প্রিয় অসুখ ও একাকিনী,পর্ব:৮+৯

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৮ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
কা কা শব্দ ঘুম ভাঙে আবরারের। চোখ খুলে দেখে চারধারে অন্ধকার। নূপুরগুঞ্জনে গা ছমছম করে উঠে তার। যথেষ্ট বয়স হলেও আবরার অনেক ভীতু স্বভাবের ছেলে। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে, ফোন হাতে ভয়ে ভয়ে শব্দের উৎসের খোঁজে মেঝেতে পা রাখে সে। বারান্দায় পা রেখে বামে তাকালে সেখানেই মোহিত হয়।

বারান্দার মরিচা পড়া দোলনায় বসে আছে এক নারী। পরনে পুরানো সাদা শাড়ি, আঁচল ও এলোমেলো চুলগুলো রাতের বাতাসে স্বাধীন ভাবে উড়ছে। হাতভর্তি লাল চুড়ি, আর নূপুরের কলরব অন্যরকম নেশা জাগাচ্ছে হৃদয়ে। চারদিকের নিস্তব্ধতায় ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, মৃদু বাতাস, তার মাঝে যুবতীকে এমন রূপে অনেকটা উপন্যাসের কোনো রহস্যময়ী নারী চরিত্রই লাগছে।

“তোমাতেই সূচনা, তোমাতেই সমাপ্তি। তবুও কেন যে তুমি দূরে থাকো… কষ্ট দিতে বুঝি ভালোবাসো, তাই কষ্ট দাও? এই সাজ যে বৃথা তুমি হীনা, তা কি তুমি জানো? জানো বলেই বুঝি এই বিরহ। ভালো লাগে না, একটুও ভালো লাগে না। এই একাকিত্ব কাটা হয়ে বিঁধে বুকে। বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়, তবুও তুমি আসবে না। এ বিধাতার বিধান আমি জানি, তবুও যে চেয়েও মানতে পারি না। বারবার চাই তোমার দরবারে হাজিরা দিতে।”

আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলে থামে সামিয়া। তার বচন যদিও অন্যের উদ্দেশ্যে, তবুও গাঢ় ভাবে দাগ কাটে আবরারের হৃদয়ে। আনমনেই বলে ফেলে,

“আমি তো হতেই চাই তোমার। তুমিই তো ধরা দিচ্ছো না আমাতে। কেন বল তো? কী কমতি আছে এই আমিতে? জানি আমি অসম্পূর্ণ, আমার পূর্ণতা যে তুমি।”

আবরারের আওয়াজে ঘোর ভাঙে সামিয়ার। চোখ মুছে, কান্না লুকানোর বৃথা চেষ্টা আর করে না। কিছুটা ভাঙা গলাতেই বলে,

“আপনি…? আপনি এখানে? মানে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?”

“আর বোলো না কাকের শব্দতে ঘুম ভেঙে গেল, তবে ভালোই হলো। নাহলে যে কন্যার এমন ঘোর লাগানো রূপ দেখা হতো না।”

বলতে বলতেই তার চোখ যেয়ে পড়ে সামিয়ার পা জোড়াতে। ফ্ল্যাশলাইটের শুভ্র আলো, আর চারিদিকের অন্ধকারে আলতার লাল রঙটা যেন যেন আরও পুলকিত করছে তার হৃদয়কে। মাথাটা তার ঝিমঝিম করছে, তৃষ্ণা পেয়েছে আবরারের, তৃষ্ণা। তবে কীসের সে তৃষ্ণা?

থমথমে চেহারা নিয়ে ফটাফট হৃদয়ঘাতক এক আবদার করে ফেলে সামিয়ার নিকট আবরার।

“আমার না তোমার দুই পায়ে গাঢ় ছোঁয়া দেওয়ার তেষ্টা পেয়েছে। বিশ্বাস করো এত অসভ্য চিন্তা আমার কোনো জনমেই আসেনি, তবে আজ এই তেষ্টা না মেটালে যে মরণ হবে আমার।”

