প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:১০+১১

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১০ম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
আবরার তাড়াহুড়ো করে কোনোরকম নিজের কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরে ঢাকা যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। সায়রাজ কবির কল করেছিলেন সামিয়া না কি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঢাকা ফিরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাসপাতালে যায় সে।

সায়রাজ কবির করিডোরে দাঁড়িয়ে নার্সের সাথে কথা বলছে। তখনই আবরার এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে,

“আঙ্কেল, সামিয়া কোথায়? ও ঠিক আছে তো?”

সায়রাজ কবির খেয়াল করলেন দুপুরের টগবগানো রৌদ্রে ছেলেটা ঘামে নেয়ে চেহারার অবস্থা কাহিল করে ফেলেছে। পাশেই একটা পানির ফিল্টার রাখা সাথে গ্লাসও দেওয়া। সেখান থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে তা আবরারকে পান করতে ইশারা করে উত্তর দেন,

“হুম, এখন মোটামোটি ভালোই।”

তারপর দু’জনে যায় সামিয়া চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকা ডাক্তারের কেবিনে। দুপুরের সময়, শামিম হাসান নিজের খানাপিনায় ব্যস্ত। স্ত্রী তার জন্য আজ বেশি করে ঝাল দিয়ে গরুর গোশতের রেজালা আর ঘিয়ে ভাজা পরোটা পাঠিয়েছে। ভোজন প্রিয় শামিম হাসান তা চেটেপুটে খাচ্ছে।

খাবারের আনন্দ নেওয়ার সময় রোগীর লোকদের আসতে দেখে বেশ বিরক্তই হন তিনি। তারপর বুড়ো আঙুলে লেগে থাকে ঝোল টুকু চাটতে চাটতে বলেন,

“আমি জানি আপনারা কী জন্য এসেছেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন আপনার মেয়ের কেসে আমার কিছুই করার নেই, শুধু আমার কেন কোনো ডাক্তারেরই কিছু করার নেই।”

শামিম হাসানকে এভাবে দেখে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। সে কিছুটা শুচিবাইগ্রস্ত বটে। তাই অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“সরি… বুঝলাম না, কী বলতে চাচ্ছেন?”

“মানে খুব সোজা। আমি যতটা সামিয়ার কেস স্টাডি করে বুঝেছি মেয়েটার ভালোবাসা লাগবে, যত্ন লাগবে আপন জনের; তা তো আর ডাক্তার দিতে পারবে না। মেয়েটা পর্চণ্ড একাকিত্ব অনুভব করে, যার জন্যই ডিপ্রেশন। সেই একাকিত্ব দূর করার কোনো মানুষ নেই।

এজন্যই তো তার কাব্য নামক কাল্পনিক চরিত্রের আগমন দরকার হয়। এজন্যই সে ঔষধ খায় না। আর ঔষধ খায় না বলে প্রোপার ঘুম হয় না, তাই আজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার সুস্থ হওয়ার কোনো চান্স নেই, কারণ আপনাদের কোনো এফোর্টই নেই।।”

আবরারের প্রচণ্ড অপরাধবোধ হলো। সে কার সাথে অভিমান করে তাকে একা করে দিয়েছিল, যে আগে থেকেই এতোটা একাকিত্বে ডুবে, যার মাঝে এসব প্রেম বা ভালোবাসা বোধ নয় কাজে করে শুধু সঙ্গী হীনতা বোধ।

ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে সে শুধালো,

“এভাবে বলবেন না স্যার। কোনো তো উপায় থাকবে ওকে স্বাভাবিক করার। আমাকে বলেন, আমি সবকিছু করতে রাজি।”

শামিম হাসানের বয়সের ছাপ পড়া চেহারায় আলতো হাসি। কেন যেন আবরারের এই হাসি উপহাসের মনে হচ্ছে। রাগে কিছু বলতে যেয়েও বলল না।

“শুনো ছেলে, এসব বলা অতি মাত্রায় সহজ, করা ততোটাই মুশকিল। ঢাকায় প্র্যাক্টিস করছো তা-ই না? ঢাকা ছাড়তে হবে। এখানে সামিয়ার বিষাক্ত সব অনুভূতি এবং স্মৃতি জুড়ে আছে, যা পদে পদে তাকে দংশিত করে।

