প্রিয় অসুখ ও একাকিনী, পর্ব:২১+২২

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বেলা বারোটা বেজে গেছে তবুও নিশার জ্ঞান ফিরার কোনো খবর আসেনি। অহনের টেনশনে অবস্থা খারাপ, নিনাদের দেওয়া মিথ্যে সান্ত্বনাও আর তাকে শান্তি দিচ্ছে না।

বেশ খাণেক ক্ষণ হাসফাস করে আর অপেক্ষার প্রহর গুণতে পারে না সে। নার্সকে যেয়ে জিজ্ঞেস করে,

“আমার ওয়াইফের জ্ঞান কেন ফিরছে না এখনো?”

“উই ট্রাইড আওয়ার বেস্ট সার। কিন্তু এখনো যেহেতু জ্ঞান ফিরছে না উনি মনে হয় কোমায় চলে গেছে। ডাক্তার সাহেব আসলে…”

আর বলতে পারলেন না তিনি। কারণ অহন তো বাকি কথা শোনার আগেই তার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছুটে চলে যায় নিশাকে রাখা কক্ষে। হয়তো তার বলা প্রথম দুই বাক্যই সহ্য করতে পারেনি যুবক।

নার্স রুজিনার চোখ জুড়ে যায়। তাই আর আটকায় না তিনি। যদিও একজন নার্স হিসেবে তার এই কর্ম অনুচিত।

স্বামীর থেকে ধোঁকা খাওয়া নারী রুজিনা। এত গভীর ভাবেও যে কেউ ভালোবাসতে পারে তা তার জানা ছিল না। এই হাসপাতালেরই এক বিপত্নীক পুরুষ তার আগে-পিছে ঘুরছে, প্রেম নিবেদন ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে বহু আগেই। কিন্তু ধোঁকার ভয়ে আগায়নি তিনি।

আজ অহন আর নিশাকে দেখে ভাবছে বৈবাহিক জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দিবেন তিনি। আরেকবার বিশ্বাস করবেন পুরুষকে, সম্পর্ককে। যদি এবার সুখ ধরা দেয় দাম্পত্য জীবনের।

এদিকে অহন কক্ষ ঢুকেই দেখতে পায় নিশার নিষ্প্রাণ হয়ে বেডে পড়ে থাকা দেহটাকে। মায়াবী মুখশ্রীটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, অধরজোড়াও শুকনো। কতকিছু লাগানো এই নিথর দেহেতে।

ঢুকরে কেঁদে উঠে সে। নিশার বেডের পাশা রাখা মোড়াটাতে বসে তার হাতটি নিজের হাতজোড়ার মাঝে নেয়। নিজের কপাল ঠেকায় সেই অচেতন হাতে।

“আমি সরি, জান। অনেক সরি। বিশ্বাস করো জান আমি এমনটা চাইনি। কী করে এমনটা হয়ে গেল আমি নিজেও জানি না। আমি কী করব সব ঠিক করতে আমি কিছুতেই তা বুঝে উঠতে পারছি না।

আমার তো নিজেকে মেরে ফেলা উচিত তাই না? আমি কী করে পারলাম নিজের ভালোবাসার মানুষকে এতটা কষ্ট দিতে? ছিঃ! তুমি নিশ্চিত এখন আমাকে ঘৃণা করবে?”

“ঘৃণা তো সেদিন থেকেই করি যেদিন থেকে রক্ষিতা নামক বিশ্রী শব্দটা আমার নামের সাথে জুড়ে গিয়েছিল। এখন আর নতুন করে…”

অত্যন্ত পরিচিত নারী কণ্ঠে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য মাখা কথাগুলো শুনে বিস্ময়ে চোখ তুলে সে। অহন চোখ তুলে তাকাতেই নিশা এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।

অহন উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে,

“জান তোমার জ্ঞান ফিরেছে! ইউ আর অলরাইট! আলহামদুলিল্লাহ জান! আলহামদুলিল্লাহ!”

