প্রিয় অসুখ ও একাকিনী, পর্ব:১৯+২০

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১৯তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
দুপুর তিনটা তেমন কোনো পেশেন্ট ছিল না শামিমের তাই আবরারের কল পাওয়ার সাথে সাথেই কেবিন ছাড়ে সে। টং দোকানে দুই বন্ধু বসে ধোঁয়া উঠানো মালাই চা পান করছে। চা প্রেমিদের মতে দামী হোটেলের চাকেও হার মানায় এই মামাদের চা।

খাণিকটা সময় চা বিরতি নেওয়ার পর শামিম জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো? কী জন্য ডাকসোস তাই-ই তো বলিস না।”

“আমার সাথে তোর একটা জায়গায় যেতে হবে।”

আবরারের গম্ভীর উত্তর শুনে সে ভ্রু কুচকে ফেলে।

“মানে?”

“সামিয়ার ফোনে প্রায়শয়ই ফাহাদ নামক কারো কল আসে। আর যখনই কল আসে ও খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, অস্বস্তিকর লাগে ওকে। আমি যতটুকু জানি এটাই ওর এক্স ফাহাদ। কিন্তু এত বছর পর ও বারবার কল… আই থিংক আই নিড টু মিট হিম।”

“তবে ও যদি জানতে পারে তুই ভাবীর হাজব্যান্ড তাহলে কি তোর সাথে মিট করতে রাজি হবে?”

“হুম, তাই-ই ভাবছি। পরিচয় না বলেই দেখা করতে বলি। দেখি কী বলে।”

“হুম।”

আবরার কল করে ফাহাদের নাম্বার। কয়েক মুহূর্ত রিং হওয়ার পরই কল রিসিভ করে কেউ একজন ভারী পুরুষালি গলায় অত্যন্ত আদবের সাথে বলে উঠে,

“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন? ”

আবরার অবাক হয়। ছেলেটার গলায় এত মাধুর্য! অনেকটা পাকিস্তানি গায়ক আতিফ আসলামের সাথে মিলে যায়।

নিজেকে সামলে জবাব দেয়,

“জী, আমাকে আপনি চিনবেন না। তবে আমি হয়তো আপনাকে চিনি অল্প হলেও। আপনার সাথে দেখা করাটা খুব জরুরি আমার জন্য। দেখা করতে পারবেন?”

“এভাবে চিনি না, জানি না, আবার দেখা-সাক্ষাৎ…”

সন্দিহান গলায় বলল ফাহাদ।

“চিন্তা করবেন না। আপনার ক্ষতির কারণ হব না। আমি একজন ডাক্তার, আমি চট্টগ্রাম সরকারি হাসপাতালে কার্যরত। আপনি কি আশেপাশে কোনো পাবলিক প্লেসেই আধঘণ্টার জন্য সময় দিতে পারবেন?”

“আপনি যখন এত করে বলছেন তাহলে সমস্যা নাই। আজকে মিট করতে পারবেন পনেরো মিনিটের মাঝে? আমি এখন ফ্রী আছি।”

আবরার অতিদ্রুত বলে ফেলল,

“হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমার কোনো সমস্যা নেই।”

“গ্রেট। আমি এড্রেস ম্যাসেজ করছি।”

___

আবরার রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখতে পায় জোড়ায় জোড়ায় ভরপুর প্রতিটি টেবিল। শুধুমাত্র একটি টেবিলে একজন সুদর্শন পুরুষ একাকি বসে ফোনের দিকে নজর তাক করে আছে। আবরারের বুঝতে বাকি রয় না এটাই ফাহাদ।

এত মোহনীয়তা যে পুরুষের মাঝে হয় তা জানতো না আবরার। ছেলেটার যেমন গলা, তার চেয়ে দ্বিগুন চমৎকার তার রূপ। মেয়েদেরকেও হার মানানো চেহারা।

দুধে আলতা গায়ের রঙ, এতই ফর্সা যে হাত লাগালেই ময়লা হয়ে যাবে এমন ভাব। মাঝারি সাইজের চোখজোড়ার সৌন্দর্য প্রতি মুহূর্ত বর্ধন করে বড় বড় বাঁকানো পাপড়িগুলো। ঠোঁট জোড়া একদম লালচে।

দুনিয়াতে সবাই-ই কম-বেশি সৌন্দর্যের পুজারী, যা যত বেশি দেখতে ভালো তা তত তাড়াতাড়ি বিকে।

সে অজান্তেই ভেবে উঠে,

“এমন একজন পুরুষকে যে পেয়েছিল, সে কি কখনোই আমার প্রেমে মন ভুলাবে? এ কী সম্ভব? আমার ভালোবাসাটা সৌন্দর্যকে হার মানাতে পারবে?”

নিজের মনের এই ভাবনাগুলোকে এই মুহূর্তে বড্ড বেশিই অহেতুক লাগছে আবরারের। কারণ একজন প্রতারকের সাথে সে কী করে নিজের পবিত্র ভালোবাসার তুলনা করতে পারে? এ তো ঘোর অন্যায়!

ফাহাদের হঠাৎই বোধ হয় কেউ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং তাকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ফোন থেকে চোখ উঠিয়ে সামনে তাকাতেই বিস্মিত হয়ে যায়।

মুখ থেকে অস্ফুট ভাবে বেরিয়ে আসে,

“ক-কাব্য?”

