প্রিয় অসুখ ও একাকিনী, পর্ব:২৩+২৪

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৩তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বাড়ি ফিরতেই আবারও আবরারের ফোনে কল আসে অনন্যার। সে বিরক্তির সাথে কলটা ডিসকানেক্ট করে দেয়। সামিয়া বিষয়টা পুরোপুরি খেয়াল করে।

তারপরও মিথ্যে কৌতূহল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কে কল করেছে আবরার? ফোন তুলছো না কেন?”

“তেমন কেউ না। বাদ দাও।”

“ওহ। আচ্ছা, তুমি বসো আমি রাতের খাবার তৈরি করে আসি।”

“তুমি একা কেন? আমিও আসছি।”

সামিয়া আলু সিদ্ধ করে, পেয়াজ ও মরিচ কুচি করে আলুর ভর্তা করে নেয়। আর আবরার ভাত বসিয়ে, লাল করে একটা ডিম ভেজে নেয়, সাথে সামিয়ার জন্য ডিম সিদ্ধও করে নেয়।

তাদের অল্প সময়ের সংসার হলেও আবরার খুব ভালো করেই জানে সামিয়া ডিম ভাজা খেতে পারে না, মুখে তুলতেই তার বমি আসে। দাম্পত্যজীবনে এটাই সবচেয়ে মিষ্টি বিষয়, একে অপরকে জানা।

সব শেষ করে দুজনে দুই প্লেটে খাবার নিয়ে টেবিলে বসে পড়ে খেতে। আবরারের ফোনে তখন আবারও কল আসে। সে ফোন আনতে উঠতে গেলে সামিয়া কী একটা ভেবে উঠে বলে,

“আপনি খান, আমি নিয়ে আসছি। ”

সামিয়া বেডরুমে যেয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখে যা ভেবেছিল তাই। অনন্যাই কল করেছে। বাঁকা হেসে দেয়। বড্ড হিংস্র সেই হাসি। সাদাসিধে মেয়েটার মাঝে তা বড়োই বেমানান লাগছে।

কলটা রিসিভ করে সে বলে,

“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

অনন্যা কিছুটা চমকিত হয় নারী কণ্ঠ শুনে। যদিও সে খুব ভালো করেই জানে আবরার এখন বিবাহিত। তবুও মনের কোথাও এক ক্ষীণ আশা আছে যে মানুষটা আজও তারই।

“ওয়ালাইকুম আসসালাম আপনি কে? আমি আসলে আবরারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আমি ওর কাছেরই একজন।”

“আপনার মাথা ঠিক আছে তো আপু? একজন বিবাহিত পুরুষ সম্পর্কে এসব বলছেন তাও স্ত্রীর কাছে।”

সামিয়ার রাগী গলা শুনে অনন্যা ঠিক বুঝতে পারে আবরার আর থেমে নেই, এগিয়ে গেছে জীবনে। তবুও তার অনেক প্রয়োজন আবরারকে। সেটা দৈহিক, মানসিক আর অর্থনৈতিকও। তাই ইচ্ছে করেই তাচ্ছিল্যের সুরে জবাব দেয়,

“ওহ, তাহলে আপনিই সে! আপনার লজ্জা করে না একটা ছেলের গলায় এভাবে ঝুলে থাকতে তার অনিচ্ছাতেও। আবরারের সম্পর্কে আপনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশিই জানি তাই মাথা বেঠিক থাকার প্রশ্নই আসে না।”

অনন্যা ভেবেছিল মেয়েটা এবার কষ্ট পাবে, কাঁদবে। মেয়েটার গলাই বেশ মোলায়েম এবং অসহায় ধরনের। কিন্তু সে তো জানে না সারাটা জীবন কষ্ট পেতে পেতে এই রমণী এখন এক হিংস্র বাঘিনী ন্যায়।

“ইশ! আপনাদের মতো মেয়েদের দেখলে আমার বড়োই করুণা লাগে। আপনারা টাকার খোঁজে প্রেমিক ছাড়েন, আবার প্রেমিকের খোঁজে স্বামী ছাড়েন। তা কী কারণে প্রয়োজন আমার স্বামী মানে আপনার প্রাক্তনকে? দৈহিক না মানসিক না দুটোই?”