এমন কোনো জায়গায় যাও যেখানে সে মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে পারে। এতে তার অনুভূতি শূণ্যতা দূর হবে, স্বাভাবিক মানুষদের মতোন মুগ্ধ হবে, উত্তেজিত হবে।

এখানের সাথে সম্পর্কটা মিটিয়ে ফেল। তার একটা কাঁধ প্রয়োজন ভরসা করে মাথা রাখার জন্য, মন প্রয়োজন তাকে বুঝার জন্য। যদি সেই মন আর কাঁধের অধিকারী তুমি হতে পারো, তবে অদূরেই সামিয়া আর আট-দশটা সাধারণ মেয়ের মতো হয়ে যাবে।”

আবরার নিজেকেই প্রশ্ন করে উঠে,

“সত্যি তো! নিজের চাকরি-বাকরি, বন্ধু-বান্ধব রেখে যেতে পারব আমি দূরে, শুধু এই মেয়েটির জন্য?”

___

সারা রেস্টুরেন্টের মানুষের দৃষ্টি নিশার মাঝে স্থির। একটু আগেই নিশা একজন অতিব ভদ্র এবং হাবাগবা চেহারার যুবককে ঠাশঠাশ দুটো চড় লাগিয়েছে। যুবকটা তবুও মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। নিশা পুনরায় চেঁচিয়ে বলে,

“তুই করতে চাস আমাকে বিয়ে? সামান্য এই রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার মুরোদ নাই, সে করতে আসছে আমাকে বিয়ে। নিশাকে বিয়ে! হাহ্!”

যুবক তথা অহন এবার মাথা উঁচু করে তার চোখে চোখ রাখলো। ছেলেটার ফর্সা মুখশ্রীতে গোলাপি আভা ছেয়ে আছে, চশমায় ঢাকা চোখ দুটোও অসম্ভব লাল। বলল,

“এভাবে বোলো না। আমি তো চেষ্টা করছি একটা চাকরি পাওয়ার। খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবও।”

বস্তুত অহন সম্পর্কে নিশার বয়ফ্রেন্ড বা সাধারণ বাংলায় প্রেমিক বলে যাকে। অহনের সাথে নিশার সাক্ষাৎ ফেসবুকে। এরপর স্কুলে না যেয়ে একদিন অহনের কলেজের সামনে উপস্থিত হয় নিশা। প্রচণ্ড সরল, সাদামাটা এবং যত্নশীল এক ছেলে। বলতে গেলে এই সবকিছুতেই মন আটকে গিয়েছিল নিশার।

কিন্তু আজ যখন সে অনেকটাই বাস্তববাদী অথবা তার কাছে এখন যেহেতু টাকার মূল্যায়নটাই বেশি তখন আর অহনকে তার নিজের জন্য সঠিক মনে হয় না। কারণ যুবক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, তার উপর বেকার।

“চাকরি তো না ছেলের হাতের মোয়া বললেই পাবা! হুহ! চাকরি হওয়া এত সোজা কথা না। আর তোমার তো টাকাও নেই, আবার বাপ-দাদার জোরও নেই। সো আমি আর এই সম্পর্ক আর কন্টিনিউ করতে পারব না।”

বলেই অহনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের ব্যাগ তুলে বেরিয়ে যায় নিশা। অহন এক ঝটকায় চোখ থেকে চশমা ছাড়িয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। তার চোখজোড়া রক্তিম, তবে তা কষ্টে না রাগে? এর পরিণামই বা কী? পৃথিবীর কোনো জীব জানে না, একমাত্র অহন ছাড়া।

নিশা রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা বাসায় ফিরে, তারও কষ্ট হচ্ছে। তবুও তাতে ধ্যান দিচ্ছে না, নিজেকে সামলিয়ে নিচ্ছে সবটুকু দিয়ে। কেন না, সে জানে যে এই ব্যথাটা সাময়িক তবে সম্পর্কটা না ভাঙলে তার পরিণতি হত স্থায়ী।

আলিফা খাতুন চিন্তিত হয়ে বসে আছেন একটু আগেই তার বোন কল দিয়ে কান্নাকাটি করেছেন নিজের ছেলের দুর্দশা নিয়ে। আলিফা খাতুনের বোন মনসুরা খাতুনের টাকা-পয়সার অভাব নেই, কিন্তু ছেলেটা নেশা করে। এ নিয়েই যত ঝামেলা, ছেলেটার বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, ভালো ঘরের মেয়েরা কী আর এসব দেখে আসবে!