আবরার কিছু শুনতে পায়নি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ফাহাদের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

“আসসালামু আলাইকুম৷ আমি সামিয়ার হাজব্যান্ড আবরার।”

ফাহাদ হেসে দেয়, তীব্র বিষাদময় ও বিদ্রূপমাখা এই হাসি।

“তো শেষ পর্যন্ত বেগম জান আপনাকে পেলোই? বাহ্! খুব ভালো! আমার না হোক, আমার বেগম জানের চাওয়া-পাওয়া তো পূরণ হয়েছে।”

তার মুখ থেকে বের হওয়া ‘বেগম জান’ শব্দটা বের হতেই আবরারের চোখ-নাক-কান রক্তিম হয়ে যাচ্ছে রাগে। অন্যকেউ স্ত্রীকে এত প্রেমময় নামে ডাকলে কোন পুরুষ পারে সহ্য করতে পারে? কোনো প্রকৃত স্বামীই না, সে যতই মহান হোক কিংবা অধম হোক।

“লিসেন মিস্টার ফাহাদ, সামিয়ার সাথে আপনার কী বা কেমন অতীত ছিল তাতে আমি নূন্যতম কেয়ার করি না। মনে রাখবেন সে এখন আমার স্ত্রী। আই ডোন্ট লাইক কেউ আমার স্ত্রীকে এসব বলুক।”

ফাহাদ হো হো করে হেসে উঠে। তার ফর্সা মুখশ্রী লাল হয়ে এসেছে, ঘন পল্লব বিশিষ্ট রক্তিম নয়ন জোড়ায় নোনাজল এসে জেমেছে। তার হাসির সে কী ঝংকার! বেদনা যেন টপকে টপকে পড়ছে।

রেস্টুরেন্ট তখন মানুষের কথার কলরবে মুখরিত। তাই অস্বস্তিকর কোনো পরিস্থিতির রচনা হয়নি।

“আমি এদিকে গর্ধব একদিকে কষ্ট পাই ভালোবাসাকে হারানোর, ঠকানোর অপরাধে, আরেক দিকে পুড়ি প্রেয়সীকে না পাওয়ার অগ্নিরথে। অধম আমি এ-ই জানলাম না এই পোড়ন, কষ্ট সব সুখের। আমার অন্ততেও ভালো থাকুক আমার বেগম জান। আমার পোড়নেও শীতলতা পাক সে।”

আবরারের কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ছেলেটার কথার। একদিকে রাগ লাগছে ফাহাদ ‘বেগম জান’ ডাকায়, অপরদিকে ছেলেটার কথার দ্বারা তার জানা, মানা সব তথ্য তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার চোখের অশ্রু, আক্ষেপ সব দেখেও যেন দেখছে না সে, বড্ড অন্ধ হয়েছে যে ঈর্ষায়।

সে কিছু বলবে তার আগেই ফাহাদ তার চোখের কোণে জমা অশ্রু টুকু পুনরায় শুধালো,

“আমার ‘বেগম জান’ আপনাকে খুব ভালোবাসে। জানেন প্রতিটি সকাল, রাত শুরু হয় আপনার ভাবনায়, আপনার অনুভূতিতে। ওকে কখনো কষ্ট দিবেন না প্লিজ, মেয়েটা বড্ড নরম, আগলে রাখবেন।

আর হ্যাঁ ‘বেগম জান’ ডাকায় রাগ করলেও কিছু করার নেই। এটা বলার অধিকার আমার থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না, না কেউ দিতে পারবে। কারণ এই শব্দ, এই অধিকার পুরোটাই আমায় জুড়ে, আমিই এই অধিকার দিয়েছি, আমার মৃত্যুতেই এর সমাপ্তি।”

গোটা মাথা কনফিউজ হয়ে গেছে আবরারের। যে ছেলেটা ধোঁকা দিয়েছে তার এমন প্রেমিক পুরুষ ভাবখানা কেন তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যুবক। ফুস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

“তখন টেনে পড়ে বেগম জান যখন তার বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমার বেগম জানটা বড্ড উদাসীন থাকত, একাকি থাকতে পছন্দ করত, একাকিত্ব বিলাস করত আমার একাকিনী।

মেয়েটা সবার থেকে আলাদা ছিল। যেখানে ওর বয়সী সব মেয়েরা আড্ডাবাজী, গসিপিং, সাজগাজ, ঘোরাঘুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সেখানে সে থাকত সদা নীরব, ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা এ নিয়ে কটুবাক্য উচ্চারণ করলেও সে চুপ থাকত। কিন্তু অশ্রু, বেদনার বাহ্যিক রূপকে কি আটকানো যায়। ক্লাসের ফাঁকে মেয়েটা ঠিকই অশ্রু মুছতে মুছতে করিডোর হয়ে ওয়াশরুমে যেত।

আমি আমার কলেজের করিডোর থেকে সবই দেখতাম। ছিলাম এক অমনোযোগী ছাত্র, ক্লাস বাঙ্ক দিয়ে হাঁটাচলা করতাম। বাকি মেয়েরা যখন টিফিন আউয়ারে গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে থাকত, তখন এই মেয়েটা মুখ গুঁজে আছে বইয়ে।

তার ছিল না অতি আধুনিক সাজ, স্কুলের আনঅফিশিয়াল দিনগুলোতে তার পরিধানে থাকত সাদামাটা থ্রিপিস আর সাজে শুধুই নীল কাজল লেপ্টানো চোখ। আমি নিজের অজান্তেই বেগম জানের সব কর্ম ফলো করছিলাম, বুঝতেই পারিনি কখন এতটা ভালোবেসে ফেলেছি।

সে আমার কাছে জান্নাতের ন্যায়ই ছিল। আমার মন রাজ্যের বেগম ছিল সে। তাই তাকে তার অগোচরেই ডাকতাম ‘বেগম জান’ বল্র ”

থেমে মুগ্ধ চোখে নিয়ে আলতো হাসে ফাহাদ। না, এই হাসিতে কোনো বেদনার ছোঁয়া নেই, আছে শুধুই প্রথম প্রেমের একঝাঁক মুগ্ধতা।

“কিন্তু প্রণয়ের, সম্পর্কের শুরুটা কীভাবে করব বুঝিনি। এই ফাহাদ, যে এত এত প্রেমের প্রস্তাব, লাভ লেটার পেত; সে কি না পারছিল না মনের কথা জানাতে। অবশেষে সূচনা হয় আমার প্রণয়ের।”

