প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:১৫+১৬

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
যুবকের নিজের সাথে হওয়া দ্বিধা-দ্বন্দের মাঝেই হাসপাতাল থেকে কল আসে যাওয়ার জন্য। “আসছি” বলে কলটা কেটে ক্ষুণ্ণ হয়ে মনে মনে আওড়ায়,

“আজকের দিনটাই খারাপ! নাহলে সবগুলো বাজে সিচুয়েশনে কী আর আজকেই পড়তে হত! এতটা প্রথমবার এত ক্রিটিকাল একটা সার্জারিতে থাকব, তার উপর আবার সামিয়াকে অজান্তেই হার্ট করলাম।”

এর মধ্যেই দেওয়াল ঘড়িটা ঢংঢং করে বেজে উঠে। আবরার প্রচণ্ড বিরক্ত হয়।

“উফঃ! একটু আফসোস করারও সময় নেই হাসপাতালে যেতে হবে।”

বলতে বলতেই নিজের বস্ত্র নিয়ে বাথরুমে ঢুকে সে। সামিয়া ঘরে এসে দেখে আবরার ঘরে নেই, ক্লান্তিতে কিংবা আগ্রহের অভাবে সেদিকে ধ্যান দেয় না যুবতী। চুপচাপ বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় সে।

আবরার শোয়ার ঘরে সামিয়ার আগমনের শব্দ পেয়ে যত দ্রুত সম্ভব কাপড় বদলিয়ে বের হয় কথা বলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাতে কী? সামিয়া তো গভীর ঘুমে ডুবে। গোমড়া মুখ নিয়েই হাসপাতালে প্রস্থান করে সে।

___

একটা দিন কেটে গেছে নিশার এই জীর্ণ বাড়িতে। যুবতী এখনো ঘোরে আছে, সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এটাই তার জীবন। সকালের আলো ফুটতেই সে পালানোর জন্য উঠে পড়ে লাগে।

পুরো ঘরে একটা মাত্র থাই গ্লাস দিয়ে আটকানো জানালা, খুব টানাটানি করেও খুলতে পারে না তা। আর আছে ভেন্টিলেটর, কিন্তু অতিমাত্রায় কিছু একটা মনে পড়তেই দৌড়ে রান্নাঘরে যেয়ে কাঠের ডাল ঘুটনি, বঁটি নিয়ে আসে। তা দিয়ে বেশ কয়েকবার নিজের সর্বশক্তি দিয়ে বারি মারে। খুব আনন্দিত সে।

“আর একটু অপেক্ষা, তারপরই মুক্ত হয়ে যাব। ”

কিন্তু তাকে অবাক করে একটা আঁচড়ও পড়ে না জানালার কাচে। তার বিস্মিত চোখজোড়ায় অশ্রুও স্পষ্ট, সাথে কিছুটা রাগও মিশ্রিত আছে৷

মনিটরে তার মুখশ্রীর এমতাবস্থা দেখে বিস্তৃত হাসি ফুটে উঠে অহনের চেহারায়। সেই চেনা শয়তানি হাসি।

বিড়বিড় করে বলে,

“এতই সহজ ভেবেছো অহনের হাত থেকে বাঁচা? আমি ভাবছি এই জানালা ভেঙে বের হলে বাহিরের অবস্থা দেখলে তোমার কী হাল হবে। গেম ইজ অন জান।”

মলয় আগমন হয়। তাকে অহন পাঠিয়েছিল নিশার বিষয়ে ভালো ভাবে খোঁজ-খবর নিতে। কারণ নিশার কথাগুলোতে সে মিথ্যা ও প্রতারণার ছোঁয়া পাচ্ছে; এই সন্দেহ থেকেই মলয়কে পাঠানো।

“দাদা, খবর নিয়া আয়া পড়সি।”

অহন দুই হাত মুঠোবন্দী করে চোখ বন্ধ করে বলে,

“বলতে থাক। শুনছি আমি।”

“দাদা, বৌদি তো আলিফা খাতুন আর সায়রাজ কবিরের আপন মাইয়া না। সায়রাজ কবিরের কোন দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে যানি। সৎ মায় বাইততে বাইর কইরা দেওয়ার পর সায়রাজ কবির না কি কাজের মাইয়া লাগব কইয়া আনসে। কিন্তু পরে না কি নিজের মাইয়ার মতোই রাখসে লোক মুখে শুনলাম। তয় এয়াও কারো কারো থেকা শুনলাম পরের মাইয়া কী আর আপন হয়…”

অহনের মস্তিষ্কে এখন সবকিছুই ধীরেধীরে স্বচ্ছজল। নিশা তাকে দিনের পর দিন মিথ্যে বলে গেছে তার অবস্থান, পরিচয় ও অস্তিত্ব নিয়ে। তার মন প্রশ্ন করে উঠে তার নিকট,

“কিন্তু কেন? এত মিথ্যে বলার কারণ কী?”