তার ভাবনার মাঝেই বাড়িতে প্রবেশ করে নিশা। হুট করেই তার মস্তিষ্কে এক পরিকল্পনা এসে পড়ে।

“নিশা, এদিকে এসে বস। তোর সাথে একখান কথা ছিল। ”

নিশা ম্লান মুখে বলে,

“হুম, বলো।”

“মনোয়ার রে চিনোস না? তোর মনসুরা খালার ছেলে যে? ভাবছি ওর সাথে তোর বিয়ে দিব। ছেলেটার টাকা-পয়সা ভালো, চেহারাও মন্দ না। বয়সটা একটু বেশি এই আর কী…”

মৃদু হাসে নিশা। সে এই মহিলাকে চিনে। প্রথম প্রথম নিশা ভাবতো সে তাকে পেটের মেয়ের মতোনই ভালোবাসে। কিন্তু ধীরেধীরে বুঝতে পেরে আলিফা খাতুন শুধুই তাকে আশ্রিতা আর এতিম ভেবে সহানুভূতি দেখায়, মমতা অনেক মহৎ বিষয়, সেটা নিশার প্রতি উনার নেই।

বড্ড স্বার্থপরও তিনি, নিশাকে আদর-যত্ন করার দ্বিতীয় কারণ ছিল তার অনুপস্থিতিতে সামিয়ার উপর চোখ রাখা। এজন্যই সামিয়ার প্রতি চাপা ঈর্ষা, ক্ষোভ জমে আছে নিশার।

নিশা কি পারতো না সামিয়ার জায়গায় থাকতে? তারও একজন ধনী বাবা থাকতো, অনেক মমতাময়ী ও যত্নশীল মা থাকতো, তাহলে কী এমন হয়ে যেতো? সে জানে মনোয়ারের বখাটেপমা সম্পর্কে। এবারও এই নারী নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চাইছে তার দ্বারা।

তার ভাবাভাবির মাঝেই আলিফা খাতুন উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে পুনরায় প্রশ্ন করে উঠে,

“কী রে! কী এত ভাবছিস?”

“না, কিছু না। ভেবে বলছি।”

___

আবরারের ঘুমের ঘোরেই গরম অনুভব হচ্ছে, যেমন তেমন গরম নয় একদম আগুন গরম। প্রচণ্ড কষ্ট চোখের পাতা মেলে সে। দেখতে পায় সামিয়া তার গায়ে লেপ্টে আছে। যুবকের এবার বুঝতে যুবতীর গায়ের উষ্ণতাই বোধ হচ্ছিল এতক্ষণ। তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ে সে। কেবিন থেকে বের হয়ে ওয়ার্ড বয়কে জানায়।

খাণিক বাদেই একজন সামিয়ার চেকআপ করে জানায়,

“সামান্য জ্বর, ঠিক হয়ে যাবে। আমি ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি, আগামীকালই রোগীকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।”

আবরার ক্লান্তির ভঙ্গিমায় তাকে ধন্যবাদ জানায়। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। সামিয়ার গায়ে চাদর জড়িয়ে সে ক্যান্টিনের দিকে যেতে লাগে।

এক কাপ কফির বড় দরকার এখন, একে তো সেই কক্সবাজার থেকে জার্নি করে এই হসপিটালে এসেছে, আর এসেই দৌড়াদৌড়ি, তার উপর এখন আবার কাঁচা ঘুম ভেঙে গেছে। সবমিলিয়ে মাইগ্রেনের ব্যথায় অবস্থা খারাপই তার।

এক কাপ কফি তৈরি করে কেবিনে ফিরার পথেই ভয়ে শেষ সে। এমনিতেই তার জ্বিনের ভয় প্রচুর, আবার আছে হাসপাতালে, হাসপাতাল সম্পর্কিত সব ভৌতিক গল্পগুলো কানে ভাসছে। বেশ কিছুক্ষণ পথে দাঁড়িয়ে থেকে এক দৌঁড়ে চলে যায় কেবিনে। কেবিনে ফিরেই হাঁপাতে হাঁপাতে সামিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে এবং ঘুমের দোয়া ও তিন ক্বূল পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়।