ধক্ করে উঠে সামিয়ার মনটা। ভাবনার অথৈজলে সে আবার ডুবে যায়, এলোমেলো সব ভাবনা, তার ভেতরটাই যে এলোমেলো হয়ে গেল এমন আবদারে। এরপরই আবরার সবচেয়ে আতঙ্কদায়ক কাজটা করে ফেলে হাঁটু গেড়ে বসে প্রেয়সীর পায়ের পাতায়। ভয়ংকর এক সিক্ত ছোঁয়া দেয়, এ কোনো সাধারণ ছোঁয়া নয়, অনুভূতির গাঢ় দ্রবণ যুক্ত এ ছোঁয়াতে।

সামিয়া শিউরে উঠে, ঘটনার আকস্মিকতায় সে মূর্তি বনে গিয়েছে। আবরার নিজেই স্তম্ভিত। মনে মনে ভাবে,

“হায়! হায়! এ কী করলাম আমি একটু আগে! কতটা ছ্যাঁচড়া ভাবছে আমায়!”

আড়চোখে একবার যুবতীকে দেখে দ্রুত পায়ে ঘরে যেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। পুরোপুরি কাঁপাকাঁপি ধরে গেছে তার।

‘না, এই মেয়ের থেকে যথা সম্ভব দূরে থাকতে হবে নাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। পাগল! কী সব অশ্লীল কাজ-কারবার করে ফেলছি এর জন্য! আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউজুবিল্লাহ!”

___

উদাসীন বেলা, সামিয়া ফেসবুকের জবস্ অপশনটা চেক করছে যদি কোনো ভালো পার্ট টাইম জব পায়। তার ঘুম থেকে উঠার আগেই আবরার বাড়ি ছেড়েছে। আবরারের কথা মনে পড়তেই তার সারা গা শিউরে উঠে, মনে পড়ে যায় সেই ভয়ংকর চুমুর কথা। নিজেকে সামলে আবার জবস্ চেক করতে শুরু করে সে।

হুট করেই দেখে হেলথ্ ও ট্রাভেলিং রিলেটেড লেখালেখি করার জন্য এডভারটাইজমেন্ট দেওয়া হয়েছে, এমাউন্টও মোটামোটি ভালোই। দ্রুত এপ্লাই করে সে। তারপর মাস্টার্স করার জন্য ভালো একটা ভার্সিটির খোঁজে নেমে পড়ে। আনমনেই ভাবে,

“চাকরিটা হলেই হলো!”

এসব কিছুর মাঝেও কাব্যের কথা মনে পড়ে যায়। লোকটা কতদিন ধরে আসে না তার কাছে। বড্ড মনে পড়ছে লোকটাকে। কফি পান করতে হবে, মাথা ধরেছে, বেডরুম থেকে বের হয়।

রান্নাঘরে কেউ নেই, শুধু রান্নাঘর কেন পুরো বাড়িই নীরব। নিশাকে নিয়ে আলিফা খাতুন বাপের বাড়ি গেছেন, আর সায়রাজ সাহেব তো নিজ কাজেই ব্যস্ত।

ডাইনিং টেবিলে বসে নিজের ডায়রিতে সামিয়া লিখতে শুরু করে,

“আজ অনেকদিন কাব্য আসে না। রোজ কতবার যে তার স্মৃতিগুলো আওড়াই মনে মনে, তা শুধু আমিই জানি। সে কি শুধু আমার প্রেমিক না কি! আমার বন্ধু সে, আমার মন নয়, আত্মার সাথে জুড়ে সে। জানি বুদ্ধির খরচে ভাবলে এসব মিথ্যে অনুভূতি, মানুষটাই যে মিথ্যে। না, না, মানুষও তো নয় সে। তবে কী? জানি না, শুধু জানি অনেকটা জুড়ে সে আমার। উন্মাদ লাগে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে ভিতরটা তাকে ছাড়া।”

এতটুকু লিখেই ধ্যান আসে চুলোর পানির কথা। উঠে যেয়ে চুলো বন্ধ করে। কাপে কফি, গুঁড়ো দুধ আর চিনি মিশিয়ে নেয় তারপর তাতে ফেলে গরম জল। বেশ তৈরি হয়ে গেল তার পছন্দের ধোঁয়া উঠানো গরম গরম কফি।

কফিতে ঠোঁট ভিজিয়ে আনমনেই বলে উঠে,

“বন্ধু? বন্ধুত্ব?”

