প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:১৭+১৮

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১৭তম ও ১৮তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
একটা সপ্তাহ কীভাবে যে কেটে গেছে আবরার-সামিয়া বুঝতেই পারেনি। ছোট্টখাটো খুনসুটি, মৃদু রাগ-অভিমান, সংসারের কাজকর্ম, একটু-আধটু রোমান্স সবমিলিয়ে ভালোই চলছে তাদের বাবুই পাখির সংসার।

আজ সকাল থেকেই আবরার কনফফারেন্স কল এটেন্ড করার জন্য লেপটপের সামনে বসে আছে। সামিয়ার চিকিৎসক মনোবিশেষজ্ঞ শামিম সাহেব, আবরার ও সায়রাজ সাহেব আজ আবার মিটিংয়ে বসবেন এই বিষয়ে।

“সামিয়া, এক কাপ চা দিয়ো তো।”

লোকটার ডাক শুনে সামিয়া বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। লোকটা এই নিয়ে সাত কাপ চা সাবাড় করেছে। এমনিতেই হাতে এত কাজ, কাপড় কাচতে হবে, রান্না করতে হবে, ঘর ঝাড়ু দিতে।

চা বানাতে বানাতে কোনো কাজই করা হচ্ছে না। রাগে যুবকের সামনে যেয়ে দু’হাত কোমড়ে রেখে দাঁড়ায় সে।

“জানেন কত কাজ পড়ে আছে ঘরে! তিন-চার দিন ধরে তো গোসল করে সুন্দর করে কাপড়গুলো রেখে আসেন, আন্ডারউইয়ারটা পর্যন্ত ধোন না। এগুলো কে করবে? ঘরের, রান্নাঘরের অবস্থা দেখসেন? এগুলো সাফ করতে হবে না?

সকাল থেকে চা দাও, চা দাও বলে সাতবার চা বানিয়েছেন। একবারে বলতে পারেন নাই বেশি করে বানাতে? আরেকটা বার যদি চায়ের নাম নিয়েছেন তো চায়ের বালতিতে ডুবিয়ে তো রাখবই সাথে আজকের খাবারও বন্ধ আপনার।”

শাসিয়ে এতগুলো কথা বলে হনহন করে রান্নাঘরে চলে যায় সে। যুবক তো স্ত্রীর রণচণ্ডী রূপ দেখে একদম বাক্যহারা হয়ে পড়েছে। এতদিন বন্ধুদের কাছে শুনত স্ত্রীর এই রূপের বিষয়ে, আর খুব গর্ব করে বলত,

“আমার বউ তো পুরোই মিষ্টি রসমালাই। কখনোই এভাবে বলতে পারে না। বরং, ও কথা বললে তো রস টপকায় কথায়।”

তখন বন্ধুদের মাঝে কারো উত্তর হত,

“অতি বাড় বাড়িস না, ঝরে পড়ে যাবি। মেয়ে যতই সুইট হোক নারী তো। নারীদের রাগে অগ্নিমূর্তি রূপের আগমন হলো বিন মৌসুম বৃষ্টির আগমনের মতোন, কখন হবে ঠিক নেই।

সেসব কথা চাপাবাজী করে উপেক্ষা করে যেত আবরার। অথচ আজ তারই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল নারীর এই রূপের। তবে এটাও এক খুশির খবর যে সামিয়া আজ পাক্কা গিন্নির রূপ নিয়ে এসেছে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনে তাকাতেই লজ্জায় মাথা নুয়ে গেল। সে কনফারেন্স কল রিসিভ করতেই সামিয়া খুনতি হাতে এসেছিল ।

লেপটপে শ্বশুর মশাই ও ডাক্তার সাহেব দুজনেই হাসছে। সায়রাজ কবির হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করলেও ডাক্তার শামিম হাসান নির্লজ্জের ন্যায় দাঁত কেলিয়ে হাসছে, ব্যাপারটায় অনেকটা রাগই লাগে আবরারের। মনে মনে বলল,

“এই শামিম নামের মানুষগুলোই একেকটা বেজাত! এক বেজাত, বাদর আমার বেস্টু, আরেক এই ডাক্তার বেটা। কিন্তু আঙ্কেল আবার কিছু মনে করবে না কি? ভাববে না কি যে তার আদরের কন্যাকে আমি খাটিয়ে খাটিয়ে মারছি?”