সামিয়ার কিছুটা ঘুম কাঁচা হতেই ভার ভার লাগে। চক্ষু খুলে তাকাতেই বিস্মিত হয় যুবতী। যুবক যে একদম ছোট্ট শিশুর মতো বুকে মাথা রেখে ঝাপটে ধরে শুয়ে আছে তাকে। লজ্জায় রাঙা হয়ে আবরারকে এক ধাক্কা দিয়ে ছোট পেশেন্ট বেড হতে ফেলে দেয় সামিয়া।

আবরার আচমকা ব্যথা পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ফ্লোরে। সামিয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। গালটা যেন উষ্ণ হয়ে উঠছে তার। লাল আভাও কি ছেয়েছে? লোকটা কি তবে বুঝতে পারছে তার জন্য লাজে রাঙা যুবতী? এসব কিছুই বারবার ভাবাচ্ছে সামিয়াকে, পুলকিত করছে তার গোটা হৃদয়কে, দেহকে।

“একাকিনী, এভাবে লজ্জা রাঙা হইয়ো। ক্ষতি হবে তোমারই এতে, তখন আবারা বোলো না কিছু এই অধমকে। বড্ড লাগে এখানটায়, বিশ্বাস করো। মন চায়, এক ঝটকায় ছুঁয়ে দেই ঐ কপোল, ঐ ললাট, ঐ চিবুক। নীল কাজল লেপ্টানো নয়ন জোড়ায় ডুবিয়ে ফেলি নিজেকে। নিজের মনের সব যন্ত্রণা, বিষ ঢেলে ঐ অধরসুধায় মুক্তি দেই নিজেকে।

এতটাও সাধু পুরুষ নেই আমি যে সর্বক্ষণ সামলে রাখবো নিজেকে নিজের সঙ্গিনী হতে। এমনেই বড় মুশকিল আমার জন্য তা। তুমি আর মুশকিল কোরো না।”

শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিনরিনে গলায় এই রোমাঞ্চকর কথাগুলো বলেই চোরের মতো কেবিন ছেড়ে পালালো আবরার। সামিয়ার মনে হচ্ছে সে এবার লাজে আরও বেশি উষ্ণ হয়ে উঠছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি তার মন তাকে বারবার প্রশ্ন করছে,

“সত্যিই কি আমায় লজ্জা পেলে এতোই মধুর রমণী লাগে? এতোই মনরোমা লাগে দেখতে এই একাকিনীকে?”

___

আজ নিশার বিয়ে। হ্যাঁ, নিশা মনোয়ারের সাথে বিয়ে হওয়ার জন্য নিজের সম্মতি দিয়ে দিয়েছে। অবশ্য দিয়ে দিয়েছে না কি দিতে বাধ্য হয়েছে এও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তবে এই প্রশ্নে গুরুত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই আনন্দে সরব এই ভরা মজলিসে।

নিশা দুয়েক বার চেয়েছিল এই বিয়েতে না করতে। এজন্য একবার আলিফা খাতুনের নিকট যেয়েও বলেছিল,

“শুনলাম, মনোয়ার ভাই না কি নেশা করে, আবার খারাপ স্বভাবও আছে। তাই বলছি…”

“আরে ওসব কিছু না। বিয়ে করলে ঠিক হয়ে যাবে। আর তুইও তো কোনো জান্নাতের হুর না, বাপ-মা ছাড়া এক মেয়ে ওরা না নিলে কে নিবে তোকে? তাই বাজিয়ে বিয়েটা করে নে।”
মধ্যবয়স্ক নারীর তেজস্বী কথায় বুঝে যায় বিয়েতে মানা করলে এই বাড়ি ছাড়া হলেও হতে পারে তাকে।

হুজুগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বভাব নেই নিশার। তাই অনেক ভাবনা শেষে এই বিয়ে করবে বলেই ঠিক করে। বাড়ি হারা হওয়ার চাইতে, টাকা-পয়সা সহ স্বামী বা সংসারের সুখ ছাড়া থাকাই তার কাছে শ্রেয় মনে হয়।

নিশার বড়লোক শাশুড়ি তার জন্য বাংলাদেশের সুনামধন্য এক পার্লারে দেড় লাখ টাকার ওয়েডিং মেকওভার বুক করেছে। সেখানেই এসেছে সে। ভাগ্যের নির্মম সত্য, এমন একটা দিনেও তার পাশে কেউ নেই, অবশ্য কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়েছে। একাই উবার নিয়ে বাড়ি ফিরতে বলা হয়েছে তাকে। এত টাকার ভারী সাজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে সে উবারের অপেক্ষায়।