সামিয়ার কথায় তেঁতে উঠে অনন্যা।

“এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বলো!”

“আহা! মুখটা চালালাম কই এখনো? যাকগে আমার স্বামী কোনো কলবয় নয় যে চাইলেই পাওয়া যাবে চাহিদা পূরণে। সে একান্তই আমার সকল চাহিদার পূরক। অন্য ছেলে খুঁজুন নয়তো নিজে রাস্তায়… আর বেশি কিছু বলে বুঝানো লাগবে না আশা করছি। গুড বাই মিস হোয়াট এভার ইউ আর!”

বলেই কলটা কেটে দেয় সে। তার ঠোঁটের কোণে এখনো সেই ক্রুর হাসি বিদ্যমান। তবে আকস্মাৎ মুখটা কাঁদো কাঁদো করে ফেলে সে।

বাম হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে, চোখজোড়ার কাজলকে আরও লেপ্টে দেয়, শাড়ির যতনে আগলে রাখা আঁচলটাও ছেড়ে দেয়। তারপর ঠাশ করে এক শব্দ তুলে ফোনটা হাত থেকে ফেলে নিজেও ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে।

আবরার আওয়াজ শুনে দৌড়ে বেডরুমে আসে। স্ত্রীর এই বিধ্বস্ত অবস্থা ও ফোন নিচে পড়া দেখে মুখ খানা থমথমে হয়ে যায় তার। এই কিছুটা সময়ে কী এমন হয়ে গেল ভেবে পাচ্ছে না যুবক।

আবরার ফোনটা হাতে তুলে সামিয়াকে ধরতে গেলেই তার হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেয় সে। যুবতীর চোখজোড়া যেয়ে টপটপ করে অশ্রু পড়ছে।

ভাঙা গলায় চাপা ক্ষোভ ও অভিমান মিশিয়ে বলে,

“আমি তো বলিনি আপনাকে আমার কাছে আসতে, আমাকে বিয়ে করতে। এই দয়া, সহানুভূতি তো আমি চাইনি কখনো কারো। তবুও কেন আপনার স্ত্রী পরিচয় দিলে শুনতে হবে আমায় আমি জোর করে আপনার গলায় ঝুলেছি? আমি ছ্যাচড়া এক মেয়ে?

অন্যকাউকে ভালোবেসে, অন্যকারো সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আমার সাথে এই ভালোবাসার নাটক করলেন আমি। বিয়ে বিয়ে খেললেন! আমি বলদ আপনার সহানুভূতিকে ভালোবাসা ভেবে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসলাম!”

সামিয়ার পাশে মেঝেতে বসা থাকা পুরুষটি এসব শুনে দফায় দফায় অবাক হচ্ছে। কী বলবে, হঠাৎ করেই কী হলো আবরার ভেবে পাচ্ছে না।

❝কারো ভালোবাসাই কি আমার প্রাপ্য নয়? মৃত্যুই কি শুধু আমার সুযোগ্য? তবে আমার মরণ…”

আর বলতে দেয় না আবরার। বুকে চেপে ধরে যুবতীকে। তার বক্ষের উথাল-পাতাল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে বর্তমানে ভাবতেও পারছে না তার জীবন এই নারীটিকে ছাড়া।

নিজের একাকিনীর মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে শাসিয়ে বলল,

“কী সব আজগুবি কথা বলছো তুম, হ্যাঁ? আমি তোমাকে দয়া দেখিয়েছি? আমার ভালোবাসা, প্রেম, যত্ন সবকিছুই তোমার দয়া লাগছে? আর পবিত্র ভালোবাসার এই প্রতিদানটাই দিলে তুমি।