___

রাত প্রায় নয়টা, সামিয়া আনমনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ফ্লাটটা নিচ তলায় হওয়ায় বেশ মনকাড়া দৃশ্যই দেখা যায় দিবরাত্রি। বারান্দার ঠিক সম্মুখে ঘাসভূমি উঠান এবং বাড়ির গা ঘেঁষে বাড়তে থেকে কৃষ্ণচূড়া যেন পদে পদে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদনি রাত্রির। যদিও এই চাঁদনিতে গা ভাসানোর মন-মানসিকতা তার নেই, তবুও অভাবনীয় সব ভাবনায় ডুবে সে, হয়তো ইচ্ছেকৃত ভাবেই কিছু অনুভূতি থেকে লুকানোর প্রত্যাশায়।

তার ভাবনার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠে। শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে সদর দরজার কী-হোলে চোখ রাখে। তার রুহ কেঁপে উঠে সদর দরজায় দাঁড়ানো মানুষটির বিধ্বস্ত রূপ দেখে।

তাড়াহুড়ো করে দরজা খুলে প্রথমেই চিন্তিত হওয়ার সুরে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,

“কী হয়েছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেন? কোথাও লেগেছে না কি?”

আবরারের এপ্রোন ধরে তার শরীরের এদিক-ওদিক আঘাতের চিহ্ন খুঁজায় ব্যস্ত সে। মলিন চেহারা, রক্তিম চোখেজোড়া জলে টইটুম্বুর এবং এলোমেলো চুল ও পোশাকে দাঁড়ানো আবরার। সে নিঃশ্চুপ, যেন মৌনব্রত রেখেছে।

পাশেই শামীম বন্ধুর স্ত্রীর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চেহারা দেখে প্রথমে একটু ভাবনায় পড়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়।

“ভাবী, আবরার ঠিক আছে। ভিতরে যেয়ে কথা বলি, চলেন।”

সামিয়ার এবার খেয়াল হল এখানে আবরার ও তাকে ছাড়াও আরেকজন আছে। আজ দ্বিতীয় বার তার শামীমের দেখা তাও এমনভাবে, কিছুটা দ্বিধান্বিত হয় সে। তারপর শান্ত গলায় শুধালো,

“হুম, আসেন ভাইয়া।”

তিনজনেই ঘরের ভিতরে ঢুকে। শামিম আবরারকে নিয়ে সোফায় বসতেই সামিয়া হাড়তাড় করে যেয়ে এক গ্লাস ভর্তি ঠাণ্ডা জল নিয়ে এসে স্বামীর সম্মুখে ধরে। আবরারও কিছু না বলে পান করে নেয়।

তারপর যুবতীর চিন্তিত মুখ খানার দিকে আবেগপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকায়।

“তুমি আমার জন্য চিন্তা কোরো না, আ’ম ওকে। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।”

এই দুটো বাক্য বলেই সে বসার ঘর থেকে প্রস্থান করে। সামিয়া কিছু বুঝতে পারছে না যে হঠাৎ করেই কী হল। সে শামিমের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করে,

“ভাইয়া, আসলে… আমি জানতে চাচ্ছি যে উনার কী…?”

“আমি জানি তুমি কী জানতে চাও। আসলে আজকে যে পেশেন্টের সার্জারি হয়েছিল তার এখনো হুশ আসে নাই। এসব কারণেই হয়তো ও… ছেলেটা কী ভালো মুডেই না ছিল আজ দুপুরে। বলছিল তুমি না কি গরুর মাংস রান্না করেছে, ওর তো অনেক পছন্দের সেটাই আজ রাতে খাবে। আচ্ছা, ওকে একটু সামলে নিয়ো। আমি যাচ্ছি।”

শামিম ম্লান গলায় কথাগুলো বের হতেই সামিয়া দরজা লাগিয়ে দিল। যুবতী ভাবনায় ডুবে থাকা মুখশ্রী এখন স্বামীর কষ্টের তাপে পুড়ছে। আহা! সে কী এক অদ্ভুৎ অনুভূতি! প্রিয় মানুষের কষ্টে নিজে নিমজ্জিত হওয়ার অনুভূতি! এই প্রথম এই অনুভূতি অনুভব করছে সামিয়া।

বেডরুমে উঁকি দিতেই দেখে আবরার ফ্রেশ হতে চলে গেছে। সেও আঁচল কোমড়ে বেধে আবরারের খাবার গুছাতে রান্নাঘরে এসে পড়ে। তরকারির পাতিল সরাতেই নিজের উপরই রাগ হয় তার।

“ইশ! সামিয়া তোরে কে বলসিল রেগে সব খাবার দিয়ে দিতে। এখন যেটুকু আছে, তুই খাবি কী আর উনি খাবে কী! মুখপোড়া একটা!”