সায়রাজ কবির মেয়ের জামাইকে লজ্জা পেতে দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসেন। তারপর অতি বিনম্রতার সাথে বলে উঠেন,

“বাবা, তুমি মেয়েটার কথায় কিছু মনে করে না। হুট করেই একা হাতে সব সামলাচ্ছে তো…”

“না, না, আঙ্কেল এতে রাগের কী আছে? আমি কিছু মনে করিনি, আপনিও কিছু মনে করবেন না। আমি খুব তাড়াতাড়িই কাজের লোক রেখে দিব।”

“সেটা বাবা তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। তোমাদের দুজনের টোনাটুনির সংসার। কতই বা কাজ তোমরাই ভালো জানো, লাগলে নিবে, না লাগলে নেই। আমার বাড়িতে আমার রাজকন্যা তাই দায়ের বোঝা গায়ে লাগতে দেইনি, তোমার বাড়িতে তোমার রাণী তাই তোমাদের সংসার রাজ্যের দায় তো তারও অর্ধেক নিতে হবে।”

শামিম হাসান শ্বশুর আর মেয়ে জামাইয়ের ব্যক্তিগত আলাপ-আলোচনা শুনে একটু বিতৃষ্ণাই বোধ করেন। তাই কথায় বা’হাত ঢুকিয়ে শুধালেন,

“এই যে এসব প্যাঁচাল এখানে পারলে চলবে না। এখানে চিকিৎসার কথা হবে। তা আবরার না কী যেন নাম তোমার?”

“জী, আবরারই। ”

“শোনো আবরার সামিয়া কী ঔষধ রেগুলার নিচ্ছে? আর কোনো এবনর্মালিটি ফলো করেছো এর মাঝখানে?”

“না, ও একদম স্বাভাবিক।”

“গুড, আমার মনে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে ও কয়েকমাসের মাথায়ই একদম সুস্থ হয়ে যাব। আর আমারও ছুটি হয়ে যাবে।”

শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করেই তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন, যেন কত মজার জোকস্ বলেছেন। সাথে মুখে গুঁজে নিলেন গরম চায়ে ভেজানো পাউরুটি। বাকি দুজন বুঝলেন না এই হাসির মানে, তবুও সৌজন্যতা রক্ষার্থে মুখে চওড়া হাসি এঁটে রাখলেন।

আবরার আনমনেই ভাবছে,

“লোকটা আচ্ছা পেটুক তো। যখনই দেখি তখনই খাবার থাকে সাথে। উনি পাগলের ডাক্তার না নিজেই পাগল? একেই বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, পাগলে সাথে সাথে থাকতে নিজেও…”

তার ভাবাভাবির মাঝেই শামিম সাহেব ভাবুক কণ্ঠে বলেন,

“তবে একটা বিষয় বুঝলাম না সামিয়া বলে ও কাব্যকে ভালোবাসে, কাব্য ওর রুহুতে মিশে, এমন কী তোমাকেও তো তাই বলেছে। ও শুধু একাকিত্বের কষ্টে নয় এই কারণেও ঔষধ খেতে চাইত না।

ও ভাবত ঔষধ ওকে কাব্য থেকে দূরে রাখে। তাহলে ও তোমাকে বা এই বিয়েকে বা কাব্যকে ভুলাকে এত তাড়াতাড়ি এক্সেপ্ট করছে কীভাবে?”

প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার দূরে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক পুরুষটির কথাতেই আবরারের সারা গা কেঁপে উঠে। চোখে-মুখে কাজ করে সংকীর্ণতা, যেন তার মাঝে ভয় অজানা কিছু কথা বেরিয়ে আসার।

বিবর্ণ মুখ নিয়ে “কাজ আছে” বলে তাড়া দেখিয়ে কলটি ডিসকানেক্ট করে দেয়। তার মাঝে বিপুলভাবে ভয় কাজ করছে, প্রেয়সীকে হারানোর ভয়। এতটা ভয় বিয়ের আগে কোনোদিন কাজ করেনি সব জেনেও।

কোনো কিছু না পাওয়ার ভয় হতে অধিক গ্রাস করে পেয়েও হারানোর ভয়, বিশেষ করে বস্তুটি যদি প্রিয় হয়ে থাকে।

“না, না, আমার একাকিনীকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। আমি জানতে দিব না কাউকে। কিন্তু সত্য কতদিন চাপা থাকে?”