শেষ বাক্যটা বেশ তৃপ্তি নিয়েই বলে সে।

“সেদিন কলেজ শেষে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছিল। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই চলে গেছে। স্কুলের পাশের ছাত্র ছাউনিতে আমি, বেগম জান সহ গুটিকয়েক জন দাঁড়িয়ে। তার চুলগুলো কিছুটা সিক্ত ছিল, মুখে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টিজল, আমি বেশ আসক্তি বোধ করছিলাম। হুট করেই তার সাথে কথা বললাম। প্রথমে হাই-হ্যালো, তারপর পরিচয়।

ভেবেছিলাম সে আনফ্রেন্ডলি হবে, কিন্তু না, সে বেশ সাবলীলভাবেই পরিচিত হচ্ছিল। সেদিন তার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টেও জায়গা করলাম। ধীরেধীরে কথাবার্তা আগালো। সে জানালো কাব্য নামক একজনকে সে ভালোভাসে, যে তার হওয়ারই নয়। সে না কি প্রপোজও করেছিল, বিনিময়ে পেয়েছে একরাশ অবজ্ঞা, উপেক্ষা।

কাব্যের প্রতি ওর ফিলিংস ভীষণ কনফিউজিং ছিল। আমাদের সারাদিনের কথোপকথনের বড় বিষয় ছিল কাব্য। অত্যন্ত মুগ্ধতা, প্রেম নিয়ে তার বিষয়ে বলত। কিন্তু যখনই সেই অপমানের কথা মনে পড়ত তখনই আবার বেশ খাণেক ঘৃণা জড়িয়ে ধরতো তাকে।

একদিন হুট করেই প্রপোজ করে ফেললাম। আমি যেহেতু তার বিষয়ে সব জেনেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আবার তাকে খুব আগলে যতন করে রাখতাম, সবমিলিয়ে তার মানা করা দায় ছিল। তবুও সে আমতা আমতা করছিল, কিন্তু আমার জোরাজুরিতে অবশেষে…

তবে হ্যাঁ আমার থেকে ওয়াদা নিয়েছিল যে ওর কাব্যের প্রতি অনুভূতি নিয়ে আমি কোনোদিন প্রশ্ন তুলতে পারব না। আমি সাবলিল ভাবেই নিয়েছিলাম বিষয়টাকে, অতটা জটিল ভাবিনি, রাজি হয়ে গেছিলাম।”

গম্ভীর মুখ নিয়ে মনযোগের সাথে কথাগুলো শুনছিল আবরার। হঠাৎ করে থেমে যাওয়ায় তার মনযোগ ভঙ্গ হয়, কিছুটা বিরক্তই হয় সে।

“কী হলো? চুপ হয়ে গেলে যে…?”

“জ্ঞানী-গুণীজন বলে গেছেন বলা যত সহজ করা তত কঠিন। আমিও রিলেশনে যাওয়ার পর তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। প্রেম, প্রণয়, পরিণয় সবটা ছিল আমাদের, আমার আর বেগম জানের। সুন্দর মুহূর্তগুলো, কথোপকথনগুলোও নিশ্চয়ই আমাদের জুড়ে হওয়ার উচিত ছিল। কিন্তু হত কী?

সবকিছু জুড়ে ছিলে তুমি। শুধু তুমি। তার মুগ্ধ দৃষ্টি, তার সব কথাবার্তা, তার স্মৃতিচারণ সবকিছুতেই শুধু তুমি। আমার ভালোবাসার মানুষ আমার সামনে বসে সারাটা সময় অন্য এক পুরুষের গল্পে মেতে থাকত এর যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশের মতো না। আমি সারাটা সময় মিথ্যে হাসি ঝুলিতে পুড়তাম এই অনলে। পেয়েও না পাওয়ার অনল, সহ্য করতে পারছিলাম না।

এর মধ্যেই সামিয়ার বিয়ে ঠিক হয়। সে প্রস্তুত ছিল না এসবে, বস্তুত, সে প্রস্তুত ছিল না কাব্যকে ভুলতে। আমরা সিদ্ধান্ত নেই আমরা পালিয়ে যাব বিয়ের দিন, সে আসেও। কিন্তু শেষপর্যন্ত হার মানে আমার ভালোবাসা। আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না এই প্রাপ্তিতে অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা সহ্য করা। তারপর আমি তার চেহারা নিয়ে যা নয় তাই বলে অপমান করে চলে আসি।”

“তুমি না ওকে ভালোবাসতে, তবে অপমান কী করে করলে? নিজের মনের কথাটুকুও তো জানাতে পারতে?”

কিছুটা ক্ষোভ আবরারের কণ্ঠে স্পষ্ট। ফাহাদ নিজের চোখে জমা অশ্রুটুকু মুছে নেয়।

“আমি যদি ওকে সত্যি বলতাম যে আমার সম্পর্কে থেকে কাব্যের মানে তোমার প্রতি এ টান আমি কীভাবে মানব বা এতটা দিন কতটা যন্ত্রণা বোধ করেছি তাহলে ও সবসময় নিজেকে আমার দোষী মনে করত। তার চেয়ে বরং ও আমাকেই ধোঁকাবাজ, সুন্দরের পূজারী ভাবুক।”

“তবে একটা জিনিস বুঝলাম না। আমি কাব্য…? ওকে অপমান?”