কে কী বলল তা নিয়ে তুমি মাতামাতি করছো? মরে যাওয়ার কথা বলছো? তুমি জানো আমার কেমন লাগছে? আমার বুকে হাত দিয়ে দেখো আমার হার্টবিট কত বেড়ে গেছে।

আমি কাউকেই না, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। হ্যাঁ, আমার একটা অতীত আছে, সম্পর্ক ছিল একটা মেয়ের সাথে; তা তো তোমার জানোই? এটা সত্যি যে তাকে নিয়ে আমার অনুভূতি এখনো শেষ হয়নি, তবে মৃতপ্রায়, ভালোবাসার মানুষকে একেবারে ভুলা তো সম্ভব হয় না।”

ফুস করে তপ্ত এক শ্বাস ছাড়ে যুবক। তারপর সামিয়ার বিধ্বস্ত মুখশ্রী দুহাতের মাঝে নেয়।

“ভালোবাসা পরিমাপ করার যন্ত্র নেই, নাহলে সেটা দিয়েই আমার ভালোবাসার শুদ্ধতার প্রমাণ দিতাম আজ। তবে সমস্যা নেই তোমার জন্য আজ নাহয় টিনেজার হলাম। তোমার জন্য প্রাণ ত্যাগের ছোট্ট এক প্রয়াশ করেই প্রমাণ দিলাম ভালোবাসার।”

বলেই সামিয়াকে ছেড়ে দিয়ে সে উঠে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় আবরার। সামিয়া তার কথা শুনে ঘাবড়ে যায়, উক্ত কথাগুলো বলার সময় যুবকের চোখ, মুখ ও কণ্ঠ বড়োই কঠোর ছিল। তাই সেও পিছু নেয় স্বামীর।

যেয়ে দেখে আবরার ছুড়ি হাতে নিয়েছে। ভয় পেয়ে যায় সে, এই মানুষটার গায়ে একটা আঁচড়ও তার সহ্য হয় না। ছুটে যেয়ে হাত থেকে ছুড়ি সরিয়ে নিতে নেয়। কিন্তু তার আগেই আবরার নিজের হাত সরিয়ে ফেলে।

সামিয়া চেঁচিয়ে বলল,

“কী করছেনটা কী আপনি? পাগল হয়েছেন আপনি?”

আবরার খুব গম্ভীর গলায় শুধায়,

“না। তুমি তো মনে করো আমি তোমাকে ভালোবাসি না, ভালোবাসার অভিনয় করি। তাহলে প্রমাণ তো করতেই হবে আমায় নিজের ভালোবাসাকে। তোমার তো বিশ্বাস নেই আমার উপর, তাই না?”

আবরারের রাশভারী আচারণেও স্পষ্ট ছিল অভিমান। রমণী গলা জড়িয়ে ধরে যুবকের। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।

“আমাকে ক্ষমা করে দিন, প্লিজ। নিজের কোনো ক্ষতি করবেন না৷ আই প্রমিজ আমি কখনো এসব বলব না আবরার।”

আবরারের রাগ দমে সামিয়ার কান্নায়। এই নারীটিকে যে বড্ড নমনীয়তার সাথে সামলাতে অভ্যস্ত সে। তবুও রাগ একবিন্দু কমেনি তার।

___

নিশার জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে অহনের বেডরুমে আবিষ্কার করে। মাথাটা ধরে আছে তার। বিয়ের পর থেকে সবকিছু পুনরায় মাথায় আওড়িয়ে নিতেই, বিশেষ করে নিজের চুলের অবস্থা মনে করতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার।

হাসপাতালের ইউনিফর্ম তখনো তার পরনে। সেই অবস্থায়ই ঘরের বাহিরে চলে যায়। হলরুমে নিনাদ, অহন ও ঝুমকোকে দেখেও সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ বড় বড় পা বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে যেতে নেয়।

অহন ছুটে যেয়ে তাকে আটকে ধরে। মেয়েটাকে দেখে সে অনেকটাই ভড়কে গেছে। কাজের লোকদের মাঝে পুরুষও আছে জানা সত্ত্বেও সে কীভাবে এমন ওড়না ছাড়া রুম থেকে বের হতে পারে?