চোখেমুখে ছেঁয়ে যায় বিদ্রূপের হাসিতে। আপন মনেই নিজের জীবনের ‘বন্ধুত্ব’ সম্পর্কিত ঘটনা, স্মৃতিগুলো আওড়ে নেয়।

খুব ছোট থেকেই হীনমন্যতায় ভুগে। সে জানে, মানে সে এই সুন্দর পৃথিবী বড্ড বিশ্রী এক জীব, যার সাথে মানুষ মিশতে অত পছন্দ করে না। জীবনে তাই তো তার বন্ধু ছিল না।

তবুও স্কুলে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথে একটু-আধটু মিশতে জানতো মানুষের সাথে। যদিও নিজে থেকে কখনো কারো প্রতি অগ্রসর হতে পারতো না ঐ যে হীনমন্যতা, কিন্তু অন্যকেউ অগ্রসর হলে বেশ তাড়াতাড়িই সুসম্পর্ক গড়ে ফেলতো তার সাথে।

প্লে গ্রুপ থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত তার খুব ভালো তিনজন বান্ধুবী ছিল। নাম তাদের রায়না, মনি, শিখা; তবে তিনজন পড়ালেখায় বেশ দুর্বল, ফাঁকিবাজও বলা চলে। তাদের সাথে সাক্ষাৎ প্লের ক্লাসরুমে, কথা বলতে বলতেই বন্ধুত্ব হয়ে যায়, বেশ ভালো বন্ধুত্ব। সামিয়া যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে তখনই নিশা কী যেন একটা যেয়ে বলে তার মাকে, আর সেখান থেকেই সবটা বিনষ্ট।

সেদিন প্রতিদিনকার ন্যায় সামিয়া তার বন্ধুদের সাথে ছুটির পর গেটের সামনে দাঁড়ায় মায়ের অপেক্ষায়। আলিফা খাতুন আসেন। খুব রাগী রাগী ভাব নিয়ে সামিয়ার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করেন,

“তোমাদের মায়েরা কোথায়?”

অল্প বয়স মনি, শিখা ও রায়নার, অত না বুঝলেও রাগ দেখে ভয় পায়। কাছুমাছু হয়ে নিজেদের মায়েদের হাতের ইশারায় দেখায়। আলিফা খাতুন বড় বড় পা ফেলে যেয়ে তাদের বেশ কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেন। বলেন,

“আপনাদের বাচ্চাদের জন্য আমার মেয়ে নষ্ট হচ্ছে। নিজেরা তো রেজাল্ট খারাপ করেই, সামনে আমার মেয়েকে দিয়েও করাবে। আপনাদের নাহলে নিজের বাচ্চার ধ্যান নেই। কী শিক্ষা দিয়েছেন বাচ্চাদের আল্লাহ জানে! আমি শেষবারের মতো বলছি আমার বাচ্চার থেকে দূরে থাকতে বলবেন! যত্তসব থার্ডক্লাস!”

কোনো মা-ই এমন কোনো কথা সহ্য করতে পারে না, সামিয়ার বন্ধুদের মায়েরাও পারেনি, মোটামোটি ভালোই একটা তর্কাতর্কি হয় সবার মাঝে। পরদিন স্কুলে সামিয়া আসলে মনি, শিখা, রায়না কেউই তার সাথে কথা বলে না। বেশ বেশ দূরে দূরে থাকে। সামিয়া নিজ উদ্যোগে কথা বলতে আসলে সবাই উপেক্ষা করে যায়। আর রায়না শুধু বলে,

“তোর মতোন বন্ধু যাতে আল্লাহ কাউকে না দেয়। তুই কারো বন্ধু হওয়ার যোগ্য না, দয়া করে কারো বন্ধু হতে যাইস না আর।”

সামিয়া সেবার আরেকদফা মানসিকভাবে আহত হয়, রায়নার দুই বাক্যের বক্তব্য যে সামিয়াকে কতটা আঘাত করেছিল তা হয়তো রায়নাও জানে না। এরপর আর কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারেনি, ঐ যে সে বন্ধু হওয়ার যোগ্য না।

তবে হ্যাঁ, তার একখান বন্ধু ছিল, জীবন হীন বন্ধু, সে ছিল তার ডায়েরি। সেখানে নিজের সব মনের কথা লিখতো। ডায়েরিকে নীরবে জানতো, ডাকতো সে ‘কাব্য’ বলে।