“হুম, আপনিই কাব্য যাকে ও অন্ধের মতোন ভালোবাসে। শুধু ভালোই বাসে না, ওর অবসেশন আপনি। আমি যতদূর জানি আপনি টুকটাক কবিতা-উক্তি লিখেন কাব্য নামক পেইজ থেকে।”

“হ্যাঁ, লিখতাম। তবে ঐ আইডি আর এসব তো অনেক আগেই ছেড়েছি। ”

“আমি আপনাকে খুব বেশি বলতে পারব না। ভালো হয় বেগম জান থেকেই জেনে নিবেন। আচ্ছা আমি চলছি, একটা মিটিং আছে। মন চাইলে এক অমবস্যার রাতে বেগম জানকে বলিয়েন এই পুরুষটিও বড্ড বেশি ভালোবাসে তাকে।”

ঘড়ির দিকে শেষ কথাটুকু বলে কালো সানগ্লাসটা চোখজোড়া ঢেকে বের হয়ে যায়। পুরুষের চোখে অঘোষিত ভাবে অন্যায়, তার সম্পাদিত এই অন্যায় ঢাকতেই সানগ্লাসের সাহায্য নিয়েছে সে।

বর্তমানে,
চা পান করতে করতে অতীতে হারিয়ে গিয়েছিল আবরার। নার্সের ডাকে হুশ ফিরে তার। কিছুদিন আগেই এই সত্য আবিষ্কার করে সে। যদিও তার মনে অনেক প্রশ্ন এই সত্য নিয়ে, তবে জিজ্ঞেস করতেও বেশ ভয় পান। যদি সামিয়া তার করা অবজ্ঞা, উপেক্ষা মনে করে উত্তেজিত হয়ে যায় তাহলে?

তবে একটি প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে, তা হলো সামিয়ার সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কী করে? কিন্তু এখনো জানার বাকি। তার মধ্যে প্রধান একটি হলো সে কখন সামিয়াকে অবজ্ঞা করেছিল? আর কখনই বা তাদের মাঝে সত্যিকার অর্থে পরিচয় এবং কথোপকথন হয়েছিল?

সে এসব ভাবতে ভাবতেই অপরাশেন থিয়েটারের সামনে এসে থামে। একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও গ্রহণ করে। মনে মনে ভাবে,

“না, আর এসব ভাবা যাবে না। আবরার মাথা ঠাণ্ডা কর, নাহলে যেকোনো একটা ভুল হয়ে যেতে পারে। মনে রাখিস প্রতিটি চিকিৎসকের নিকটই আগে রোগী পরে সব, পেশেন্টস্ কাম ফার্স্ট।”

ডাক্তারদের বিশেষ করে সার্জনদের মানসিক চাপে থাকতে নেই, আর থাকলেও সেই চাপ নিয়ে রোগীর সেবা করতে নেই। এতে ভুল করার সুযোগ থাকে, জীবনের ঝুঁকি থাকে।

___

একমাস কেটে গেছে বিয়ের। নিশার আজকাল মরে যেতে ইচ্ছে করে। সে অহনের বউ, অথচ এই বাড়ির প্রতিটি কাজের লোক তাকে চিনে অহনের রক্ষিতা হিসেবে। ‘রক্ষিতা’ নামক বাজে শব্দটি আজ তার নামের সাথে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। কাজের লোকগুলো যখন তার দিকে বাঁকা চোখে তাকায় তখন গা ঘিনঘিন করে উঠে।

বলতে গেলে তো অহনের আলিশান বাড়িতে অহনের অনুপস্থিতিতে তার আধিপত্য। কিন্তু দিনশেষে তার স্থান অহনের শক্ত বুকে কিংবা নরম বিছানায় নয়। তার স্থান হয় ব্যালকনির ধুলোময় মেঝেতে, বিনা কোনো বালিশেই ঘুমোয় সে।

সে এখন প্রায়শয়ই আনমনে বলে উঠে,

“কী অদ্ভুতুড়ে না জীবনটা আমার! বাহির থেকে যতটা না সুন্দর, ভিতর থেকে তার চেয়ে বেশিই তিক্ত আর কাটায় ভরপুর।”

“এই যে আপনার কফি।”

বেশ রসকষহীন ভাবেই বলে কফিটা টেবিলে রাখল ঝুমকো। ঝুমকো এই বাড়ির বা অহনের কী হয় সম্পর্কে তা ঠিক জানে না নিশা।

প্রথম প্রথম বাবুর্চি কিংবা কাজের লোক ভাবলে দুদিনের মাথায় ঠিকই টের পায় এই মেয়ে এর চেয়ে অনেকটা বড় পদের কেউই। একবার জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল কিন্তু মেয়েটার ত্যাড়া ত্যাড়া আর খোঁচানো কথায় সাহস ও ইচ্ছে হয়নি।

কফিটা মুখে দিতেই মুখটা বিদঘুটে করে ফেলে সে। একে তো অতিরিক্ত কফির জন্য তেতো স্বাদ, তার উপর চিনির জায়গায় লবণ। বেশ রাগলেও ভাবল কিছু বলবে না। তবে ঝুমকোর মুখের কুটিল হাসি দেখে আর নিজেকে আটকাতে পারল না।

“এই মেয়ে দাঁড়াও! এটা কেমন চা বানিয়েছো তুমি, হ্যাঁ?”

ঝুমকোও ভেঙচি কেটে চড়া গলায় বলল,

“যা দিয়েছি তা-ই খাবে, আর না মন চাইলে না খেয়ে থাকবে। তুমি এমন কিছু হয়ে যাওনি যে তোমার কথামতো সব হবে।”

“তুমি কে আমাকে এসব বলার!”

“আমি যে-ই হই এট লিস্ট তোর মতো দেহব্যবসায়ী নই৷ সামান্য এক রক্ষিতা হয়ে এত হ্যাডম!”

হিসহিসিয়ে বলা এই কথা শুনে নিশার যেন রাগের আর সীমানা থাকে না, এক চড় লাগিয়ে দেয় ঝুমকোর। ঠিক তখনই ঠাশ শব্দে মুখরিত হয় পরিবেশ।

অহন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে। পুরুষ মানুষের শক্ত হাতের মারের জোর কি আর যেমন তেমন কথা? নিশার মাথার পেছনটা যেয়ে পড়ে মেঝেতে, ব্যথায় তার বাম পাশের গালটা অবশ লাগছে। সে চোখ উঠিয়ে দেখে অহন। অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে,

“তুমি মারলে আমায়? তাও এই মেয়ের জন্য? সামান্য কাজের মেয়ের জন্য!”