“কোথায় যাচ্ছো তুমি? আর এই অবস্থায় বের হয়েছো কেন? কাজের ছেলেগুলো তোমায় এভাবে দেখলে কী ভাববে?”

“এমনেও কনসা ভালো চোখে দেখে? প্রোস্টিটিউটই তো মনে করে। তাও যে সে পতিতা নয়, রক্ষিতা, তোমার প্রাইভেট বেশ্…।”

“নিশা!”

চেঁচিয়ে উঠে যুবক। কিন্তু রমণীর কোনো হেলদোল নেই। সে আগের মতোই স্বাভাবিক।

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
“চেঁচিয়ো না তো অহন। অনেক প্যাঁচাল হয়েছে, তুমি তোমার প্রতিশোধ তুলেছো, রক্তাক্ত করেছো, এবার আমায় ক্ষ্যামা দেও। আমি আর থাকতে পারব না তোমার এই রাজমহলের শোপিস অর তোমার প্রোস্টি…”

শব্দটি পুনরায় বলতে নিলেই রাগ তড়তড় করে বেড়ে যায় অহনের, এক চড় বসিয়ে দেয় নিশার গালে। নিশাও দমবার পাত্র নয়, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় অহনকে নিজের সামনে থেকে।

“কুত্তা, তোর কত বড় সাহস তুই আমার গায়ে হাত তুলোস! তুই কোন অধিকারে আমার গায়ে হাত দেস? শালা কী জন্য আটকায় রাখতে চাস আমায়, হ্যাঁ? পছন্দ তো আমায় করোস না! ওহ বুঝছি, এখনো তো আসল মনোবাসনা পূরণ করতে পারোস নাই এইজন্য যাইতে দিতে চাস না?”

নিশার মুখের ভাষা ছোটবেলা থেকেই বেশ মন্দ। যদিও সায়রাজ কবিরের সান্নিধ্যে আসার পর বেশ অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে সে, তবে রাগ উঠে গেলে এখনো আগের মতোই যা তা বলে। এতে অবশ্য তারও দোষ নয়।

জন্মের পর থেকে সে গালিই শুনেছে বেশি, কখনো সৎমায়ের মুখে নিজের জন্য, কখনো তো নিজের পিতা আর দাদীর মুখেও। ছেলেবেলার অভ্যাস ভুলা যায়, তবে সেই অভ্যাস যদি স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়, তাহলে তা আর ভুলা যায় না।

এদিকে কথাগুলো শেষ করা মাত্রই নিশাকে কোলে তুলে ঘরে এনে দরজা লক করে দরজায় চেপে ধরে রেখেছে অহন। নিশা একের পর এক গালি দিয়েই যাচ্ছে। অহন সহ্য করতে তার অধরজোড়া বন্ধ করার রোমাঞ্চকর ব্যবস্থা নেয়। তাতেও খ্যান্ত হয়ে বসে নেই তার সুন্দরী, পা দিয়ে তার পায়ে লাথি, গুতোগুতি করেই যাচ্ছে।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে হারমানে রমণী। অহন তাকে শান্ত হতে দেখে ছেড়ে দেয়৷ সে যখন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত তখন অহন বড়সড় এক হাসি দিয়ে বলে,

“আরেকবার একটা বাজে কথা বললে এর চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থা হবে জান।”

নিশার চোখজোড়ায় তখনো ক্ষোভ পরিস্কার। তবুও ক্লান্তির কাছে হার মেনে চুপ থেকে সেখানে বসে পড়ে সে। অহন বেডের পাশের টেবিলে রাখা গ্লাস ভর্তি পানি টুকু এনে দেয় নিশার কাছে, সেও নীরবতার সাথে পান করে নেয়।