এমন সময়ই তার সামনে একটি মাইক্রো থামে, দরজা খুলে এক ঝটকায় ভিতরে নেওয়া হয় তাকে। সে কোনো প্রতিক্রিয়া তার দেখানোর আগেই তার নাকে চেপে ধরা হয় ক্লোরোফর্ম ভর্তি রুমাল। অন্ধকার নেমে পড়ে নিশার চোখের সামনে।

চোখ খুলতেই নিজেকে বেশ ধুলোময় একটা ঘরের মেঝেতে আবিষ্কার করে নিশা। বেশ ভয়ে ভয়ে আছে সে। এমন সময় এক পুরুষ প্রবেশ করে সেই ঘরে, মুখটা তার রুমাল দিয়ে ঢাকা। লোকটা যত কাছে এগুচ্ছে, নিশা ততোই পেছাচ্ছে। দেয়ালে গা আটকে যায় যুবতীর। ভয়ে ভয়ে কিডন্যাপারের দিকে তাকায় সে। লোকটা তার দিকে হাত বাড়াচ্ছে দেখেই মনে মনে ভাবে,

“আজ বুঝি আর বাঁচোন নেই। সর্বনাশটা আমার আজ হয়েই যাবে।”

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||১১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
তাকে অবাক করে লোকটা তার শাড়ির আঁচলে হাত না লাগিয়ে, তার গাল চেপে ধরে। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে সে। নিশা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে, চোখ দিয়ে তো অশ্রু ঝরছেই।

“প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমার জুয়েলারি, টাকা-পয়সা সব রেখে দিন, কিন্তু আমায় ছাড়ুন। কী ক্ষতি করেছি আমি আপনার?”

বলতেই লোকটা নিজের মুখের রুমাল এক টানে খুলে ফেলে। নিশা হতবাক, এতোটাই যে কান্নাও থেমে গিয়েছে। থমথমে চেহারায় বলে উঠে,

“অ-অহন তুমি…? তুমি আমাকে তুলে এনেছো?”

অহনের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি, কিন্তু এ হাসি সুখের বা দুঃখের নয়, বরং পৈশাচিক এক হাসি। নিশার কেন যেন ত্রাশ বোধ হচ্ছে হাসি দেখে, আতঙ্কে ঠোঁট, গলা, কলিজা সব শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিশার গোলাপি আভা ছেয়ে থাকা তীক্ষ্ম নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অহন হাত দিয়ে নাকের ঘাম টুকু মুছে রিনরিনে গলায় বলে,

“কী ভেবেছিলে জানেমান, আমি এভাবেই ছেড়ে দিব তোমায়? নো, নট এট অল। অহন দেলওয়ার এত সহজে কোনো ধোঁকাবাজকে ছাড় দেয় না। টাকার জন্য আমাকে ছেড়েছিলে না? এই অহনের ওয়াদা তোমাকে সর্বস্বান্ত না করে আমি থামছি না।”

“অহন ত-তুমি কিন্তু এসব ঠিক করছো না। আমার মামনি জানলে তোমার…”

“এই অহন দেলওয়ারের সামনে টিকার ক্ষমতা এই গোটা কেরানিগঞ্জে কারো নাই।”

নিশা ভয়ের মাঝেও আশ্চর্যান্বিত হয়। সামান্য এক গরীবের ছেলের এত দম্ভপ্রকাশ? এ সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। অহন নিশাকে ছেড়ে যেতে নিলেই কিছু একটা ভেবেই আবার তার গাল জোরে চেপে ধরে।

“ওহ, জানেমান, তোমাকে তো একটা গুড নিউসই দেওয়া হলো না। আজ থেকে তুমি এই এক কামড়ার ঘরেই থাকবে। গরীবের ঘর, বুঝলে তো। খাট-পালঙ্ক ছাড়া ময়লা মেঝেতে ঘুমাবে, ঝাড়ু আছে তাই চাইলে অবশ্য পরিষ্কার করে নিতে পারো। আর হ্যাঁ এসির বাতাস, এলিডি লাইট ভুলে যাও। এখন থেকে ঐ ছোট সিলিং ফ্যানের বাতাসে আর এই হারিকেনের আলোয় থাকতে হবে।”

