প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:১২+১৩+১৪

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১২ তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
শোঁ শোঁ করে গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে। সামিয়ার একদৃষ্টিতে সেই দৃশ্য দেখছে গাড়ির জানালা দিয়ে। বিড়বিড় করে বলছে,

“কীসের জন্য ছুটছো তুমি মানব?
কী এত চাওয়া তোমার?
ছোট্ট একটাই তো জীবন,
একটু সুখ, একটু আনন্দ, একটু ত্যাগ,
এবং সাথে আল্লাহর ইবাদতে
কাটিয়ে কি দিতে পারো না তুমি জীবন?
টাকার মূল্য কি শান্তির চাইতেও তৃপ্তিকর?”

তার কথাগুলো কিছুটা অস্পষ্ট ভাবেই আবরারের কানে আসে। সে যুবতীর দিকে দৃষ্টি দিতেই মোহিত হয়। মৃদু হাওয়ায় সামিয়ার চুলগুলো উড়ছে, কখনো ছুঁয়ে দিচ্ছে তার ঈষৎ গোলাপি ঠোঁট, তো কখনো ঢেকে দিচ্ছে তার মনের ছবি তথা গভীর দু চোখ। এ দৃশ্য দেখা যেন এক অক্লান্তকর্ম।

“আচ্ছা, অন্য কারো চোখে এই নারীটিকে এত নয়নাভিরাম (eye catching) লাগতো যতটা আমার এই দুই চোখে লাগে। না কি তার প্রেমিক পুরুষ হতে পেরেছি বলেই এমনটা?

তবে বলাই যায় প্রেমিকের চোখেই রমণীর প্রকৃত সৌন্দর্য ধরা পড়ে। তাই-ই নারী প্রতিটি নারী অপেক্ষা করে নিজের প্রেমিক পুরুষের আগমনের, নিজের রূপের সঠিক মর্যাদা পেতে, তার রূপকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে।”

মনে মনে বলতে বলতেই আরেকদফা আড়চোখে যুবতীর দিকে তাকায়। তার একাকিনী তো সেই যে বাহিরে মুখ ঘুরিয়েছে আর তার দিকে ফিরছেই না। ভেবেই এক সুদীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে। এতে ছিল খাণিকটা রাগ, বেশ অভিমান, অনেকটা আক্ষেপ, কিছুটা হতাশাও।

এদিকে সামিয়ার প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছে। লোকটা এমন দৃষ্টি উপেক্ষা করা বহু মুশকিলের কারবার তার নিকট। কপোলটা উষ্ণ হতে শুরু করেছে, লাল আভা ছেয়েছে কী না…

মূলত নিজের লজ্জায় ছেয়ে থাকা মুখশ্রী লুকোতেই বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকা। তবে এখন ঘাড়টাও ব্যথা করছে একপাশ হয়ে থেকে। না পারলেই মিনমিনে সুরে বলে উঠল,

“বলি কী আমার দিকে না তাকিয়ে থেকে গাড়ি চালানোতে ধ্যান দিন। নাহলে আবার এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।”

আবরারের সাধারণ ছেলেদের মতো লাজলজ্জা কম হলেও, খাণিকটা আছেই। আচমকা এমন বাণীতে সে বেশ লজ্জাই পায়। খাণিক নড়েচড়ে বসে সামনের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে এমন একটা ভাব করে যেন সে বেশ মনযোগী চালক। সামিয়া একটু হেসেই ফেলে তা দেখে। কিন্তু এরপরই তাকে একদম অপ্রস্তুত করে ফেলে যুবক।

“আমি দেখছি তুমি বুঝলে কী করে? তার মানে তুমিও আমায় দেখছিলে। আমি তো তোমার স্বামীই হই এভাবে চোরা চোখে না দেখে সোজাসুজিই দেখতে পারো।”

সামিয়া উত্তর স্বরূপ কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু মুখে কোনো কথা আসছে না। নিজের উপর একরাশ বিরক্তি ও আবরারের উপর একরাশ রাগ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ফোন চালানোয় মন লাগায় সে। যুবক বেশ খুশি যুবতীকে হেনেস্তা করতে পারে। মুচকি মুচকি হাসছে সে।

হুট করেই তার মনে পড়ে গেল সকালের কথা। মেয়েটা কী বিস্ময়কর কাজই না করল…

অতীত,

সামিয়া কাপড় ব্যাগে ভরার কারণ জানতে চায় আবরারের কাছে। আবরার কী বলবে ভেবে পায় না। কারণ সে চাচ্ছে না তারা কোথায় যাচ্ছে কেউ জানুক। সে চায় সামিয়াকে সম্পূর্ণ রূপে এই জীবন ও তার সাথে জড়িত সবকিছু থেকে দূরে রাখতে।

তাকে নীরব দেখে সামিয়া পুনরায় প্রশ্ন করে উঠে,

“কী হলো! বলছেন না আমরা কই যাব?”

আবরার আরও কিছুক্ষণ নীরব থাকল, হয়তো নিজের কথাগুলো সাজিয়ে নিচ্ছে। তারপর অত্যন্ত শান্ত ও বিনম্রতার সাথে বলল,

“আমি তোমার স্বামী। স্বামী কিন্তু শুধু একটা শব্দ না, এই পদবীর মর্যাদা ভাষায় বলে শেষ করার মতোন নয়। স্বামী মানে বাবার পর মাথার উপর ছায়াতল, স্বামী মানে ভাই-বোনের পর ঝগড়া এবং ভাগাভাগির সঙ্গি, স্বামী মানে মায়ের পর নিজে অব্যক্ত কথাগুলো বলার সঙ্গি, স্বামী মানে সকল চাহিদার পূরক। জানি না তুমি কতটুকু মানতে পেরেছো আমাকে এই পদবীতে। তবে হ্যাঁ, আমি পুরো তোমাকেই আপন করে নিয়েছি; স্ত্রী রূপে, সঙ্গিনী রূপে, প্রেয়সী রূপে।”

কয়েক মুহূর্তের বিরতি। আবারও হয়তো নিজের কথাগুলো কীভাবে ব্যক্ত করবে ভেবে নিচ্ছে। সামিয়া তার দিকে তাকিয়ে বুঝে উঠার চেষ্টা করছে এসব বলার কারণ।

“স্বামী হিসেবে আমি তোমার মন্দ চাইব না, তোমার অনিষ্ঠ হবে এমন কোথাও নিয়েও যাব না নিশ্চিত। এই আবরারকে না, তবে তোমার স্বামীকে একটু ভরসা কর। আমার ভালোবাসাতে না-ই বা এত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস রাখলে, তবে আমার মনোবাসনাকে সন্দেহ কোরো না। বেহুলা নিজের স্বামীর জন্য কত নদ-নদী পেরিয়েছিল, তুমি কি বিশ্বাস করে আমার হাত আঁকড়ে নিঃশ্চুপ হয়ে নিঃসঙ্কচ ভাবে পারবে না যেতে যেখানে আমি যাব?”