“তুমি চাচ্ছো কী আমার কাছে? এভাবে আমাকে নিজের রক্ষি… ”

“ডোন্ট সে দিস ওয়ার্ড এগেইন। লাস্ট ওয়ার্নিং।”

দুজনের গলাই বেশ শান্ত ও শীতল।

“বাহ! তুমিই তো এই নাম দিয়েছো আমি বলতে সমস্যা কোথায়? যাকগে তোমার নাটক তুমিই ভালো জানো। আমি এভাবে আর থাকতে পারছি না৷ ঐ কাজের লোকগুলো আমার দিকে যেভাবে তাকায়, তোমার কাছের মানুষ আমার সাথে যেমন আচারণ করে।

এসনের চেয়ে ভালো হতো আমাকে কথা নো পতিতালয়ে রেখে আসতে, তখন মানুষজনের এই খারাপ নজরটাকেও এত খারাপ লাগত না। এট লিস্ট এটা ভেবে তো সান্ত্বনা পেতাম যে আমার কর্মের জন্যই এই ঘৃণ্যদৃষ্টি।

আমি না এত কিছু বলতে চাই না। আমি জাস্ট এখানে থাকতে পারব না। আমার যতটা মানুষজনের কথাবার্তা শুনে গা ঘিনঘিন লাগে, ততটা তোমাকে দেখলেও গা ঘিনঘিন করে। কারণ তোমার জন্যই এসব কিছু আমায় দেখতে হচ্ছে।

আমি আর কিছুদিন এখানে থাকলে হয় পাগল হয়ে যাব নয় নিজেকে শেষ করে দিব। তাছাড়া তুমি নিজেও তো আমায় ঘৃণা করো, তবে কেন আটকে রাখতে চাচ্ছো? আরও শোধ তুলা বাকি বুঝি? ঠিক আছে, নিতে থাকো প্রতিশোধ, কিন্তু কত তারিখে আমার মুক্তি হবে তাও জানিয়ে যাও।”

প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করার সময় নিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, এখনো কাঁদছে। অহন নিজেকে বারংবার ধিক্কার জানাচ্ছে, তবে এতে কি লাভ আছে? যা করার তাতো সে করেই ফেলেছে। এজন্যই গুরুজন বলে গিয়েছেন, ‘ভাবিয়া করিয়ো কাজ, করিয়া ভাবিয়ো না’।

সে নিশার ভেজা কপোল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে,

“আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমি তোমার প্রতি পোষণ করে রাগে, ক্ষোভে পশুর মতোন হয়ে গিয়েছিলাম, ভালো-মন্দ জ্ঞান করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবুও একটা সুযোগ কি দেওয়া যায় না? আমায় ক্ষমা করা যায় না? চলো না, আমরা নতুন ভাবে শুরু করি একসাথে।”

উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে অহন নিশার চোখজোড়ায় দিকে। অপরদিকে, নিশার মন যেন বারবার তাকে বলছে হ্যাঁ বলে দিতে। কিন্তু এই একটা মাসের নরক যন্ত্রণা মনে পড়তেই রাগ ও ক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। অহনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে সে।

“এটা সম্ভব না। আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না এই একটা মাস আমি কেমন পরিবেশে ছিলাম। আমি যতবার তোমাকে দেখব আমার সব মনে পড়বে, আমি জ্বলব-পুড়ব সব ভেবে। তোমাকে দেখলেই আমার এখন রাগ লাগে, অন্যকোনো অনুভূতি আসে না।”

অহন নিশাকে অনেক বার ঠাণ্ডা মাথায় বুঝায়, কিন্তু নিশা নিজের কথায় তটস্থ। শেষপর্যন্ত অহনেরই রাগ উঠে যায়। সে শাসিয়ে বলল,

“জান তুমি না আসলে সোজা কথা শুনার মেয়ে না! আমি খারাপ তো তোমার কাছে, এই খারাপের কাছেই তোমার থাকতে হবে, এই খারাপের মুখ দেখেই তোমার দিন শুরু হবে, এই খারাপের সাথেই তোমার খেতে হবে, এই খারাপের বুকেই মাথা রেখে তোমার প্রতি রাত্রি পাড় হবে। যত্তসব!”