“হয়েছে আর জুতো মেরে গরু দান করতে হবে না। ন্যাকামি না করে আমার রিলিজের ব্যবস্থা করুন দয়া করে। আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরছি না।

আর আমাকে শাস্তি দেওয়া কি শেষ হয়েছে? মানে মন ভরেছে আপনার? তাহলে দয়া করে আমাকে মুক্তি দিন। নাহলে আমাকেই নিজেকে পৃথিবী থেকে মুক্ত করতে হবে।”

বেশ শক্ত ও স্পষ্ট কথাবার্তা নিশার। অসুস্থ হয়ে যেন আরও দৃঢ়তা এসে পড়েছে তার বাকশক্তিতে।

অহন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কারণ যুবক যে জ্ঞাত যুবতীর রাগ সহ প্রতিটি স্বভাব, অভ্যাস, আচারণ সম্পর্কে।

এখন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালে নিশা নির্ঘাত একটা সিন ক্রিয়েট করবেই। তাই চুপচাপ নিশার গালে টুপ করে এক চুমু দিয়ে বাহিরে চলে গেল ডাক্তার আনতে।

বস্তুত, নিশার জ্ঞান ফিরেছে আজ সকাল ভোরেই, নার্স চেক করতে আসার আগে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই কাউকে ডাক বা সাড়া দেয়নি, আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এখন তার ভাষায় অহনের অহেতুক ন্যাকামি অর্থাৎ কান্নাকাটি সহ্য করতে না পেরে সাড়া দেয়।

ডাক্তার এসে নিশাকে পুরোপুরি সুস্থ ঘোষণা করেন। নিশা কে অহন ধরে উঠানোর সময় হুট করেই নিশার চোখ যেয়ে পড়ে আয়নায়। থমথমে মুখ নিয়ে সে নিজের মাথায় হাত দেয়।

“আমার চুল…? আমার এই অবস্থা কেন?”

অনেকটাই উত্তেজিত হয়ে যায় নিশার। মাথার পিছনে ক্ষত থাকায় তার চুলগুলো কেটে দিতে হয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই নিশা চুলের প্রতি বেশ সচেতন। বোঝ হওয়ার পর থেকে চুল ছাটাই করা বাদে কখনো চুল কাটেনি, আজ তার চুলের এই অবস্থা সে মেনে নিতে পারছে না।

বহু নারীর কাছে শুধু সৌন্দর্যই, রূপ তার অহংকার। তাতে সামান্য আঘাত লাগলেও সাময়িক সময়ের জন্য হলেও নারী ভেঙ্গে পড়ে।

নিশাকে উত্তেজিত হতে দেখে অহন তাকে কোমড় আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

“কিছু হয়নি জান। কয়েকদিন পরই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তোমার ট্রিটমেন্টের জন্যই ডাক্তার…”

তাকে বলতে না দিয়েই ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয় নিশা। জায়গা মতো আঘাত লাগলে, ক্ষত-বিক্ষত বাঘিনীর শক্তি অনেকটাই বেড়ে যায়।

“ডোন্ট টাচ মি ইউ রাসকেল! তোর জন্যই আজকে এতকিছু! এখন কুমিরের কান্না কাঁদতে আসছোস!”

সে আর কিছু বলবে তার পূর্বেই ঢলে পড়ে যায় নিনাদের বাহুতে। নিনাদই ধীরপায়ে পিছন থেকে এসে তার অজান্তেই তার হাতে অচেতন করার সুঁই ঢুকিয়ে দেয়। অহন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর নিশাকে কোলে তুলে বেরিয়ে পড়ে। ডাক্তার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কী থেকে কী হলো বুঝতে পারলেন না তিনি।

___

“উফঃ মেয়ে! তুমি কোথায় তোমার স্বামী নিয়ে ব্যস্ত হবে, তা না, বসে বসে ফোন চালাচ্ছো? পাশে যে একটা সুইট, কিউট স্বামী শুয়ে আছে তাতে কোনো ধ্যানই নেই তোমার।”

আবরারের সদ্য ঘুম ভাঙা নিদ্রাতুর গলা শুনে সামিয়ার অঙ্গে অঙ্গে শিহরণ বয়ে যায়। সবসময়ই বড্ড মায়াবী লাগে তার গলা সামিয়ার নিকট, তবে নিদ্রাতুর এই কণ্ঠ একটু বেশিই আসক্তিকর যেন।