কখনো কখনো ভাবতো কাব্য যদি মানুষ হতে তবে সে কেমন হতো, এ বিষয়ে লিখতো ডায়েরিতে। এখান থেকেই তার কাব্য নামক কাল্পনিক চরিত্রের রচণার শুরুটা।

এসব ভাবতেই ভাবতেই কেমন একটা আওয়াজ কানে আসে সামিয়ার। চুলোর দিকে তাকাতেই তাড়াতাড়ি চুলো বন্ধ করে সে। চুলোতে যে কফি বানানোর পর দুধ জ্বাল দিতে রেখেছিল তা মাথায়ই ছিল না তার। মুখ দিয়ে ‘চ’ বোধক শব্দ করে ভাবে,

“ইশ! দুধ পড়ে কী কাজটা বাড়লো! এখন এগুলোও পরিষ্কার করতে হবে।”

দুধের পাতিল ঢেকে ভেজা তোয়ালে দিয়ে কোনোরকম মুছে রেখে দেয় সে। কফির কাপ ধুঁয়ে ঘরে চলে যেতে নেয়। কিছু একটা ভাবতেই ফিরে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পুনরায় ডায়েরি খুলে সে। কলম হাতে নিয়ে লিখে,

“আজকাল কাব্যকে ছাড়াও আরেকজন পুরুষের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে জীবনে। লোকটা আমার স্বামী, আবরার। তবে আদৌ স্বামী মানি কি না জানি না। কিন্তু সে কাছে আসলে অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়, কাব্য কাছে আসলেও কখনো এমন বোধ হয়নি।

তার ছোঁয়াতে উষ্ণতা কেমন একটা। হৃদয়টা বুঝি থমকে যায় সে কাছে আসলে, কেমন জোরে জোরে শব্দ করে। কেন এমন হয়? এই অনুভূতির নাম কী? প্রশ্ন আসে মনে। উত্তর জেনে তো লাভ নেই অবশ্য, মানুষগুলো অতি ধোঁকাবাজ। কালই ছেড়ে চলে যেতে পারে। তাই তাকে হৃদয়ে জায়গা দেওয়া নিষেধ। সে নামক অনুভূতিগুলো ভুল।

ফাহাদকে বিশ্বাস করে ঠকেছি, আর কোনো মানুষকে বিশ্বাস করার নূন্যতম সামর্থ্য টুকুও আমার নেই। যদিও ফাহাদকে কখনো ভালোবাসিনি। তবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন বুনেছিলাম অনেক, বেইমানটা যে অনেকটাই বিশেষ অনুভব করাতো এই অতি সাধারণ আমিকে। আবরারও হয়তো এমনটাই করবে, এখন বিশেষ বোধ করাচ্ছে, কাল কাছে আসলে ফেলে দিবে…”

এটুকু লিখতেই কল আসে ফোনে। টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম দেখতে মুখটা থমথমে হয়ে যায় তার। আনমনেই বলে,

“ফাহাদ? এত বছর পর আমায় কল করলো? কিন্তু কেন? এই বেইমানের কলটা কি আমার ধরা উচিত?”

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||৯ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
কক্সবাজারের অনুজ্জ্বল এক সন্ধ্যা, এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে আবরারের কক্সবাজার আসার। আর্জেন্ট একটা কাজে এখানে আসতে হয়েছে তাকে। তবে তার মনটা সবসময় বিষণ্ণ থাকে আজকাল, যুবতীর প্রেমে এমন ভাবেই মত্ত হয়েছে সে। নিজের মন লাগানোর চেষ্টায় বিচে হাঁটতে এসেছে সে।

এত ভিড়ে হঠাৎ এক পরিচিত চেহারায় চোখ আটকে যায়, ঢেউ খেলে যায় হৃদয়ে। “প্রাক্তন” নামটা যেন চকচক করছে আবরারের মস্তিষ্কে।

“আরে আবরার, কেমন আছো?”