নিজেকে বকতে বকতেই আবরারের জন্যই সব তরকারি প্লেটে রাখে সে। এও এক নব কর্ম, অনুভূতি ও প্রশান্তি তার। প্রিয় মানুষের জন্য ত্যাগ করার প্রশান্তি।

আবরার ড্রেসিংটেবিলের সামনে উন্মুক্ত বক্ষে চুল মুছতে মুছতে আপন মনে গুনগুন করছে গান। কারো আগমনের আভাষ পেতেই আবার মন খারাপ করে ম্লান মুখে আলতো ভাবে চুল মুছতে মুছতে বিছানায় বসে সে।

সামিয়া খাবারের প্লেট বিছানায় রেখে আবেদন করল,

“খাবার খেয়ে নিন নাহলে শরীর খারাপ করবে। আর জীবনের মালিক, রিজিকের মালিক আল্লাহ। আপনি চেষ্টা করেছেন, বাকি টুকু আল্লাহর হাতে।”

যুবক চোখ-মুখ আঁধার করে আফসোসের সাথে জবাব দেয়,

“না থাক, খাব না। খেতে ভালো লাগছে না। আজ আপন কেউ নেই বলে… দাদী থাকলে আজ খায়িয়ে দিত।”

কথাটা শুনে সামিয়ার মন আরও ভার হয়ে যায়। হাত ধুয়ে নিজেই খায়িয়ে মুখের সামনে নলা ধরে। আবরার সোনামুখ করে অনায়াসে খেয়ে নেয়। সেও সামিয়ার মুখে একগ্রাস খাবার তুলে দিতেই যুবতী অবাক চোখে তাকায়। সে গম্ভীর গলায় বলে,

“আমার হাতে খেলে তেমন ক্ষতি হবে না হয়তো।”

সামিয়া প্লেট রাখতে গেলে আবরারের ফোনে কল আসে। স্ক্রিনে শামিমের নাম ভেসে উঠে। সে হাসি হাসি মুখে কলটা রিসিভ করে বারান্দায় চলে যায়।

উৎফুল্লিত হয়ে বলল,

“আরে বন্ধু, তুই তো আসলেই লাভ গুরু রে! তোর আইডিয়া একদম কাজ করেছে।”

শামিমও খুশি মনে উত্তর দেয়,

“আমি বলেছিলাম না মেয়েরা স্বামীর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। দেখ, তোরে কষ্টে দেখে ভাবী আসলেই রাগ ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু খবরদার এই সিধাসাধা মেয়েটাকে আর কষ্ট দিবি না। আর হ্যাঁ আমার বোনের তরফ থেকে আমি আবার…”

“আরে কী যে বলিস না! ও ছোট মানুষ বুঝেনি… কিন্তু তোর ভাবীকে আজ যা ফাঁসালাম। মেয়েটা আসলেই অনেক ভালো মনের রে। কত্ত কেয়ার করে আমার জন্য।”

এমন নানা ধরনের কথোপকথন হতে থাকে তাদের মাঝে। বলা বাহুল্য, আবরার এতক্ষণ মন খারাপের ভং ধরে ছিল, বাস্তবতায় তেমন কিছুই হয়নি। সেই রোগী এখনো পুরোপুরি সুস্থ নাহলেও বিপদের বাহিরে। মূলত হাসপাতালে আবরার শামিমকে সব কিছু খুলে বলতেই সে এই কূটনৈতিক বুদ্ধি দেয়।

কথা বলার মাঝেই আবরার ব্যালকনির দরজার দিকে চোখ দিতেই হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। তার মন-মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে শুরু করে এই অগ্নিমূর্তি নারীটির থেকে সে কী করে বাঁচবে।

সামিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাছে যেয়ে টিশার্টের কলার দুই হাতে খামচে ধরে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,

“ফাজলামি করেন, হ্যাঁ? আপনি জানেন আমি কতটা টেন্স হয়ে গিয়েছিলাম! না তা জানবেন কী করে আপনি তো আমাকে ফাঁসানোর আনন্দে মেতে।”

সে তো আরও বলতেই আছে।

আবরার কী করবে ভেবে পাচ্ছে না, মনে হচ্ছে তার প্রেয়সী গোলাপজাম অধরজোড়া দিয়ে সর্পের মতোন বিষ ছাড়ছে। হুট করেই সে এক অচিন্তনীয় কাজ করে ফেলে। শুষে নিতে শুরু করে প্রেয়সীর অধরের সকল বিষ।

কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যেতেই হুশ আসে তার। সঙ্গে সঙ্গে প্রেয়সীর থেকে কিছুটা দূরত্বে সরে কানে ঝুঁকে বলে,

“কী করতাম আমি তুমি বল? তোমায় রেগে দেখা যে বড্ড মুশকিল। আমার ভুল হয়েছে আমি জানি, এবার ক্ষমা দেও এই অধমকে। আসলে হাসপাতাল থেকে দুপুরে চিন্তিত হয়ে এসে মাথা কাজ করছিল না। ভেবেছি তুমি হয়তো রাঁধোনি তাই…”