সামিয়া নীরব, তার চাহনি অনেকটাই নির্বোধের মতোন। যুবক উত্তরের আশায় মগ্নচৈতন্য, তবে সে অপেক্ষা করছে নেতিবাচক উত্তরের, ইতিবাচক উত্তরের নয়। কারণ সামিয়ার ট্রাস্ট ইশ্যুস ও অতীত সম্পর্কে সে জ্ঞাত, এই অবস্থায় এ কয়দিনের পরিচয়ে তাকে বিশ্বাস করা অনেকটাই মুশকিল, অসাধ্য কার্যই বলা চলে।

তাকে অবাক করে সামিয়া ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে নিরুদ্যম ভঙ্গিমায় উত্তর দেয়,

“ঠিক আছে। কখন বের হবেন?”

আবরার বিস্মিত এমন জবাবে, এতোই যে তার চোখ কোটর ছাড়িয়ে বের হবার উপক্রম। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিল্য

“তুমি তৈরি হলেই বের হব। আমার গাড়ি করেই যাচ্ছি।”

সামিয়ার বিশ্বাস দেখে সে বিস্মিত। অথচ, সামিয়া সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। না কি তার স্বাভাবিক থাকারই কথা কোনো অজানা ও অব্যক্ত কারণ বশত?

বর্তমানে,

আবরার গাড়ি হঠাৎ করে অনেক জোরে ব্রেক করায় সামিয়ার মাথা গাড়িতে লাগার উপক্রম প্রায়। সামিয়ার বুক ভয়ে কেঁপে উঠে, বুকে থুঃথুঃ দিয়ে সে রাগী সুরে বলে উঠে,

“ঐ আপনাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিসে কোন গাঁধায়! কী গাড়ি চালান, হ্যাঁ? এত জোরে কেউ ব্রেক করে? আমি যদি ব্যথা পেতাম?”

আবরার অপরাধীর ভঙ্গিমায় মাথা নত ছোট বাচ্চাদের মতোন কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,

“আ’ম সরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি।”

যুবকের এমন মুখ ভঙ্গিমায় কি আর রাগ ধরে রাখতে পারে যুবতী। মুহূর্তেই নিভে যায় সে।

“ইট’স ওকে। আমিই একটু বেশি বলে ফেলেছি।”

“এখন চলো?”

“আরে বাবা খাবা না?”

“এখন…? মানে ৬টা বাজে মাত্র।”

“তারপরও খেয়ে নেও।”

“আমি খাব না।”

আবরার চোখ রাঙিয়ে শক্ত গলায় বলে,

“চুপচাপ খেতে চলো, নাহলে এখানে ফেলে রেখে চলে যাব।”

এবার সামিয়া মুখ গোমড়া করে ভদ্র বাচ্চার মতোন আদেশ পালন করে। সন্ধ্যালোকের আবছা আলোয় সামিয়া দেখে “হক ইন” নামটা চকচক করছে, এই রেস্টুরেন্টেই খেতে যাচ্ছে তারা। আশেপাশে তাকাতেই কিছু বোর্ড, ব্যানার খেয়াল করতেই জায়গার নাম পড়ে বুঝতে পারে এটা কুমিল্লা। অবাক হয় সে, যদিও কোনো প্রশ্ন করে না। আবরার সামিয়ার জন্য গরুর মাংস ভুনা আর রুটি অর্ডার দেয়। এই সময়ে খাওয়ার জন্য তার নিকট এই খাবারটাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

সামিয়া অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করেনি আবরারের কী অর্ডার দিয়েছে। কিন্তু খাবার আসতেই তার মুখ বাংলা পাঁচের মতোন হয়ে যায়। তার যে নিতান্তই অপছন্দ রুটি জাতীয় খাবার, ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঝোল লাগিয়ে খাওয়াকে তার বিরক্তি লাগে। এর মধ্যেই আবরার ভ্রুজোড়া কুঁচকে বলে উঠে,

“তাকিয়ে আছো কেন এমনে খাবারের দিকে? খাও!”

সামিয়া আমরা আমতা করে উত্তর দেয়,

“আসলে আমি রুটি খাই না। ছিঁড়ো, লাগাও, খাও এত ঝামেলা খেতে আমি করতে পারব না।”

“কী আজব কথাবার্তা! আচ্ছা, আমি খায়িয়ে দিচ্ছি।”

সামিয়া নিজের আশেপাশে তাকায়, মোটামোটি ভালোই মানুষজন। ছোট্ট এক ঢোক গিলে শুধালো,

“না, না, দরকার…”

সে কথা শেষ করার আগেই যুবক তার মুখে একগ্রাস খাবার গুঁজে দেয়। লজ্জায় আরেকদফা এদিক-ওদিক তাকালো। না, কেউ দেখছে না তাদের, সবাই নিজ কাজে ব্যস্ত। তবে দুয়েকজন যুবতী তার দিকে চোরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

___

সামিয়া মায়ের প্রেশার হাই। তার মেয়ে ঘর থেকে গায়েব। স্যালাইন লাগিয়ে বেডরুমে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে তাকে। কাজের মেয়ে লিমু হাত-পায়ে তেল ডলছে। বলা বাহুল্য, আবরার কাউকে না বলেই সামিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। অবশ্য, সায়রাজ কবিরকে একটা ছোট্ট ম্যাসেজ দিয়েছে। তা হলো-

“আঙ্কেল ডাক্তারের কথা মোতাবেক আমি সামিয়াকে নিয়ে দূরে চলে যাচ্ছি। আমরা সেখানেই থাকব ওর স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত। দুঃখিত আপনাদের না জানানোর জন্য এই ব্যাপারে কিছু। আমি চাই না ওর অতীতের কোনো অংশ বা মানুষ ওর ছায়ার কাছেও আসুক।”

এই ব্যাপারটিই আলিফা খাতুনের শ্রবণ দ্বারে পৌঁছাতেই তার অজ্ঞান হওয়ার দশা। অসুস্থতার মাঝেই আবরারকে বকেই যাচ্ছে সে। তো আবার কতক্ষণ সায়রাজ কবিরকে বকছে।

“কোথাকার কোন ছেলে আমাকে না বলে আমার মেয়েকে নিয়ে গেল। ওর সাহস কত বড়! আমার মেয়েটা না জানি কী অবস্থা! হায় আল্লাহ!”

এবার স্বামীর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,

“এই তোমার জন্য ঐ হতচ্ছাড়া ছেলেটা আমার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছে। তুমি কেমন বাবা, হ্যাঁ! এত কিছু হয়ে গেছে তারপরও চুপ করে বসে আছো! আমার মেয়েটা…”

প্রায় অনেকটা সময় ধরে মধ্যবয়স্ক নারীটির বিলাপ সহ্য করে নিলেও এবার বিরক্তিতে বলে উঠে এক তিক্ত বাক্য।

“যেখানেই নিয়ে যাক তোমার মতো অবস্থা তো করবে না মেয়েটার। ভুলে যেয়ো না তোমার জন্যই সামিয়ার এই অবস্থা।”

আলিফা খাতুন এবার নিঃশ্চুপ। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সায়রাজ কবিরকে দেখছে। ভাবছে,

“সত্যিই কী আমার জন্যই আমার মেয়েটার এই অবস্থা?”