হুট করেই মনে পড়ে যায় ফাহাদের কথা। ছেলেটা গান প্রিয় ছিল, অবশ্য মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টস্ চালানো বা শুনা তার মাঝে ছিল না, খালি গলায় গাওয়া ও শুনা পছন্দ করত। কারণ বাদ্যযন্ত্র হারাম, তা সে খুব ভালো করেই মানত।

ছেলেটা তাকে উদ্দেশ্য করে কতশত বার তার চমৎকার কণ্ঠের কত রোমাঞ্চকর, অনুভূতি মিশানো, আবেগী গান গেয়েছে; অথচ সেই গানের লিরিক্সের একটি শব্দও তার মন ছুঁতে পেরেছিল কি না সন্দেহ। কেন এমন হলো?

আনমনেই ভেবে উঠে সে,

“জীবনের প্রতিটি কোণে যে বা যারা আমাদের চায় তাদের মনে ঠাঁই দেওয়া হয় না। আর যে বা যারা আমাদের ছিলই না তাদের পেতে আকুল হয়ে উঠি।

আসলে নারীরা সহজলভ্য প্রিয় নয়, অসাধ্য সাধন করতে চায়। যার দরুণ নিজেই ধ্বংস হয়ে যায় সাধ্যের বাইরে পেতে যেয়ে।”

আবরার তার হাত ধরে একটানে নিজের উপর ফেলায় ঘোর ভাঙে তার, সাথে বেশ হচকচিয়েও উঠে। আবরারের তপ্ত শ্বাসগুলো আগুনের থেকেও পোড়ায় বেশি। এ যে স্বয়ং প্রেমানল তার জন্য।

যুবক সেসব পরোয়া না করেই তাকে শক্ত হাতের প্রেমময় বন্ধনে আবদ্ধ করে রিনরিনে গলায় বলে,

“ও রমণী, তোমার সব ভাবনাগুলো আমি ময় করে দাও, বিনিময় আমার হৃদয়ের মরুভূমিতে তোমার নামে করা এক সমুদ্র ভালোবাসা টুকু গ্রহণ করে নেও।”

“আমার অঙ্গে অঙ্গে নয় লোমে লোমে তোমার বাস। গোটা আমিকেই তুমি বহু আগে ছুঁয়ে ফেলেছো, নিজের করে ফেলেছো কোনো স্পর্শই ছাড়াই। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে, নয় আমার প্রশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস, দোয়াতেও তুমি কাব্য।

আমার প্রিয় সুখ নয়, অসুখ তুমি। তুমি কাছে আসলেও আমি তোমার, তুমি না আসলেও আমি তোমার। তোমার অগচোরেই আমি প্রতিমুহূর্ত তোমার ছিলাম, আছি, থাকব।”

এই কথাগুলো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে মন চাইলেও মনে মনে বলেই শান্ত হয় সামিয়া। শুধু ডান হাতটায় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আবরারের দেহ।

‘কিছু ভালোবাসা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ, অগোচরে থাকতে বাধ্য। তা নাহলে যে জটিলতা বাড়বে, তিক্ততা বাড়বে। তার চেয়ে বরং আবরণেই আবদ্ধিত থেকে নিরাপদ থাকুক ভালোবাসা।’

___

আবরার গোসল করতে ঢুকলে সামিয়া ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়। তাড়াতাড়ি কাঙ্ক্ষিত নম্বরে কল লাগায়। কিন্তু নাম্বার সুইচ অফ দেখে তাড়াতাড়ি অন্য আরেক নম্বরে কল দেয়।

রিসিভ করতেই সে চাপা ক্ষিপ্ত গলায় বলতে শুরু করে,

“তুমি না বলেছিলে অনন্যা আর কখনো ফিরে আসবে না কাব্যের জীবনে? তবে এখন ওই মেয়ে ওর সাথে কন্ট্রাক্ট করতে চাচ্ছে কী করে?”

“শান্ত হ, মামনি। শান্ত হ। সব খুলে বল আমায়। আমি তো তোর কথা মতোই…”

“আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাচ্ছি না মা। আমার জীবনটা শেষ হয়েছে তোমার জন্য, তোমার জন্য আমি সিক, কোনো চাওয়া-পাওয়াই তো পূরণ করতে পারোনি।

শুধু একটা জিনিসই তো চেয়েছিলাম তোমার আর বাবার কাছে, সেটা পূরণ করার বিনিময়েও তো কম কথা শুনাওনি। সব সময় বাজে বাজে কথা বলে গেছো। বাসে কাব্যকে দেখে বাজে কথা বলেছো, গ্রামে কাব্য ভুল করে আমায় ভুলভাল কথা বলায় বলেছো, আরও কতবার কত কী বলেছো!