সামিয়ার শক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় সে। যদিও তার এখন লজ্জা পাওয়ার কথা, কিন্তু আবরার সকালের কথা তুলায় আগের রাগ ও ক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

“আমি যদি না-ই রাঁধতাম, তো আপনাকে টেবিলে খেতে বসাতাম কেন? আসলে আপনি ঐ মেয়েটার মতোই মানেন যে আমি কোনো কাজেরই না। না আছে রূপ, না গুন। রাঁধতেও পারি না।”

“মোটেও না। আ’ম সরি তোমাকে এত বাজে বোধ করানোর জন্য। আসলে আমি চিন্তায় এত কিছুতে খেয়াল দেইনি। আর আমি মেয়েটাকে কিছু বলিনি কারণ ও শামিমের বোন। যার বাসায় থাকছি তার বোনকে কী করে…

সেসব নাহয় বাদ দিলাম, তোমার প্রতিবাদ আমি কেন করব? তুমি কেন চোখে আঙুল দিয়ে তাকে তার ভুল ধারণা ধরিয়ে দেওনি? আমি চাই তুমি আত্মনির্ভরশীল, আত্মবিশ্বাসী হও। আমি তোমার সঙ্গী হতে চাই, নির্ভর করার মানুষ নই।”

সামিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। লোকটা কী সত্যিই তাকে নিয়ে এত ভাবে! সত্যিই তাকে ভালোবাসে! সবকিছুই কেন যেন তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। হয়তো পিছনে দায়ী কোনো অতীত

এর মধ্যেই আবরার তাড়া দিয়ে বলে,

“আচ্ছা, চলো, চলো। ঘুমাতে হবে তাড়াতাড়ি, কাল আবার অফিস আছে। শোনো ব্রেকফাস্টে আমি মুরগি ভুনা আর পরোটা খাব। তুমি পরোটা করে রেখো, পরোটা বাহির থেকে…”

“আমি পারব।”

“না, না, হাত ব্যথা করবে বেললে। কাল আমি আসার সময় রুটি বানানোর মেশিন নিয়ে আসব নে, আমার হাসপাতালের পাশেই দোকান। কিন্তু কাল বাহির থেকেই খাব।”

“ঠিক আছে। চলো তাহলে।”

দুজনেই চলে গেল ঘুমাতে। কিন্তু ঘুমাতে গেলেই বাধল আরেক বিপত্তি। নীরব পরিবেশ, শেয়াল ও নানা পোকার ডাক স্পষ্ট। গতকাল ক্লান্তিতে অতিদ্রুত ঘুমিয়ে গেলেও আজ ভীতু আবরারের ঘুম তো আসছেই না, বরং ভয় লাগছে। ভয়ে সে সামিয়াকে ঝাপটে ধরে, এত জোরেই যে শ্বাসরোধ হওয়ার দশা।

সামিয়া হুড়মুড়িয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসে বিরক্তির ও অবাক সুরে বলে,

“কী হয়েছে? মেরে ফেলবেন না কি শ্বাস বন্ধ করে?”

“আমার না… আসলে আমার ভয় লাগছে, আর ঘুম আসছে না।”

আবরারের আমতা আমতা উত্তর শুনে সামিয়া হেসে দেয়। এত দামড়া ছেলে বলে কি না ভয় পায়। তারপর হাসে থামিয়ে বলল,

“আচ্ছা, আমি তো আছি। ভয় কীসের?”

“এত কথা বুঝি না, আমার ভয় লাগছে, তাই আমি এভাবেই ঘুমাব। নাহলে কিন্তু আজ আমিও ঘুমাবোই না, তোমাকেও দিব না।”

সামিয়ার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে, এতটাই যে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। অতঃপর আবরার নিজের ইচ্ছে মতোনই ঘুমাল তাকে আঁকড়ে ধরে।

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১৬তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিশার আরেকটা সকাল শেষ হল এই বন্দীঘরে। বর্তমানে এই বন্দীত্বের উপর নয় রাগ জমছে তার অন্যকিছুর উপর। এই গরমে এতটা সময় সে একই পোশাকে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে তার। তার উপর তার নারীত্বের বিশেষ দিনগুলোর সময়কালও নিকটবর্তী।

সিচুয়েশনের উপর নোংরা এক গালি ছুঁড়ে অহনকে উদ্দেশ্য করে বেশ চেঁচিয়েই বলে,

“শালা, কিডন্যাপ যখন করসোস সব তো ঠিকঠাক করেই করবি, তাই না? না কিনে আনসোস কোনো জামা-কাপড় থাকার জন্য, না কোনো আন্ডারগার্মেন্টস্, না পিরিয়ড কিট! শালার মাথা মোটা একটা কপালে পড়সে।”