ম্লান হেসে যুবতী জিজ্ঞেস করল। এই যুবতীর নাম অনন্যা, আবরারের প্রথম প্রেম, ভালোবাসাই বলা যায়। তাকে ভালোবেসে আবরার ডাকতো অনন্য বলে।

অনন্য অর্থাৎ অদ্বিতীয়, আবরারও মনে করতো তার জীবনে সে অদ্বিতীয়, অন্য নারীকে কখনোই তার ভালো লাগার নয়। কিন্তু ভালো লেগেছে এক নারীকে, সামিয়া, তার হৃদমোহিনী, তার একাকিনী, তার রুবি রায়। যদিও এখন হিসেব করলে ভালোবাসাটা অনন্যার প্রতিই গভীর, সামিয়ার চাইতে। তবে সে জানে হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়িই।

“কী হলো বললে না কেমন আছো?”

ঘোর ভাঙে আবরারের। শান্ত গলায় উত্তর দেয়,

“হুম, ভালো আছি। তুমি তো ভালোই আছো, তা-ই না?”

“আমার আর ভালো…

“ভালো থাকার জন্যই তো সবটা।”

দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে অনন্যা। তারপর প্রস্তাব দেয়

“ওদিকটায় যাবে? অনেক ভিড় এদিকে। ”

কিছুটা সময় নিল আবরার ভাবার জন্য, তারপর সায় জানায়। খাণিক নীরব স্থানে যেয়ে দাঁড়াল দুজনের। দুজনের মাঝেই নীরবতা চলমান অনন্যাই তা ভেঙে প্রশ্ন করল,

“বিয়ে করেছো?”

“হুম, কয়েকদিন হবে। বয়স তো আর কম হলো না, বিয়ে না করে থাকা যায়!”

“বাহ্! সবসময় তো বলতে আমি তোমার জীবনে অনন্য কিছু, আমার স্থান কেউ পাবে না। তা ভালোবাসতে পেরেছো তো?

“হুম, ভালোবাসি, ভালো লাগে তাই তো বিয়ে। আমার অদ্ভুৎ কন্যা আমার জীবনে দ্বিতীয় হলেও বিশেষ, অতি বিশেষ একজন। যে আমার মন ভুলাতে পারে এক মুহূর্তেই, আমার একাকিনী।”

“যা-ই বল, প্রথম ভালোবাসা ভুলাটা কষ্টকর তাই না?”

আবরারের হাতে হাত রেখে আবেগী দৃষ্টিতে তাকায় অনন্যা। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় যুবক, যেন গা ঘিনঘিন করে উঠেছে তার। অথচ, একসময় কবে বউ করে এই হাতটি একবার ছুঁবে সেই অপেক্ষায় থাকতো সে।

আহা! ভাগ্য এক অদ্ভুৎ খেলা বটে! আজ যা, কাল তার বিপরীতও হতেই পারে।

“নবি করিম (স) এর প্রিয় স্ত্রী ছিলেন আয়েশা (রা)। অথচ, তিনি দ্বিতীয় নয়, সর্ব কনিষ্ঠ স্ত্রী ছিলেন নবিজি (স) এর। সেখানে তোমার সাথে তো আমার কোনো মজবুত সম্পর্কই ছিল না, একটা হারাম রিলেশন যার থেকে ধোঁকা বৈ কিছুই পাইনি তা ছিল। বলতে পারো, সে আমার কাছে অনেকটাই তেমন, প্রথম নাহলেও অতি এবং অধিক প্রিয়। সুতরাং, ওসব ভুলভাল তথ্য।”

অনন্যা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আবরার আর কথা বাড়াতে চায় না। “আসছি” বলে সে হোটেলের দিকে যেতে শুরু করে। পিছনে ফেলে আসা মেয়েটির চোখে যে জল চিকচিক করছে, তা আর তার দৃষ্টিতে পড়ল না, আর পড়লেও কী?

যে মায়া একবার ত্যাগ করেছে, তা আর গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এমন কী উচিতও নয়, নাহলে নিজের সাথেই যে বেইমানি হয়ে যাবে।

হোটলে এসে ফোনটা অন করতেই অনন্যা নামক ভাবনা গায়েব হয়ে যায় তার মস্তিষ্ক থেকে। লক স্ক্রিনে তার একাকিনীর আলতা রাঙা পায়ের ছবি, যার ফলে তার ভাবনা জুড়ে বসে শুধুই একাকিনীময় অনুভূতিগুলো।

সেদিন রাতের পর লজ্জায় ভোরে সে সামিয়াদের বাড়ি ত্যাগ করার সময়, সে টুপ করে ঘুমন্ত সামিয়ার, বিশেষ করে তার পায়ের বেশ কয়েকটি ছবি তুলেছিল। আর সেদিনই তাকে জরুরি ভাবে আসতে হয় এই কক্সবাজারে।

আবরারের বেশ অভিমান চেপে ধরছে। ভাবছে,

“এতদিন হয়ে গেল বর বাহিরে, মেয়েটা একটি বারও কল দিল না! বড্ড বেশি দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে! সে কল না দিলে আমিও করব না, আমিও দেখি কতক্ষণ পারে সে।”

কলের অপেক্ষায় বসে থাকে যুবক। কিন্তু আবরার কি পারবে অপেক্ষার তিক্ত দ্রবণ পান করতে?

