা, মরার আগে কি একবার আমায় ছুঁয়ে দিয়ে যাবে কাব্য? আমি তার শেষ স্পর্শ টুকু পেতে চাই।
♪____________________________♪
হুট করেই দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার প্রাণবায়ু কেউ ধীরেধীরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। সে আজ আমায় বলেছে, সে আমায় ভালোবাসে না। তার জীবনে অন্যকেউ আছে। একটু আগে দেখলাম তার পেজ থেকে অনন্যা নামক এক মেয়েকে ট্যাগ করে পোস্ট করেছে,
“সেদিন প্রথমবারের মতোন আমি তোমায় ডাকলাম অনন্য বলে। তুমি বেজায় রাগ করলে, তোমার বাবা বেশ ভালোবাসার নামটার বিকৃত রূপ তোমার সহ্য হল না। তবে তুমি তো জানো না সেদিন প্রথমবারের মতোন আমি উপলব্ধি করেছিলাম তুমি আমার জীবনে, হৃদয়ে অনন্য কেউ। তোমার স্থান কেউ নিতে পারবে না।”
♪____________________________♪
কাব্যের আইডিতে ছোট্ট নক দিয়েছিলাম। তাকে ছাড়া থাকতে পারব না আমি জানিয়েছিলাম। জানো প্রিয় নোটবুক সে কী বলেছে? বলেছে, আমার মতো ছ্যাঁচড়া মেয়ে আর দুটো নেই। আমি রাস্তার মেয়ের চেয়েও জঘন্য। আমি তার সম্পূর্ণ রূপে অযোগ্য, তার পাশে দাঁড়ানোর রূপ-গুন কিছুই না কি আমার নেই। আরও কত বাজে বাজে কথা।
আল্লাহ কেন আমাকে এমন একাকিনী বানাল? এই একাকিত্ব বিলাস শুধু আমাকেই কেন করতে হয়? ছোটবেলা থেকেই সব থেকেও আমার নেই। মায়ের চেয়ে আপন কেউ হয় না, তার কোলেই না কি সব মমতা। অথচ, আমার মা আমাকে নিচু বোধ করাতে একটা সুযোগও ছাড় দেয় না৷ তাও কার কথায়? সামান্য কাজের মেয়ের কথায়৷ নিশার কথায়।
নিশাকে তো বাড়িতে কাজের মেয়ে করেই এনেছিল, তবুও ওকে আমার মতো করেই রেখেছে মা-বাবা। আমিও ওকে বোনের নজরেই দেখেছি। কিন্তু তাতে ওর হয়নি, ও আমার জায়গা নিতে চেয়েছে, কাজের মেয়ে হয়েও ঘরের কন্যা হতে চেয়েছে। এর জন্য মায়ের কাছে যা তা মিথ্যে বলে আমাকে কত নিচে নামিয়েছে। আমার বন্ধুরাও আজ নেই ওর জন্য। এসবে কোনো লাভ হয়েছে? পিঠের চামড়া কোনোদিন পেটে লাগে? ও হতে পেরেছে এই বাড়ির মেয়ে? আর সবাই যে বলে আল্লাহ শ্রেষ্ঠ বিচারক, কই ও তো ভালোই আছে, সুখী৷ পুড়ছি না আমি!
আর আমার মা? সে আমার মা, কিন্তু বিশ্বাস আমায় নয়, করে অন্যকে। কী কপাল আমার! সব থেকেও নেই। বাবার কাছেও আমার চেয়ে কাজ বড়। শেষবার কবে তার সাথে মন খুলে আড্ডা দিয়েছিলাম মনে পড়ে না। আমার সব থেকেও নেই। কপাল পুড়া! আর দেখো নিশাকে, তার সব আছে, কিছু না থেকেও!
♪____________________________♪
মরতে যেয়েও ভাগ্যের জোরে আজ বেঁচে গেলাম। কাজের আন্টি দেখে ফেলেছিল। মা আবার খুব করে বকেছে, চড়ও মেরেছে। তারপর নিজেই কেঁদে দিয়েছে আমায় জড়িয়ে ধরিয়ে। তার এমন করার কারণ বুঝলাম না। সে তো সদা বলে আমি না থাকলেই ভালো। বাবাও খুব কান্নাকাটি করেছে আমার হাত ধরে। জানতে চেয়েছে এসবের কারণ। প্রতিশ্রুতি চেয়েছে এই কাজটি আর না করার।
আমিও এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে একটা জিনিস চেয়েছি। খুব জঘন্য এক জিনিস চেয়েছি, নিজের সাথে চোখ মিলাতে পারছি না। খুব ঘৃণ্য কাজ করতে যাচ্ছি, কিন্তু তারপরও শান্তি অনুভব হচ্ছে৷
আমার প্রিয় মানুষটি আমার না হলেও এট লিস্ট অন্যকারো হবে না। আমি যে কাব্যের বিচ্ছেদ চেয়েছি বাবা-মায়ের কাছে, শুধু তাই না তার নিঃসঙ্গতাও চেয়েছি।
শুনেছি ভালোবাসলেই পাশে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ঠিক আছ, আমিও নাহয় ত্যাগ করলাম, না পেলাম নিজের ভালোবাসা। কিন্তু অন্যকারো সাথে নিজের ভালোবাসার মানুষকে দেখতে পারব না।
সারাটা ক্ষণ আমি হারিয়েছি। আমার প্রাপ্তির তালিকার জিনিসগুলো নিশা ছিনিয়ে নিয়ে আমায় অপ্রাপ্তির তালিকা বাড়িয়েছে। তবুও ভালো মানুষি দেখিয়ে গিয়েছি। খারাপ চাইনি কোনোদিন কারো। তাতেও ভালো কিছু হয়েছে আমার?