অহন অদূরে বসে হেডফোনে এসব শুনে রাগে ফুঁসছে। অথচ, এক সময় মেয়েটার কত গালি, এমন কী চড়-থাপ্পড়ও অনায়াসে হজম করে নিয়েছে। কিন্তু এখন সামান্য তাচ্ছিল্যেও গা জ্বলে যায়।

ময়-মুরব্বি বেশ সত্য এক বচনই বলে গেছে, যাকে ভালো লাগে তার দোষ-গুন সবই ভালো লাগে।
আর যাকে মন্দ লাগে সে যা-ই করুক সবই চোখের বালি।
কিন্তু কথা কখন কাকে কার ভালো লাগে তারও ঠিক নেই। মানুষের পছন্দ হলো মৌমাছির মতো, কখনো এই ফুলে, তো কখনো ঐ ফুলে। নির্দিষ্ট কোনো ঠিক-ঠিকানা হয়তো নেই, হয়তো আছেও অজান্তেই।

অহন রেগেমেগে কিছু একটা করার জন্য অগ্রসর হবে তার পূর্বেই পাশে তাকাতেই নিজের আরেক চ্যালা কিশোরকে দেখে মাথা খারাপ। এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে তাকে। মারতে মারতে রক্তাক্ত হয়ে গেলেও মায়া হয় না তার।

বস্তুত, কিশোর সেই ঘরে যেতেই আকস্মিক চোখ যেয়ে পড়ে মনিটরের দিকে। নিশা এমনিতেই চোখ ধাঁধানো সুন্দরী, তার উপর ওশিয়ান ব্লু রংয়ের বেনারসিতে একদম সুন্দরীশ্রেষ্ঠা লাগছে, তার উপর আবার এমন ব্লাউজ ছাড়া কুচি বিহীন শাড়ি পরায় মনে হচ্ছে আবেদনময়ী। এই রূপেই আটক কিশোর, হয় মুগ্ধতায় নয় কিছু কুচিন্তায়। তার শাস্তিই পেতে হচ্ছে তাকে।

সে মিনতি করে বলতে শুরু করে,

“ভাই, মাফ করে দেন আমারে। ইচ্ছা কইরা হয় নাই। ভাই দয়া করেন। কোনোদিন আপনার কথার বাইরে যাই নাই, আজই প্রথম। আমার ক্ষমা করেন ভাই।”

যুবকের রাগ একটু কমে, তবুও কিশোরকে ছাড়েনি। বড় বড় শ্বাস ফেলে রাগ নিবারণের চেষ্টা করছে।

“ওর ওপর এত রাগ দেখাচ্ছিস কেন? ও পরপুরুষ হলে তুইও তো পরপুরুষ, তোর অধিকার নেই ওকে দেখার, তারপরও তো মেয়েটাকে রাস্তার সস্তা মেয়ে বানিয়ে দেখছিস এই রূপে। তুই যেহেতু নিজেই মেয়েটাকে সস্তা বানিয়েছিস, তবে ও সেভাবে দেখলে সমস্যা কী?”

দপ্ করে নিভে অহনের সকল অনুভূতি। কিশোরের শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে সামনের মানুষটির দিকে তাকায় সে। মেয়েটি কথাগুলো বলে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েটির নাম নিনাদ, সম্পর্কে অহনের কিছুই না। না বন্ধু, না আত্মীয়, তবুও তারা পাশাপাশি, একে অপরের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে। নিনাদ ইশারায় কিশোরকে যেতে বলে। কিশোরও সুযোগদের ব্যবহার করতে পিছ পা হয় না।

“কী রে উত্তর দিলি না?”

“তুই কে রে? তোকে কেন উত্তর দিতে হবে এই অহন চৌধুরীর?”

“আমি কে তা তুই খুব ভালো করেই জানিস। তোর সব কাজের হিসাব রাখার মানুষ, প্রত্যক্ষ সাক্ষী, সঙ্গী সবই তো আমি। কিন্তু এখন সেটা বিষয় না। বিষয়টা হলো তোর হিপোক্রেসি নিয়ে। তুই নিজেই যেই পাপ করছিস, সেটা অন্যে করলে এত জ্বলছিস কেন রে? মেয়েটা তো স…”

তাকে বলতে না দিয়েই অহন তেঁতে উঠে চেঁচিয়ে বলে,

“জাস্ট শাট নিনাদ! এই তিনবার তুই এই শব্দটা ওর উদ্দেশ্যে বলেছিস। আরেকবার বললে তোর জিভ টেনে ফেলতেও আমার হাত কাঁপবে না।”

“দেখলি কত বড় হিপোক্রিট তুই! তুই বানাতে পারিস, আর বললেই দোষ। হাহ্! আর এত বড় স্ক্রিনে যে তোমার তারে রাখো, যে কেউ তো এসে দেখবেই। জানো তো দামী রতন মানুষ পারে না অন্তরের তলে লুকিয়ে রাখতে, আর তুমি রাখসো খোলা, তাহলে সস্তাটা কে বানাইল? বলি শাস্তি তো আপন করে নিয়েও দেওয়া যায়।”

“ওর মতো মাইয়া হবে অহন চৌধুরীর বউ, ইম্পসিব্যাল!”