কথাগুলো বিড়বিড়াতেই গলা শুকিয়ে আসছে তার। এই তৃষ্ণার নিবারণ জীবনের জন্য অনিবার্য জলে সম্ভব নয়। একমাত্র দরকার ও উপায় হলো তার গোটা প্রেয়সী।

সে ছুটে যায় রান্নাঘরে। বেখায়ালে কোনোদিক না দেখেই প্রেমের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় যুবতীকে।

কী আশ্চর্য বিষয় না? স্ত্রীর দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাতেই, তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিতেই বুকের বামপাশটা হালকা হয়ে যায়, বোঝা লোপ পায়। এজন্যই হারাম সম্পর্কের চাইতে হালাল বিয়ে এত উত্তম।

সামিয়া দুপুরের জন্য ইলিশ মাছ ভাজছিল ঠিক তখনই আবরার এসে তাকে পিছন থেকে। অপ্রত্যাশিতভাবে এমন হওয়ায় প্রথমত সে ভয় পায়, তার উপর চমকে উঠায় তার হাত থেকে খুনতি তেলে পড়ে তেলের ছিটেফোঁটা লাগে ডানহাতে।

ব্যথায় “আহ” বোধক আর্তনাদ বেরিয়ে আসতেই আবরারের ধ্যান ভাঙে। তাড়াতাড়ি সামিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চিন্তিত হয়ে ও আর্তনাদ উৎস খোঁজার ব্যস্ততা নিয়ে বলে,

“কী হয়েছে ? কোথায় লেগেছে? সরি সোনা, আমার জন্য লেগে গেল। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।”

সামিয়া আবরারের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাছ নামিয়ে নিতে নিতে বলল,

“আরে বাবা, ছাড়ুন তো। এমন করেন না যেন আমার কত কিছু হয়ে গেছে। তেমন কিছুই না তেলের ছিঁটে পড়েছে হাতে, রান্নাবান্না করলে এমন এট্টু পড়েই।”

“কী! তেলের ছিঁটে! ইশ! দেখি, দেখি, কোথায় লেগেছে? বার্নল ক্রিম দেই চলো।”

বলেই সামিয়ার হাত থেকে মাছ ভর্তি প্লেটটা সিঙ্কে রেখে তাকে টেনে এনে ডাইনিং টেবিলে বসায়। তারপর জুতার শেলফ্ থেকে ফার্স্ট এইড কিট নামিয়ে ঠিক চেয়ারের সামনে ফ্লোরে বসে বার্নল লাগিয়ে দেয়।

সামিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে,

“বদ্ধ উন্মাদ একটা! হুহ্!”

আবরারও মুচকি হেসে জবাব দেয়,

“শুধু আপনার জন্য জনাবা। আমার সকল উন্মাদনা, পাগলামি, দুষ্টুমি, রাগ, অভিমান, ভয়, বেদনা, চিন্তা, হাসি, সুখ, এমন কী গোটা আমিটাকেই আপনার চরণে উপহার দিলাম। আমার এই উপহার গ্রহণ করে আমায় বাধিত করবেন না গো?”

সামিয়া উত্তর দেয় না। শুধুই চোখে চোখ রেখে লজ্জা মাখা এক হাসি দেয়। তা-ই হয়তো তাদের প্রেমের ভাষায় ‘হ্যাঁ’। যার মানে শুধু আবরার ধরতে পারে।

যুবতী লজ্জা কাটিয়ে কাজ করার জন্য উঠতে যাবে। তবে আবরার সেভাবে বসে থাকার কারণে পারে না।

আবরার বাঁকা হেসে বলে,

“আজ এত তাড়াতাড়ি ছাড়া দেওয়া যাবে না আপনাকে জনাবা। আজ শ্বশুর সাহেব আর ডাক্তার সাহেবের সামনে কী লজ্জাটাই না দিলেন আমায়! তারা ভিডিও কলে এসব শুনে ভাববে কি না এমন দামড়া ছেলে বউয়ের মুখের গাল শুনে, আবার ভাববে কামচোর! কী লজ্জাজনক কথা!”