আর থাকতে চাই না আমি ভালো মানুষ হয়ে, অন্য সবকিছু নাহয় বাদ দিলাম। তবে কাব্য? তাকে আমি কাউকে দিব না। সে যদি আমার নাহয় কারোই হবে না। আমার একাকিত্বে সেও ভুগবে।
আমি বাবা-মাকে বলেছি তার যাতে কোনো ভাবেই বিয়ে না ঠিক করতে পারে তার দাদী বা কোনো আত্মীয়। যেহেতু একই গ্রাম তাই এটা একদম সহজ কার্য। আর যতটুকু অনন্যার বিষয়। যদি তাদের ভালোবাসা আমার চেয়েও তীব্র হয়, তবে দোয়া করি যাতে আমার পরিকল্পনার অসফলতায় তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়।
♪____________________________♪
ইশ্! তোমাদের ভালোবাসার ভিতটা বড়োই নড়বড়ে ছিল কাব্য। খাণিক অর্থের বায়ুই সহ্য করতে না পেরে ভেঙ্গে পড়ল সবকিছু। কী লোভী মেয়ে তোমার প্রেমিকা! ছিঃ! আমার খুব বেশি কিছু করতেই হয়নি। শুধু খুব বড়লোক এক ছেলের সন্ধান দিয়েছিলাম তোমার প্রেমিকাকে ও তার পরিবারকে।
কোনো চাপ বা লোভও দেখাতে হয়নি, তোমার প্রেমিকা ছেলের টাকা দেখে এমনিতেই নাচতে নাচতে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে। এখন তুমিও প্রতিটা মুহূর্তে নিঃসঙ্গ থাকবে। কারণ এই ঘটনার পর তোমার পুনরায় কারো প্রেমে পড়াটা প্রায় অসম্ভব, আর পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হওয়ার রাস্তা তো আগে থেকেই বন্ধ করে রেখেছি।
ভালোবাসা তো সবকিছু ভাগাভাগির সম্পর্কে। তবে আমি একাকিত্বে থাকলে, তুমি কেন সঙ্গির সুখ পাবে?
♪____________________________♪
অনেকটা দিন পর তোমার সাথে কথা হচ্ছে প্রিয় নোটবুক। কাব্য নামক প্রিয় অসুখ থেকে বহুদিন দূরে আমি, ঔষধ খাচ্ছি প্রতিনিয়ত। মনটা সবসময় আনচান করে, তবুও প্রতিশ্রুতির বলে দূরে আমি সে নামক সবকিছু থেকে।
দমবন্ধ এক জীবন পাড় করছিলাম। কিন্তু এতে স্বস্তি হয়ে এসেছে ফাহাদ। ছেলেটা বেশ দেখতে, বেশ সুন্দর কথাবার্তা, গলাও মাধুর্যতা ভরপুর। সে না কি আমায় ভালোবাসে।
কিন্তু আমার মতো মেয়েকে কি এত সুদর্শন পুরুষ ভালোবাসতে পারে? জানি না, তবুও তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছি। তার সাথে কথা বললে যে নিজেকে একটু হলেও মুক্ত লাগে।”
আবরার পুরোটা পড়ে ফেলল। তার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমেছে। কেন সে জানে না। অদ্ভুৎ রকমের অনুভূতি হচ্ছে তার। সে বোধ করতে পারছে না তার এখন কী করা উচিত বা সামিয়ার কার্যকলাপ কত টুকু ঠিক বা ভুল।
তবে হ্যাঁ, এসব কিছুর জন্য সে কখনোই বিচ্ছেদ বা স্ত্রীকে হারাতে চায় না। ঐ নারী যে এখন আবরারের প্রাণবায়ুতে পরিণত হয়েছে, তাকে ছাড়া এই যুবকের জীবন অভাবনীয়। তবে এখনো কিছু প্রশ্ন বাকি।
সব ভুলে কল করে সায়রাজ কবিরকে। সায়রাজ কবির তখন নিজের মামাতো বোনের সাথে কথাবার্তায় মশগুল ছিলেন। আকস্মাৎ কলে তার কপালে ভাজ পড়ে। ফোন হাতে নিয়ে যখন দেখেন আবরারের কল তখন মুখশ্রী মৃদু গম্ভীর হয়। যদিও তিনি জানেন আবরার বেশ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের ছেলে, একটা অতীতের ভিত্তিতে নিজের সংসার ধ্বংস করবে না তারপরও…
“হ্যালো। বলো আবরার।”
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আপনারা কোথায়? আমি নিতে আসছি আপনাদের।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে আমার মনে হয় তোমাদের দুজনের একা এক জায়গায় থাকাটা ঠিক নয়। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মোটামোটি সবকিছুই জেনে গেছো। যাকগে অতীতের হিসেব বর্তমানে করে লাভ নেই।
তার চেয়ে বরং আমার বোনের বাড়িতে আসো। বাগান বাড়ি, রিসোর্টের মতোই। এখানে দিন দুয়েক থেকে রিলেক্স হয়ে সংসারে ফিরো, সেটাই ভালো। তাছাড়া সামিয়াও এখন তোমার সামনে অস্বস্তি বোধ করবে। এখানে মানুষজন আছে, ভালো লাগবে তোমাদের। বাকিটা তোমার ইচ্ছে। আমি ঠিকানা ম্যাসেজ করছি।”
চলবে…