“জানিস কষ্ট যতটা অপ্রাপ্তির হয়, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি হয় পেয়েও না পাওয়ার জ্বলন, যন্ত্রণা। ও এক আলিশান স্বামী-সংসার চেয়েছিল, তুই দে, তবে নামমাত্র। এর চেয়ে কঠোর শাস্তি আর হতে পারে না।”

নিনাদের কথাগুলো অহনকে ভাবাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে অকারণেই।

___

সামিয়া চটজলদি নিজ উদ্যোগে ডিম ভাজি আর পান্তা ভাত মরিচ ডলে খায়িয়ে দিচ্ছে আবরারকে, নাহলে যে লোকটা না খেয়েই চলে যাবে। আজ শুক্রবার তবুও ভোর চারটায় আবরারকে বাড়ির বাহিরে পা রাখতে হচ্ছে।

আসলে চিকিৎসকদের বিশেষ, সাধারণ, সময়-অসময়, দিনরাত কিছু নেই। যখন জরুরি ভিত্তিতে রোগীর দরকারে ডাক আসবে তখনই দৌড় দিতে হবে সব উপেক্ষা করে।
যারা সব উপেক্ষা করে রোগীর সেবাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে না সে প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসকও হতে পারে না, শুধুই পদবী ও পেশায় মাত্র।

খাওয়ানো শেষে নিজে হাত ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করে,

“আচ্ছা, আপনার তো যেতে দেরি হবে। এর মধ্যেই যদি রোগীর কিছু হয়ে যায় বা সাথে সাথেই চিকিৎসা লাগে তখন…? হাসপাতালে কি রাতে ইমারজেন্সি কোনো চিকিৎসক থাকে না? থাকলে আপনাকে কেন ডাকাচ্ছে?”

“বাবা রে বাবা! কত প্রশ্ন! হাসপাতালে ইমারজেন্সির জন্য থাকে, যার নাইট শিফট্ পড়ে সেই থাকে। তবে ক্রিটিকাল কিছু কেসে অন্যান্য চিকিৎসকের পরামর্শ বা বোর্ড মিটিং বসানো লাগে, অনেক সময় কোনো কেসে অন্য আরেক ডাক্তার সাথে থাকলে বা সে করলে ভালো হয় এজন্যই…”

“তাহলে আপনাকে নাইট শিফট্ দেয় না কেন?”

বেসিন থেকে সরে তার সামনে এসে আরেকদফা প্রশ্ন করে সামিয়া। আবরার ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে তার সামনে আসা চুলগুলো সরাতে সরাতে বলে,

“কারণ তারা জানে আমার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। এই নব বিবাহিত জীবনের স্বর্ণযুগ তো রাত্রীগুলোই, তাই না? এটা বুঝেই হয়তো। এখন বুঝেছো?”

যুবকের ছোঁয়ায় তার একাকিনী কেঁপে কেঁপে উঠছে। মুখ দিয়ে কথা বলার শক্তি টুকুও অবশিষ্ট নেই, এতটাই কাবু হয়েছে লজ্জা বা অন্য অনুভূতিতে৷ আবরার মিষ্টি হেসে তাকে ছেড়ে বেরিয়ে চলে যায়।

আবরারের বাড়ি ফিরতে ফিরতে নয়টা বেজে গেছে। তিন বছরের ছোট্ট মেয়ের গলায় কয়েন আটকে গিয়েছিল, এই কেসটা নিয়ে ভাবতেও ঘাম ঝরেছে আবরারের। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে ঢাকা থেকে বাংলাদেশের এক সুনামধন্য সার্জন এসে করাবে, যেহেতু কেসটা বেশ জটিল, আবার রোগীও বাচ্চা।

আবরার বেল বাজাতেই সামিয়া দরজা খুলে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,

“আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি নাস্তা দিচ্ছি।”

এতক্ষণে দারোয়ানের হাতে এক কেজি গরুর গোশত আনিয়ে ভুনা করে ফেলেছে। সাথে আনিয়েছে হোটেলের গরম গরম পরোটা, এনেই হটপটে রেখে দিয়েছে, যাতে গরম থাকে।

আবরারকে খাবার দিয়ে সামিয়া বেশ উত্তেজিত এবং উদ্বিগ্ন মনে তাকিয়ে আছে। ভাবছে,

“লোকটা কখন চমকে উঠে বলবে এটা আমার খাওয়া বেস্ট গরুর গোশত ভুনা?”