“একদম চুপ!”

খেঁকিয়ে উঠে যুবক।

“জানো ও কে? এই পৃথিবীতে ও আমার একমাত্র আপনজন, আমার চাচাতো বোন ও, এ বাড়ির মেয়ে। তোমার সাহস কী করে হয় ওকে কাজের লোক বলার?

কাজের লোক তো তুমি! তোমার কাজ আমার বিছানায় সঙ্গ দেওয়া! এটা আমার লাস্ট ওয়ার্নিং ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট, ভালো হবে না বলছি।”

বলেই অহন ঝুমকোর হাত ধরে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেল। ঝুমকোর মুখের কুটিল হাসি ঠিকই খেয়াল করল নিশা। তবুও সে নির্বোধের মতোন মেঝেতে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়। তার চুল বেয়ে ঝর ঝর করে বেয়ে যাচ্ছে লালচে রক্ত।

তার মনে পড়ে যায় জীবনে করা সবগুলো অন্যায়, মিথ্যেগুলো। বিশেষ করে সামিয়ার প্রতি করা অবিচার। আস্তে আস্তে চোখজোড়ার সামনে সবকিছু ঘোলাটে হতে শুরু করে।

অর্ধচৈতন্য দেহে তার অবচেতন মন বারবার একই প্রার্থনা করে যায়,

“আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করো। শুধু একবার সুযোগ চাই সামির নিকট ক্ষমা চাওয়ার। দিবে কি আল্লাহ সেই সুযোগ? দিলেও কি ভুলে যাবে সে আমার প্রতি সকল অভিযোগকে?”

কয়েকমুহূর্তেই পুনরায় ঢলে পড়ে সে মেঝেতে। এবার ক্ষত তৈরি হয় কপালের ডানপাশে। রক্ত এবার দুই ধার দিয়েই ঝরছে। কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য! এভাবেই বুঝি মৃত্যু ছিল তার?

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২০তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
অহন সব হাসপাতাল ছোটাছুটি করেও আর দুই ব্যাগ রক্ত জোগাড় করতে পারে না। তার নিজেকে খুব বেশি এলোমেলো লাগছে, কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মনে হচ্ছে এ জীবনের অন্ত হলেই বুঝি শান্তি। ভাবছে,

“আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেললে তুমি আমাকে?”

বিকেল বেলার ঘটনার পর সে বাড়ি ফিরে ঠিক আটটায়। সাড়ে আটটায় নিশাকে ডিনারের জন্য কাজের লোক ডাকতে গেলেই দেখে সারা ফ্লোরে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, তার মাঝখানে শুয়ে ছিল নিশা। অহনকে জানালে সে তাড়াতাড়ি তাকে কাছের হাসপাতালে নিয়ে আসে।

ডাক্তার তার অবস্থা দেখেই তাড়াতাড়ি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায় আর জিজ্ঞেস করে,

“রোগীর এই অবস্থা কী করে? এক্সেসিভ ব্লাড লস হয়েছে হয়তো!”

“সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল।”

অহন কিছু বলার আগেই মলয় উত্তর দিয়ে দেয়। তাই আর পুলিশ অবধি গড়ায় না বিষয়টা। ড্রেসিং করার পরও নিশার অবস্থা শোচনীয়। নার্স এসে জানায় দ্রুত ও নেগেটিভ রক্তের ব্যবস্থা করতে।

এক ব্যাগ রক্ত ব্লাড ব্যাংকে পেলেও, আর দুই ব্যাগ পায় না অহন। এরপর থেকেই অহনের অত্যন্ত মানসিক চাপে অবস্থা খারাপ। সে যখন করিডোরে বসে নিজেকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত তখনই একজন তার কাঁধে হাত রাখে।

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে নিনাদ। এতসব ঝামেলায় তাকে জানানোর কথা মাথায় ছিল না অহনের, হয়তো মলয় জানিয়েছে। চেনা মুখটাকে দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না অহন। হু হু করে কেঁদে ফেলে।

“আমি কী করে পারলাম নিনাদ? আমি ওকে এতটা টর্চার…! আমি ওকে শেষ…”

তার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই নিনাদ তার মুখ ঢেকে ফেলে। আশেপাশের লোকজন সহ কিছু নার্স তাকিয়ে আছে, বিচ্ছিরী একটা ঘটনা তৈরি হতে দেরী লাগবে না।

“শান্ত হ অহন। সমস্যা নেই, আমি রক্ত দিব দুই ব্যাগ। আমার ব্লাড গ্রুপ ও নেগেটিভ।”

আনন্দে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে অহনের যেন কত দিনের পথভুলা পথিক সঠিক রাস্তা পেল। ডাক্তার নিনাদের থেকে দুই ব্যাগ রক্ত নিতে না চাইলেও নিনাদের জোরজুরিতে নেয়।

ডাক্তার ওটি থেকে বের হতেই অহন হাড়তাড় করে প্রশ্ন করে,

“এখন কেমন আছে আমার ওয়াইফ? ও সুস্থ আছে তো?”