নিশার চিবুক ধরে মুখ উঁচু করে ফুঁ দিয়ে,

“ইশ্! আমার জানেমানের মুখটা একদম ছোট হয়ে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চয়ই? ঐ যে আলু, কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ নিয়ে এসেছে, সাথে মোটা চাল। হাতের বামে রান্নাঘর রেঁধে খেয়ে নিয়ো। কী করব বলো আমার তো আর তোমায় বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোর মুরোদ নেই, তাই এই কম পয়সার আহারই খেতে হবে তোমায়।”

বলে শিস বাজাতে বাজাতে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করে সে। নিশা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সব ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে দৌঁড়ে যেয়ে অহনের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল যুবতী।

“আমাকে প্লিজ ছেড়ে দাও অহন। তুমি তো জানো আমি এসব কাজ পারি না। তুমি না আমায় ভালোবাসো, তাহলে আমায় কষ্ট কী করে দিতে পারো?”

যুবক প্রেমময় চাহনি নিয়ে উঠে দাঁড় করালো নিশাকে। নিশা খুশি হলো ভেবে যে এবার বুঝি মন গলেছে ছেলেটার। সেই সাথে এও পরিকল্পনা করে নিল যে এখান থেকে বের হয়েই জেলে ভরবে অহনকে।

কিন্তু তাকে আরেক দফা বিস্মিত করে অহন হো হো করে হেসে উঠলো।

“বাব্বাহ! আজ আবার আমার ভালোবাসার কথা মনে পড়ে গেল। তুমি নারীও না, বড় সেয়ান। যাকগে জানেমান, তোমায় কষ্ট দিচ্ছি না তো, তোমার কর্মের পরিণতি দিচ্ছি।”

নিশা এবার আর নিজের রাগে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না।

“ইউ বাস্টার্ড” বলে চড় মারতে নেয় অহনকে। যুবক তার হাত মুচড়িয়ে পিঠের সাথে লাগিয়ে শান্ত কিন্তু চাপা রাগের সুরে শুধালো,

“না, না, জান। ভুলেও এই কাজ কোরো না। নাহলে কিন্তু হাত আর হাত থাকবে না এবার।”

নিশাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে যুবক বাহিরে চলে যায়। নিশা রাগে, অপমানে, দুঃখে, ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। তবে তাতে কী কারো কিছু আসে যায়? না কি আসে যায় অজান্তেই, অগোচরেই?

___

মনসুরা খাতুনের চেঁচামেচিতে সামিয়াদের সারা বাড়ি সরব হয়ে আছে। সামিয়ার বাবা-মায়ের মুখে বিরক্তির ছাপ। চেঁচামেচি শেষে মনসুরা খাতুন শান্ত হয়ে বসে এমন এক আবদার করে বসেন যাতে রেগে যান আলিফা খাতুন নিজেই।

“তোর ঐ পালক মাইয়া তো পালাইয়া গেল, আমার নাম-ডাক ডুবায়া। তুই এক কাজ কর সামিয়ারে ঐ ছেলের লগে এহনই তিন তালাক দেওয়ায়া আমার ছেলে লগে বিয়া দিয়া দে।”

“আপা, তুমি এইসব কী বলো? আমার মেয়ে বিবাহিত তুমি জানো না!”

“আরে তাতে কী হইসে? তালাক দেওয়ায় দে। এমনেও তোর মনে হয় ঐ ছেলে তোর অসুইক্ষা মাইয়ারে রাখব, কয়দিন পরই দূরদূর কইরা তাড়ায় দিব নে, দেহিস। আমিও তো নিতাম না এমন অসুইক্ষা আবার রূপেও কম মাইয়ারে। না পারতে…”

তাকে শেষ করতে না দিয়েই আলিফা খাতুন চেঁচিয়ে বললেন,

“একদম চুপ! অনেক বলছো তুমি! তোমার সাহস কী করে হয় আমার মেয়ের ব্যাপারে এসব বলা! আরে তোমার ছেলের আমরা জানি ভেবেছো? তোমার ছেলের মতো নেশাখোরের কাছে আমি আমার মেয়ে দিব ভাবলা কী করে? দরকার হলে আমি বাসায় বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবো তারপরও তোমাদের মতোন কুলাঙ্গারের কাছে আমি মেয়ে দিব না।”