প্রতিটা সময় আমাকে বুঝিয়েছো আমি ইউজলেস, শুধুই তোমাদের নাম ডুবাই। সব তো চুপ করে সয়ে গেছি ছোটবেলা থেকে, কখনো টুঁশব্দও করিনি। কিন্তু আমার কাব্য অন্য কারো হয়ে গেলে আমি… আমি কী করব?”

কিছুটা মতিভ্রষ্টের মতোন মাথায় হাত রেখে চাপা আহাজারি করে কথাগুলো বলে সামিয়া। আলিফা খাতুনের দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কাকে বলবে? সায়রাজ কবিরও ব্যবসায়িক কাজে ঢাকার বাহিরে। তবুও মেয়েকে শান্ত তো করতে হবে।

“মা রে শান্ত হ। ঐ মেয়ে কোনোদিন আবরারের ছায়াও মাড়াতে পারবে না, আমি এমন ব্যবস্থাই করব।”

মায়ের ওয়াদা শুনে কিছুটা শান্ত হয় সামিয়া। আস্তে আস্তে করে কল ডিসকানেক্ট করে দেয়। অশ্রু মাখা চোখে ক্রুর হেসে বিড়বিড় করে বলে,

“সেটাই যেন হয় মা। নাহলে আমি কিছুই ঠিক থাকতে দিব না।”

এর মধ্যেই আবরার এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সামিয়া তার সিক্ত দেহে নিজের মাথা ঠেকিয়ে অশ্রু টুকু মুছে নেয়। প্রশ্ন করে,

“বাসায় যাবেন না আপনি? টাওয়াল না পড়ে থেকে তাড়াতাড়ি তৈরি হন। আলমারিতেই তো এক্সট্রা কাপড় আছে দেখলাম, এই শাড়িটাও পেলাম। এগুলো কি হোটেল থেকে…”

“উহু, আমি কিনে এনেছি। আর এত দ্রুত যেতে চাচ্ছো কেন? ভালো লাগছে না এখানে?”

বেশ রিনরিনে গলায় উত্তর দেয়। তার শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমশ ধীর হচ্ছে।

“না, তা না। তবে কাল থেকে তো আপনি ডিউটিতে যাবেন তাই গুছগাছও তো করা লাগবে কিছু। তাছাড়া নিজের বাড়ি তো নিজের বাড়িই।”

“আচ্ছা তবে লাঞ্চটা করেই এখান থেকে বের হবে। কারণ বুকিং সারাদিনের জন্যই দিয়েছিলাম। যাকগে লাঞ্চ কি রুমেই করবে?”

“হুম।”

“ঠিক আছে, আমি চেঞ্জ করে অর্ডার করছি।”

বলেই ললাটে অধরের স্পর্শ এঁকে বারান্দা থেকে প্রস্থান করল সে। অন্যসময় হলে যুবতীও আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলতে, কিন্তু আজ তার মাথায় নানা জটিল ভাবনার প্রজাপতি উড়ছে।

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২২তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
আবরার ও সামিয়া রিসোর্ট ছেড়েছে প্রায় বিকেলের দিকে। যদিও রিসোর্ট ছেড়ে সোজাসুজি বাড়ি ফিরার কথা ছিল, কিন্তু তাকে অবাক করে আবরার তাকে নিয়ে আসল এক ফসল ক্ষেতের সামনে।

আকস্মাৎ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দেওয়ায় বিচলিত হয় সামিয়া। আবরার নিজে নেমে তাকেও নামতে ইশারা করে। হেসে আবেদন করে,

“আমার বহুদিনের স্বপ্ন প্রিয় মানুষের মাথা কাঁধে নিয়ে কোমড়টা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে হাতে হাত রেখে সুর্যডুবি দেখব। পূরণ করবেন না আপনার জনাবের স্বপ্ন?”