মা হিসেবে কখনো সামিয়ার মন্দ চাইনি তিনি, সবটাই করেছে মেয়ের মঙ্গলের জন্য। তবুও যৌক্তিকতার দিক দিয়ে সে অপরাধী। সায়রাজ কবির তার করুণ দৃষ্টি লঘুজ্ঞান করেই সেখান থেকে প্রস্থান করে।

___

নিশা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখতে পায় সিলিংয়ে ঘূর্ণায়মান ময়লায় কালো রঙ ধারণ করা ফ্যানটি। সাথে সাথেই মনে পড়ে যায় সবকিছু, রঙচঙা মুখটা মলিন হয়ে যায়। উঠে বসে পেট চেপে ধরে, সারাদিন খাওয়া হয়নি, এখন সত্যিই ক্ষুধা লেগেছে। তার চোখ যেয়ে পড়ে অহনের রেখে যাওয়া বাজারের থলিটির দিকে।

ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে মেঝে থেকে উঠে থলিটি হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় সে। সে জানে তার কাছে আর কোনো বিকল্প নেই।

হিডেন ক্যামেরায় এসব দেখে অহন পৈশাচিক হাসি দিচ্ছে। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করতেই সে হতবাক হয়ে যায়।

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১৩তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিশা অনায়াসে পিয়াজ কাটছে বঁটি দিয়ে, যেন এ কাজ সে বহুবার করেছে। অহনের ভ্রুঁ কুচকে যায়, সে জানে নিশা বড়লোকের দুলালী। এমন কী এও শুনেছে এই যুবতীর নিকট যে সে না কি কোনোদিন নিজ হাতে পানিও তুলে পান করে না। আপন মনেই প্রশ্ন করে উঠে,

“এই মেয়ে এভাবে পাকা হাতে কাজ করছে কীভাবে?”

আলুর ভর্তা নিশার খুব একটা পছন্দ না তবে বাগাড় দিলে খেতে মন্দ লাগে না। তাই সেটা করার জন্যই কড়াই খুঁজতে লাগল পাকঘরে, খুব তাড়াতাড়ি পেয়েও গেল। খুব ছোট্ট একটা পাকঘর, এতটাই যে একজন দাঁড়ালে অপরজনের থাকা যাবে না। সেখানে বাসন হারানোর বা খুঁজে না পাওয়ার জোঁ নেই।

আলুর ভর্তা দিয়ে গরম গরম ভাত মেখে নিল। একি লোকমা মুখে তুলে খেতেই ফুস করে এক স্বস্তি ভরা নিঃশ্বাস ছাড়ল। বিড়বিড় করে বলল,

“ক্ষুধা সহ্য করা বহুত মুশকিল! বহুত!”

অহন নিশাকে ঠোঁট নাড়ানো দেখল মাত্র, তবে কী বলল ঠিক বুঝতে পারল না। নিশার কণ্ঠ অত্যন্ত নিচু হওয়ায় এবং ভয়েস রেকর্ডারগুলো বেশ ভালো দূরত্বে থাকায়। নিশার খাবার শেষ করতেই বেশ গা ঘিনঘিন লাগছে, গরমের দিন, তার উপর এত ভারী রঙচঙা সাজ আর পোশাক, তার শরীর একবারে ঘামে ভিজে গোসল। যদিও অহন তাকে হারিকেনের কথা বলে গিয়েছিল, কিন্তু সে হারিকেন খুঁজে পায়নি। পেয়েছে এক প্যাকেট মোমবাতি, সেই বাজারের থলিতেই ছিল। সেটা জ্বালিয়েই রান্নাবান্না।

এখন মোমবাতি নিয়েই বাথরুমের দিকে যায় সে। নির্ঘাত বাথরুমেও কোনো কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা নেই। বাথরুমটা খুলতেই ফিনাইলের তাজা গন্ধ পায়, হয়তো সে আসার আগেই পরিষ্কার করানো হয়েছে বাথরুমটা। বাথরুমে পা ফেলেও কী মনে করে যেন লাইটের সুইচটা অন করে সে। তাকে অবাক করে বাথরুমের লাইট জ্বলে যায়। মুহূর্তেই উৎফুল্ল হয়ে পড়ে সে।

গোসল শেষ করে বাথরুম থেকে বের হবে এমন সময় মনে পড়ল তার কাছে কিছুই নেই পড়ে বের হবার মতোন। একবার ভাবল, সে তো একাই ঘরে। কিন্তু পরক্ষণেই মন আর সায় দিল না।

হ্যাঙারে ঝুলানো কাপড়গুলোর দিকে তাকায় সে। আফসোস মাখা গলায় বলে,

“ইশ! ব্লাউজ আর সায়াটা যে কেন ভিজালাম!”

শুকনো বেনারসি শাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই মুখে হাসি ফুটে উঠে। কোনোরকম কুচি ছাড়া শাড়ি পরে নেয়।

এদিকে অহন নিশাকে ওয়াশরুমে যেতে দেখে কিছু একটা ভেবে কল করে নিজের বিশ্বস্ত লোক মলয়কে।

“হ্যালো দাদা?”

“তোরে যে কাজ করতে বলসিলাম করেছিস? থানার থেকে খোঁজ-খবর নিয়েছিস?”

“হ, দাদা। তয় কেউ মেয়েরে পায় না বইলা কেস লেখায় নাই।”

অহন আরেকদফা ধাক্কা খেল। কারণ নিশা সবসময় তাকে বলে এসেছে তার বাবা-মা তাকে এতোই ভালোবাসে যে চোখের আড়াল হলেও তাদের কলিজা কেঁপে উঠে।

“হ্যালো ভাই! আছেন?”