___

ধীরে ধীরে সামিয়া ও আবরার দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে খাবার খেয়ে নেয়। আবরারের রাগ এখন অবধি কমেনি, শুধু চেপে গেছে, মুখশ্রী তার এখনো গম্ভীর।

খাওয়া শেষ করেই আবরার জিজ্ঞেস করে,

“কে বলেছিল তোমায় ওসব কথা?”

“জানি না, আপনার ফোনে অনন্যা দিয়ে সেভ করা আপুটার নাম্বারটা।”

নত মাথায় মিনমিনে সুরে উত্তর দেয় সামিয়া। আবরার নিজের ফোনটা নিয়ে হনহন করে বেডরুমে চলে যায়। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে সামিয়া কী ভেবে যেন বাঁকা হাসে।

আবরার বেডরুমে ঢুকেই অনন্যার নম্বরে কল করে। রাগে তার হাতের পেশি শক্ত হয়ে গেছে। অনন্যা কল রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে উঠে আবরার।

“আপনি আমাকে ফোন দিচ্ছেন কেন বারবার? আর আমার বউকে এসব কী বলেছেন? আমি আপনাকে কবে বলেছি আমি আমার বউকে সহানুভূতি দেখিয়ে বিয়ে করেছি বা ওকে আমি ভালোবাসি না? যত্তসব ফাউল! আরেকবার এমন উল্টাপাল্টা প্যাঁচ লাগালে একদম হ্যারেসমেন্টের কেস করে দিব!”

অনন্যা থতমত খেয়ে যায় আবরারের কথাগুলো শুনে। তার কপাল বেয়ে চিকুন চিকুন ঘাম ঝরছে। নরম গলায় শুধালো,

“আবরার, তুমি তোমার বউয়ের কথাই বিশ্বাস করলে। তুমি জানো সে আমাকে কত কিছু…”

“জাস্ট শাট আপ! আমার ওয়াইফের নামে একটা কথাও নয়। আমার ফোনে কোনো কল দিবেন না।”

“ওয়েট, ওয়েট, আবরার! আমার তোমার সাথে খুব জরুরি দরকার। প্লিজ আমার সাথে কাল বিকেল চারটায় মিট করতে পারবে?”

“সম্ভব না। তাছাড়া আমি ঢাকাতেও নেই।”

“আচ্ছা, তবে সময় করে একদিন একাকি যেয়ে প্লিজ আমায় একবার কল দিয়ো। যদি আমাকে জীবনে কখনো একটু হলেও ভালোবেসে থাকো তবে না করবে না।”

ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে আবরার ‘ওকে’ বলে কল ডিসকানেক্ট করে দেয়।

ডাইনিং রুমে বসে এক গ্লাস ঠাণ্ডা মজো পান করতে করতে আবরারের চেঁচামেচি উপভোগ করছিল সামিয়া। এ যেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিনোদন ছিল তার নিকট। তাই থেমে যেতেই বিরক্তির সুরে বলল,

“আর কিছুক্ষণ চললে ভালো হতো। এত এত ড্রামার পর মাত্র এতটুকু এন্টারটেইনমেন্ট? নট ফেয়ার কাব্য।”

___

দুইদিন পর,

সাত-সকালে বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠায় বিরক্ত হয় সামিয়া। আবরার তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। সে উঠে যেয়ে সদরদরজার কী-হোলে চোখ রাখতেই অবাক হয়ে যায়। সায়রাজ কবির ও আলিফা খাতুন এসেছেন।

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে হাসি মুখে প্রশ্ন করে,

“কেমন আছো বাবা? শরীর ভালো তো তোমার?”