সামিয়া হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানায়। কিন্তু আশপাশ দেখে ভ্রুঁ কুচকায়। তারা বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছে পাঁকা রাস্তায়, রাস্তার দুপাশেই নানা ফসলের ক্ষেত।

“সূর্যডুবি তো দেখতে বেশি ভালো লাগে নদী-সমুদ্রের তীরে। আপনি এখানে এসেছেন দেখতে আবরার?”

“হুহ্! তুমি শহুরে মেয়ে কী আর বুঝবে শস্যক্ষেতে পড়ন্ত সূর্য দেখতে কতটা চমৎকার।”

কিছুটা বিদ্রূপ করেই বলে আবরার। সামিয়া ভেঙচি কাটে। অতঃপর সময় আসে সেই মনোরম মুহূর্তের। সূর্য ঢলে পড়তে শুরু আকাশের চাদর থেকে, ধীরে ধীরে আবছা আলো ধেয়ে আসছে চারপাশে।

আবরার কাছে টেনে নেয় সামিয়াকে। আবরারের কাঁধে মাথা এলিয়ে রমণী দেখতে শুরু বাংলা মায়ের অপরূপা সৌন্দর্য। আবরার একবিন্দুও মিথ্যা বলেনি।

এই দৃশ্য সত্যিই অতুলনীয়। সারা সবুজের মাঠের শেষপ্রান্তে যেন আকাশ বেয়ে নেমে আসছে লালচে রক্তিম এক অগ্নিকুণ্ডলি; নামতে নামতে নীল আকাশে যেন গৌধূলী, ধূসর, কালচে রঙ মিশিয়ে দিয়ে আসছে; ধীরেধীরে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে।

কী চমৎকার সেই দৃশ্য! সবচেয়ে মজাদার বিষয় হচ্ছে তার চোখজোড়ার মনে হচ্ছে এই ক্ষেতটা পেরিয়ে গেলেই সে ছুঁতে পারবে এই রক্তিম গোলকটিকে। কিন্তু তা কি সম্ভব? চোখের ধোঁকা সবটা।

আবরারকে অনেকটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল,

“আমার ছোট স্বপ্নগুলো কতকাল ধরে অধরা,
তোমায় পেয়ে পূর্ণ হলো আমার সকল অপূর্ণতা।
আজ আমার সূর্য তুমি, চন্দ্র তুমি,
তোমায় দিয়েই দিনের সূচনা,
তোমার থেকে রাত্রির শুরুয়াত।
গোটা তুমিটারই আমাতেই বাস।
আমার কোনো ক্ষণিকের সুখ তুমি নও,
আমার একমাত্র প্রিয় অসুখ তুমি,
যার শুরু আমাতে, সমাপ্তি আমাতে।”

___

বেলা পড়েছে। পাখিরা ডানে মেলে নিজ নিজ নীড়ে পৌঁছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়েছে। সূর্যটাও নিজ নীড় ফিরতে তৎপর, প্রিয়তমা অপেক্ষা করছে কি না কে জানে? ফাহাদ একদৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখছে।

হুট করেই আফসোসের সুরে বলে,

“আমার একটা নীড় হলো না গো, নীড় হলো না।”

শব্দ করে হেসে বড় বড় পা ফেলে চায়ের খাল কাপটা টেবিলে রেখে মরিচিকা পড়া লোহার দোলনায় শুয়ে পড়ে। এই দোলনা জুড়ে বেশ মধুর স্মৃতি আছে, এখানটায় বসলে একপ্রকার শান্তি অনুভব করে সে।

ফাহাদের মা বেঁচে থাকতে প্রায়শয়ই ছোট্ট ফাহাদ দেখতো বাবা-মাকে আসরের নামাজের পর এখানে এসে চা-আড্ডা দিতে। সেই যে মা পৃথিবী ছেড়ে গেল বাবাকে আর কখনো দেখেনি প্রয়োজন ছাড়া এই মিনি ট্যারেসে আসতে।

” তুমি দূরে দূরে আর থেকো না,
এ চোখে চেয়ে দেখো না।
আমায় ভালোবেসে
ঐ হৃদয়ে বেঁধে রাখো না।”
( দূরে দূরে- ইমরান ও পূজা)