সামিয়া জিভ কাটে। মুখটা ফ্যাকাসে করা অকপটে প্রশ্ন করে ফেলে,

“তখন বাবা আর আঙ্কেল কলে ছিল? ইশ! তারা কী ভাববে এখন! আপনি আগে বলবেন না, ইডিয়ট কোথাকার!”

আবার জিভ কাটে যুবতী। দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে তাকায় আবরারের দিকে। লোকটাকে কি না আবার সে গাল-মন্দ করে ফেলল!

“বাহ্! বেশ ভালোই তো সাহস হয়েছে আপনার জনাবা। উহু, একদম ছাড় দেওয়া যায় না আপনাকে। তা কী যেন বলছিলেন আপনি? আমি কাজে হেল্প করি না, কাপড় রেখে আসি বাথরুমে, আর ঘরের অবস্থা দেখি না, সব তোমার একা করতে হয়।

তা কাপড় কী আমি রেখে আসি না আপনি আমাকে বলেছেন রেখে আসতে? আর আমি হেল্প করতে গেলে কে আটকায় এই বলে যে ‘আপনি পারবেন না’ , ‘আমার ঝামেলা বাড়ায়েন না’…. ব্লাহ! ব্লাহ ! ”

“সরি তো।”

“এসব বললে তো চলবে না। জরিমানা হয়েছে আপনার অপকর্মের, জরিমানা দিতে হবে আমায়, জরিমানা।”

“জরিমানা?”

কনফিউজ মুখখানা বিড়বিড়িয়ে উঠে যুবতী, পরের ক্ষণেই চোখজোড়া বড় বড় করে ফেলে। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে,

“আমার কাছে তো টাকা নেই জরিমানা দিব কোথ থেকে?”

“ওরে বাংলার কন্যা, উর্বশীর মতোন সৌন্দর্যের অধিকারী হয়ে, গোলাপজামের মতোন অধর জোড়া নিয়ে চিন্তা করো কি না কী করে শোধাবে আমায় জরিমানা? খুব বেশি না এই অধরজোড়ার ছোঁয়া টুকু আমায় দিয়ে দাও তাতেই জরিমানা শোধ গেল।”

“মোটেও না।”

ভেঙচি কাটে যুবতী।

“ভেঙাও, ভেঙাও, যখন দেখবে মুখ আর সোজা হচ্ছে না তখন বুঝবে। সবাই বলবে ওরে বেঁকি! যাকগে না দিলে নাই। তুমিও বসে থাকো, আমিও বসে থাকি, ডুবে যাই দুজন দুজনাতে।”

আকস্মাৎ সামিয়ার মাথায় আসে দুর্দান্ত এক দুষ্টু পরিকল্পনা। সে ঠোঁট চেপে হেসে বলে,

“ঠিক আছে, বালক। দিলাম তোমায় জরিমানা। তবে তার জন্য যে তোমায় করতে হবে আঁখি জোড়া বন্ধ।”

প্রিয় খেলনা পেলে ছোট্ট শিশু যেমন খুশি হয় তেমনই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা নিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে আবরার। সামিয়া চট করে এক ধাক্কা দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দৌড় দেয় রান্নাঘরের দিকে।

আবরার থতমত খেয়ে যায়। তারপর উঠে পিছু নিতে গেলে স্ত্রী রাগী সুরে তাকে বলে,

“ভুলেও আমার পিছনে আসবেন না। অনেক কাজ পড়ে আছে। বলেন না আমি না করেছি তাহলে আজ ছুটি নিয়ে বাসায় আছেন যেহেতু কাজ করেন। পারলে ঘরটা ঝাড়ু দিন।”

সামিয়ার রাগী গলা শুনে আবরার আর দুষ্টুমি এগুনোর সাহস পেল না। মুখ বেজার করে কাজে লেগে পড়ল।

রাতের বেলা, খাবার খেয়ে নিজের প্লেট ধুয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে আবরার। সামিয়া সব গুছগাছ করে বেডরুমে এসেই বাথরুমে ঢুকল ফ্রেশ হত। ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে টুলে বসে চুল আচরাতে আচরাতে গান ধরে।।

“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালোবেসে।
…”

আবরার ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে মিটমিটিয়ে হাসছে গান শুনে। একটু অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় সে প্রশ্ন করল,

“বাব্বাহ! এত ভালোবাসা আমায়?”