এই অপেক্ষা বড্ড খারাপ এক বিষয়, যা জ্বালায়-পুড়ায়, একদম ছাই বানিয়ে দেয়, তবুও পোড়ন থামে না। না শান্তিতে শ্বাস নেওয়া যায়, না ফেলা যায়। কেমন একটা অস্বস্তিকর এবং বেদনা জর্জরিত পরিস্থিতির রচণা হয় চারিধারে।

___

সামিয়া বেডরুমে বসে হুমায়ূন আহমেদের “দেয়াল” বইটি পড়ার অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছেই না।

পাঠক হতে হলে মনযোগী হওয়া অনেক জরুরি, নাহলে পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাওয়া যায় না। মন, মস্তিষ্কে একত্রে নিয়ে পড়তে হয় গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতা।

আর সেখানে সামিয়া হয়ে পড়েছে অমনোযোগী, তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে এক পুরুষের চেহারা, ফাহাদের চেহারা। ভয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে।

ঐদিন ফাহাদের কল পেয়ে ডিসকানেক্ট করে তাকে ব্লক মারে সে, কারণ বর্তমানের মাঝে অতীত টানার ইচ্ছে তার মোটেই নেই। তবুও বারবার বিভিন্ন নাম্বার থেকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে কল রসিভ করতে বলছে লোকটা।

তার নিজেকে বড় একা একা লাগছে। অবশ্য এত বড় ফ্ল্যাটে একাই সে, আলিফা খাতুন এখনো বাপের বাড়ি থেকে ফিরেনি, আর সায়রাজ কবিরকে রাতের নয়টা ছাড়া পাওয়া যায় না কি… সবমিলিয়ে একাকিত্ব বিলাসই করছে। তবে আজ একটু বেশিই একা লাগছে।

বই রেখে ফোন নয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে কী মনে করে যেন সেদিন তার আর আবরারের করা চ্যাটিং পুনরায় পড়তে লাগে সে। প্রথমে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায় সামিয়ার। আনমনেই বলে,

“মানুষগুলো এত ধোঁকাবাজ কেন? এই বলল আমার হতে চায়, আমি বিনা অসম্পূর্ণ। অথচ, দেখো কক্সবাজার যেয়ে তো বেশ আছে আমাকে ছাড়া, হয়তো বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজীতে ব্যস্ত, নাহলে অন্যকিছু। আর আমি…? আমি তো একাকিনী, একাকিত্ব বিলাসই করছি।”

হাটুতে মাথা গুঁজে আরেকদফা চোখের নোনাজলগুলোকে বাধামুক্ত করে দেয় সে, তারা ঝরে যায় বৃষ্টির পানিকণার মতোন। কাঁদতে কাঁদতেই বিড়বিড় করে বলে,

“একজন আসবে জীবনে যে বারবার তোমাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করবে যে সে তোমার ভাঙা হৃদয় জুড়ার জন্য এসেছি। অতঃপর তুমি যখন সেই দায়িত্ব হাতে তুলে দিতে চাইবে কিংবা মনে ক্ষীণ আশা রাখতে শুরু করবে তখনই সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে যাবে।”

এমনসময় তার কাঁধে হাত রাখে কেউ। সামিয়া চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে কাব্য। অবাক হয়, এতোটাই যে চোখগুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনে মনে বলে,

“এ সময় তো তার আসার কথা না। ”

আশেপাশে তাকাতেই দেখে তার কৌতূহল এবং প্রশ্ন দুটোই দূর হয়। বস্তুত বাহিরে রাত নামছে ধীরেসুস্থে, তার ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে পর্দা দিয়ে ঘেরা, আর পুরো ফ্ল্যাটের আলো বন্ধ। সবমিলিয়ে তার ঘরটা অন্ধকারচ্ছন্ন বা আবছা আলোয় পরিপূর্ণ। কাব্যের আসার জন্য একদম যথাযথ পরিবেশ।

“আমাকে দেখে খুশি হওনি বুঝি?”