চলল দুই বোনের মাঝে কঠোর তর্কাতর্কি বা ঝগড়াই বলা চলে। কিন্তু এসবে মনোয়ারের এত অপমান হওয়া সত্ত্বেও সে নিঃশ্চুপ, হাতের সিগরেট খাওয়ায় আর ফোন দেখার জন্য ধ্যানে বসেছে যেন সে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে আলিফা মনসুরাকে ঘর বিদায় দিয়ে দেন, আর তিনিও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেড়িয়ে যান বাড়ি থেকে।

___

আবরার সবে হাসপাতাল থেকে এসে বাড়িতে ঢুকেছে। বেশ ক্ষুণ্ণমনা সে আজ নিজের অবস্থার উপর। তার একমাত্র শ্যালিকার বিয়ে, অথচ সেই উপস্থিত থাকতে পারলো না। তৈরি হয়ে যেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে তখনই হাসপাতাল থেকে কল তার আগমনের জন্য। আর কী সব ছেড়ে-ছূঁড়ে চলে যায় হাসপাতাল, কারণ ডাক্তার হিসেবে তার কাছে সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার রোগীর, তারপর সবাই।

বাড়িতে ঢুকতেই দেখে সব নীরব। কোথায় আমেজ হবে বিয়ের সেখানে লোকজন লাইটিং, ডেকোরেশন খুলছে। একজনকে যেয়ে প্রশ্ন করে উঠে,

“এখানে না বিয়ে, তাহলে তোমরা এইসব খুলছো কেন?”

লোকটা বিরক্তির ভঙ ধরে বলল,

“আর বইলেন না সাহেব। মেয়ে না কি পার্লারের থেকাই ভাইগা গেসে।”

শুনে একটু অবাক হলেও গায়ে লাগায় না। আসলে তার এই বাড়ির কোনো কিছুতেই কিছু আসে যায় না শুধু সামিয়াকে ছাড়া।

ঘরে ঢুকে সামিয়াকে একপলক দেখে বাথরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। সামিয়া এক মনে ‘শেষ বিকেলেত মেয়ে’ বইটি পড়ছে, আবরারের আগমন তার চোখে পড়েনি। যুবক বাথরুম থেকে বেরিয়েই আলমারিতে থাকা সব জামা-কাপড় নামাতে একে একে শুরু করে। হঠাৎ করিয়েই সামিয়ার চোখ যেয়ে পড়ে তার এবং বিশেষ করে আলমারির উপরে। চোখ বড় বড় হয়ে যায়, দৌঁড়ে উঠে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কী অবস্থা! আপনি আমার জামা-কাপড় বের করছেন কেন?”

“আরে বের করছি কই? প্যাক করছি। এখন আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ো না তো। সরো! সরো!”

বলে সামিয়াকে সরাতে নিলেই সে আঙুল উঁচিয়ে ধমক দিয়ে উঠে।

“ঐ মিয়া, একদম দূরে থাকেন। দূরে! দূরে!”

আবরার হুট করেই এমন আচারণ দেখে সেখানেই মূর্তি বনে যায়। তারপর নিজেকে সামলে ভ্রু কুঁচকে সন্দেহর সুরে বলে,

“তুমি এমন করছো কেন বল তো? কোনো খিচুড়ির গন্ধ পাচ্ছি।”

সামিয়া আমতা আমতা করছে। ভাবছে কী বলবে… বস্তুত, আলমারির যেই পাশটায় সামিয়ার মেয়েলি এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখা আবরার সেখানে হাত দিতে যাচ্ছিল। কিছু একটা ভাবতেই সে বলে উঠে,

“আমি কাপড় বদলাবো। আপনি ঘর থেকে বের হন!”

আবরার কিছু বলবে তার আগেই তাকে ধাক্কিয়ে বের করে দেয় সামিয়া। দরজা লাগিয়ে স্বস্তির এক শ্বাস ফেলে নিজেই জামা-কাপড় গুছিয়ে নেয় ব্যগে। গুছানো শেষ করতেই আচমকাই তার মাথায় উদয় হয় এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তা হলো-

“আচ্ছা, আমার কাপড়-চোপড় ব্যাগে ভরছিল কেন লোকটা?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here