ডাক্তার সাহেব শব্দ করে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জবাব দেয়,

“রক্ত দেওয়ার পর রোগী আউট অফ ডেঞ্জার হলেও ভয় এখনো পুরোপুরি যায়নি। কাল সকাল অবধি জ্ঞান না ফিরলে ধরে নিতে হবে সে কোমায় চলে গিয়েছে।”

অহন সেখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে। নিনাদ নিজেও মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে তার মুখটা নিজের হাতে আগলে নেয়।

“দেখ, বান্দা আল্লাহকে ভুলতে পারে, আল্লাহ বান্দাদের ভুলে না, এজন্যই তিনি মহান। সবাই ফিরিয়ে দিতে পারে ঐ উপরওয়ালা কখনো বান্দাদের খালি হাতে ফিরায় না যদি চাওয়ার মতোন চাইতে পারিস। ঐ আল্লাহর কাছেই চা।”

অহন শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তারপর দুম করেই সেখান থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করে। ওজু করে এসে পরম ভরসা নিয়ে নামাজে দাঁড়ায় সে। তার পনেরো বছর হওয়ার পর কোনোদিন নামাজ পড়েছে কিনা মনে পড়ে না।

জীবনের পথপ্রদর্শকদের যে হারিয়ে ফেলেছিল। আজ জায়নামাজে দাঁড়াতেই শীতলতা অনুভব করছে সে। কারণ বান্দা ভুলের পরও দিনশেষে অনুতপ্ত হয়ে যখন আল্লাহর দরবারে আসে তখনো আল্লাহ তাকে সাদরেই গ্রহণ করে।

___

সামিয়া ধবধবে সাদা বর্ণের জামদানী পরে সাজতে বসেছে। জুয়েলারির বক্সটা খুলেই আশ্চর্য বোধ করে সে।

২২ ক্যারেট স্বর্ণের একটা মোটা চেইন নেকলেসের আদলে বানানো, আর দুটো কানের পাসা, সাথে আরেকটা কাগজের প্যাকেটে দুই মুঠো সাদা কাচের চুড়িও আছে।

ভাবছে,

“কী জানি আজ কী রঙ লেগেছে লোকটার মনে! সাত-সকালে শাড়ি, জুয়েলারি পাঠিয়ে বলে কি না সেজেগুজে তৈরি হয়ে থাকতে। আজ আসুক খালি লোকটা! আর কীসব দামী জিনিসপত্র এনেছেন।”

যদিও রমণী রাগে গজগজ করছে, কিন্তু আপন মনে সে ভীষণ খুশি, ভীষণ সুখী বোধ করছে।

বেশিরভাগ বাঙালী নারী এমনই, যখন তাকে তার চাওয়া বা পাওয়ার উর্ধ্বে কিছু পায় তখন সে রেগে যায় কিংবা বলা যায় রাগার ভান করে, কিন্তু সেই মুহূর্ত তার চেয়ে আনন্দ কেউ আর বোধ করে না।

সামিয়ার সাজসজ্জা প্রায় শেষ। নিজেকে একবার আয়নায় ভালোভাবে দেখে নিল। যাতে কোনো কমতি না থাকে।

ধবধবে সাদা কাপড় গায়ে লেপ্টানোতে আজ একটু বেশিই শুভ্র লাগছে তাকে, যেন সদ্য ফুটন্ত পবিত্র এক পদ্মফুল। তার সাথে স্বর্ণের অলংকার পরিধানে সোনালি এক আভায় ছেয়ে আছে তার গোটা মুখমণ্ডল।

“মাশাআল্লাহ! চেহেরায় যেন রহমতের নূর এসে গেছে!”

নিজের দিকে আপন মনেই বিড়বিড়ায় সে। অবশ্য নূর আসবেই না কেন স্বামীর জন্য সেজেছে সে, যার জন্য সে হালাল। কোনো পরপুরুষের জন্য তো সাজেনি।

তৈরি হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্লাট থেকে বের হয়। সদরদরজায় তালা দিতেই শামিমের বোন রওজা এসে হাজির। সামিয়ার মুখশ্রীতে কিছুটা আঁধার নেমে আসে।

“কী হলো? মুখটা এমন করে রেখেছো কেন? আমাকে দেখে বুঝি খুশি হওনি?”

সৌজন্যতার খাতিরেই সামিয়া উত্তর দিল,

“না, না, তা কেন হবে? কেমন আছো তুমি?”

“আছি ভালোই। তুমি বাহিরে যাচ্ছো না কি? ”

“হুম, তোমার ভাই কই যেন নিয়ে যাবে। সাত-সকালে কল দিয়ে বলে তৈরি হয়ে থাকতে পিক করবে।”

‘তোমার ভাই’ শব্দ দুটি শ্রবণগত হতেই রওজার মুখ খানায় যেন অমাবস্যার আঁধার নেমে আসে। সামিয়ার অধরজোড়া বাঁকা হাসি দিচ্ছে, সে ইচ্ছে করেই এভাবে সম্বোধন করে আবরারকে।

“তোমার কেন জ্বলে রে বন্ধু?
তোমার কেন জ্বলে?”

সামিয়ার গানের লিরিক্স আওড়ানোর মাঝেই নিশার গলা পেয়ে থেমে চায়। কিছুটা নড়ে-চড়েও দাঁড়ায় সে।

“কিছু বললে বুঝি?”

“বললাম আবরার আমার কোন কালের ভাই লাগে? এসব আজাইরা সম্পর্ক বাধাতে যাবা না যার-তার সাথে!”

রওজার কণ্ঠে ক্ষোভ স্পষ্ট। সামিয়া একটুও বিচলিত হয় না, বরং তার চোখমুখ উজ্জ্বল, হাসিখুশি একদম।

“আরে বাবা, ভাইয়ের বন্ধু তো ভাইয়ের মতোই তা-ই না? তাছাড়া আবরার তো তোমাকে নিজের ছোট বোনের মতোই দেখে। প্রায়শয়ই বলে, ‘আমার তো ছোটবোন নেই, তাই রওজাই আমার বোন।”

শেষ বাক্যটি শতভাগ মিথ্যে, আবরার রওজাকে ছোটবোন ভাববে তো দূরে থাক, কোনোদিন তার নামও নেয় না। কিন্তু সামিয়া কী সুন্দর অনায়াসে ডাহা মিথ্যে বলে ফেলল।

নিজের প্রয়োজনে কত অন্যায়ই না করে এই মানবসমাজ। অথচ, অন্য কেউ করলে তাকে শাস্তি দিতে ভুল করে না কেউ! হিপোক্রিট, প্রতিটি মানবই হয়তো হিপোক্রিট!