“হু। রাখছি এখন, পরে কথা বলছি।”

অহনের নিশা সম্পর্কিত সবকিছুই জানা থেকে হঠাৎ করেই অজানা মনে হচ্ছে। ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে তাকে এসব। অন্যমনস্ক ভাবেই চোখ আটকে যায় ক্যামেরার ফুটেজে।

লালচে কালো কাঁধ সমান চুলগুলো বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে নিশা ফর্সা কাঁধ, ঘাড়, গলা। নগ্ন পিঠে বিন্দু বিন্দু জলকণা যেন একেকটা মুক্ত। বিশেষ করে পিঠের ডান পাশের তিল একটু বেশিই আকৃষ্ট করছে তাকে। যুবকের যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে এই আবেদনময়ী রূপে।

আচমকাই চোখ ফিরিয়ে নিল মনিটর থেকে। এই ঘর ছেড়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল। একটা সিগরেট ধরিয়ে কালচে বেগুনি বর্ণের ঠোঁটগুলোর মাঝে গুঁজে নিল। বড্ড অপরাধ বোধ হচ্ছে তার। বিড়বিড় করে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলে,

“ছিঃ! অহন তুই এমনটা কেমনে করতে পারলি! যতই ও তোর প্রতিশোধের প্রাপ্য হোক…

নিজেকে আরও নানাভাবে ধিক্কার জানাল সে।
তার চাহনি যে এবার যুবতীর দিকে নিতান্তই অপবিত্র ছিল, পবিত্র নয়। তাতে কামনা ছিল, প্রেম ছিল, মনের সুপ্ত বাসনা ছিল; তবে ভালোবাসা এবং বিশেষ করে শুদ্ধতা ছিল না। বৈধতা পাওয়ার পর এই চাহনি যেমন হয় ভালোবাসার পূর্ণতা ও সম্পর্কের বৈধতার প্রতীক, তেমন বৈধতা পাওয়ার আগে হয় অপবিত্রতার দৃষ্টান্ত।

___

শীতল বাতাসে কখন যে চোখ দুটা লেগে এসেছে সামিয়া বুঝতেও পারেনি। আবরার খেয়াল করতেই দেখে যুবতী ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কী স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে! তার বড্ড লোভ হয় মেয়েটিকে গভীর দৃষ্টিতে দেখার, কিন্তু ঐ যে ড্রাইভিং… তাতো মনোযোগ সহকারেই করতে হবে, নাহলে কেল্লাফতে। ফুস করে এক বিরক্তি মাখা শ্বাস ছেড়ে গাড়ি চালানোতে মন দেয়।

গন্তব্যে পৌঁছাতেই ক্লান্তি মাখা হাসি দেয় সে। তৃপ্তির সুরে বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ফাইনাল্লি…”

তারপর গাড়ি থেকে নেমে অপরপাশের দরজা খুলে সামিয়াকে বের করার জন্য। তবে দরজা খুলে ঘুমন্ত প্রেয়সীকে দেখে সম্মোহিত হয় সে। মেয়েটির রূপে তো এমন সম্মোহিত করার মতো কিছুই পাচ্ছে না সে।

না বড় বড় ডাগর দুইখানা চোখ আছে, না মেঘের মতোন ঘন কালো রেশমি দীঘল চুল, না তীক্ষ্ম নাক। বেশ সাধারণ এভারেজ লুকিং মেয়ে সামিয়া। উলটো বাচ্চাদের মতো একটু একটু লালা নিঃসরণ হচ্ছে মুখ থেকে। তবুও কেন গা ঘিনঘিন অনুভূতি না হয়ে মুগ্ধতা জন্মাচ্ছে?

নিজের এলোমেলো ভাবনার মাঝেই আলতো হেসে উঠে সে। মনে মনে বলে,

“হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন যে নারী ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে সুন্দর লাগে সেই প্রকৃত সুন্দরী। প্রকৃতপক্ষে, যে যেই নারীর প্রেমে পড়ে আর ভালোবাসায় ডুবে তার নিকট সেই নারীই সর্বাপেক্ষা সুন্দরী, তা ঘুমন্ত অবস্থায় হোক কিংবা অন্য কোনো সময়।”

সামিয়ার গালে ছেয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো সরিয়ে আলতো এক স্পর্শ দেয়। সামিয়া বুঝতে পারে, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না, তার চোখ দুটো যে খুলতে ইচ্ছুক নয়। তার ঘুম আবার বেশ অদ্ভুৎ, ঘুম পাতলা একটুতেই জেগে যায় সে, সব বুঝতে বা শুনতে পারলেও অকেজো চোখগুলো পুরোপুরি আর নিজে অনেকটা ঘুমেই নিমজ্জিত থাকে। আবরার সামিয়াকে কোলে তুলে ঘরের বেল বাজায়। বেশ রূপবতী এক মেয়ে এসে দরজাটা খুলে দেয়। আবরার সামিয়াকে নিয়ে সোজা বেডরুমে চলে যায়।

বেডে শুয়িয়ে আরেক দণ্ড ছুঁয়ে দেয় যুবক তার গালে। ফিসফিসিয়ে বলল,

“প্রেমের নেশায় ডুবলাম আমি, প্রেমের নেশায় ডুবলাম।
তোর মাঝে আমি নিজের সর্বনাশটা দেখলাম।”

কথাটুকু বলে যেই না অধরসুধার দিকে আগাবে তখনই সামিয়া আচমকা চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে আছে। আবরার নিজেও নার্ভাস হয়ে পড়েছে, যার দরুণ দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে শুরু করে। এ তার পুরাতন অভ্যাস, স্বভাবই বলা চলে। বস্তুত সবকিছুই এক অঘোষিত ঘোরে হয়ে গেছে, হয়তো সম্পর্কের বৈধতা ছিল বিধায় মস্তিষ্কের বাধা পায়নি। পরিস্থিতি এড়াতে সে বলে উঠে,

“আমি আসছি, হ্যাঁ? আমার একটু কাজ আছে।”

বলে হনহন করে বেডরুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে শুরু করে, যেন সে খুব কষ্টসাধ্য এক কাজ সম্পাদন করে এসেছে।

এদিকে সামিয়া এমনভাবে স্তব্ধ হয়ে যেন কেউ স্ট্যাচু খেলায় তাকে স্ট্যাচু বলে দিয়েছে। তারপর নিজের অজান্তেই নিজের হাতটা গালে রেখে বলে,

“আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম না কি সত্যি? তাহলে আমি না উঠলে তো আজ… এই ভদ্র সেজে থাকা লোক তো তবে বড্ড সাংঘাতিক।”

শামিমকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে আবরার। দুই বন্ধুর মিলন হয়েছে বহুদিন পর, একসাথে নিকেটিনের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে আড্ডা দিচ্ছে তারা। কথোপকথনের একপর্যায়ে শামিম খেয়াল আবরারের মুখটা ম্লান। বলা বাহুল্য, সে বন্ধুর জীবনের সব তথ্যই জানে, প্রেম বিষয়কও।

“কী রে! এমন মুখ বানায়া বসে আছিস কেন? কিছু হয়েছে না কি?”

আবরার মলিন হাসি জুড়ে শুধায়,

“না, না, কী হবে আবার? এত দূর জার্নি করে এসেছি তাই হয়তো।”

“ওহ। তা তোর আর ভাবীর সম্পর্কের কী অবস্থা? উন্নতি হয়েছে? আর ভাবীর মেন্টাল হেলথ্…?”