সামিয়া মুচকি হাসে। তারপর হুট করেই তার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করে,

“আচ্ছা, আপনি যে আমার এত রূপের তারিফ করেন? কিন্তু আমার রূপে তো এমন অসাধরণ কিছু নেই। আমি পাই না। তাহলে সব কি বৃথা আর মিথ্যা?”

আবরার বিছানা ছেড়ে উঠে তার পিছনে দাঁড়ায়। তাকে আয়নার দিকে ঘুরিয়ে বলে,

“সৌন্দর্য? তার সঠিক ব্যাখ্যা আমি জানি না? তুমি জানো বিশ্বের একেক দেশে সৌন্দর্যের প্যারামিটার একেক রকম। চায়নার এক জায়গায় মেয়েদের পায়ের বিকৃত রূপকে সুন্দর মনে করা হয়, সাউথ কোরিয়াতে ছেলেদের মেকআপ করাটাও সৌন্দর্যের অংশ, আমাদের দেশে ফ্রেকেলস্ বেশির ভাগ মানুষের কাছেই একটা ত্রুটি, অথচ বহির্বিশ্বে অনেক মানুষ তা চায়।

তুমি জানো ইরানি এক রাজকুমারী, যাকে কিনা সবচেয়ে সুন্দরী বলা হত তখনকার ইরানে, যার জন্য বহুজান প্রাণত্যাগও করেছে, সে ছিল অনেকটাই পুরুষালি, স্বাস্থ্যবান এক নারী। তবুও সেসময়ে ইরানে সেটাই নারীর সৌন্দর্য মনে করা হত।

আসলে প্রেয়সী আমি জানি না তুমি বিশ্বের সকল বিউটি স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সুন্দরী কি না বা সত্যিকার অর্থে তুমি সুন্দরী কি না। আমি জানি আমার নিকট তুমি এক অপরূপা সুন্দরী রমণী।

কারো ডাগর ডাগর চোখে আমি মায়াজাল দেখিনি, না ডুবতে পেরেছি। কিন্তু তোমার এই ছোট ছোট চোখজোড়ার গভীরত্ব টের পেয়েছি, বারবার ডুবেও এর গভীরত্ব মাপতে পারিনি। আর তাতে যখন ঐ একরাশ নীল কাজল লেপ্টে দাও না, তখন মনে হয় আমি ঘায়েল এই চোখে ঘায়েল। চোখে চোখ রাখতে পারি না ডুবে যাওয়ার ভয়ে। অতএব, আমি এই চোখজোড়ার মায়াজালে বন্দিনী।

কারো তীক্ষ্ণ নাক ছুঁয়ে দেইনি, ছুঁতে মন চায়নি। যদিও প্রেমের সম্পর্ক ছিল আগে। অথচ, প্রতিদিন ফজরের ওয়াক্তে তোমায় জাগানোর আগে তোমার বোচা নাকের ডগায় ঠোঁট ছুঁয়াই নাহলে আমার সকাল হয় না।

আর তোমার গোলাপজাম অধরজোড়া, তুলোর মতোন কপোল, ললাটের বিষয়ে কী বলব। তুমি জানোই আমি কতটা উন্মাদ তোমার জন্য এবং তোমাতে।

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, আল্লাহর চমৎকার সৃষ্টি। সে অনুযায়ী তুমি এবং প্রতিটি মানব সুন্দর। নিজেকে বা অন্য কোনো মানুষকে অসুন্দর মনে করা আল্লাহর সৃষ্টির অপমান, যার পাপ সবচেয়ে বড়। এই পাপ কোরো না প্রিয়।”

বলেই পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখে গালে আলতো পরশ দেয় সে। সামিয়া গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ভাবে,