তার কথা বলার মাঝেই আবরারের গাড়ি এসে থামে উঠানে। তিনতলা এই বাড়িটির সামনে বিশাল উঠান, নানারকম গাছে, ঘাসে ভরপুর, তবে সবচেয়ে বেশি লোকচক্ষু আকর্ষণ করে কাঠগোলাপ।

সামিয়া আবরারের গাড়ির দিকে এগুচ্ছিল। তখনই রাগ থামিয়ে হুট করেই হেসে উঠে বলল,

“হুম, তবে মায়ের পেটের বোন তো আর না বলো? এমন কত ভাইয়ের বন্ধুর সাথে বিয়ে হয় মেয়েদের। কে কখন কী হিসেবে থাকে বলা তো যায় না।”

প্রথমে সামিয়ার মৃদু রাগ হলেও পরে হাসল। যেতে যেতে বেশ উচ্চ গলায় উচ্চারণ করল,

“মেয়ে তোমার সতীন হবার সখ বড়। তবে আমার অত পালার সখ নাই। তাই হাতটা এবার অন্যকারো সামনেই নাহয় পাতো।”

___

বর্ষার মৌসুম এই বৃষ্টি নামছে তো, এই থামছে।সামিয়ার মন রাজ্য আর দেহ মহল উভয়ই বারংবার শীতল হাওয়ায় শিহরিত হচ্ছে। তার আজ বেশ অন্যরকম বোধ হচ্ছে। এর কারণ অবশ্য আবহাওয়া বা আনন্দিত মন খানা নয়, আবরারের ঘোরলাগা দৃষ্টি।

তাছাড়া লোকটাকে আজ বেশ লাগছে দেখতে সামিয়ার, গ্যাবার্ডিং প্যান্টের সাথে ধবধবে সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরনে লোকটার, সামনের চুলগুলো এসে বাম চোখের উপর পড়ে আছে।

“আমার স্বামী। শুধু আমার প্রিয় সে।”

বেশ তৃপ্তি নিয়ে ছোট ছোট বাক্য দুটি বের হয় তার মুখ থেকে। ভালোবাসা পূর্ণতার তৃপ্তি এত সুখকর তা আজ বোধ করছে সে।

এদিকে আবরারের মন চাচ্ছে গাড়ি চালানো থামিয়ে শুধু পাশে বসে থাকা এই নারীটিকেই পর্যবেক্ষণ করে যেতে। বিশেষ করে লাল আলতায় সেজে থাকা হাত জোড়া আর পা জোড়া তাকে একটু বেশিই আকর্ষণ করছে।

সামিয়াকে তার নিকট একদম বাঙালি গৃহবধূই লাগছে। যার ব্যাখ্যা দিয়ে গিয়েছে বাংলা লেখক-লেখিকারা। তার অবচেতন মন ভেবে উঠছে,

“এই অপরূপা বাঙালী নারীটিই বুঝি আমার ভাগ্যরেখায় ছিল? সত্যিই আমি পেয়েছি তাকে? কোনো স্বপ্ন নয় তো?”

গাড়িটি হুট করেই থামল। সামিয়া ভাবল এসে পড়েছে তারা গন্তব্যস্থলে। কিন্তু তাকে অবাক করে আবরার নিজের পকেট থেকে একটা কালো কাপড় বের করে তার চোখের উপর পরিয়ে দিতে নেয়।

“কী আশ্চর্য! করছেনটা কী আপনি!”

হুড়মুড়িয়ে আবরারের হাত সরিয়ে জিজ্ঞেস করে সে। আবরার শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,

“আপনার জন্য আপনার জনাব বিশেষ উপহার তৈরি করেছে। দেখলে তো আর তা সারপ্রাইজ থাকবে না, তাই আগেই চোখ দুটো ঢেকে দিচ্ছি। সুতরাং জনাবা বেশি না নড়েচড়ে কাজ করতে দিলেই বেটার। সো মে আই?”

সামিয়া কিছু না বলে আবরারকে ইশারায় হ্যাঁ বলে তার দিকে পিঠ দিয়ে বসে। তার চোখের সামনে নেমে আসে অন্ধকার।

গাড়ি আবার খাণিক চলে থেমে যায়। সামিয়া একটুও বিচলিত হয় না। তার বিশ্বাস যে বড্ড মজবুত। আবরার গাড়ি থেকে নেমে তাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।

তারপর থেমে তাকে একটু সেই স্থানে দাঁড়াতে বসে কিছুটা দূরে যেয়ে কারো সাথে কথা বলে। তারপর আবার দুজনের একই সাথে পথচলা।

চোখ খুলতেই সামিয়া অবাক হয়ে যায়। কী সুন্দর ভাবে সাজানো সারা ঘর! লাল গোলাপের পাপড়ি ঢাকা মেঝে। ঘরে মাঝ বরারব থাকা বিছানায় হার্ট আঁকা আস্ত আস্ত সব কামিনি ফুল দিয়ে। তাছাড়া হার্টের মধ্যখানে সাতেক পদ্ম রাখা।

বাসর লতা ফুল লটকানো বিছানার পিছনের দেওয়ালের উপরের দিকে। বিছানার সাইড টেবিলে গোলাপি কাগজে গোল্ডেন গ্লিটার পেন দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লিখা ‘আই লাভ ইউ হানি’। ড্রেসিংটেবিলের উপর কিছু কাঠগোলাপ আর বেলিফুলের মালা রাখা।

তার দেখাদেখির মাঝেই একজোড়া পুরুষালি হাত তার কোমর জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,

“সারপ্রাইজ কেমন লাগল একাকিনীর উপস্ সরি আমার মনমোহিনীর?”