“মেডিসিন তো রেগুলার দিচ্ছি, আর ও খাচ্ছেও। অস্বাভাবিক কিছু খেয়াল করিনি… আর সম্পর্কের উন্নতি হতে অনেকটাই যাত্রা বাকি।”

“তুইও না… একটা মেয়েকে প্রেমে ফেলতে এত কিছু লাগে না। মেয়েরা হলো সাকুলেন্টের মতোন অল্প পানি মানে কেয়ার লাগে, আর বেশ খাণিকটা সূর্যালোক মানে ভালোবাসা। তাহলেই দেখবি তোকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ফেলবে।”

আবরার ঠোঁট কামড়ে শামিমের দিক্ব তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে দেয়।

“উহু, আমি তো আমার প্রেয়সীকে আমার প্রেমে ফেলতে চাই না এখন। আমি চাই সে নিজের সব টুকু দিয়ে প্রথমে নিজেকে ভালোবাসুক, নিজের প্রেমে পড়ুক, নিজের রূপে মুগ্ধ হোক, নিজেকে পারফেক্ট ভাবুক, আত্মবিশ্বাসী হোক।।”

থেমে ভাবুক গলায় পুনরায় বলে উঠে,

“জানিস মেয়েরা খুব অদ্ভুৎ হয়।

তারা নিজের চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি অন্যকে ভালোবেসে ফেলে। নিজেকে ভুলে যায় তার যত্ন ও সংসার করতে, তার বাড়িটাকে শান্তির নীড় বানাতে। তাই তো পাঁচটা বছর সংসারজীবনের যেতে না যেতেই তার চুলে পাক ধরে, চেহারার মাধুর্য নষ্ট হয়।

যেই মেয়েটার রূপচর্চায় ডুবে থাকতো, সে আর আজ এসব ভাবেও না। হঠাৎ একদিন স্বামীর বেফাঁস কিছু কথায় সেই এককালের রূপবতী কন্যাও নিজেকে কুৎসিত ভাবে।

আমি চাই আমার প্রেয়সী নিজেকে আগে ভালোবাসুক, নিজের যত্ন নিক, নিজের বাহ্যিকতাকে এক্সেপ্ট করুক, যাতে কারো কথায় কিছুই না আসে যায় তার। সব প্রেমিকের চাওয়া, দরকার, ইচ্ছে হয় নিজের প্রেমে ফেলা তার প্রেয়সীকে; আমি নাহয় একটু ভিন্নই হলাম।”

আরও কিছু কথাবার্তার পর শামিম বলে,

“ফ্রেশ হয়ে বাসায় আয় তাড়াতাড়ি। আম্মা তোদের জন্য আয়োজন করেছে।”

দুজনেই সিগরেট সেখানে ফেলে পা মাড়িয়ে সেন্টারফ্রেশ মুখে নিয়ে চিবাতে চিবাতে স্থান ত্যাগ করে। সিগারেটের নেশা করার পর সবচেয়ে পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ হল তার গন্ধ দূর করা। নাহলে বাড়ি ফিরলে মা নাহয় স্ত্রী যেকোনো এক নারীর হাতে অঘোষিত ভাবে শাস্তি তার হবেই।

আবরার এসে দেখে সামিয়া গোসল করে এসে চুলের পানি ঝাড়ছে। সে নিজের লাগেজ খুলে একটা প্যাকেট বের করে বলে,

“এই শাড়িটা পরে নেও। উপরের ফ্লাটে আমার বন্ধু থাকে, সেখানে দাওয়াত।”

সামিয়া স্মিত হেসে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাগটা হাতে নেয়। কিন্তু ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতেই তার মুখ অন্ধকার। ব্যাগে একটা লাল রঙের ঝুম শাড়ি আর সায়া, ব্লাউজ। ভাবে,

“উনি কি জানেন না লাল রঙে আমায় বিশ্রী দেখায়? একদম বিদঘুটে! তাই তো লাল আমার প্রিয় রঙ হওয়ার পরও একবারও পরিনি বা বলা যায় পরতে নিষেধ ছিল।”

তার পাণ্ডুর মুখশ্রী দেখে আবরার নিচু গলায় প্রশ্ন করে,

“শাড়ি পছন্দ হয়নি? না কি এই রঙ পছন্দ না?”

“না, না, এ রঙ তো আমার অনেক প্রিয়। শাড়িটাও বেশ, কিন্তু এই রঙে তো আমায় অনেক বাজে লাগে দেখতে। তাই তো কোনোদিন পরতে পারিনি। কেন যে এমন অসুন্দর হলাম নাহলে এই রঙটাও পরতে পারতাম…”

বেশ আফসোসের সুরে বলল সামিয়া। যুবক কিছু না বলেই তাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। নিজেও তার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ায়। শাড়িটা মাথায় ঘোমটার মতো পরিয়ে বলল,

“কে বলেছে এই রঙে তোমায় মন্দ লাগে? তার রুচির অভাব বড়। যেখানে এই রূপে তোমায় এক নজর দেখাই আমার জন্য হৃদয়ঘাতক।”

নিজের দিকে ঘুরিয়ে চোখে চোখ রেখে,

“লাল শাড়ি, লাল কাঁচের চুড়ি, এলোমেলো চুলে তোমায় কেমন লাগবে জানো? গ্রীষ্মের মন মাতানো রূপ আর স্বস্তির উৎস লাল বর্ণের কৃষ্ণচূড়ার মতোন, যার ভুবনো মোহিনী রূপে মানব এই ঋতুর উষ্ণতার প্রতি সকল অভিযোগ ভুলে ডুবে যায় অন্য এক ঘোরে।

তুমি আমার সেই ঘোর লাগানো কৃষ্ণচূড়া হবে, প্রেয়সী? যার এক দর্শন আমায় তৃপ্তি দিবে শুধু এই খাঁখাঁ রোদ কিংবা গরমে নয়, সকল সময়ে? সাজবে এই যুবকের একগুচ্ছ সতেজ কৃষ্ণচূড়া?”

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১৪তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
সামিয়া সত্যিই নিজের দেহ আবৃত করে লাল শাড়িতে, হাত ভর্তি কাচের চুড়ি পরে সজ্জিত করে নিজেকে। আবরারের তো দেখেই চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। এতোই মুগ্ধ হয় সে যে আর দাওয়াত খেতে যায় না। আপন মনেই ভেবে উঠে,

“এই অদ্ভুৎ নারীটিকে এই দুনিয়া-জাহান ভুলানো রূপে দেখার অধিকার শুধু মাত্রই আমার। না, অন্য কাউকে আমি আমার প্রেয়সীকে দেখতে দিব না। কখনোই না।”

শামিম অনেকটা জোরাজুরি করেও বন্ধুকে নিতে না পেরে নিজেই এসে খাবার দিয়ে যায়। আবরার খাবার নিয়ে এসে নিজ হাতে মুখে তুলে খায়িয়ে দেয়। সামিয়ার খুব করে না করতে ইচ্ছে করলেও, কোনো এক কারণে সোনা মুখ করে খেয়ে নেয়, হয়তো অজানা এক তৃপ্তি পাচ্ছে সে, জান্তে কিংবা অজান্তেই।

খাবার শেষে ঔষধ খাওয়ার পর আবরার প্লেট নিয়ে চলে গেলে বিছানায় গা লাগাতেই ঘুমে ঢলে পড়ে সামিয়া। আবরার এসে মুচকি হেসে নিজেও তাকে ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে যায়।