কিন্তু তাকে দমিয়ে আবরার চুপচাপ খাবার খেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ‘বেশ ভালো হয়েছে’ বলে উঠে চলে গেল। তার আজ বহু কাজ পড়ে আছে।

তাছাড়া আসলেই খাবারটা মোটামোটি হয়েছে, আহামরি ভালো না। সামিয়া প্রথমে একটু নিরাশ হলেও পরে মৃদু হাসলো।

কী কারণে কে জানে? হয়তো প্রিয় মানুষের আশানুরূপ তারিফ নাহলেও সামান্য প্রশংসাও নারীর মন ভুলাতে যথেষ্ট।

সামিয়া খেয়ে থালা-বাসন ধুয়ে নিল। সেও আবরারের মতোনই শুচিবাইগ্রস্ত, তারপরও তার যুবকের এঁটো খাবার লেগে থাকা বাসনটা ধরতে একটুখানিও ঘিন লাগল না। নিজের উপর নিজেই অবাক হল। আনমনেই বলল,

“আজ তার প্রেমে গোটা আমিই মজেছি,
হয়তো তার প্রেমে অভ্যাসগুলো বদলেছি,
নয়তো তাকে নিজের অংশ ভেবে নিয়েছি।”

___

বিকেল হয়েছে, আসরের নামাজ পড়তে আজ আর মসজিদে যেতে পারেনি আবরার। কী যে বৃষ্টি পড়ছে! বাঁকানো ধারায় ইয়া বড় বড় ফোঁটা, যাকে বলে মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশ তো ডাকতেই আছে জোরেশোরে।

ঘরে নামাজ পড়ে আবরার বারান্দায় এসে বসে। বেশ বড়সড় এক বারান্দা। সেখানে বেশ কয়েক পদের ফুলগাছ; যেমনঃ গন্ধরাজ, জুঁই, বেলি, রায় বেলি, রেইন লিলি, নয়নতারা, কাটামুকুট। তবে আবরারের সবচেয়ে মন লুভায় বেলি, জুঁই আর গন্ধরাজের মনকাড়া সুবাসে, সাথে ভিজে মেঠোপথের ঘ্রাণ তো আছেই।

নাক টেনে সে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,

“আহা! কত সুন্দর তোদের খুশবু রে! আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের যেন সুখে মরার উপক্রম রে।”

সামিয়া দুই মগ কফি নিয়ে এসে দোলনায় বসতেই আবরার চেয়ার থেকে উঠে চট করে একটা বেলি ফুল ছিঁড়ে তার খোঁপায় গুঁজে দেয়। যুবতীর লাজে মাথা নত, অথচ বৃষ্টিয়ে সিক্ত পরিবেশ বৈকী কেউ দেখার নেই। তবে কেন সেই লজ্জা? বুঝতে পারে না যুবক।

আপনমনেই আবরার রবি ঠাকুরের গান বিকৃত করে গাইতে শুরু করে,

“ভেঙে তোর লজ্জা টুকু,
তোরে নিয়ে যাব মধুচন্দ্রিমাতে। ”

সামিয়া চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আবরার মিটমিটিয়ে হাসতে লাগে। মেয়েটার এই রাগী দৃষ্টি একটু অতিরিক্তই ভালো লাগে আবরারের। প্রকৃতপক্ষে কেউ চোখ রাঙালে তার রাগ উঠে।

কিন্তু ঐ যে মানব মন বড্ড জটিল, কখন কার কী ভালো লাগে বলা যায় না। অকারণে, বিনা শর্তে, যুক্তি ছাড়াই অনেক কিছুই মনকাড়ে।

আবরার হুট করেই একটা বেমানান কথা বলে ফেলে।

“জানো, জীবনে প্রথমবার প্রেমের আগমন আমার জীবনে এই ভরা বৃষ্টিতেই হয়েছিল। তোমার জীবনে প্রথম প্রেমের আগমন কবে ঘটেছিল? আজ এই মৌসুমে সেই গল্পই শুনি।”

সামিয়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তার প্রশ্নে। পর মুহূর্তেই ভারী এক শ্বাস ফেলে স্মৃতিচারণে ব্যস্ত হয়।

“পহেলা বসন্তের দিন ছিল। জিয়া উদ্দানের ধারের কৃষ্ণচূড়ার মেলা দেখতে দেখতে অগ্রসর হচ্ছিলাম। ভিড় ছিল প্রচুর, হুট করেই ভিড়ের মাঝেই শাড়িতে পা দিয়ে মাটিতে পড়ে যাই৷ খুব বাজে ভাবেই। নিশা আর কাজিনরা বেশ দূরে চলে যাওয়ায় আমার অবস্থা দেখেনি।

আমার নীল কাজল মাখানো চোখজোড়া যখন কান্নায় লেপ্টাতে যাব তখনই সে আসল। আমার কাছে হাটু গেড়ে বসল। বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘খুব লেগেছে তোমার? পায়ে লেগেছে? উঠতে পারবে তো না কি আমি ধরব?'”