“এমন পুরুষ বুঝি আমার পাওয়ার ছিল একান্তই আমার করে? এভাবে বুঝি সবাই ভালোবাসতে পারে? না, এভাবে শুধুই আবরার ভালোবাসতে পারে তার প্রিয় একাকিনীকে৷ আবরারের একাকিনী, একাকিনীর প্রিয় অসুখ তুমি।”

___

আলিফা খাতুনের পাশে বসে আছেন সায়রাজ কবির। স্যালাইন চলছে। দুদিন ধরে নাওয়া-খাওয়া বন্ধ রেখেছে এই নারী যার দরুণ এই দশা। তার এক কথা সামিয়া কোথায় আর কেমন আছে না জানা অবধি তিনি একটা দানাও মুখে তুলবে না।

“আলিফা, তোমার বয়স পঞ্চাশের বেশি, বিশের কম নয় যে এমন বাচ্চামি করছো? চুপচাপ খাবার টুকু খাও। ডাক্তার ঔষধ দিয়ে গেছে তো।”

“আমার মেয়ে কোথায় না কোথায় খেয়ে না খেয়ে পড়ে আছে, আর আমি কি না বসে খাবার ঠুসব? আগে আমার মেয়ের খবর দেও আমায়।”

সায়রাজ কবির ছোট্ট এক শ্বাস ফেললেন স্ত্রীর জেদ দেখে তারপর বললেন,

“আরে বাবা, ভালো আছে তোমার মেয়ে। আজ সকালেই আবরার আর সামিয়ার সাথে কথা হয়েছে।”

“তুমি কি পাষাণ সামিয়ার আব্বু? আজ এতগুলো দিন মেয়েটা মায়ের চোখের সামনে নেই। তারপরও তুমি একা কথা বললে আমায় দিলে না?”

“চোখের সামনে থাকতেই কী করে ফেলেছিলে? মেয়েটা তো অসুস্থই ছিল। আর আমি তোমার মতোন রং-তামাশা করতে কল দেইনি, আজ ডাক্তারের সাথে মিটিং ছিল তাই কনফারেন্স কল দিয়েছিলাম।”

বেশ তাচ্ছিল্যের সুরেই স্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে বলেন তিনি। আলিফা খাতুন শুনেও অন্যদিকে তাকিয়ে না শুনার ভান করে আবদার করেন,

“এখন একটা কল দাও না। একটু দেখি মেয়েটাকে।”

সায়রাজ কবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বারোটা বাজে।

“কাল দেই, আজ রাত হয়ে গেছে।”

“আজই দাও না গো, মনটা কেমন যেন করছে ওর জন্য। আমার একটাই তো মেয়ে।”

বেশ করুণ গলায় বলেন আলিফা খাতুন। সায়রাজ কবির আর জীবনসঙ্গীর এই করুণ গলা উপেক্ষা করতে পারে না। কল লাগায় আবরারকে।

আবরার আর সামিয়া তখন বিছানায় সদ্য গা এলিয়েছে। ইমোর কল রিংটোন শুনতেই আবরার ভ্রু কুঁচকায় এত রাতে ইমোতে কে কল দিল ভেবে। হাতে নিয়ে দেখে সায়রাজ কবির। এত রাতে শ্বশুর মশাইয়ের ভিডিও কল দেখে অবাক হলেও পরে বিপদ-আপদ হল কি না চিন্তা করে দ্রুত কল রিসিভ করে।

“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। একটু সামিয়াকে দাও তো বাবা তোমার আন্টি কথা বলবে।”

সামিয়া পাশে থাকায় সবই শুনতে পায়। সামিয়ার সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলিফা খাতুনের কথা হয়। পুরোটা সময়ই সামিয়া উদাসীন ছিল। আলিফা খাতুনই নিজ উদ্যোগে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন, সামিয়া শুধু হু-হা করছিল।

কথাবার্তা শেষে বিছানায় গা ছেড়ে দিয়ে সামিয়া ভাবে,

“মা তো সবার বিশ্বাস কেন্দ্র হয়? সবার বিশ্বাস থাকে যত কিছুই হোক মা তাকে বুঝবে। তবে আমার মা কেন এমন হল না?”