সকাল সকাল এর্লামের শব্দ ঘুম ভাঙে আবরারের। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই নীল দেওয়ালের উপর বড় আকারের ঘড়িটায় চোখ আটকে যায়। আজ থেকেই তার জয়েনিং এখানে। তাই সামিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়েই চলে যায় ফ্রেশ হতে।

মূলত সামিয়ার সুস্থতার জন্যই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে চলে আসা। অবশ্য শামিমের সহযোগিতা না থাকলে প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় শিফট্ করা কম কঠিন বা কম সাহসের কাজ নয়। তবে শামিমও এই শহরের বাসিন্দা হওয়ায় তার বাড়িতেই ভাড়াটিয়া রূপে থাকতে পারছে, সব সরঞ্জাম সহ।

আবরার একদম সব ঠিক-ঠাক করে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে ডাক দেয় সামিয়াকে।

“এই যে? উঠো… সকাল হয়ে গেছে আমি হসপিটালে যাব তো।”

বলতে বলতে একটু একটু করে তার মুখশ্রীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে। সামিয়া ঝট করেই উঠে বসে। যুবক তার এমন আচমকা ঘুম থেকে জেগে ধড়ফড় করে উঠে বসায় থতমত খেয়ে যায়। এতোটাই যে তার কণ্ঠে এতক্ষণ কাজ করা মাধুর্যতা ও রোমান্টিকতা সবই হারিয়ে যায়।

“এই যে মিস, সবসময় এমন ভাবে ঘুম থেক উঠেন যেন চোর এসেছে বাড়িতে।”

এ কথায় ভেংচি কেটে যুবতী বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে,

“হুহ! আপনি লোকটা মনে হয় চোর থেকে কম! চোর তো তারপরও জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেলেই স্বস্তি। আপনি কাছে আসলেই আমার দমবন্ধ হয়ে যায়, আর সারাদিন মাথায় এগুলোই ঘুরঘুর করে।”

আবরার খুব কাছাকাছি থাকায় যুবতীর সব অভিযোগই শুনতে পেল। আলতো হাসলো সে। তারপর কিছুই শুনেনি এমন একটা ভাব ধরে জিজ্ঞেস করল,

“কী বললে? ঠিক বুঝলাম না, আবার বল তো।”

“আমি? না, না, আমি কিছুই বলিনি। বলছিলাম আপনি খেয়ে যাবেন না নাস্তা?”

আবরার তার দিকে অনেকটায় ঝুঁকে সামিয়া মুখশ্রী পিছাতে নিয়ে খাটের সাথে মাথা লাগিয়ে ফেলে। রিনরিনে গলায় জিজ্ঞেস করে যুবক,

“এই তোমার শরীর ঠিক আছে তো? একবার বলছো কিছু বলনি, আরেকবার বলছো খাবারের কথা জিজ্ঞেস করছিলে। আসলে তোমার একটা বিশেষ চিকিৎসা লাগবে বুঝলে, একাকিনী? তোমার এই গোলাপজাম অধরের পরশ দিতে হবে প্রতিদিন আমার গালে। তাহলেই না সব ঠিক থাকবে? দাও! দাও!”

সামিয়া তো চোখ জোড়া গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। এতোটাই অবাক হয়েছে সে আবরারের কথায় যে বাকশক্তিই যেন অন্ত হয়ে গেছে। তার দৃষ্টি উপেক্ষা করেই আবরার ডান হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে ঘর থেকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বেরিয়ে যায়।

তার বের হওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাথায় সম্মোহন ভাঙে যুবতীর। সে আপন মনেই কিছু মুহূর্তে আগের ঘটনাগুলো ভেবে হেসে উঠে। মনে মনে বলে,

“এই প্রথমবার কারো কথায় বুনা জালে সম্মোহিতা হলাম আমি। আর এই সম্মোহনকারী লোকটা আপনিই আবরার।”

নিজেও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। প্রথমেই বিছানা গুছিয়ে নেয়, একটু ঝামেলার কাজই। সামিয়ার আগে কখনোই এসব অতটা করতে হয়নি, বাসায় থাকলে কাজের লোক বা নিশা, আর হোস্টেলে থাকতে বেশিরভাগ সে করলেও মাঝেসাঝে নিশাকেই করতে হত। কারণ আলিফা খাতুনের মোটেও পছন্দনীয় নয় বাড়িতে অন্যান্যরা থাকতে তার মেয়ে কাজ করুক। তাই হোস্টেলে থাকতে যেদিন রাতের দিকে আলিফা খাতুন নিশাকে ভিডিও কল করত, শুধু সেদিনই নিশা কাজ করে দিত।

আসলে নিশা মেয়েটার প্রতি সামিয়ার ক্ষোভ বা রাগ নেই, তবে তেমন ভালোবাসাও নেই। মানে কোনো জোরালো অনুভূতিই নেই, পরপর সম্পর্ক অনেকটা। যদিও সে জানে তার জীবনের অধিকাংশ ধাক্কার কারণ নিশা, তবুও মেয়েটার করুণ অবস্থান ও অতীত ভেবে সে চেয়েও রাগ রাখতে পারে না।

কাজ শেষ করে হাত-মুখ ধুঁয়ে রান্নাঘরের খোঁজে বের হয় সে। কাল রাতে এসে নিজেদের ব্যক্তিগত কামরা থেকে বেরই হওয়া হয়নি তার। ভাবতেই পুরো ফ্লাট ঘুরঘুর করে দেখতে শুরু করে।

“ইশ! কী সুন্দর ছোট্ট বাবুই পাখির ঘর আমার, আমার সংসার! ঠিক যেমন ছোটবেলায় পুতুলের সংসার সাজাতাম তেমন।”

কথাটা বলার সময় আলাদা এক ভালো লাগা অনুভব করে সামিয়া, তার মুখটা সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই ফ্লাটটি খুব একটা বড় নয়। মাঝারি সাইজের একটা বেডরুমের সাথে এটাচ বাথরুম ও মোটামোটি চলনসই বারান্দা, রান্নাঘর, বেশ ভালো ড্রইংরুম কাম ডাইনিংরুম স্পেস। সবমিলিয়ে সামিয়ার ছোটখাটো নয়া সংসার।

আবরারের তৈরি রুটি-ভাজি খেয়ে সেও লেগে যায় দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে লেগে যায়। হোস্টেলে থাকার দরুণ টুকটাক রান্নাবান্না তার জন্য সহজসাধ্য বিষয়। কিন্তু ফ্রীজ খুলতেই নাক কুচকে যায়। ডিপে এক পোঁটলা গরুর গোশতের, আর নর্মাল কম্পার্টমেন্টে একটা পেপে, এক পোঁটলা কাঁচা মরিচ, লেবু ও সস সহ টুকটাক উপাদান রাখা। আর কিছুই নেই। এদিকে সামিয়ার তো গরুর গোশত তেমন পছন্দ নয়। কিন্তু কী করার, অগত্যা গরুর গোশত ভুনা করে, আর পেপে-আলু ভাজি করে নেয়।

জীবনে প্রথমবার একাহাতে সবকিছু করে ঘেমে নেয়ে গেছে যুবতী। নিজের গায়ের কিছুটা গন্ধ শুকতেই নিজেই চোখ-মুখ কুঁচকে বলে উঠে,

“ছিঃ! কী বিচ্ছিরি ভ্যাঁপসা গন্ধ!”