আলিফা খাতুন নিরাশ হয়। মেয়েটা তাকে আজও অদৃশ্য মানবের মতোন উপেক্ষা করে দিল। একমাত্র সন্তানে প্রতি ক্ষেত্রে উপেক্ষা মেনে নেওয়ার মতো না।

“খুব ভালো আছি, মামনি। আবরার কোথায়?”

“উনি তো ঘুমুচ্ছেন। তুমি বসো আমি ডেকে আনছি। ”

“না, না, লাগবে না। ঘুমাক, একটু পর তো ডিউটিতে যাওয়ার জন্য উঠবেই।”

“ঠিক আছে। আমি তাহলে তোমাদের জন্য চা করে আনি, বাবা।”

তিন কাপ চা নিয়ে এসে চলতে থাকে বাবা-মেয়ের আড্ডা, আলিফা খাতুন সেখানে অসহায় এক জীব। চুপচাপ শুনেই যাচ্ছে, অবশ্য তিনি চাইলে নিজে থেকেও কথা শুরু করতে পারেন। তবে কোনো এক সংকীর্ণতায় তাও করছেন না। কিছুক্ষন পর সামিয়া উঠে যায় সবার নাস্তা আর আবরারের জন্য লাঞ্চ তৈরী করতে।

আবরার তো ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীর খোঁজে বসার ঘরে এসে শ্বশুর-শাশুড়িকে পেয়ে বিস্মিত। নিজের বিস্ময় সামলে তাড়াতাড়ি সালাম দেয়। কথায় কথায় সায়রাজ কবির বলেন,

“মেয়েটার কথা অনেক মনে পড়ছিল, তাই দেখতে চলে এলাম।”

আবরার ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে ব্রেকফাস্টটা সেরেই বেড়িয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তার সাথে সায়রাজ কবিরও বের হন হাঁটাহাঁটি করতে। তিনি ভিন্ন ধাঁচের মানুষ, তার ঘরে থাকতে ভালো লাগে না।

সবাই বেরিয়ে যেতেই সামিয়া টেবিল থেকে এঁটো থালা-বাসন নিয়ে চলে যায় ধুঁতে। আলিফা খাতুনও তাকে সাহায্য করেন।

“আমার মেয়েটা তো বেশ ভালোভাবেই সংসার সামলানো শিখেছে।”

সামিয়া বাসন ধুতে ধুতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বলে,

“হুম, তা শিখেছি। কিন্তু আমি যা বলেছিলাম য়া করেছো তুমি? খোঁজ নিয়েছো এই মেয়েটা কী করে ফিরে এল?”

“সেসব নাহয় পরে হবে। তুই তো ফাঁদ বিছিয়ে অনন্যাকে আর আবরারকে আলাদা করেছিস, এখন তো ভাগ্যের জোরে পেয়েছিসও তো আবরারকে, তাহলে চিন্তা কীসের? এখন তুই বল তোদের সংসার কেমন চলছে?”

মায়ের প্রশ্ন নিজের তিক্ত সেই অতীত মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় কাব্যকে ভালোবাসার জন্য প্রাপ্ত অপমান থেকে শুরু করে অনন্যাকে কাব্যের জীবন থেকে সরানো এবং তারপর কাব্যকে ভুলে জীবনের পথচলা।

“উহু, মা ভুল বললে তুমি। আমি কোনো ফাঁদ বিছাইনি, অনন্যা আর ফাহাদকে আলাদাও আমি করিনি। আমি শুধু সোনার একটা হরিণ রেখেছিলাম অনন্যার সামনে, সে যদি নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে হরিণের পিছনে ছুটে তাতে আমার কী করার?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here