তার তপ্ত শ্বাসগুলো বড় বেশিই শীতল লাগছে সামিয়ার। এতোটাই যে গা শিরশির করে উঠছে।

“ইশ! একটা কাজ তো ভুলেই গেছি।”

বলেই সামিয়াকে টেনে নিয়ে বসালো ড্রেসিংটেবিলের সামনে রাখা টুলটাতে।

তার দু হাতে ব্রেসলেটের মতোন পরিয়ে দিল বেলির মালা। কানের পিঠে গুঁজে দিলে কাঠগোলাপ। এরপর মেঝেতে হাঁটু ভাজ করে বসে তার ডান পা হাতে নিয়ে তাতেক বেশ যতন করে পরিয়ে দিল বেলির মালা, অধরজোড়ার দ্বারা পায়ের পাতায় একটি মিষ্টি ছোঁয়া এঁকে দিতেও ভুল করল না সে।

যুবতী তো সেই কখন থেকে লাজে চোখ নামিয়ে বসে আছে। যেন সদ্য ষোলোতে পা দেওয়া মেয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষকে বহুদিন পর দেখেছে। তার মনও হয়তো আজ তৃপ্তি নিয়ে বলছে,

“সুখী আমি! বহু সুখী!”

সামিয়া লজ্জারাঙা চোখজোড়া উপরে তুলতেই তথা আয়নায় তাকাতেই সাথে সাথে চোখ জোড়া বুজে ফেলে। আবরার তার দুই কাঁধে দুই হাত রেখে আয়নায় চোখ রেখে তাকেই পর্যবেক্ষণ করছে।

আজ আবরারের চাহনিতে একপ্রকার মাদকতা আছে, ভালোবাসার সাথে কামনার মাদকতা যোগ হয়েছে যে। এই মাদকতায় রমণী নিজেও ডুবে যাচ্ছে নিজের অগোচরেই। পবিত্র কামনার মাদকতা বুঝি এমনই?

বড় বড় শ্বাস ফেলছে সামিয়া, অজানা এক অস্থিরতা বোধ হচ্ছে তার। তবে এই অস্থিরতা বড় সুখকর! বড়োই!

যদি আজ তারা অবিবাহিত হত তবে যুবতীর তবে হয়তো এই পূর্ণতায় মনে শান্তি বা সুখ নয় শুধুই কলঙ্কের ভয় থাকত। এ জন্যই বিয়ের পবিত্রতা সব কিছুর উর্ধ্বে।

আবরার তাকে অত্যন্ত বিনীতভাবে আবেদন করে,

“মনপাখি, আমি জানি না তুমি কথাটা কীভাবে নিবে। তবে আমার এ-ই একমাত্র, সর্বপ্রথম এবং শেষ চাওয়াও হতে পারে। আমি আমার একটা পরিবার চাই, নিজের ছোট্ট এক রাজকন্যা চাই। যে বাবা বলে ডাকবে, আমার সারাটা ঘর মাতিয়ে রাখবে।

জানো আমি জীবনে পরিবার, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কারো ভালোবাসাই ঠিক-ঠাক পাইনি। শুধু দাদীই এক নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছিল, আগলে রেখেছিল। ছোট থাকতে মানে বাবা-মা অবশ্য সবাই আদর করত।

কিন্তু ঐ যে বলে না, চাচা-ফুফু আর মামাদের আদর, ভালোবাসা বুঝা যায় বাপ-মার মরণে। আব্বু-আম্মু মরার পর সবাই দূর-দূর আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত, সবার নজর ছিল আমার সহায়-সম্পত্তিতে।

এতোটাই যে তাদের কালো ছায়া থেকে বাঁচাতে আমাকে পড়া-লেখার বাহানায় ক্লাস এইটে থাকতেই ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। এক দাদী ছিল তখন থেকে তাকেও হারিয়ে ছিলাম, ছুটিতেও বাড়িতে যেতাম না আত্মীয়-স্বজনের কথাবার্তার জন্য। তারা সবসময় আমার সম্পত্তি তাদের লিখে দেওয়ার দাবী তুলত।

আমার কখনো সত্যিকর অর্থে আমি পরিবারই পাইনি। যখন বন্ধুদের দেখতাম বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে মেতে থাকত অজান্তেই খারাপ লাগত। এবার আমি নিজের একটা পরিবার চাই। দিবে আমায় একটি রাজকন্যা?”

সামিয়ার চোখের কোণে অশ্রু জমেছে। প্রিয় মানুষের ছোট কষ্টও অনেক গায়ে লাগে। সে কোনো এক বেদনা মাখা ঘোরেই আবরারকে জড়িয়ে ধরে সে। তার সম্মতিতেই পূর্ণতা পায় দুজনের সম্পর্ক।

___

বিকেলের দিকে ঘুম ভেঙে যায় সামিয়ার। আবরারের নগ্ন বুকে নিজেকে দেখে লজ্জায় লাল-কমলা হয়ে উঠে সে। গায়ে চাদর জড়িয়ে ধীর পায়ে উঠে ওয়াশরুমে যায় সে। এই প্রেমের পূর্ণতার যন্ত্রণাও যে বড় বেশি ভয়ংকর।

গোসল করে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ড্রেসিংটেবিলে থাকা আবরারের ফোন বেজে উঠে। সামিয়া ফোন হাতে উঠিয়ে স্ক্রিনে থাকা নামটি দেখেই থমকে যায়।

“অনন্যা” কল করেছে। দ্রুত কল কেটে জড় হয়ে ড্রেসিংটেবিলে গা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে। তার চোখ-মুখে অন্যরকম এক ভয় কাজ করছে।

অস্থির সুরে বিড়বিড়ায়,

“এত কষ্টের পর আবরারের জীবন থেকে অনন্যাকে বের করেছি, তাকে পেয়েছি। তাহলে এতদিন পর এই মেয়ে…? না, আমি আবরারকে কারো হতে দিব না। ও শুধুই আমার!”

শেষ বাক্যটি চোখ-মুখ মুছে বেশ দৃঢ় গলায় বলে সে। উঠে যেয়ে কাউকে কল লাগাতে নিজের ফোনটা হাতে নিবে তখনই আবরার উঠে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here