চট করে গোসলে ঢুকে সে। গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরছে সামিয়া। নীল ফুলের প্রিন্টের শাড়ি। শাড়িটা সফট্ সিল্ক হওয়ায় একদম গায়ের প্রতিটি ভাজে ভাজে এঁটে আছে।

শাড়ি পরে নিজেকে টুকটাক অলঙ্কৃত করতে বসে সে। এর আগে কোনোদিন একরাশি নীল কাজল বৈকী কোনো সাজসজ্জাতেই মন টানেনি তার, এমন কী আয়নার সম্মুখে এতটা তৃপ্তি আর আগ্রহ নিয়েও কোনোদিন বসেনি। কিন্তু আজ নিজেকে সাজাতে, আয়নায় দেখতে বেশ লাগছে তার।

দুই আঁখি নীল কাজলে রাঙিয়ে, ঠোঁটজোড়ায় হালকা গোলাপি বর্ণের লিপবাম দেয় সে। তারপর একটুখানি আতর গায়ে মাখিয়ে হাত ভর্তি নীল মেটেলের চুড়ি পরে।

এমনসময় কলিংবেলের শব্দ। নীল মেটেলের চুড়ির দ্বারা ঝনঝন শব্দ তুলতে তুলতে দরজা খুলতে অগ্রসর হয়।

নতুন জায়গায় ভরা দুপুর বেলায় কারো আগমনে একটু উদ্বিগ্নই হয় সামিয়া। খুলবে না কি খুলবে না ভাবতে ভাবতেই দরজার কাছেই এসে পড়েছে। কী-হোলে চোখ রাখতেই দেখে আবরার এসেছে। হাসি মুখেই দরজা খুলে সামিয়া।

আবরারের মাথায় হাজারো দুশ্চিন্তা ভর করে আছে। এক ছোট্ট মেয়ের কেস এসেছে হাসপাতালে, খুবই করুণ অবস্থা, মাত্র নয় পার্সেন্ট বাঁচার চান্স আছে। বিকেলে তারই সার্জারি করতে হবে আবরারকে। এই চিন্তিত মুখেই সামনে তাকায় যুবক।

হুট করেই একঝাঁক চক্ষু শীতল বাতাস ও স্নিগ্ধ কিরণ যেন সে দেখল। সকল দুশ্চিন্তা, দ্বিধা, ভীতি যেন আড়াল হল সেই স্নিগ্ধতার মাঝে। এই শীতলতা আর কারো নয় তার প্রেয়সীর, তার একাকিনীর। আজই প্রথম গোটা নীলসাগর সাজে আবরার দেখল তাকে। আর চোখ ফিরানোই যেন দায় হয়ে গেল তারপর।

আবরারকে শীতল চাহনিতে সম্মোহিত ব্যক্তির ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় নুয়ে পড়ে সামিয়া। খাণিক গলা উঁচিয়ে বলে,

“এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? ঘরে আসবেন না?”

“হুম।”

মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানিয়ে আবরার চলে যায় ফ্রেশ হতে। মুখে পানির কয়েক ঝাপটা দিয়ে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে ফিসফিসিয়ে বলে,

“প্রকৃত রূপসী নারী কিংবা সুদর্শন পুরুষ তো সেই যে হাজারো দুশ্চিন্তার মাঝে একঝাঁক স্নিগ্ধতার তীর ছুঁড়ে শীতল করে দিতে পারে মন-মস্তিষ্ক।”

আবরার খাবার খেতে টেবিলে বসেছে, সামিয়া তরকারির পাতিল আনতে তখনই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। সামিয়ার বিরক্ত লাগলেও তা মুখে না এনেই আবরারকে ইশারায় বসতে বলে সদরদরজা খুলতে যায়। গতকালের সেই সুন্দরী নারীটি এসেছে ট্রে হাতে, সে ঘুমের চোখে বেশ অস্পষ্ট ভাবেই দেখেছিল এই নারীকে।

আবরার মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে হেসে প্রশ্ন করে,

“আরে রওজা তুমি?”

রওজা মেয়েটাও বেশ লজ্জা লজ্জা হাসি দেয় বিপরীতে। গ্রামের বউরা স্বামী বহু বছর পর ভিন দেশ থেকে আসলে যেমন হাসি দেয় ঠিক তেমন হাসি। সামিয়ার বিষয়টা ভালো লাগল না, তবুও হাতে হাত চেপে নীরব থাকল।

“কী করব বল? তোমাকে বাহিরের খাবার খায়িয়ে বা না খায়িয়ে তো আর খেতে পারি না, তাই খাবার নিয়ে আসলাম। আমি তো জানি তোমার ঢাকার বউ কোনো কাজ পারে না।”

কথাটা সরু চোখে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত হয়েই বলল। সামিয়া চোখজোড়া নত করে ফেলেছে। চোখজোড়া মৃদু জ্বলছে কেন বুঝতে পারছে না সামিয়া, তার কি খারাপ লাগছে রওজার কথা? হয়তো।

রওজা পুনরায় বলল,

“কী হলো? খাও!”

আবরার একপলক টেবিলে তাকিয়ে দেখে কোনো খাবার নেই। সে ভাবে হয়তো সামিয়া রান্না করেনি, তার ধারণা সে রান্নার কিছুই জানে না। কারণ সামর্থ্যবান পরিবারের একমাত্র মেয়ে এসবে পটু না থাকাই স্বাভাবিক। সে তাই দেরি না করে রওজার হাতের ট্রেটা নিয়ে টেবিলে রাখে। প্লেট দুটোর থেকে ঢাকনা উঠিয়ে দেখে মুরগির ঝাল কারি আর সাদাভাত।

“সামিয়া খেতে বসো।”

বলে সে খাওয়া শুরু করে দেয়। সামিয়া ছলছল চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,

“আমি পরে খাচ্ছি। কিছু কাজ আছে বেডরুমে।”

সামিয়া সেই মুহূর্তেই স্থান ত্যাগ করে। বারান্দায় এলোমেলো অর্ধ ভেজা চুল নিয়ে বসে নিচু গলায় আবৃতি করতে শুরু করে ঈপ্সিতা শিকদারের লিখা কবিতা,

“সেই নিস্তব্ধ সন্ধ্যা বেলায় দেখেছিলাম তোমায়,
চোখে চোখে মোদের কথা হলো,
তবে প্রেমটা ছিলো কোথায়?

সেই গৌধূলী লগ্নে দুজন চেয়েছিলাম দুজনাকে,
মনে মনে তো জুড়ে গেলাম এক সুতোতেই,
তবে প্রেমটা ছিলো কোথায়?