তার চোখজোড়া বেয়ে একফোঁটা অবাদ্ধ জল গড়িয়ে পড়ে। তখনই আবরারের শক্ত হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে তাকে। এই হাত বহু বিশ্বস্ত তার কাছে। অনায়াসে প্রিয় এক সুখে ঘুমে তলিয়ে যায় সে।

___

দেখতে দেখতে এই জীর্ণ ঘরেই সাধারণ এক থ্রিপিস পরে নিশার বিয়েটা সম্পাদন হয়। নিশা কোনোদিনও ভাবেবি তার বিয়ে এমন ভাবে হবে। বিনা কোনো উৎসবে, বিনা কোনো সাজে, বিনা কোনো কলরবে বিয়ে হলো তার।

আজ সকাল বেলাই অহন এসে বাঁকা হেসে তাকে জিজ্ঞেস করল ,

“কেমন লাগল এই গরীবের ঘর-বাড়ি? এই জীর্ণ ঘর, এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাও?”

নিশা কথাগুলোর মাঝে তীব্র তাচ্ছিল্যের আভাষ পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। অহন পুনরায় গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল,

“শোনা জান আমি তোমার মতো ন্যাকামি করতে পারি না। সোজাসাপ্টা বলছি সোজাসাপ্টা এক মিনিটের মাঝে ভেবে-চিন্তে উত্তর দিবে। যদি মুক্তি চাও তবে আমাকে বিয়ে করতে হবে, এখন এই মুহূর্তেই। ইউর টাইম স্টার্টস্ নাউ টু থিংক।”

মুক্তির নাম শুনতে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে যুবতীর চোখেমুখে। সে কিছু না ভেবেই বলে উঠে,

“আমি রাজি।”

তারপরই এই বিয়ে। নিশা জানে না সে কি শুধু মুক্তির জন্যই এই বিয়েটা করল না কি কোথাও একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল অহনের জীবনসঙ্গী হওয়ার।

বিয়ে শেষে কাজি ও সাক্ষীরা বিদায় হলে অহন নিশার হাত আঁকড়ে ধরে সেই পরিচিত পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,

“চলো, তোমার সংসারে যাবে না? তোমার আলিশান স্বামীর ভিটে পড়ে আছে, তাতে রাজরানি হয়ে থাকতে হবে তো, চলো!”

বলেই টানতে টানতে নিশাকে বের করে আনে সেই ঘর থেকে বাইরে বের হতে নিশা আরও অবাক। এই বাড়ির আশপাশ বড় বড় গাছে ঘেরাউ করা, তারপর অনেক উঁচু দেওয়াল, প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান। সেই দেওয়ালের মাঝে ছোট্ট একটা গেট।

অহন নিশাকে নিয়ে বের হলে সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বিএমডব্লিউ গাড়িটিতে তাকে নিয়ে পিছনের সিটে বসে পড়ে। নিশা বুঝতে পারছে না এত দামী গাড়ি অহনের কাছ থেকে আসলো কোথা থেকে, আবার জিজ্ঞেসও করতে পারছে না দ্বিধায়।

তারপরও জড়তা কাটিয়ে নেয় সে।

“তোমার কাছে এত দামী গাড়ি আসলো কোথা থেকে?”

বিপরীতে অহন শুধুই বাঁকা হাসে। গাড়ি নিজ গন্তব্যে যেয়ে থামতেই অহন নেমে পড়ে। তারপর নিশার পাশের দরজাটা খুলে বাঁকা হেসে বলে,

“ওয়েলকাম টু ইউর হাজব্যান্ড’স প্যারাডাইস। বাট ফর ইউ ইট ইজ গোয়িং টু বি লাইক হেল!”

নিশা পা নামিয়ে সামনে তাকাতেই হতবাক। সম্পূর্ণ সাদা এক দুই তলা বাড়ি, রাজকীয় বাংলোর মতোন ডিজাইনের ডুপ্লেক্স বাসা। তারা বর্তমানে ডুপ্লেক্সের বাগানে মাঝে রাখা গাড়ি ঢোকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

চট করেই সে প্রশ্ন করে ফেলে,

“সত্যি করে বলো তো এসব কী হচ্ছে? এত বড়লোকের বাড়ি, গাড়ি তোমার কাছে কোথা থেকে আসলো?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here