“এমন মনে হলো কেন? বরং, আমি তো বেশ খুশি আমি তোমায় দেখে। বেশ খুশি! এতদিন কই ছিল প্রিয়? জানো এই একাকিনীর তুমি ছাড়া এই দুনিয়াতে কেউ নেই প্রকৃত অর্থে। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো আমি কত একা!”

কাব্য দুঃখ করে বলে,

“কী করব বল? আমিও যে বড় অসহায়, নিজের ইচ্ছেতে তোমার নিকট আসার সামর্থ্য আমার নেই। তুমি তো জানোই ঔষধ খেলে আমি তোমার কাছে আসতে পারি না।”

“এজন্যই তো খাইনি। আমি তো জানি, সবাই যতোই বলুক এই ঔষধ আমার মঙ্গলের জন্য, আসলে এতে আমার শুধুই অনিষ্ঠ আছে। কারণ সবাই শুধু সময়ে সময়ে বা হুট করেই কোনো একদিনের জন্য আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হবে। আমার সঙ্গি কেউ কখনোই হবে না, তুমি ছাড়া।

তবুও সবার কথা মেনে ভুল করেছিলাম আমি, ভেবেছিলাম এবার বুঝি মানুষগুল সত্যিই… গত তিনদিন ধরে এই একাকিত্ব আর সইতে না পেরে আমি আবার পিলস্ নেওয়া বন্ধ রেখেছি, যাতে তুমি আসো, দূর করো আমার একাকিত্ব।”

বলতেই একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তার চোখ হতে, কিন্তু তা বিছানার চাদর ছোঁয়ার আগেই আবরার ধরে ফেলে।

“এবার তো আমি এসে পড়েছি, তবে আমার একাকিনী এই মুক্তগুলো ঝরাচ্ছে কেন! না, না, এ তো ঘোর অন্যায় এই অন্যায় করা যাবে না।”

কান্নায় ফুলে উঠা মুখে এক চিলতা হাসি ফুটে উঠে। সারাটা রাত্রি এভাবেই পাড় হয় দুজনের; কথাবার্তায়, হাসি-ঠাট্টায়।

সকালে ঘুম ভাঙতেই মায়ের চেঁচামেচির আওয়াজ পায় সামিয়া। কৌতূহলী হয়ে বসার ঘরে যেতেই শুনতে পায় আলিফা খাতুন বলছেন,

“তুমি এমন একটা ছেলের কাছে মেয়ের বিয়ে দিলে কেমনে? এমন চালচুলোহীন ছেলে!”

“উফঃ ছেলে ডাক্তার কমতি কী! সম্পত্তি দিয়ে কী করবে যদি মেয়ে না সুখে থাকে?”

“সুখের কী বুঝো তুমি? টাকা ছাড়া না সুখ পাওয়া যায় না। ওসব কিতাবি জ্ঞান দিতে এসো না আমায়। আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিলে তুমি!”

বিলাপ করে কথাগুলো বলতে বলতে মাথায় হাত রেখে সোফায় বসে পড়েন তিনি। সায়রাজ কবির গম্ভীর গলায় বলেন,

“দেখো, ছেলেটা আমাদের মেয়েকে ভালোবাসে। ওর খুঁত নিয়েও এক্সেপ্ট করেছে এটাই কী অনেক নয়!”

আলিফা খাতুন আরও তেঁতে উঠেন। সামিয়া তাদের কথাবার্তায় আসল ঝামেলা বুঝলো।

বস্তুত, আবরাররের পরিবার বংশীয় ভাবে ভালো পয়সাওয়ালা হলেও আবরারের ভাগে শুধু একটা জমি বৈকী কিছুই নেই বর্তমানে। কারণ তার অংশ বিক্রি হয়েছে তার পড়ালেখার জন্য, এছাড়া বাপ-মা হারা বলে তাকে কিছুটা ঠকতেও হয়েছে। এ নিয়েই আলিফা খাতুনের যত যন্ত্রণা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here