সব ব্যস্ততাকে ভুলে ডুবেছিলাম নয়নজোড়ার মাঝে,
একে অপরের মাঝেই থাকতে চেয়েছিলাম,
তবে প্রেমটা ছিলো কোথায়?

তোমার সাথে হলো কথোপকথন হলো চিঠির লেনাদেনা,
হাতে হাতটি রেখে সেদিন পথ চললে,
তবে প্রেমটা ছিলো কোথায়?

তোমার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে দিলাম আমি প্রতিশ্রুতি,
আমি রাখলে তুমি তা ভুলে অন্য পথেই গেলে,
তবে প্রেমটা ছিলো কোথায়? -ঈপ্সিতা শিকদার”

তারপর হঠাৎই উন্মাদের মতোন হেসে উঠে, সেই হাসির কলরবে যেন সারা ঘর নেচে উঠছে। সিক্ত চোখে বিষাদ গলায় বলে উঠে,

“তুমি কেন বারবার নতুন আশা দেও আমায় কাব্য, বল তো? তুমি তো কোনোদিনই প্রকৃতার্থে আমায় ভালোবাসার নয়, তবে কেন মিথ্যে স্বপ্ন দেখাও? আমি তো জানি আমি তোমার যোগ্য নয়। তুমি শুধু আমার কল্পনাতেই আমায় ভালোবাসতে পারো, বাস্তবতায় নয়। তবুও বারবার আমাকে এই জানা কথাটি ভুলে যেতে বাধ্য করে আবার মনে করিয়ে দেও। আমার ক্ষতটা বারবার সতেজ করতে ভালো লাগে তোমার? কী যানি কেন করো? কিন্তু বিশ্বাস করো আমি শেষ হয়ে যাই তোমার এই কার্যে।”

আবরার খেয়ে-দেয়ে নিতেই রওজা বিদায় হয়। যুবকও হাফ ছেড়ে বাঁচে।

“মেয়ে তো নয়, একদম চুয়িংগাম!”

বিরক্তির সুরে বাক্যটি উচ্চারণ করে বেডরুমে ঢুকতেই সামিয়ার সাথে ধাক্কা খায় সে। চোখ তুলে কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে কিন্তু সামিয়াকে দেখে কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। কিছুটা অভিযোগে, কিছুটা রাগে এবং কিছুটা ক্ষোভে ভরপুর চাহনি। সামিয়া যে চোখের নীল কাজল ছাড়া সব সাজ ছাড়িয়ে নিয়েছে, অর্ধভেজা এলোমেলো চুলগুলোতে বেশ সময় নিয়ে ডুবার ইচ্ছে ছিল আবরারের, কিন্তু পঁচা মেয়েটা চুলগুলোও বেধে নিয়েছে।

সামিয়া আবরার কিছু বলবে বুঝেও তাকে অবজ্ঞা করে রান্নাঘরে চলে যায়। আবরার তার পিছনে গেলে দেখতে পায় পাতিলে একটু খানি রেখে প্রায় এক বড় বাটিতে গরুর গোশত ভুনা ভরছে সামিয়া। যুবক তো অবাক, গরুর গোশত এলো কোথা থেকে? দেখেই তার জিভে জল চলে আসছে।

দেরি না করেই জিজ্ঞেস করে ফেলল,

“এগুলা কই নিয়ে যাচ্ছো? আর কে দিল?”

“আমিই রান্না করেছিলাম দুপুরের জন্য। আর কই নিয়ে যাচ্ছি তা এখনই দেখতে পাবেন।”

বলতে বলতেই আবার কলিংবেল বেজে উঠে। আবরার যায় গেট খুলতেই দারোয়ানকে দেখতে পায়। সে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই সামিয়া এসে তিনটা বড় বড় বক্স ধরিয়ে দেয় লোকটাকে। মধ্যবয়স্ক লোকটি তথা নাদিম মিয়াও পানের লাল দাঁত বের করে হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে যায়।

আবরার অবাক চোখে তা দেখে বলে,

“তুমি উনাকে কই পেলা?”

সামিয়া নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয়,

“আমি বারান্দায় বসেছিলাম। উনি এসে জিজ্ঞেস করলেন আমি নতুন ভাড়াটিয়ার বউ কিনা… তো আমি হ্যাঁ বলতেই জানালেন উনি এই বাড়ির দারোয়ান, আর সামনেই উনার বউ-মেয়ে নিয়ে থাকে। তাই ভাবলাম এতগুলো গোশত না ফেলে উনাকে দিয়ে দেই।”

“তুমি রান্না করেছিলে আমাকে বললা না কেন?”

“বললেও কি খেতেন, আমার হাতের খাবার তো, আমার হাতের মতোন বিশ্রীই হতো, তাই না? তাছাড়া আপনার খাওয়ার জন্য আরও ভালো ব্যবস্থা করাই ছিল। আচ্ছা, আপনি রেস্ট নিন ঘরে যেয়ে।”

বলে তাকে বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই আবার রান্নাঘরে ঢুকে সামিয়া। কথাগুলো বলার সময় সামিয়ার গলা কেঁপে উঠছিল, তবুও নিজেকে স্বভাবিক রাখার অপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। থালা-বাসন ধুঁয়ে, এক প্লেট ভাত ও ভাজি, তরকারি নিয়ে খেতে বসে সে। যদিও খেতে ইচ্ছে করছে না, তবুও খাবারগুলো নষ্ট হবে ভেবে কিংবা পেটের তাড়নায়ই খেয়ে ফেলে। এই গরমে খাবার পেটে যেতেই ক্লান্তি ছেয়ে যায় সারা দেহে।

এদিকে আবরার ছটফট করছে বেডরুমে। সামিয়ার গলায় সে অভিমান ও ক্ষোভের আভাষ পেয়েছে আবরার। সবমিলিয়ে নিজ ভাবনাতেই ডুবে সে,

“মেয়েটা কি আমার উপর রাগ? আমি না জেনেই রওজার খাবার খেয়ে ফেলায়? না কি রওজার খোঁচানো কথা শুনে আবার হতাশা জুড়েছে ওর সাথে? আমারই উচিত ছিল রওজাকে স্পষ্ট জবাব দেওয়ার। কিন্তু আমিই বা কী করতাম। শামিমদের বাসায় থেকে ওরই বোনকে কিছু বললে ব্যাপারটা কেমন দেখায়। উফঃ! কী এক জ্বালা!

আমি এখন মেয়েটার রাগ কী করে ভাঙাব এখন? ওর মানসিক যেই অবস্থা এই ঘটনাটা সহজ হলেও মনে হয় না ও সহজ ভাবে নিয়েছে। এখন কি ও আগের মতোন আর মিশবে আমার সাথে? ওর রান্নার ব্যাপারে কমেন্ট নিশ্চয়ই ওর আত্মবিশ্বাসকে হার্ট করেছে?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here