পরিচিত নারী কণ্ঠে গানটি শুনে মুচকি হাসি ফুটে উঠে ফাহাদের মুখশ্রীতে। মেয়েটা যে নিজের অনভিজ্ঞ গলায় বারবার গানের এই চরণগুলোর মাঝেই প্রেম নিবেদনের চেষ্টা করে তা সম্পর্কে সে ভালোভাবেই জ্ঞাত। অবশ্য সদ্য সতেরো পেড়িয়ে যাওয়ার মেয়ের থেকে এর বেশি কী আশা করা যায়।

“বিরক্ত করিস না তো সাথী। যা এখান থেকে।”

“কেন রে ফাহু! আমি আসলে তোর কোন ভাতে ছাই পড়ে?”

“তুই তো পুরোটা ছাই। আবার থাকিস কত রঙচঙ মেখে আমার চোখ জ্বলে যায় রে, চোখ জ্বলে যায়!”

মেয়েদের বাক্যের তীর ছুঁড়ার জন্য সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো তার সম্মান, আর সম্মানের পরই হলো তার রূপ ও সাজসজ্জা। এ নিয়ে কোনো প্রকার নেতিবাচক কথাই সহ্য সীমার বাহিরে, আর মেয়েটি যদি কিশোরী বা অপরিপক্ব হয় তবে তো কথাই নেই।

ফাহাদ বেশ বুঝে শুনেই তার বাক্য ছুঁড়ে দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সাথী।

“তুই খুব খারাপ রে ফাহু! খুব খারাপ! তোর সাথে আড়ি আর কথা নেই।”

বলেই ছুটে চলে যায়।

এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন ফারুখ সাহেব, তিনি এতক্ষণ ছেলে ও ভাতিজির দুষ্টামি দেখছিলেন। ছেলেটা আজ বহুকার নির্জীব হয়ে থাকে, শুধু সাথীর বাচ্চামিতেই যেন সতেজ হয়। যেমনটা বর্ষণে বৃক্ষ হয়।

“মেয়েটাকে মিথে মিথে না চেতালেও পারতিস ফাহাদ। কয়দিন পর তোর বউ হবে এমন আচারণ মোটেও কাম্য…”

“কী বলছো বাবা এসব?”

বাবাকে পুরো কথা সম্পন্ন করতে না দিয়েই প্রশ্ন করে ফাহাদ।

“হুম, তোর চাচা-চাচী আর আমি মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাথীও নিমরাজিই। ও যে তোকে পছন্দ করে তা তুইও তো জানিস আর তুই-ই তো কিছুক্ষণ আগে গাইছিলি নিজের একটা নীড় পাইলি না, তাই সেই ব্যবস্থা করলে তোর না করার কথাও না।”

“তাই বলে বাবা এত পিচ্চি একটা মেয়ে। ওর সাথে কি আমার যায় বলো? তাছাড়া আমি এখনো সামিয়াকে… ”

“বোকা ছেলে । হুমায়ূন আহমেদ কী বলেছে জানা নেই? ‘যা হারিয়েছো তার জন্য আফসোস করবে না। ওটা তোমার জন্য না। যদি তোমারই থাকতো, তবে তোমার থেকে তার পালানোর সাধ্য ছিল না।’

সুতরাং পিছুটান নিয়ে বসে থেকে লাভ নেই। আমাদের এগিয়েই যেতে হয় জীবনে, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য, ভালো থাকার জন্য। তোরও আগাতে হবে আমার জন্য, তোর জন্য, ঐ মেয়েটার জন্য।

আর যতটুকু বয়সের বিষয়, বিয়ে হলেই তো আর সংসার করা লাগছে না। তুই তোর ঘরে থাকবি, ও ওর ঘরে। আঠারো শেষ হোক এরপর ওর আর তোর সময় মতোই দাম্পত্যজীবন শুরু করবি, তাড়া কীসের? এতদিন নাহয় বোঝা-পড়া করে নে হালাল ভাবেই।তাছাড়া একটা কথা জানিস?