বলতে বলতেই নিজ খেয়ালেই হেসে উঠল সামিয়া। একদম সতেজ হাসি, কতশত ভালো লাগা মেশানো।

“তার কণ্ঠ, একদম ভরাট পুরুষালি গলা, তবুও কী যে মিষ্টি নেশাদ্রব্য তা কথায় বলে বুঝানো মুশকিল! তার ঈষৎ দোল খেলানো উলটে রাখা কিছু চুল চোখের উপর এসে আড্ডা জমিয়েছিল, তাতেও ঘায়েল ছিলাম কিনা কে জানে? চাপ দাড়ি রৌদ্রে পোড়া শ্যামা গড়নে কতটা যে দৃষ্টিনন্দন লাগে তা তাকে না দেখলে জানতামই না।

তবে আফসোস ছিল বেশ কিছু, তার তীক্ষ্ম নাকটা একবার ছুঁয়ে দিতে পারলাম না, তার বেগুনি ঠোঁটগুলোত হাসি দেখলাম না, শুধু নীরব হয়ে মুগ্ধতার বেড়াজালে বন্দিনী হয়েই থাকলাম।

সে আমার নীরবতাকে সাহায্যের আঁকুতি ভেবে আমার হাত কাঁধে তুলে নিয়ে গেল এক পাশে। তারপর কাকে যেন কল দেওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরই হুন্ডায় বসে হেলমেট পড়া এক লোক বরফের ব্যাগ নিয়ে এল। আমার দিকে তা এগিয়ে দিয়ে পুনরায় সেই নেশা ধরানো গলায় বলল,

‘শোনো মেয়ে, এটা ব্যথার জায়গায় ধর। আর একা এসেছো না কি কারো সাথে? একা?”

কী জন্য জানি না মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালাম। বলে ফেললাম বিনা কারণেই এক মিথ্যে, অথচ এতে আমার ক্ষতিরও সুযোগ ছিল। কেন যে বিশ্বাস করতে হল জানি না। হয়তো এই বয়সটা থাকলে করতাম না, এইটে পড়ি, মস্তিষ্কের উপর মনের বাহাদুরি চলে।

সে ‘চ’ বোধক শব্দ করে বলল,

‘এ তো বেশ অন্যায়! এট্টুনি মেয়ে তুমি কি না একা একা ঘুরতে এসে পড়লে। আসো, আমার বাইকে করে ঐ মাথায় নিয়ে যাই, ওখান থেকে রিকশা করে দিব নে।’

তিনি সামনে বসল, আমি পিছনে। আমার চুলগুলো উড়ে উড়ে তার গায়ে লাগছে। সে বিরক্ত বোধ করছিল কি না জানি না, আমার বেশ সুখ সুখ বোধ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমি নায়িকা আর সে নায়ক।সে একটা রিকশা করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় আমায়।

সেদিনের পর প্রায় কয়েকমাস একটুও ঠিক ছিলাম না আমি। দিন-রাত শুধু তার ভাবনাই মাথায় জেগে থাকত। কৈশোরের প্রথম পুরুষ, প্রথম প্রেম বলে কথা। মনে হত তাকে নিয়ে কোথাও লুকিয়ে পড়ি, যেথায় থাকবে না কেউ। শুধু আমি, সে আর আমাদের একাকিত্ব।

প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্কে তেমন বাস্তব জ্ঞান না থাকলেও সিনেমা-নাটক দেখে বেশ ভালোই এক ধারণ হয়ে গিয়েছিল। বুঝতাম আমি প্রেমে পড়েছি, বেশ ভয়ংকর ভাবে প্রেম রোগে আক্রান্ত রোগী আমি, আর অসুখের একমাত্র দাওয়া সে।”

থামে সামিয়া। তার মুখে এখনো সেই সতেজ হাসি স্থির, সে অতীতের সুবর্ণময় স্মৃতিপথে ডুবে। কিন্তু আবরার? সে ভিষণ ঈর্ষান্বিত।

“আমার প্রেয়সী এতটা প্রেমে মজেছিল ফাহাদের? আমিও তো মজেছিলাম কারো প্রেমে, তবুও কেন এই অতীত মেনে নিতে এত কষ্ট হচ্ছে? কেন?”

ব্যথিত গলায় জিজ্ঞেস করে,

“বেশ ভালোই ডুবেছিলে ফাহাদে।”

“উহু, সে কাব্য৷ ডুবেছিলাম কাব্যতে। তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা নিবারণে ফাহাদের খাণিকের মোহ এসেছিল জীবনে। মোহ ছিল, তাই যত দ্রুত এসেছিল, তত দ্রুত চলেও গিয়েছিল।”

তবে কী কাব্য সত্যিই ছিল? কোনো বাস্তবিক চরিত্র সে, শুধুই কাল্পনিক নয়? এসব কোনো কারণ বশতই প্রশ্ন মাথায় আসে না আবরারের, বরং আপন মনেই সে তৃপ্তির হাসি দেয়। কারণটা হয়তো একান্তই সে জানে আপনমনেই। তার সামনে বসে থাকা নারীটিও তার হাসার রহস্য উন্মেচন করতে পারে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here