ভালোবাসার জন্য কিশোরীরাই হয় ষোলো আনা পরিপূর্ণ। তাদের ভালোবাসা হয় অন্ধ ষাঁড়ের মতোন কিংবা নরম এঁটেল মাটির মতোন। যার কোনো সীমা নেই, কাজ করে না কোনো বাধা-বিপত্তি, ভাবে না ঠিক-ভুল বা কোনো যুক্তি। এই ভালোবাসাটাকে সামলে নিয়ে নিজের পছন্দ মতো আকার দিতে পারা যায়। তাদের নিজের মতোন ভালোবাসা যায়, নিজের মতোন গড়ে নেওয়া যায়। তাদের বাচ্চামোটাও বেশ আদুরেই।”

বাবার কথা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মনযোগ সহকারে শুনছে ফাহাদ। তার মোটেও বই-উপন্যাস পড়ার স্বভাব নেই, বরং বিরক্তিকর তার নিকট এসব। তবে তার বাবা বেশ কাব্যিক পুরুষ, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারেও বটে। তাই বলে এতটা তা সে জানতো না।

সে অন্যদিকে তাকিয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

“তা আমার বিয়েটা হচ্ছে কবে?”

ফারুখ সাহেবের মুখে এবার হিরের টুকরোর মতোন চকচকে হাসি চলে আসে।

“এই তো আগামী মাসের চার তারিখে।”

তারপর বাবা-ছেলে মিলে বেশ খাণেকটা সময় আড্ডা দিয়ে মাগরিবের আজান পড়তেই মসজিদের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

মাগরিবের নামাজ পড়ে নিজ রুমে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনই কেউ ল্যাং মেরে ফেলিয়ে দেয় তাকে। ফাহাদ রাগী দৃষ্টি নিয়ে চোখ তুলতেই দেখে সাথী হাতে মুখ চেপে হাসছে। মেয়েটা বেশ ইতরে স্বভাবের। বুঝ হওয়ার পর থেকে জীবনে একবারও ফাহাদ তাকে দিয়ে ভাইয়া বলাতে পারেনি।

ফাহাদ উঠে তাকে ধরতে এগুতেই সে দৌড় দিতে নেয়। কিন্তু ঐ যে কপাল! তাকে ধরে ফেলে ফাহাদ। তার শাস্তি হয় পাঁচ বার কান ধরে উঠ-বস করা। তা নাহলে যে ফাহাদ আজ আর বেডরুমের দরজা খুলবে না।

সেও উঠ-বস করতে করতে শাসিয়ে বলে,

“দিয়ে নে ফাহু যত পারো শাস্তি। দুদিন পর যখন বউ হব, শাস্তির নাম মুখে আনলেও একদম নারী নির্যাতন কেস করে দিব।”

ফাহাদ আপন মনেই হেসে উঠে। ভাবে,

“বাবা ঠিকই বলে এর বাচ্চামোও বেশ আদুরে। তবে তাও কোথায় যেন ডাকছে আমায় একঝাঁক পিছুটান।”

___

ব্যবসার কাজ সেড়ে হোটেলে ফিরে সায়রাজ কবির স্ত্রীর এতগুলো কল পেয়ে চিন্তিত হন। কারণ আলিফা খাতুন এমনিতেও কখনো প্রয়োজন ছাড়া কল দেন না। তিনি কল করেন স্ত্রীর ফোনে।

কল রিসিভ হতেই উদ্বিগ্ন গলায় বললেন,

“কোনো সমস্যা হয়েছে না কি বাড়িতে? এত বার কল দিয়েছিলে কেন?”

আলিফা খাতুন স্বামীর গলাতে ঠিক-ই ক্লান্তির ছোঁয়া পেলেন।

“না, এখন বলাটা ঠিক হবে না। এমনিতেই ব্যবসার কাজে এত ক্লান্ত থাকে।”

তাই কথাগুলো ভেবেই শুধালেন,

“না, না, তেমন কিছু না। আসলে কবে আসবে জিজ্ঞেস করতেই… তা কবে ফিরছেন?”

“এই তো আগামীকাল সকালের বাসে। আচ্ছা, এখন রাখো। খেয়ে-দেয়ে ঘুমাবো।”

“জী, ঠিক আছে। রাখছি।”

কল কেটে আলিফা খাতুন একা একাই সব ঝামেলা নিয়ে ভাবতে থাকলেন। কীভাবে সব সামলাবেন বা মেয়েটা কীভাবে ফিরে এলো কিছুতেই বুঝতে পারছেন না তিনি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here